চীন-ভারত সমীকরণ : কোন খেলা খেলছেন রাজাপাকসা?

এম কে ভদ্রকুমার | Sep 26, 2020 04:40 pm
রাজাপাকসা

রাজাপাকসা - ছবি সংগৃহীত

 

তিন ধরনের রাষ্ট্রপ্রধান রয়েছেন : টুইটারে আসক্ত (ডোনাল্ড ট্রাম্প, নরেন্দ্র মোদি, জাওয়াদ জারিফ, ইত্যাদি); যারা এড়িয়ে চলেন (ভ্লাদিমির পুতিন, অ্যাঞ্জেলা মের্কেল, শি জিনপিং, ইত্যাদি); এবং যারা এই প্ল্যাটফর্মের সীমিত ব্যবহার করেন।

এই শ্রেণীবিভাজনের মধ্যে তৃতীয় ভাগে পড়েন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসা।

গত সপ্তাহে একটা দিনের জন্য অস্বাভাবিক সক্রিয় ছিলেন রাজাপাকসা। নতুন জাপানি প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি টুইট করেছেন। এরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ৭০তম জন্মদিনে তাকে ‘উষ্ণ অভিনন্দন’ জানিয়ে, তার ‘সাফল্য ও সুস্বাস্থ্য’ কামনা করেছেন তিনি। এটুকুতে কোনো বিস্ময় নেই।

কিন্তু তার তৃতীয় টুইটটি ছিল শ্বাসরুদ্ধকর। মোদিকে বার্তা দেয়ার চার ঘন্টা পর রাজাপাকসা টুইট করেন : “চীনের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ও অন্যারা আমার সাথে কলম্বোর বন্দর নগর পরিদর্শনে যাচ্ছেন, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আর আমি যৌথভাবে যেটা শুরুর পর ৬ বছর পূর্ণ হয়েছে। সেখানে আমি কিছুটা গলফ খেলারও চেষ্টা করবো”।

মোদির ৭০তম জন্মদিনে চীনা কূটনীতিকদের সাথে গলফ খেলছেন রাজাপাকসা? শ্রীলঙ্কার ভূ-রাজনীতির তিনটি বড় বিষয় থেকে হয়তো এর ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।

প্রথমত, ২৬ আগস্ট মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর চীনের ২৪টি রাষ্ট্রায়ত্ব কোম্পানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দেয়। এর মধ্যে বেশ কতগুলো কোম্পানি চায়না কমিউনিকেশান্ত কন্সট্রাকশনা কোম্পানির (সিসিসিসি) অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান। বেইজিংয়ের বৈশ্বিক ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড কর্মসূচি বাস্তবায়নের ব্যাপারে এই কোম্পানিকে প্রথমসারির ঠিকাদার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ওয়াশিংটন চীনকে এই বার্তা দিয়েছে যে, তারা তাদের সম্প্রসারণবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সিসিসিসি এবং অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ব কোম্পানিগুলোকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না।

এ বিষয়ে ব্রিফিংয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এক সিনিয়র কর্মকর্তা সুনির্দিষ্টভাবে শ্রীলঙ্কার দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন: “শ্রীলঙ্কায় চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়াইং কর্পো. এবং হামবানতোতা বন্দর প্রকল্প নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি আর ঘুষ আদান প্রদানের অভিযোগ রয়েছে, বেল্ট অ্যান্ড রোডের ইতিহাসে এটা অনেকেরই জানা”।

এবং অনেকটা ভারতের দিকে ইঙ্গিত করেই যেন তিনি আরও দাবি করেছেন: “আমাদের এই উদ্বেগটা রয়েছে… যে উদ্বেগটা আরও অনেকের রয়েছে, এবং আমরা জানি যে, অন্যান্য দেশ চীনের সাথে তাদের ব্যবসায়, একাডেমিক বিনিময়, ভিসা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে নিজেদের নীতি পুনর্বিবেচনা করে দেখছে”।

সবদিক থেকেই দেখা যাচ্ছে শ্রীলঙ্কায় বেল্ট অ্যাণ্ড রোড প্রকল্পকে দমনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র-ভারত প্রচেষ্টা চালাবে, বিশেষ করে কলম্বো পোর্ট সিটির ব্যাপারে এটা করা হবে, যেটার সাথে সিসিসিসি জড়িত। ভারতের কর্মকর্তারা বলেছেন যে, কলম্বো বন্দর নগরী প্রকল্পের জন্য বড় সমস্যা অপেক্ষা করছে।

