নির্ভীক যোদ্ধা সালাহউদ্দিন আইয়ুবী : যার শূন্যতা এখনো অনুভব করে বিশ্ব

অন্য এক দিগন্ত ডেস্ক | Dec 19, 2020 12:37 pm
সালাহউদ্দিন আইয়ুবী

সালাহউদ্দিন আইয়ুবী - ছবি সংগৃহীত

 

আবু-নাসির সালাহউদ্দিন ইউসুফ ইবনে আইয়ুব। বিশ্ব-বিজয়ী মুসলিম বীর। মিসর ও সিরিয়ার প্রথম সুলতান, আইয়ুবীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। একজন শক্তিশালী শাসক, নির্ভীক ও সাহসী যোদ্ধা। যার শূন্যতা এখনো অনুভব করে মুসলিম বিশ্ব।

ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে তার সালতানাতের অংশ ছিল মিসর, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, হেজাজ, ইয়ামেনসহ উত্তর আফ্রিকার বড় একটি অংশ। তিনি খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে বহু যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং বিজয়ের জন্য পরিচিতি পেয়েছেন।

মুসলিমদের কাছে তিনি সালাউদ্দিন আইয়ুবী এবং পশ্চিমা বিশ্বে সালাদিন নামেই পরিচিত। বিজয়ী যোদ্ধা এবং শক্তিশালী ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়।
ইতিহাসের বইগুলোতে তার বহু যুদ্ধের বিজয়ী বীর হিসেবে উল্লেখ থাকলেও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের সর্বাত্মক যুদ্ধ ক্রসেড বিজয়ের জন্য তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও আলোচিত।

ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ এই যুদ্ধে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ছিলেন একজন কিংবদন্তি যোদ্ধা। ক্রুসেডারদের সাথে এই যুদ্ধে তিনি অসীম সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছেন এবং তাদেরকে পরাজিত করে পবিত্র ভূমি জেরুজালেম মুক্ত করেছিলেন। যুদ্ধে জয়লাভ করেও তিনি ইউরোপোর সম্মিলিত শক্তিগুলোাকে ফিরেযেতে দিয়েছিলেন। বিশ্ব এমন সাহসী এবং সহানুভূতিশীল বিজয়ী আর দেখেনি।

ক্রসেডের এই যুদ্ধে খ্রিস্টানদের সম্মিলিত ইউরোপ ও পশ্চিমা শক্তিগুলো এশীয়ার মুসলিম শক্তিগুলোকে উৎখাত করতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সালাউদ্দিন আইয়ুবীর কাছে পরাজিত হয়েছিল।
সালাউদ্দিন আইয়ুবীর জন্ম :

বিশ্বজয়ী এই বীর ওই সময়ের মেসেপটমীয় বর্তমান ইরাকের তিকরিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার নানা ছিলেন আলেপ্পো নগরীর অবিভাবক ও জাঙ্গি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নুরউদ্দিন জাঙ্গি। তার পিতা নাজমুদ্দিন আইয়ুব ছিলেন ট্রাইগ্রিস এলাকার তত্ত্বাবধায়ক। তিনি বেড়ে ওঠেন সিরিয়ার দামেস্কে শহারে।

সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ১১৮২ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর বাইসান আক্রমণের উদ্দেশ্যে অসীম সাহসিকতার সাথে জর্ডান নদী পাড়ি দেন। সেখানে পৌঁছে তার সেনারা কোনো শত্রুকে না পেয়ে শহরটি জ্বালিয়ে দিয়ে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়।

রেনল্ড অব শাটিলন যখন লোহিত সাগরে মুসলিম বাণিজ্য ও হজ্জযাত্রীদের বহরকে আক্রমণ করেন, সালাহউদ্দিন এসময় পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এসময় তিনি বৈরুত আক্রমণের জন্য ৩০টি জাহাজের একটি নৌবহর গড়ে তোলেন। এরপর রেনল্ড যখন মক্কা ও মদিনা আক্রমণের হুমকি দিয়েছিল তখন সালাহউদ্দিন পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে কেরাক অবরোধ করেন। এ অবরোধ ১১৮৩ থেকে ১১৮৪ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। অবরোধ ব্যার্থ হলেও রেনল্ড শাটিলনের হুমকি থেকে রক্ষা পেয়েছিল পবিত্র মক্কা ও মদিনা নগরী।
এর পরে রেনল্ড ১১৮৫ সালে হজ্জযাত্রীদের একটি ক্যারাভানে আক্রমণ চালায়। হজ্জযাত্রীরা মুসলিম ও খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের মধ্যে সম্পাদিত শান্তিচুক্তির কথা বললেও রেনল্ড মুহাম্মাদ স:কে অপমান করেন এবং হজ্জযাত্রীদের হত্যা করেন। এই খবর শুনে সালাহউদ্দিন রেনল্ডকে হত্যার শপথ নেন।

জেরুজালেমে সর্বাত্মক জয় :
১১৮৭ সালের জুলাই মাসে সালাহউদ্দিন ক্রসেডারদের জেরুসালেম রাজ্যের বেশির ভাগ এলাকা দখল করে নেন। ১১৮৭ সালের ৪ জুলাই হাত্তিনের যুদ্ধে জেরুজালেমের রাজা গাই অব লুসিগানান ও তৃতীয় রেমন্ডের সম্মিলিত বাহিনীর সাথে সালাহউদ্দিনের বাহিনী মুখোমুখি হয়। রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধে ক্রসেডার সোনাবাহিনী প্রায় পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

