যে স্মৃতি এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়

আকাশ মাহমুদ | Nov 26, 2020 07:45 am
যে স্মৃতি এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়

যে স্মৃতি এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় - ছবি : সংগৃহীত

 

একান্তই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। ফেসবুক থেকে পাওয়া। পাঠকদের ভিন্নধর্মী একটি লেখা উপহার দেয়ার জন্যই এর প্রকাশ। লেখকের কথাই এখানে হুবহু প্রকাশ করা হলো।

২০০৬ সালের ঘটনা। ড্রাইভিং শিখে বসে আছি। কোন গাড়ি পাচ্ছি না। এক বড় ভাই সরকারি হাসপাতালে এম্বুলেম্স চালান। তিনি বললেন, তুই বসে না থেকে আমার সাথে থাক। আমারো একজন সাথে লোক দরকার। তুই থাকলে আমার সুবিধেই হবে । তোর হাতটাও চালু থাকবে। বড় ভাইয়ের কথায় আমি যেন লাল মঙ্গলগ্রহ হাতে পেলাম ।

কয়েকদিন ধরে বেশ চলছে। যারা এম্বুলেম্স চালান তাদের যে কতটা অভিজ্ঞ হতে হয় তা দেখলাম । বেশ দিন চলছে । সরকারি খরচের গাড়ি হলেও বেশ আলগা কামাই আছে। তেল মবিল নিয়মিত চুরি করা যায়। টুক টাক ভাড়াও মারা যায় । হাসপাতালে এমার্জেন্সি রুগি আসলে কল দেয়। রুগী না থাকলে রেস্ট। একদিন রাত নয়টার দিকে কল এলো হাসপাতাল থেকে। গাড়ি নিয়ে গেটের কাছে গেলাম ওস্তাদের সাথে। গিয়ে দেখি একজন আনুমানিক ৩২ বা ৩৫ বছরের মহিলা গলায় গরুর দঁড়ি পেচিয়ে ঝুলে পড়েছিলেন। কেউ দেখে ফেলার কারণে এবং দুই পা ধরে তুলে ধরার কারণে সাথে সাথে মরে নাই। অর্ধেক মরেছে। দঁড়িতে ঝুল দেওয়ার কারণে গলার ভোকাল কড ছিঁড়ে গেছে । কণ্ঠনালী ভেঙে গলার ভেতর ঢুকে গেছে। ধরধর করে রুগিকে হাসপাতালে এনেছিল। এখানকার ডাক্তার রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিতে বলেছেন।

রুগী হা করে আছেন। বুঝতে পারছি শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমি রুগীর মুখে অক্সিজেন মাক্স লাগিয়ে শুইয়ে দিয়ে বসলাম ওস্তাদের পাশে। রুগির সাথে রুগির মা বোন এবং রুগীর স্বামী।

হাসপাতাল পেড়িয়ে চারপাশে তুমুল বেগে সাইরেন বাজিয়ে ঝড়ের বেগে এম্বুলেম্স যাচ্ছে। আমি মাঝে মধ্যে মাথার কাছের নেটের জানালা সরিয়ে দেখছি কি অবস্থা রুগির।

ওস্তাদ বললেন কি অবস্থা?

আমি বললাম, ভাই গাড়ি একটু জোরে টানতে থাকেন। কমসে কম নাটোর পার হলেও কিছু টাকা পয়সা চেয়ে নেওয়া যাবে। বাড়ির কাছে মরলে চা বিড়ির টাকাও পাবো না। ওস্তাদ বললেন হারামজাদা রুগির অবস্থা কি তাই দেখ।

আমি বললাম, রুগিকে দেখে মনে হচ্ছে না এই জিনিস রাজশাহী পর্যন্ত টিকবে। যদি টেকেও তবু মন বলছে বাঁচবে না।

ওস্তাদ চোখ গরম করে তাকালেন। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে বললাম, ঠাণ্ডা মাথায় টানতে থাকেন। বনপাড়া পার হন আগে।

গাড়ি বনপাড়ার এঁবড়ো থেঁবড়ো রাস্তা দিয়ে ঝাঁকি খেয়ে খেয়ে চলছে। আমি জানালা দিয়ে আরেকবার রুগির দিকে তাকালাম। রুগির স্বামীর অবস্থা রুগির থেকেও খারাপ। সম্ভবত চরম ভয় পেয়েছেন। দেখে মনে হচ্ছে তারো নিঃশ্বাস আটকে আসছে। গাড়িতে এক্সট্রা অক্সিজেন মাক্স থাকলে তাকে একটা দিতাম। স্বামী বেচারা খুব ভীত। মনে হচ্ছে এই যাত্রায় বৌ বেঁচে গেলে বৌ তাকে গলায় দঁড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে মারবে।