এমন সময় মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলো যখন চীনের নির্মিত অবকাঠামো প্রকল্প যেমন হামবানতোতা বন্দর, মাত্তালা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বা এর পরের কলম্বো পোর্ট সিটির মতো প্রকল্পগুলোতে বিদেশী বিনিয়োগের জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

কলম্বো ভিত্তিক এক ভাষ্যকার লিখেছেন: “ভূরাজনীতির কঠিন বাস্তবতার সামনে পড়ে গেছে শ্রীলঙ্কা… শ্রীলঙ্কার বাইরের পরিবেশ ব্যাপকভাবে বদলে গেছে… [কিন্তু] অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বড় অঙ্কের বিদেশী বিনিয়োগের চাহিদা আমাদের দূর হয়নি।

কিন্তু এই ঘটনার চার দিন পরে ৩০ আগস্ট মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মার্ক এসপার শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসাকে টেলিফোন করেন এবং “অবাধ ও মুক্তি ইন্দো-প্রশান্ত অঞ্চল নিশ্চিত করার জন্য অভিন্ন প্রতিশ্রুতি’ নিয়ে তারা আলোচনা করেন”।

এসপার পরে টুইটে জানান যে, প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসার সাথে তিনি ‘আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিবেশ’ নিয়ে আলোচনা করেছেন।

কৌতুহলের ব্যাপার হলো এসপার একইসাথে “শ্রীলঙ্কার সমঝোতা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির অগ্রগতি অব্যাহত রাখার ব্যাপারেও জোর দাবি জানান। কার্যত তিনি রাজাপাকসাকে হুমকি দিয়েছে, কারণ রাজাপাকসা শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষা সচিব থাকাকালেই এলটিটিই-বিরোধী যুদ্ধ সবচেয়ে রক্তাক্ত সময় পার করেছে।

এটা আসলেও নজিরবিহীন টেলিফোন কল ছিল। স্মরণকালের মধ্যে কোন মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টকে ফোন করেছেন বলে মনে পড়ে না। এসপার এমন সময় ফোন করেন, যখন তিনি চীনকে মোকাবেলার জন্য আরেকটি কোয়াড মিশনে অংশ নিতে গুয়াম সফর করছিলেন।

এসপারের কলের আসল উদ্দেশ্যের ব্যাপারে শ্রীলঙ্কা মুখ খোলেনি। ওয়াশিংটন চায় কলম্বো যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সোফা চুক্তি চুড়ান্ত করে, কলম্বো বন্দরের ইস্টার্ন টার্মিনালকে ভারতের হাতে তুলে দেয় এবং মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশানের (এমসিসি) অধীনে ৪৮০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি সম্পন্ন করে।

ওয়াশিংটন এখনই একটা জবাব চাচ্ছে যাতে মার্কিন-শ্রীলঙ্কা প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কোয়াডের কৌশলের সাথে যুক্ত করা যায়।

শ্রীলঙ্কার জাতীয়তাবাদীরা কলম্বো বন্দর টার্মিনালকে ভারতের কাছে দেয়ার এবং দেশের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনে বিঘ্ন ঘটানোর সম্পূর্ণ বিরোধী।

পররাষ্ট্র সচিব জয়ানাথ কলম্বাজ সাম্প্রতিক এক সাক্ষাতকারে বলেছেন: “আমাদের ভারসাম্য রাখতে হবে। প্রেসিডেন্ট বেশ কিছু জিনিস নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। শ্রীলঙ্কাকে অবশ্যই নিরপেক্ষ দেশ হতে হবে। ক্ষমতার খেলায় আটকা পড়তে চায় না শ্রীলঙ্কা”।

দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনকে মোকাবেলার জন্য ওয়াশিংটন আর দিল্লীর সমন্বয়ের বিষয়টি শ্রীলঙ্কায় ভূরাজনীতির বিষয় হয়ে উঠেছে; তামিল দমনের বিষয়টি আর আগের মতো নেই। ভারত শ্রীলঙ্কাকে বাড়ির উঠান মনে করতো, সেখানে অন্য দেশের সামরিক উপস্থিতির তারা বিরোধী ছিল এবং এই অবস্থান ঠিক রাখতে তারা তামিল সমস্যাকে প্রভাব বিস্তারের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতো।