এই যুদ্ধ ক্রুসেড যুদ্ধের গতিপথ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। রেনল্ড আব শাটিলন ও গাই অব লুসিগানকে বন্দী করা হয়। পরে রেনল্ডকে মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। রেনল্ডের মৃত্যদণ্ডদেখে গাই অব লুসিগান আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কিন্তু সালাহউদ্দিন তাকে ক্ষমা করে দেন এবং বলেন ‘রাজা অন্য রাজাকে হত্যা করে না, কিন্তু ঐ লোকটা সকল সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল’।

এ কারণে সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী পশ্চিমাদের কাছে চরিত্রবান, শক্তিশালী বীর যোদ্ধা হসেবে পরিচিত। যিনি তার শত্রুদের প্রতি ছিলেন করুণাময় ও দয়ালু।

তৃতীয় ক্রুসেড
হাত্তিনের যুদ্ধ এবং জেরুসালেমের পতন তৃতীয় ক্রুসেডকে উদ্বুদ্ধ করে। ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড দ্যা লায়নহার্ট জেরুসালেম পরাজয়ের প্রতিশোধনিতে নারী ও শিশুসহ প্রায় তিন হাজার মুসলিম বন্দীকে হত্যা করেন। ১১৯১ সালের ২৮ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এসব বন্দী মুসলিমকে হত্যা করা হয়।

এসময় ৭ সেপ্টেম্বর আরসুফের যুদ্ধে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সেনাবাহিনীর সাথে রিচার্ড বাহিনীর লড়াই হয়। এতে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী বাহিনী বেশ হতাহত হয় এবং পিছু হটতে বাধ্য হয়। আরসুফের যুদ্ধের পর রিচার্ড তার বাহিনী নিয়ে আসকালনের দিকে অগ্রসর হন। রিচার্ডের পরবর্তী পদক্ষেপ বুঝতে পেরে সালাহউদ্দিন শহর খালি করে দেন এবং শহর থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে অবস্থান নেন।

রিচার্ড শহরে উপস্থিত হলে এটি পরিত্যাক্ত দেখে অবাক হন। পরে তিনি জাফায় পিছু হটার প্রস্তুতি নেয়ার সময় সালাহউদ্দিন পাল্টা আক্রমণ করেন। রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর রিচার্ড পিছু হটতে বাধ্য হন। এই দুই বাহিনীর মধ্যে এটিই ছিল সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ লড়াই। জেরুসালেম জয়ের জন্য রিচার্ডের সকল সামরিক পদক্ষেপ ও যুদ্ধ ব্যর্থ হয়ে যায়।

যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য এসময় রিচার্ডের মাত্র দুই হাজার পদাতিক সৈন্য এবং ৫০ জন পদাতিক নাইট ছিল। শহরের খুব কাছে পৌঁছলেও এত কম সেনা নিয়ে তা জয় করা সম্ভব ছিল না। রিচার্ড ও সালাউদ্দিন সামরিক প্রতিপক্ষ হওয়ার পরেও তাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল ভিন্ন মাত্রার। যদিও মুখোমুখি তাদের সাক্ষাত হয়নি, তবে চিঠি বা বার্তাহকের মাধ্যমে তাদের যোগাযোগ হতো।

অবশেষে ১১৯২ সালে তারা ‘রামলার চুক্তি’ স্বাক্ষর করেন। এর মাধ্যমে ঠিক করা হয় যে জেরুসালেম মুসলিমদের হাতে থাকবে কিন্তু তা খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এই চুক্তির মাধ্যমে ল্যাটিন রাজ্য ‘টায়ার’ থেকে ‘জাফা’ শহর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ হয়ে যায়।

শাসক এবং যোদ্ধা সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ব্যাক্তিগত জীবনে ছিলেন ধর্মানুরাগী। তিনি যুদ্ধের সময়গুলোতে এবং যেকোনো সফরে একজন ইমামকে সঙ্গে রাখতেন, যিনি তার নামাজের ইমামতি করতেন। ইমাম না থাকলে তিনি উপস্থিত ধর্মপ্রাণ গবেষক ও আলেমদের পিছনেও নামাজ পড়তেন। বলা হয়ে থাকে সালাহউদ্দিন আউয়ুবী মৃত্যুর আগে তিন দিন গভীর কোমায় ছিলেন, এই তিন দিন ছাড়া অন্য কোনো সময় তিনি নামাজ ছেড়ে দেননি।

জীবনাবসান
রাজা রিচার্ড ফিরে যাওয়ার অল্প কিছু দিন পরে ১১৯৩ সালে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিন দিন অচেতন থাকার পর ৪ মার্চ দামেস্কে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দামেষ্কের উমাইয়া মসজিদের বাইরে তাকে দাফন করা হয়। বর্তমানে তার কবরটি উমাইয়া মসজিদের উত্তর পশ্চিম কোণে সাদামাটা অবস্থায় আছে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us