যা হোক গাড়ি নাটোরের জ্যাম পার করে দ্রুত যাচ্ছে। আমি জানালা দিয়ে নিজের অর্ধেক বের করে ঐ রিকশা সর, ঐ ট্যাম্পু সর, করছি। রাত দশটা পার হয়ে গেছে। আমার প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে। গাড়ি থামানোর সময় নাই। মাঝেমধ্যে সিগারেট ধরিয়ে ওস্তাদের হাতে দিচ্ছি। তিনি দ্রুত গতিতে গাড়ি টানছেন। আমরা যখন রাজশাহী স্টেশনের সামনে রাত তখন ঠিক বারোটা। বারোটার সময় রুগির ও বারোটা বেজে গেলো। জানালা খুলে দেখলাম রুগির মা বোন লাশের গলা ধরে কাঁদছেন। ওস্তাদ রাস্তার পাশে গাড়ি সাইড করে দ্রুত রুগির কাছে গেলেন। হাত ধরে পাল্স দেখে বললেন মইরা গেছে। তিনি রুগির মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন হাসপাতালে মৃত লাশ নিয়ে গেলে ঝামেলা আর খরচ বেশি হবে। তার থেকে বাড়ি নিয়ে যান। এমনিতেই পুলিশ কেস।

ওস্তাদ গাড়ি ঘুড়িয়ে স্টিয়ারিং আমার হাতে দিয়ে বললেন তুই ধীরে ধীরে চালা। আমার শরীর টা ভালো লাগছে না। আমি ওস্তাদের গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম হালকা জ্বর আছে । আমি গাড়ি টানছি। প্রায় ফাঁকা রাস্তা। মাঝে মধ্যে ঢাকা গামি ট্রাক গুলো ধেয়ে যাচ্ছে। রাত যখন সাড়ে বারোটার মত তখন হঠাৎ গাড়ির বাম পাশের টায়ার পাঞ্ছার হয়ে গেলো। গাড়ি থামিয়ে গাড়িতে থাকা এক্সট্রা চাকা লাগালাম দুই জন। ওস্তাদ কে দেখে খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হলো।

এম্বুলেম্সের ভেতর কান্না চলছেই। ওস্তাদ বললেন আমি নাটোর পর্যন্ত চালায় তুই রেস্ট নে। আমি ওস্তাদের পাশের সিটে বসে আছি। ঝিমুচ্ছি একটু একটু। নাটোরে ঢুকতেই হঠাৎ আবার গাড়ির পেছনের ডান চাকা পাঞ্ছার হয়ে গেলো। গাড়িতে আর চাকা নাই। গাড়ি থামিয়ে ওস্তাদ কে গাড়িতে বসিয়ে রিকশায় দুইটা চাকা নিয়ে গেলাম লিক ঠিক করতে। রাতে পাঞ্ছার ঠিক করার অভিজ্ঞতা খুব কম। সব দোকানপাট বন্ধ। সব পাই পাঞ্ছার ঠিক করার জায়গা পাই না। শেষে এক অটো-রিকশার গ্যারেজে এক ঘন্টা ধরে দুইটা চাকা ঠিক করিয়ে রিকশায় উঠলাম। চাকা লাগিয়ে দেখলাম রাত দুইটা পার। ওস্তাদ আল্লাহ আল্লাহ বলে গাড়িতে টান দিলেন।

গাড়ি দশ মিনিট চলার পর হঠাৎ চরম শব্দ করে ঝাঁকি দিয়ে থেমে গেলো। নেমে দেখলাম আবার একটা চাকা পাঞ্ছার হয়েছে। ওস্তাদের চোখ মুখ শুকিয়ে গেলো। তিনি দোয়া ইউনূস পড়তে পড়তে বাঁকি আরেকটা চাকা লাগাতে লাগলেন। যে চাকাটা ফেঁটেছে সেইটা টায়ার সহ ফেঁটে গেছে। মানে পুরো চাকাই বাতিল। এখন একটা চাকাই ভরসা। আমরা আবার গাড়িতে উঠলাম। ওস্তাদ খুব সাবধানে এবং প্রায় একশো বিশ কিলোমিটার স্প্রিডে গাড়ি চালাচ্ছেন । এত জোরে গাড়ি যাচ্ছে তবু মনে হচ্ছে গাড়ি নড়ছে না। ওস্তাদ বললেন অবস্থা তো খুব খারাপ দেখছি রে আকাশ। দোয়া কালাম পড়তে থাক। আমি সূরা ফাতেহা আর সূরা এখলাস ছাড়া আর কোন দোয়া মনে করতে পারছি না। ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে ঐ দুইটা দোয়াই পড়ছি।

আকাশে মেঘ । চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। হঠাৎ মুলাডুলি পার হওয়ার পরে অটোমেটিক গাড়ি ডানে বায়ে দুলতে লাগলো। ওস্তাদ বললেন এমন হচ্ছে কেন? আমি বললাম চাকা পাঞ্ছার হয় নাই তবে দুলছে কেন?

