ম্যালকম এক্সের অজানা কাহিনী
ম্যালকম এক্স - ছবি : সংগৃহীত
ম্যালকম এক্স। তিনি আলহাজ মালিক আল শাবাজ নামেও পরিচিত। জন্মের সময়ের নাম ম্যালকম লিটল। জন্ম ১৯২৫ সালের ১৯ মে, নেবরাস্কার ওমাহায়। আর মৃত্যু মাত্র ৩৯ বছর বয়সে, ১৯৬৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, নিউ ইয়র্ক সিটিতে। আততায়ীর বন্দুকের বেশ কয়েকটি গুলিতে আহত হয়ে মারা যান। তাকে সমাহিত করা হয় ফার্নক্লিফ সেমিটারিতে। শুরুতেই জেনে নিই, মুসলমানদের নামের শেষে এক্স হচ্ছে এমন একটি প্রতীক, যা দিয়ে বোঝানো হয় এরা সত্যিকারে আফ্রিকান বংশোদ্ভূত। ইতিহাসের নানা ঘটনায় নানা কারণে এরা বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। কৃতদাসপ্রথার শিকার হতে হয়েছে। এরা নিজেরাও জানে না এদের পারিবারিক নাম কী ছিল। সে জন্য এদের নামের শেষে এক্স যোগ্য কার্যত স্বাজাত্যবোধকেই জাগরূক করে তোলে।
ছিলেন একজন সক্রিয়বাদী মানবাধিকার আন্দোলনের পুরোধা। আজীবন লড়াই করে গেছেন কালো আফ্রিকান, আফ্রিকান-আমেরিকান. আফ্রিকান-মুসলিম ও আমেরিকান-মুসলিমদের জন্য। বলা হয়, তিনি তার সংগ্রামী কর্মময় জীবনের মাধ্যমে এ ক্ষেত্রে নিজেকে করে তুলেছিলেন একজন আইকন, একজন প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। তার শুভাকাক্সক্ষীদের কাছে তিনি ছিলেন কালো মানুষের অধিকার আদায়ে এক দুঃসাহসী প্রবক্তা। কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের ওপর শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের অন্যায়-অত্যাচার নিপীড়ন প্রশ্নে শ্বেতাঙ্গদের তিনি অভিযুক্ত করেছেন কঠোরতম ভাষায়।
ম্যালকম এক্স ছিলেন তার বাবা-মায়ের সাত সন্তানের মধ্যে চতুর্থ। বাবার নাম আর্ল লিটন। মায়ের নাম লুই নর্টন লিটল। বাবার জন্ম জর্জিয়ায়। আর মায়ের জন্ম গ্রানাডায়। বাবা আর্ল ছিলেন ব্যাপ্টিস্ট লে স্পিকার। অনুসারী ছিলেন প্যান-আফ্রিকান সক্রিয়বাদী মার্কাস গার্ভের। সেই সাথে তিনি ছিলেন ‘ইউনিভার্সেল নিগ্রো ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন’ তথা ইউএনআইএ-র স্থানীয় নেতা। তিনি তার সন্তানদের মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ে সোচ্চার ও কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার গর্বে গর্বিত হতে শিখিয়েছিলেন। ম্যালকমের বয়স যখন ছয় বছর, তখন তার বাবা আর্ল লিটল বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গদের হাতে নিহত হন। কৃষ্ণাঙ্গদের দাবি, হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্ট ব্ল্যাক লেজিয়নের লোকেরাই তার বাবাকে হত্যা করে।
