ডাক্তারের মায়ের দুঃখগাথা

ড. নূরজাহান সরকার | Oct 08, 2020 05:54 pm
ডাক্তারের মায়ের দুঃখগাথা

ডাক্তারের মায়ের দুঃখগাথা - প্রতীকী ছবি

 

একজন ডাক্তার মেধাশক্তির বলেই শুধু নয়, তার মা-বাবার ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং জাতির মহান অবদানের ফলে ডাক্তার হতে পেরেছেন। ডাক্তারি এক মহান পেশা। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ গভীরভাবে বিশ্বাস করে, এ পেশা সব পেশার ঊর্ধ্বে। অন্য দিকে একজন চিকিৎসককে একজন না একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে নিয়ে জীবন কাটাতে হয়। অর্থাৎ তিনি তার পেশাগত জীবনে সার্বক্ষণিকভাবে আর্ত মানুষের সাথেই থাকেন। অর্থাৎ ডাক্তার সাহেবরা খুব কমই হাসিমুখ দেখেন, বরং তারা রোগাক্রান্ত মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে ব্যাপৃত থাকেন। একজন রোগী যখন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন, তখন একজন চিকিৎসক স্বর্গীয় আনন্দ ভোগ করেন। রোগীর জীবনে সুস্থতা ফিরে এলে রোগীর আর রোগযন্ত্রণা থাকে না, তখন অনেক রোগীর চিকিৎসককে আর মনে থাকে না, কিন্তু তাকে চিকিৎসকের মাঝে মধ্যে মনে পড়ে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে। সুস্থ হয়ে যাওয়া রোগীকে মনে করা প্রয়োজন পড়ে তখনই যখন ওই একই অসুখের রোগী আরেকজনকে দেখতে হয়।

সুতরাং ভালো হয়ে যাওয়া রোগী চিকিৎসা এবং মনের জোর ডাক্তার কিভাবে দিয়ে সুস্থ করে তুলেছিলেন তা তিনি মনে করেন এবং তার সুস্থ হয়ে যাওয়ার কথা মনে পড়ে, হাসিমাখা মুখখানা মনে পড়ে। এ ছাড়াও ডাক্তার তার রোগীদের অবচেতন মনের খাতায় লিখে রাখেন। নীরবে নিভৃতে ক্ষণে ক্ষণে সেসব পাতা তিনি উল্টিয়ে দেখেন, দেখতে ভালোবাসেন। ঠিক সে রকমই একজন রোগী যখন আর কখনো সুস্থ হবে না ডাক্তার জানেন, তখন তার মন ভারাক্রান্ত থাকে। এ সময়ে তার সবচেয়ে প্রিয়জন যে সন্তানটি কাছে ঘেঁষে তাকেও ভালো লাগে না। এই রোগীই যখন দুর্ভাগ্যবশত একসময় প্রাণ হারায়, সে দিন ডাক্তারের মুখে ভাত রোচে না। তা হলে কী দাঁড়ায়? চিকিৎসকরা মানুষের দুঃসময়ের সঙ্গী, সুসময়ের নয়।

এ পরিপ্রেক্ষিতে আমার ডাক্তার ছেলের একটি কথা প্রায়ই মনে করি। আমার ছেলে বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় ১২তম ক্রমিকে ভর্তির সুযোগ পায় এবং ওকে অত্যন্ত আনন্দের সাথে ভর্তি করে দিই। কিন্তু এর দুই-চার দিনের মধ্যে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, ছেলেটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। ওর বাবা বুয়েট থেকে সব কাগজপত্র তুলে আনেন এবং ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করে আসেন। তিনি এ বিষয়ে আমার কিংবা ছেলের কোনো মতের ধার ধারেননি। আল্লাহর অসীম রহমত আমার ছেলেটি খুব ভালো রেজাল্ট করে একজন ভালো ডাক্তার হলো। উচ্চতর ডিগ্রিও নিলো। দেশে-বিদেশে তার রিসার্চ পেপার প্রেজেন্টেশনও চলছে। একটি মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক সে। আমরা অত্যন্ত তৃপ্ত। সে রোগীদের প্রাণান্ত ভালোবাসে। মাঝে মধ্যেই আমার মাথায় হাত রেখে বলে, ‘মা আমি তোমাদের খুব একটা দেখতে সময় পাই না; অথচ রোগীদের মা ডাকি, বাবা ডাকি’। কোনো কোনো সময় এটাও বলে, ‘আমার হওয়ার কথা ছিল মানুষের সুসময়ের সাথী; হলাম দুঃসময়ের সাথী’। অর্থাৎ ও বলতে চেয়েছে একজন স্থপতি একটি পরিবারের সবচেয়ে সুসময়ের সাথী হয়ে যায়, অর্থাৎ একটি বাড়ি করার সময়কার সান্নিধ্যপ্রাপ্ত হয়। তবে ওর এটা আফসোসের কথা নয়। কারণ ওর রোগী ভালো হয়ে যখন হাসপাতাল ছেড়ে যায়, সেসব দিনের কথা আমাদের কানে প্রায়ই আসে। দূর-দূরান্ত থেকে গরিব রোগীরা কখনো কখনো ওকে ফোন করে ওর জন্মদিনে।