ওস্তাদ গাড়ির স্প্রিড প্রায় চল্লিশে নিয়ে এলেন কিন্তু গাড়ি দোলানো কমলো না। ধীরে ধীরে দুলুনি বাড়ছেই। আমি আমার মাথার কাছের নেটের জানালা খুলে দেখলাম ভেতরে কি হচ্ছে। জানালা খুলে দেখলাম লাশের সাথের সবাই বড় বড় করে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে আছেন। কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই লাশের বোন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আপার নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ওস্তাদ রাস্তার পাশে গাড়ি থামালেন। তারপর পেছনে গিয়ে সবাই কে নামতে বললেন। সবাই নামার পরেও দেখলাম গাড়ি একলাই দুলছে। দুলছে বললে ভুল হয়। বলতে হয় ঝাঁকাচ্ছে। উঁকি দিয়ে দেখলাম সত্য সত্যই লাশের নাক মুখ দিয়ে হু হু করে ধোঁয়া বের হচ্ছে।

আমরা সবাই রাস্তার ওপর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি । ঐপাড়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি গাড়ি খুব চাকার উপর বাউন্স করছে । মনে হচ্ছে পুরো গাড়িকে দশ জন মানুষ ধরে ঝাকাচ্ছে। এই সব দেখে আমি সূরা ফাতেহা, সূরা এখলাস ভুলে গেছি। শুধু লা ইলাহা ইলাল্লা পড়ছি ।

আকাশে মেঘ ছিল কিন্তু বাতাস ছিল না। হঠাৎ প্রচণ্ড বাতাস শুরু হলো। আশপাশে যাওয়ার কোন জায়গা নেই তাই আমরা গাড়ি থেকে একটু দূরে রাস্তার পাশে একটা ছোট গাছের নিচে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে বসে আছি। একটু পর পর ওস্তাদ হাতের টর্চ লাইট গাড়িতে মারছেন আর দোয়া কালাম পড়ছেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে ওস্তাদ?
তিনি বললেন গাড়ি পেছন সাইড রাস্তা থেকে দুই তিন হাত উপরে উঠে আছে।

ছেঁড়া পাতা আর ধুলোয় চারদিক অন্ধকার। আমি পরণের গেঞ্জি উঁচু করে নাক মুখ ঢেকে আছি। এমন সময় দূরে মসজিদ থেকে আজানের আওয়াজ পেলাম। আযান শেষ হওয়ার আগেই বাতাস থেমে গেলো একদম। আযান যেন ম্যাজিকের মত কাজ করলো। আমরা ভয় ডর ভুলে আস্তে আস্তে সবাই আবার গাড়িতে উঠলাম। লাশের স্বামী পেছনে বসতে ভয় পাচ্ছেন। তাকে সামনে আমার পাশে বসালাম। ওস্তাদ দোয়া দরুদ পড়ে এক্সিলেটরে চাপ দিলেন। আমরা যখন দাশুড়িয়া মোড়ে পৌছালাম তখন চারপাশ ফর্সা হয়ে গেছে । লাশ সোজা লাশের মায়ের বাড়ি নিতে হবে। তার আগে আমাদের কিছু খেতে হবে। গতকাল থেকে সবাই না খাওয়া। দাশুড়িয়া মোড়ে গাড়ি থামিয়ে সবাই একটা হোটেল থেকে নাস্তা করলাম। লাশের মা মেয়ের জামাই কে বললেন বাবা তুমি কোন কোন কিছু নিয়ে ভয় পেও না। আমি জানতাম আমার মেয়ের আচার ব্যবহার কেমন। তুমি আগেও আমাদের জামাই ছিলে এখনও আছো। আমি মনে মনে বললাম, বড় জামাইয়ের সাথে কি ছোট শ্যালিকার রাস্তা তবে ক্লিয়ার হয়ে গেলো?

সকাল সাতটার সময় লাশ লাশের বাপের বাড়িতে নামিয়ে দিলাম। এলাকার মানুষ ছিঃ ছিঃ করতে করতে এগিয়ে এলো। মনে হলো বেঁচে থাকতে ঐ মহিলা এলাকার সবাইকেই জ্বালিয়ে খেয়েছেন। আমরা লাশ নামিয়ে দিয়ে সোজা গাড়ি টান দিয়ে এসে হাসপাতালের গ্যারেজে ঢুকিয়ে বাড়ি চলে এলাম। টানা চার দিন জ্বর কাটালাম তারপর।

তারপর আমি আর কোনদিন এম্বুলেম্সে উঠি নাই। ড্রাইভিং পুরোই ছেড়ে দিলাম। অনেক দিন পর ওস্তাদের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি বললেন ঐ দিনেই তিনি চাকরি ছেড়েছেন। জীবণে যত তেল মবিল চুরি করেছেন তার জন্য তওবা করে এখন একটা দোকান দিয়ে বসেছেন।

দিন চলে গেছে কিন্তু বিশ্বাস করুন সেই রাতের ভয় এখনও আমাদের চোখে আছে। আমি এখনও ভুলতে পারি নাই। জানি উস্তাদ ও ভুলবে না। কখনও ভুলতেও পারবে না।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us