পুলিশ বলে, রাস্তায় একটি গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে দুর্ঘটনায় আর্ল ম্যালকম মারা যান। তিনি পা পিছলে গাড়ির নিচে পড়ে যান। কিন্তু তাকে সমাহিত করার সময় একজন ম্যালকমের ভাইদের কাছে বলেছেন, তাকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ির নিচে ফেলে দেয়া হয়েছে। জীবনবীমার পাওনা নিয়ে অনেক দেনদরবার করার পর ম্যালকমের মাকে মাত্র মাসে ১৮ ডলার করে বীমাসুবিধা দেয়া হয়।আজকের দিনের ডলারের মূল্যমানে তা হতে পারে ১০০০ থেকে ১৫০০ ডলারের সমান। অন্য একটি বীমা কোম্পানি তার এ মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে দাবি করে কোনো অর্থসহায়তা দিতে অস্বীকার করে। তখন সংসারের খরচ জোগাতে তাদেরকে বাগানের একটি অংশ বন্ধক দিতে হয়েছিল।
প্রতিবাদি তরুণ ম্যালকম এক্স
তার তিন চাচা নিহত হন শ্বেতাঙ্গদের হাতেই। এক চাচাকে শ্বেতাঙ্গরাই কুপিয়ে হত্যা করে। যুক্তরাষ্ট্রের একসময়ের চরম ডানপন্থী বর্ণবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন কঁ কষীঁ কষধহ- এর হুমকির কারণে আর্ল লিটলের ইউএনআইএ’র কর্মকাণ্ড সমস্যার মুখে পড়ে। এই সংগঠনটি প্রতিক্রিয়াশীলতা প্রদর্শন করে আসছিল হোয়াইট সুপ্রিমেসি, হোয়াইট ন্যাশনালিজম ও অ্যান্টি-ইমিগ্রেশনের পক্ষে ঐতিহাসিকভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। এ সংগঠনের হুমকির প্রেক্ষাপটে তার পরিবারকে ১৯২৬ সালে সরিয়ে নিতে হয় উইসকনসিনের মিলওয়াউকিতে। এর সামান্য ক’দিন পর সেখান থেকে চলে যেতে হয় মিশিগানের লেনসিংয়ে। সেখানেও তার পরিবারকে মাঝে মধ্যেই হোয়াইট সুপ্রিমেসি গ্রুপ ‘ব্ল্যাক লেজিয়ন’-এর সদস্যদের হামলার শিকার হতে হয়। এরা ১৯২৯ সালে তার বড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। আর্ল লিটন এ জন্য ব্ল্যাক লেজিয়নকেই দায়ী করেন।
ম্যালকমের বয়স যখন ১৩, তখন তার মাকে পাঠানো হয় একটি মানসিক হাসপাতালে। তার বাকি জীবন কাটে হাসপাতালেই। জুনিয়র স্কুলে চমৎকার ফল নিয়েই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন ম্যালকম লিটল। কিন্তু একটি ঘটনায় তাকে স্কুল থেকে ঝরে পড়তে হয়। তখন এক শ্বেতাঙ্গ শিক্ষক তাকে বলেন, আইন পড়ে আইন ব্যবসায়কে পেশা হিসেবে বেছে নেয়া একজন নিগ্রোর জন্য বাস্তবসম্মত পছন্দ নয়। এ শিক্ষকের কথা শুনে ম্যালকম লিটলের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, একজন নিগ্রো যত মেধাবীই হোক নিজের পছন্দের পেশাজীবনে প্রবেশের কোনো স্থান নেই এই শ্বেতাঙ্গের জগতে।
এরপর ম্যালকমকে থাকতে হয় বেশ কয়েকটি লালন-পালন কেন্দ্র বা ফস্টার হোমে। এরপর ১৫ বছর বয়সে ম্যালকম চলে যান রক্সবারিতে, এলা লিটল কলিনস নামের এক সৎ বোনের কাছে। সেখানে তিনি নানা ধরনের কাজ করেন। এরপর মিশিগানের ফ্লিন্টে কাটিয়ে ১৯৪৩ সালে নিউ ইয়র্কের মার্লেমে আসেন। এ সময় তাকে একধরনের আফ্রিকান ও আমেরিকান জীবন কাটাতে হয় এমন এক সময়ে, যখন বর্ণবাদী বৈষম্য ছিল পরিব্যাপক। তখন তাকে জড়িয়ে পড়তে হয় নানা ধরনের অপরাধে। ফলে ১৯৪৬ সালে ২০ বছর বয়সে যেতে হয় জেলে। তাকে ডাকা হতো ‘ডেট্রয়েট রেড’ নামে। কারণ তার ছিল এক ধরনের লালচে চুল, যা তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন তার স্কটিশ নানার কাছ থেকে। ম্যালকমকে সামরিক চাকরির জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।
ন্যাশন অব ইসলাম
