পাথর নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে কাশ্মিরিরা!

হামিদ মীর | Dec 30, 2020 06:25 pm
পাথর নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে কাশ্মিরিরা!

পাথর নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে কাশ্মিরিরা! - ছবি সংগৃহীত

 

এটা আমার সাংবাদিক জীবনের এক বিরল অভিজ্ঞতা। একজন সাংবাদিক হিসেবে আফগানিস্তান থেকে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও ফিলিস্তিনের যুদ্ধগুলো অনেক কাছ থেকে দেখেছি। বসনিয়া ও শ্রীলঙ্কার তামিল এলাকা জাফনাতে লাশের স্তূপও দেখেছি। চেচনিয়ার গ্রোজনি শহরে একজন মার্কিন সাংবাদিকের সাথে রুশবাহিনীর গ্রেফতারের মুখোমুখিও হয়েছি। যুদ্ধাঞ্চলে ধ্বংসলীলার লক্ষ্যে পরিণত মজলুম নাগরিকদের সাধারণত আর্তচিৎকার ও আহাজারি করতে দেখা যায়। কিন্তু ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর আজাদ কাশ্মিরের জোরা অঞ্চলে ভারতের বোমাবর্ষণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত নিরস্ত্র কাশ্মিরিদের ফরিয়াদ আহাজারি নয়, বরং তাদের যুদ্ধের ঘোষণা করতে দেখা গেছে। এটা শুধু আমার সাংবাদিক জীবনের নয়, বরং আমার সহযাত্রী বিশের অধিক রাষ্ট্রদূতের জন্যও এক বিরল অভিজ্ঞতা ছিল। এক দিন আগে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত দাবি করেছিলেন, তার বাহিনী পাকিস্তান শাসিত কাশ্মিরের নীলাম উপত্যকার জোরা অঞ্চলে সন্ত্রাসীদের তিনটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ধ্বংস করে দিয়েছে। পরের দিনই পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ড. ফয়সাল ইসলামাবাদস্থ ভারতীয় হাইকমিশনারের সাথে যোগাযোগ করেন এবং প্রস্তাব দেন যে, আপনার সেনাবাহিনী প্রধান যে স্থানে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ধ্বংস করার দাবি করেছেন, আপনি সেখানে আমাদের সাথে চলুন।

তবে ভারতীয় হাইকমিশনার নীরবতা অবলম্বন করেন। এই নীরবতার জবাব দেয়ার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল আসিফ গফুর বিভিন্ন দেশের প্রায় দুই ডজন কূটনীতিবিদকে নিয়ে জোরা পৌঁছেন। আমরা যখন নীলাম নদীর সাথে সাথে সফর করে নোসিরি দিয়ে জোরার দিকে যাচ্ছিলাম, তখন কিছু বিদেশী কূটনীতিবিদ দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, নদীর কাছে অধিকৃত কাশ্মিরের অঞ্চলে ভারতীয় বাহিনী চেক পোস্ট থেকে অবাক চোখে তাদের দেখছে। তবে তাদের আশপাশে স্থানীয় লোকদের চলাফেরা নজরে পড়ল না। আজাদ কাশ্মিরের অংশে পাকিস্তান বাহিনীর চেক পোস্টগুলোর আশপাশে স্থানীয় লোকেরা স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা এবং স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করছিল। আমরা একটি বেসরকারি গাড়িতে করে জোরা যাচ্ছিলাম। আমাদের গাড়ির স্থানীয় ড্রাইভার জায়গায় জায়গায় গাড়ি ধীরগতিতে এনে আমাদের ভারতীয় বাহিনীর গোলাবর্ষণের চিহ্নগুলো দেখাচ্ছিলেন।

আমরা যখন জোরা বাজারে গিয়ে থামলাম এবং গাড়ি থেকে নিচে নেমে এলাম, তখন একজন স্থানীয় উকিল আমাকে গলায় জড়িয়ে ধরলেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন, আপনি ১৯৯৮ সালে এখান দিয়ে আঠমাকাম গিয়েছিলেন। সেখানে আপনার গাড়িতে ভারতীয় বাহিনী গুলি করেছিল। তখন আমার বড় ভাই আহত হয়েছিলেন, যিনি আপনাকে মুজাফ্ফারবাদ থেকে আঠমাকাম নিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই উকিলের কথা শেষ হয়নি, স্থানীয় জনগণ ভারতের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে লাগল। আমার সাথে আসা কূটনীতিবিদগণ এদের অবাক চোখে দেখতে লাগলেন।