কিন্তু মোদির অধীনে কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগটি ভারতের প্রধান আঞ্চলিক কৌশল হয়ে উঠেছে।

যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের প্রথম সফল প্রকল্প ছিল ২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কায় ক্ষমতা বদল। এর পর থেকেই ভারত মালদ্বীপে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য শক্ত পরিশ্রম করে গেছে। ১০ সেপ্টেম্বর এই প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ফ্রেমওয়ার্ক ফর ডিফেন্স অ্যাণ্ড সিকিউরিটি রিলেশানশিপ স্বাক্ষর করেছে মালদ্বীপ।

এই প্রেক্ষাপটেই শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের তৃতীয় ঘটনাটিকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে: এসপারের ফোনকলের তিন দিন পর রাজাপাকসা নতুন সংবিধান প্রণয়নের ঘোষণা দেন। সেখানে তিনি নির্বাচনী ব্যবস্থায় পরিবর্তন এবং নির্বাহী প্রেসিডেন্সি পুনর্বহালের কথা বলেন।

নতুন সংবিধান প্রণয়নে অবশ্যই সময় লাগবে। এর মানে হলো সোফা, কলম্বো বন্দরকে ভারতের হাতে তুলে দেয়া, এমসিসি চুক্তির মতো সবগুলো বড় সিদ্ধান্তই সম্ভবত তাকে তুলে রাখতে হবে।

এসপারকে হয়তো ধৈর্যশীল হতে হবে। খুবই সম্ভাবনা রয়েছে যে, ৩ নভেম্বরের সময়সীমা পার হয়ে যাবে এটা।

এর মধ্যে, গত সপ্তাহে কলম্বো পোর্ট সিটিতে মাহিন্দা রাজাপাকসার সফরের অর্থ হলো শ্রীলঙ্কা বিআরআই প্রকল্পগুলোর ব্যাপারে কোন ছাড় দেবে না। ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় রাজাপাকসা বলেছেন যে, সামনের বছরগুলোতে কলম্বো বন্দর নগরী প্রকল্প হবে দেশের আয়ের প্রধান উৎস।

এই প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য তিনি চীন সরকারকে ধন্যবাদ দেন।

আশির দশকের শুরু থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারত যখন তামিল বিদ্রোহীদের সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছে, তখন শ্রীলঙ্কায় কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে হয়, শ্রীলঙ্কা যেভাবে কূটনীতিক মাইনফিল্ডের ভেতর দিয়ে দেশের কূটনীতি আর রাষ্ট্রযন্ত্রকে পার করে নিয়ে গেছে এবং ভারতকেও সাথে রেখেছে, সেটার প্রশংসা না করে উপায় নেই।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে মাহিন্দা রাজাপাকসার গরু জবাই নিষিদ্ধের প্রচেষ্টা একটা অসামান্য পদক্ষেপ এবং একটা ধূর্ত কৌশল। ৯৯% শ্রীলঙ্কান গরুর মাংস খায় এবং তাদেরকে আমদানির উপর নির্ভর করতে হবে।

শ্রীলঙ্কার নেতারা উপমহাদেশের রাজনীতির বিভিন্ন সম্ভাবনা ও বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে পুরোপুরি সচেতন, যার একটা অর্থনৈতিক, একটা ধর্মীয় ও একটা রাজনৈতিক মাত্রা রয়েছে।

রাজাপাকসা হয়তো এখন এখানে কূটনৈতিক মাত্রাটা যোগ করতে পারেন।

এখানে মূল বিষয়টা হলো রাজাপাকসা আর মোদি উভয়েই তাদের অতীত ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। রাজাপাকসা ভুল করেছিলেন এই ভেবে যে দিল্লীর উপরে টেক্কা দিকে পারবেন তিনি। কিন্তু তিনি খেয়াল করেননি যে, তার পায়ের নিচেই বীজ বুনে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতীয়রা, এবং সেটাই বিকশিত হয়ে ২০১৫ সালে তার পরাজয় ঘটিয়েছে।

এবার রাজাপাকসা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন যাতে তার ভিত্তিটা হয় কংক্রিটের, যেখানে এক দানা ঘাসও গজাবে না। মোদি নিজেও বুঝেছেন যে, রাজাপাকসা আগাগোড়া একজন রাজনীতিবিদ এবং তাকে নিয়েই ভারতকে চলতে হবে।

সূত্র : এশিয়া টাইমস/এসএএম

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us