জেলে থাকার সময় ম্যালকম জানতে পারেন ‘ন্যাশন অব ইসলাম’ সম্পর্কে এবং সে সময়েই তিনি এর সদস্য হন। এটি ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের একটি বিতর্কিত আন্দোলন। এর লক্ষ্য ছিল হোয়াইট সুপ্রিমেসির অর্গল ভেঙে এর বিপরীতে ব্ল্যাক সুপ্রিমেসি প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের মুক্তি অর্জন। ‘ন্যাশন অব ইসলাম’ নাম থেকে মনে হতে পারে এটি একটি ইসলামি আন্দোলন। কিন্তু এর নীতি ইসলাম ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক। সত্যিকারের ইসলামের সাথে এর সামঞ্জস্য ছিল না। জেলে থাকার সময় তার ভাইয়েরা থাকে চিঠি লিখে জানান ন্যাশন অব ইসলামের কথা। তখন এটি ছিল তুলনামূলক নতুন একটি ধর্মীয় আন্দোলন। এটি প্রচার করত কৃষ্ণাঙ্গদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের কথা। এবং চূড়ান্তপর্যায়ে গোটা আফ্রিকাকে একত্র করে কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য এমন এক দেশ গড়া, যা থাকবে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান ও ইউরোপীয়দের প্রাধান্য থেকে মুক্ত। প্রথমে ম্যালকম ন্যাশন অব ইসলাম সম্পর্কে সামান্য আগ্রহ দেখান। ১৯৪৮ সালে তার ভাই রেগিন্যাল্ড ম্যালকম চিঠি লিখে নিষেধ করেন আর শূকরের মাংস না খেতে এবং সিগারেট আর পান না করতে। এরপর ম্যালকম সিগারেট ছেড়ে দেন, শূকরের মাংস খেতে অস্বীকার করেন। তার ভাই রেগিন্যাল্ড জেলে দেখা করে তাকে ন্যাশন অব ইসলামের শিক্ষার কথা জানান। সে যা-ই হোক ১৯৫২ সালে প্যারোলে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ম্যালকম এক্স শিকাগোতে গিয়ে দেখা করেন ন্যাশন অব ইসলামের নেতা এলিজা মোহাম্মদের সাথে।
১৯৫৩ সালে ডেট্রয়েটের ন্যাশনস টেম্পল নাম্বার ওয়ানের অ্যাসিস্ট্যান্ট মিনিস্টার ঘোষণা করা হয়। এ বছরের শেষ দিকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বোস্টনের টেম্পল নাম্বার এলিভেন। ১৯৫৪ সালের মার্চে টেম্পল নাম্বার ১২ সম্প্রসারিত করেন ফিলাডেলফিয়ায়। এরপর দুই মাসের মধ্যে তাকে হার্লেমের টেম্পল নাম্বার সেভেনের প্রধান করে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি দ্রুত সদস্যসংখ্যা বাড়াতে সক্ষম হন। অল্প সময়েই তিনি হয়ে ওঠেন ন্যাশন অব ইসলামের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা। ১০-১২ বছর এমনিভাবেই চলে। কোরিয়ান যুদ্ধের বিরোধিতা করে এবং নিজেকে কমিউনিস্ট ঘোষণা করে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের কাছে চিঠি লেখার পর এফবিআই ১৯৫০ সালে ম্যালকম একোসর নামে একটি ফাইল খোলে। ১৯৫৩ সাল থেকে এফবিআই তাকে নজরদারিতে রাখে। এফবিআই ধরে নেয় তার দ্রুত ন্যাশন অব ইসলামের নেতা হওয়ার পেছনে কমিউনিস্টদের হাত আছে। ১৯৫৫ সালে এসেও ম্যালকম সংগঠনের সদস্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে তার সাফল্য ধরে রাখতে সক্ষম হন। তিনি টেম্পল নাম্বার ১৩ প্রতিষ্ঠা করেন ম্যাচাচুসেটসের স্প্রিংফিল্ডে। টেম্পল নাম্বার ১৪ প্রতিষ্ঠা করেন কানেকটিকাটের হার্টফোর্ডে, টেম্পল নাম্বার ১৫ জর্জিয়ার আটলান্টায়। প্রতি মাসে শত শত আফ্রিকান-আমেরিকান যোগ দিতে থাকে ন্যাশন অব ইসলামে। একজন বক্তা হিসেবে তার দক্ষতা ছাড়াও তার আকর্ষণীয় একটি দেহ ছিল। তার উচ্চতা ছিল ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি, অন্য হিসাবে ১.