জোরায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দশম সিন্ধ রেজিমেন্টের ইউনিট হেডকোয়ার্টারে মেজর জেনারেল আসিফ গফুর ব্রিফিং দিলেন। ব্রিফিং শেষে আমরা কূটনীতিবিদদের সাথে জোরা বাজারে এলাম। এরপর আমরা যেদিকেই গেছি, সেদিকেই শুধু ভয়ঙ্কর ধ্বংসলীলা চোখে পড়েছে। কূটনীতিবিদগণ বিধ্বস্ত দোকান ও বাড়িঘরের ছবি তুলছিলেন। কোথাও কোনো আর্তচিৎকার ও আহাজারি ফরিয়াদ ছিল না। বরং বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠা কাশ্মিরিরা ভারতীয় বাহিনীর কাছ থেকে প্রতিশোধ নেয়ার আগুনে জ্বলছিলেন। এক বৃদ্ধ কাশ্মিরি আমাকে বললেন, এলওসি’র ওপারের মানুষেরা ওদের ঘৃণা করে। কিন্তু আমরা আমাদের বাহিনীকে ভালোবাসি। যদি যুদ্ধ হয়, তাহলে অধিকৃত কাশ্মিরের লোকেরা নিরাপদ স্থানে চলে যাবে। কিন্তু আমরা কোথাও যাবো না। যখন আমাদের সৈন্যরা শত্রুর ওপর গুলি চালাবে, বোমা বর্ষণ করবে, তখন পাহাড়ে উঠে ওখান থেকে শত্রুর ওপর পাথর বর্ষণ করব। একজন রাষ্ট্রদূত আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এ বৃদ্ধ মানুষটা আপনাকে কী বলছিলেন? যখন তাকে ইংরেজিতে বললাম, এ বৃদ্ধ ভারতীয় বাহিনীর ওপর পাথর বর্ষণের কামনায় নিমজ্জিত। তখন রাষ্ট্রদূত বললেন, এখন বুঝে এলো, ভারতীয় সেনাপ্রধান এই বুড়োদের মেরে এতটা আনন্দিত কেন?’

কূটনীতিবিদরা তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জোরা বাজারের আশপাশে সঙ্ঘটিত ধ্বংসযজ্ঞের পরিপূর্ণ পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের পর একে অপরকে বলতে লাগলেন- এখানে সন্ত্রাসীদের কোনো ক্যাম্প নেই। এক পশ্চিমা দেশের সেনা অ্যাটাশে তার ইউনিফর্মেই এখানে এসেছেন। তিনি বললেন, আমি অনেক যুদ্ধাঞ্চল দেখেছি, কিন্তু কোনো যুদ্ধাঞ্চলে এত সাহসী মানুষ দেখিনি, যারা তাদের বাড়িঘর ধ্বংস হওয়ার পরও এলাকা ছেড়ে চলে যেতে প্রস্তুত নয়। অপর এক রাষ্ট্রদূত আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, জোরা থেকে শারদা কতদূর? আমি বললাম, বেশি দূরে নয়। তিনি জানতে চাইলেন, কারতারপুর করিডোর খুলে দেয়ার পর যদি শারদার জন্য একটি করিডোর খুলে দেয়া হতো, তাহলে কেমন হতো?

প্রশ্ন করলাম, এর মানে কী? রাষ্ট্রদূত বললেন, শারদা হিন্দুদের জন্য একটি পবিত্র স্থান। আল বিরুনির ‘কিতাবুল হিন্দ’ গ্রন্থে শারদায় হিন্দুদের একটি মন্দিরের কথা উল্লেখ রয়েছে। যদি অধিকৃত কাশ্মিরের পথ হয়ে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের জন্য শারদা আসা-যাওয়া সম্ভব করে দেয়া হয়, তাহলে পাক-ভারত উত্তেজনা কমে আসতে পারে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কারতারপুর করিডোর এবং শারদা রাস্তা খুলে দেয়ার পর কাশ্মির সমস্যার সমাধান হবে কি? রাষ্ট্রদূতের কাছে এ প্রশ্নের কোনো জবাব ছিল না। এ সময় একজন স্থানীয় ব্যক্তি কাছে এসে আমার কানে কানে বললেন, নওয়াজ শরিফ এখন কেমন আছেন? আমি জবাব দিতে না দিতেই পেছন থেকে আওয়াজ এলো, সব বিরোধী নেতাকে তো কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। কাশ্মির বিষয়ে জাতি এক হবে কিভাবে? একজন যুবক আমাকে ভারতীয় বোমার টুকরা দিয়ে বললেন, এটা আমাদের পক্ষ থেকে আপনার জন্য একটি স্মারক উপহার। এটা পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনদের অবশ্যই দেখাবেন। আর তাদের বলবেন, যখন আপনারা পরস্পর লড়াই করছেন, তখন আপনাদের কাশ্মিরের ভাই-বোন ভারতীয় বোমাবর্ষণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। ওই যুবকের হাত ধরে বললাম, ঘাবড়াবেন না। আপনি ঠিকই বলেছেন, পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা পরস্পর লড়াই করছে। কিন্তু যেদিন শত্রু আক্রমণে ভুল করে বসল, আমরা সবকিছু ভুলে আপনাদের খোঁজ নিতে এসেছি। আমরা এক হয়ে শত্রুদের মোকাবেলা করব। কেননা আপনারাই আমাদের নেতৃত্ব দেবেন, যারা শত্রুদের ওপর পাথর বর্ষণের অপেক্ষায় রয়েছেন। এ জন্য শ্রীনগরের পাথরযোদ্ধা শিশু আর শারদার সন্নিকটস্থ জোরার পাথরযোদ্ধা বৃদ্ধ ভারতের জন্য এক ভয়ঙ্কর স্বপ্নে পরিণত হয়েছেন।

(পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব)
ahmadimtiajdr@gmail.com

লেখক : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us