হয়তো কোনো ছেলে আমার কাছ থেকে ইন্টার্ন সময়কালে টাকা নিয়ে রক্ত দিয়ে ভালো করে তুলেছিল মহান আল্লাহর ইচ্ছায়। তাদের কারো কারো ফোনও আসে। সে ছেলে এবার কোন ক্লাসে উঠেছে, প্রথম চাকরিতে যোগদান করেছে। আবার কোনো মায়ের ফোন তার সে মেয়েটির আজ বিয়ে, যে মেয়েটির চিকিৎসা ওর হাতে হয়েছিল, তার চিকিৎসার ব্যয়ের কিছু টাকা আমার ছেলেটি দিয়েছিল।

এত কিছু আমি লিখছি কেন? রাতে ঘুমাতে পারিনি। ছেলে আমাকে জানাল- মা, বিল্ডিংয়ের বাসিন্দারা সিকিউরিটি গার্ডের কাছে বলেছেন, ‘ডাক্তারকে বলবে, ডাক্তার হয় বাসায় থাকবে নইলে হাসপাতালে। আসা-যাওয়ার মাধ্যমে করোনা ছড়াতে পারবে না।’ ও আরো বলল, ‘মা, আমি লিফটে উঠলে আর কেউ ওঠে না, বরং তাদের চোখেমুখে বিরক্তি; আমাকে দেখলে দূরে সরে যায়, তখনই লিফট পরিষ্কার করায়।’ অথচ পুরো জীবন দেখেছি- সকাল-সন্ধ্যা, দুপুর-বিকেল আশপাশের মানুষের অসুস্থতা নিয়ে ওর কাছে ছিল সবার আগমন। ও হাসিমুখে সবার চিকিৎসা করত; কখনোই ভিজিট নিত না। সেসব দিন প্রতিবেশীর মন থেকে মুছে গেল!

আমরা কি পারি না চিকিৎসক তথা স্বাস্থ্যসেবকদের প্রতি জাতীয়ভাবে শ্রদ্ধা জানিয়ে ওদের উজ্জীবিত রাখতে? এ সময়ের করোনাযুদ্ধে সামনের সারির সৈনিকদের মনোবল অটুট থাকুক এ আবেদন এই মায়ের। দুঃখের বিষয়, এরই মধ্যে কয়েকজন ডাক্তারসহ অনেক স্বাস্থ্যসেবক করোনা আক্রান্ত। কয়েকজন মারাও গেছেন। এদের মনোবল নষ্ট করা কি সমীচীন? একজন ডাক্তার যখন বাসা থেকে বের হন, তখন তার ছয় বছরের সন্তানটি রেইন কোট পরে মাস্ক লাগিয়ে দরজায় দাঁড়ায়, বাবার সাথে যাবে। আকুতি জানায়, ‘বাবা, তুমি যেও না, করোনায় ধরবে’ বলে বাবার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে অঝোরে। দুই হাত দিয়ে দরজা আগলে রাখে- কিছুতেই বাবাকে যেতে দেবে না, মাকে যেতে দেবে না। আমার ছেলের বউ ডাক্তার। তবুও যেতে হয়। কারণ যেতে যে হবেই- কেননা এটি তাদের দায়িত্ব। ডাক্তারদের প্রতি আমাদের কি সদয় হওয়া মানবতা নয়? কর্তব্য নয়? সব কিছু দেখে নির্বাক ১২ বছরের মেয়েটি। ও জানে, ওর কোনো কথায়ই কাজ হবে না। ও শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে!

যেসব প্রতিবেশী আজ ডাক্তারদের প্রতি এক অচ্ছুত ও অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকাচ্ছেন, হুট করে দূরে সরে যাচ্ছেন, ডাক্তার লিফট ব্যবহার করার পর তাকে দেখিয়ে লিফট পরিষ্কার করাচ্ছেন তারা কি করোনা সমস্যা শেষ হয়ে গেলে ডাক্তারদের দিকে তাকাতে পারবেন? ডাক্তারদের দেখলে তাদের চোখ লজ্জায় নিচে কি নেমে যাবে না?
ধন্যবাদ জানাই টিভি চ্যানেল আই-কে। ‘প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন’ করোনাকালে ডাক্তারসহ প্রথম সারির সব যোদ্ধাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে করতালির মাধ্যমে প্রতি মঙ্গলবার। অভূতপূর্র্ব দৃশ্যটি দেখে কথিত মানুষ যারা ডাক্তারদের অচ্ছুত ভেবেছিলেন, তারা এখন কিছুটা হলেও হবেন প্রশমিত। চ্যানেল আই-এর এই মানবিক উদ্যোগকে অভিবাদন। প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবুর প্রতি জানাই শ্রদ্ধা। তার মহান এ উদ্যোগ করোনাকালে বিশ্বের সব মানুষকে একত্রিত করেছে। প্রথম সারির যোদ্ধাদের দিয়েছে উজ্জীবন।

লেখক : প্রফেসর, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাবি


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us