৯১ মিটার। ওজন ১৮০ পাউন্ড বা ৮২ কেজি। একজন লেখক তাকে বর্ণনা করেছেন ‘পাওয়ারফুলি বিল্ট’ এবং অন্য লেখক ‘মেসমেরিজিংলি হ্যান্ডসাম’ বলে। একসময় তার বিরোধ দেখা দেয় ন্যাশন অব ইসলামের প্রধান নেতা এলিজাহ্ মোহাম্মদের সাথে। এ সময় সাংবাদিকদের সামনে আপত্তিকর মন্তব্য করার অজুহাতে তার প্রকাশ্য বক্তব্য রাখার ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়। এই মতবিরোধের জের ধরেই তিনি ১৯৬৪ সালের মার্চে ন্যাশন অব ইসলাম থেকে বেরিয়ে যান।
এ সময়ে তিনি পরিচিত হন মূল ধারার ইসলামের সাথে এবং তাতে নিজেকে সমর্পিত করেন। এর পরপরই হজ পালনের জন্য মক্কা যান। সাথে সাথে সফর করেন আফ্রিকা ও মধ্যপাচ্যের বিভিন্ন দেশ। দেখা করেন সেসব দেশের মুসলমান নেতাদের সাথে। এরপর আমেরিকায় ফিরে আসেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষ রূপে। আমেরিকায় ফিরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মুসলিম মস্ক, ইঙ্ক’ এবং ‘অর্গানাইজেশন অব আফ্রো-অ্যামেরিকান ইউনিটি’। এবার ভিন্নতর এক মূল্যবোধের ওপর দাঁড়িয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকেন কৃষ্ণাঙ্গদের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। তার এবারের আন্দোলনের মূল্যবোধ ছিল ‘ন্যাশন অব ইসলাম’ নামে আন্দোলনের মূল্যবোধ থেকে পুরোপুরি আলাদা। ‘ন্যাশন অব ইসলাম’ থেকে বেরিয়ে আসার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তিনি ১৯৬৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এর তিন সদস্যের হাতে খুন হন।
সময়ের সাথে ম্যালকম এক্সের প্রকাশিত বিশ্বাসের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ন্যাশন অব ইসলামের মুখপাত্র হিসেবে তিনি শেখাতেন ব্ল্যাক সুপ্রিমেসি। তখন তিনি প্রচার করতেন কালো ও সাদা আমেরিকানদের বিচ্ছিন্ন করার কথা। পরবর্তী সময়ে এর বিপরীতে তার সিভিল রাইট মুভমেন্টের সময় তিনি জোর দিয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে সংহতি গড়ে তোলার ব্যাপারে। ন্যাশন অব ইসলাম থেকে বেরিয়ে এসে তাকে বলতে শোনা গেছে, ‘একজন কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমান হিসেবে আমি এমন অনেক কিছুই করেছি, যার জন্য এখন আমি দুঃখিত। তখন আমি ছিলাম একজন জম্বি, অর্থাৎ একজন মেধাহীন, চিন্তাশূন্য ও অবিবেচক ব্যক্তি।’
একজন সুন্নি মুসলমান হওয়ার পর তিনি বর্ণবাদী ধ্যানধারণা ছেড়ে নাগরিক অধিকার আদায়ে আন্দোলনরতদের সাথে একসাথে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এর পর থেকে তিনি অব্যাহতভাবে জোর তাগিদ দেন প্যান-আফ্রিকানিজম, কৃষ্ণাঙ্গদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও আত্মপ্রতিরক্ষার ওপর।
বিয়ে ও পরিবার
১৯৫৫ সালে তার একটি ভাষণের পর বেটি সেন্ডার্স নামের এক মহিলা তার সাথে দেখা করেন। এরপর তাদের দেখা হয় আরেকটি নৈশভোজে। এর পর থেকে বেটি সেন্ডার্স নিয়মিত ম্যালকমের বক্তৃতা শুনতে থাকেন। ১৯৫৬ সারে বেটি যোগ দেন ন্যাশন অব ইসলামে এবং নাম পরিবর্তন করে রাখেন বেটি এক্স। ১৯৫৮ সালে টেলিফোনের মাধ্যমে ম্যালকম এক্স তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। এর দুই দিন পর তারা বিয়ে করেন। তাদের ছিল দুই কন্যাসন্তান : ১৯৫৮ সালে জন্ম নেয়া আত্তাল্লাহ, ১৯৬০ সালে জন্ম নেয়া কুবলাই খানের নামানুসারে নাম রাখা কুবিলা, ১৯৬২ সালে জন্ম নেয়া এলিজা মোহাম্মদের নামানুসারে নাম রাখা লিয়াসা, ১৯৬৪ সালে জন্ম নেয়া পেট্রস লুবুম্বার নামানুসারে নাম রাখা জামিলা লুবুম্বা এবং ১৯৬৫ সালে তার বাবার মৃত্যুর পর জন্ম নেয় যমজ মালিকা ও মালাক। উল্লেখ্য, এ দু’জনের নাম রাখা হয় তাদের বাবার নামানুসারে।
হত্যাকাণ্ড
১৯৬৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ম্যালকম এক্স তৈরি হচ্ছিলেন ম্যানহাটানের অডোবন বলরুমে ‘অরগানাইজেশন অব অ্যাফ্রো-অ্যামেরিকান ইউনিটির’ এক সভায় বক্তব্য রাখার জন্য। সেখনে তখন ছিল ৪০০-এর মতো শ্রোতা। হঠাৎ করে ম্যালকম সভায় একটা গোলমাল শুনতে পেলেন। ম্যালকম ও তার দেহরক্ষী গোলমাল থামানোর জন্য সেখানে এগিয়ে গেলেন। এ সময় সামনের সারিতে বসে থাকা একজন তার দিকে এগিয়ে এসে সরাসরি তার বুকে গুলি চালায়। সে দোনলা সোড-অফ শুটগান দিয়ে এই গুলি করে। এ সময় অন্য দু’জন মঞ্চের দিকে এগিয়ে এসে সেমি-অটোমেটিক গান দিয়ে ম্যালকমের ওপর উপর্যুপরি গুলি চালাতে থাকে। ঘটনার পরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কলম্বিয়া প্রেসবিটারিয়ান হাসপাতালে। কিছুক্ষণ পর বেলা সাড়ে ৩টার সময় তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন মতে, ম্যালকমের বুকে, বাম কাঁধে, পায়ে ও বাহুতে বন্দুকের ২১টি গুলির ক্ষত সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে ১০টি ছিল বড় আকারের গুলি, যা তার বুকের বাম পাশটা ও কাঁধ বিদীর্ণ করে। এসব গুলি আসে প্রথম হামলাকারীর শুটগান থেকে।
একজন বন্দুকধারী ছিলেন ন্যাশন অব ইসলামের সদস্য। তার নাম তালমাজ হায়ের, তিনি থমাস হায়ের নামেও পরিচিত ছিলেন। ঘটনার কয়েক মিনিট পর পুলিশ এসে পৌঁছার আগেই তিনি জনতার হাতে ধরা পড়েন। জনতা তাকে মারধর করে। অন্য দু’জনকেও ন্যাশন অব ইসলামের সদস্য বলে চিহ্নিত করা হয়। এরা হচ্ছেন : নরম্যান থ্রি এক্স বাটলার ও থমাস ফিপটিন এক্স জনসন। হায়ের আদালতে অপরাধের কথা স্বীকার করেন। তবে কিছুতেই তিনি অন্য খুনিদের নাম প্রকাশ করতে অস্বীকার করেন। আদালতে শুধু বলেন, বাটলার ও জনসনের সাথে জড়িত নন। আদালত এ তিনজনকেই দোষী সাব্যস্ত করে।
বাটলারের বর্তমান নাম মোহাম্মদ আবদুল আজিজ। ১৯৮৫ সালে তাকে প্যারোলে মুক্তি দেয়া হয়। তিনি ১৯৯৮ সালে ন্যাশনের হার্লেম মসজিদ প্রধানের দায়িত্ব পান। তিনি এখনো তাকে নিরপরাধ মনে করেন। জনসন তার নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রেখেছেন খলিল ইসলাম। তিনি কারাগারে থাকার সময়ে ন্যাশন অব ইসলামের শিক্ষা পরিত্যাগ করেন এবং ধর্মান্তরিত হয়ে হন সুন্নি মুসলমান। তিনি প্যারোলে মুক্তি পান ১৯৮৭ সালে। ২০০৯ সালের আগস্টে মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি নিজেকে নির্দোষ মনে করতেন। হায়েরের বর্তমান নাম মুজাহিদ হালিম। তিনি প্যারোলে কারাগার থেকে ছাড়া পান ২০১০ সালে।
সমাহিতকরণ
২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তার লাশ জনসাধারণের প্রদর্শনের জন্য হারলেমের ইউনিটি ফানার‌্যাল হোমে রাখা হয়। অনুমিত হিসাব মতে, ৩০ হাজারের মতো শোকার্ত মানুষ তার শেষকৃত্যে যোগ দেয়। শেষকৃত্য অনুষ্ঠান ২৭ ফেব্রুয়রি অনুষ্ঠিত হয় হার্লেমের ‘ফেইথ টেম্পল চার্চ অব গড ইন ক্রাইস্ট’-এ। তখন ১০০০ লোকের ধারণক্ষম চার্চ ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। চার্চের বাইরে লাগানো হয়েছিল লাউড স্পিকার, যাতে করে সমবেত লোকেরাও অনুষ্ঠান শুনতে পায়। স্থানীয় টেলিভিশন কেন্দ্রগুলো অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করে। অনুষ্ঠানে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জন লিউইস, ব্যায়ার্ড রাস্টিন, জেমস ফোরম্যান, জেমস ফার্মার, জেসি গ্রে ও অ্যানড্রু ইয়ং। অভিনেতা ও সক্রিয়বাদী অসি ড্যাভিস পাঠ করে শোনান প্রশংসাপত্র। এতে ম্যালকম এক্সকে ‘আওয়ার শাইনিং ব্ল্যাক প্রিন্স’ অভিধায় আখ্যায়িত করা হয়।
প্রতিক্রিয়া
ম্যালকম এক্স নিহত হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ম্যালকমের স্ত্রী বেটি শাবাজের কাছে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে গভীর দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘ইট ইজ দ্য শকিং অ্যান্ড ট্র্যাজিক অ্যাসাসিনেশন অব ইউর হাজব্যান্ড। আমরা কখনো সামনাসামনি বসে বর্ণবাদ সমস্যা সমাধানের উপায় নিয়ে ভাবিনি এ কথা ঠিক। তবু ম্যালকমের প্রতি আমার স্নেহের দৃষ্টি ছিল। আর আমি মনে করি, তার বড় ধরনের ক্ষমতা ছিল বর্ণবাদ সমস্যার অস্তিত্ব ও শেকড়ের বিরুদ্ধে আঙুল তোলার। তিনি তার যুক্তি-অভিমত অসাধারণ বাগ্মিতায় তুলে ধরতে পারতেন। এবং কোনো সজ্জন সংশয় প্রকাশ করতে পারেন না যে, ম্যালকম চলমান বর্ণবাদ সমস্যা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন না।
এলিজা মোহাম্মদ ২৬ ফেব্রুয়ারি অ্যানুয়ার সেভিয়র্স ডে কনভেনশনে এই খুনের সাথে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে বলেছিলেন, ম্যালকম এক্স তাই পেয়েছেন, যা তিনি প্রচার করতেন। আমরা তাকে খুন করতে চাইনি। আমরা তাকে খুনের চেষ্টাও করিনি। আমরা জানি এ ধরনের অজ্ঞতা ও বোকামির শিক্ষাই এক দিন তাকে শেষ করে দেবে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস তখন লিখেছিল, ম্যালকম এক্স ছিলেন একজন ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি অ্যান্ড টুইস্টেড ম্যান’। তিনি অনেক ভালো অবদানকে পরিণত করেছিলেন অসদুদ্দেশ্যে এবং এর ফলে তার জীবন ‘স্ট্র্যাঞ্জলি অ্যান্ড পিটিফুলি ওয়াস্টেড’। নিউ ইয়র্ক পোস্ট লিখেছিল, এমনটি তার চরমতম সমালোচককেও তার মেধার প্রতি স্বীকৃতি জানাতে হবে। তিনি কখনো ছিলেন উগ্র, কখনো তাকে বুঝে ওঠা মুশকিল ছিল, কখনো ছিলেন অদ্ভুত ধরনের খামখেয়ালি কিন্তু সব কিছু ছাড়িয়ে তিনি প্রবল সম্ভাবনা ধারণ করতেন, যা অবশ্যই এখনো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, বিশেষ করে আফ্রিকার গণমাধ্যমগুলো তার প্রতি ছিল সহানুভূতিশীল। ডেইলি টাইমস অব নাইজেরিয়া লিখেছিল, ‘ম্যালকম এক্স এক্স উইল হেভ অ্যা প্লেইস ইন দ্য প্যালেস অব মার্টিয়ার্স’। ঘানাইয়ান টাইমস তাকে জন ব্রাউন ও প্যাট্রিক লুবুম্বার সাথে তুলনা করে লিখেছিল, এমন অনেক আফ্রিকান ও আমেরিকানকেই প্রাণ দিতে হয়েছে স্বাধীনতার জন্য। বেজিং থেকে প্রকাশিত ঘানাইয়ান ডেইলি লিখেছে, ম্যালকম সম-অধিকারের জন্য লড়ে চলেছিলেন বলেই তাকে খুন করা হয়েছে। কিউবার পত্রিকা এল মুন্ডু তার হত্যাকে বর্ণনা করে আরেকটি বর্ণবাদী অপরাধ হিসেবে। এর লক্ষ্য বর্ণবাদী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে থামিয়ে দেয়া।
ষড়যন্ত্রের অভিযোগ
তার হত্যার পর কয়েক দিনের মধেই প্রশ্ন ওঠে, কে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী? ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘কংগ্রেস অব রেসিয়্যাল ইকুয়েলিটি’র প্রধান জেমস ফার্মার একটি সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন, ন্যাশন অব ইসলাম নয়, স্থানীয় ড্রাগ ডিলারেরা এই হত্যার জন্য দায়ী। অন্যেরা এর জন্য অভিযোগ তোলেন নিউ ইয়র্ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্ট তথা এনওয়াইপিডি, এফবিআই কিংবা সিআইএ’র ওপর। এরা বলেন, এ কারণেই তাকে পর্যাপ্ত পুলিশ প্রটেকশন দেয়া হয়নি। ফলে হত্যাকারীরা সহজে অডোবন বলরুমে ঢুকতে পেরেছে। তা ছাড়া পুলিশ হত্যা ঘটনার আলামত যথাযথভাবে সংরক্ষণেও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
১৯৭০-এর দশকে সাধারণ মানুষ ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে নাগরিক অধিকার আন্দোলনকারী সংগঠনগুলোর আন্দোলন বাধাগ্রস্ত ও দমিত করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত ঈঙওঘঞঊখচজঙ ও এফবিআই-এর কিছু গোপন কর্মসূচির কথা জানতে পারে। ন্যাশন অব ইসলামের ন্যাশনাল সেক্রেটারি জন আলীকে তখন চিহ্নিত করা হয় এফবিআই-এর আন্ডাকভার অ্যাজেন্ট হিসেবে। ম্যালকম এক্স একজন বিশ্বস্ত সাংবাদিককে জানিয়েছিলেন জন আলী এলিজা মোহাম্মদকে তার বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে তোলার কাজে ব্যস্ত। তিনি আলীকে ন্যাশন অব ইসলামের নেতৃত্বের প্রশ্নে তার ‘আর্ক এনিমি’ তথা চরমশত্রু বলে বিবেচনা করতেন। ১৯৬৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ছিল তাকে হত্যা করার আগের দিন। সে দিন রাতে জন আলী সাক্ষাৎ করে তালমাজ হায়েরের সাথে। তিনি ছিলেন ম্যালকম এক্সের খুনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খুনিদের একজন।
১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালে তালমাজ হায়ের দু’টি সোর্ন-অফ অ্যাফিডেভিট তার হলফনামা পেশ করেন। এ হলফনামায় তিনি আবারো জোর দিয়ে দাবি করেন, বাটলার ও জনসন এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না। এ হলফনামায় তালমাজ হায়ের চারজনের কথা উল্লেখ করেন। এরা সবাই ন্যাশন অব ইসলামের নিউ জার্সির নেটওয়ার্কের ২৫ নাম্বার টেম্পলের সদস্য। তালমাজ বলেন, এরা তার সাথে এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি জানান পরবর্তী সময়ে উইলবার ম্যাককিনলি নামে একজনকে চিহ্নিত করা হয়, যিনি চিৎকার করেছিলেন এবং একটি ডাইভার্সন তৈরির জন্য একটি স্মোক বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন। হায়ের বলেছেন, পরবর্তী সময়ে উইলিয়াম ব্র্যাডলি নামে চিহ্নিত করা হয়, যিনি তার শুটগান দিয়ে ডাইভার্সনের পর প্রথম ম্যালকম এক্সের ওপর গুলি চালান। হায়ের আরো জানান, তিনি ও লিওন ডেভিস নামের আরেক জনের হাতে ছিল পিস্তল। এরা শুটগানের বিস্ফোণের পরপরই পিস্তল দিয়েই ম্যালকম এক্সের ওপর গুলি চালায়। হায়ের আরো বলেন, বেঞ্জামিন থমাস নামে পঞ্চম এক ব্যক্তি এই ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন। হায়েরের দেয়া এই বিবৃতিতে কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ফলে এই খুনের মামলার তদন্ত নতুন করে চালু করতে তিনি ব্যর্থ হন।
শাবাজ পরিবারের লোকজনসহ আরো কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, লুই ফারাখান ম্যালকম হত্যার সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৯৩ সালে ন্যাশন অব ইসলামের নেতা ফারাহ খানের এক ভাষণ থেকে মনে হয়েছে তিনি স্বীকার করেছেন, এই খুনের সাথে ন্যাশন অব ইসলামের জড়িত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে : ম্যালকম কি বিশ্বাসঘাতক ছিলেন, না ছিলেন আমাদেরই একজন? একটি জাতি যেমনি একজন বিশ্বাসঘাতকের সাথে আচরণ করে থাকে, আমরা যদি তার সাথে তেমন ব্যবহার করে থাকি, তবে তার দোষটা কী? একটি জাতিকে সক্ষম হতে হবে বিশ্বাসঘাতক, বর্বর ও দলত্যাগীদের মোকাবেলা করার।
২০০০ সালে ‘সিক্সটি মিনিট’ অনুষ্ঠানে প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে লুই ফারাখান বলেন, তিনি এমন কিছু বলে থাকতে পারেন যা ম্যালকমের খুনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তিনি বলেন : ও সধু যধাব নববহ পড়সঢ়ষরপরঃ রহ ড়িৎফং ঃযধঃ ও ংঢ়ড়শব, ও ধপশহড়ষিবফমব ঃযধঃ ধহফ ৎবমৎবঃ ঃযধঃ ধহু ড়িৎফ ঃযধঃ ও যধাব ংধরফ পধঁংবফ ঃযব ষড়ংং ড়ভ ষরভব ড়ভ ধ যঁসধহ নবরহম. কিন্তু এর ক’দিন পর তিনি ম্যালকমকে হত্যা করার আদেশ দেয়ার কথা অস্বীকার করেন। যদিও এর পরে আবারো তিনি স্বীকার করেন, তিনিই এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেন যার ফলে ম্যালকম খুন হন। তার পরও আজ পর্যন্ত এমন ঐকমত্য সৃষ্টি হয়নি, যে সূত্রে বলা যায় কে ম্যালকমের খুনি।