পাপুয়া নিউ গিনি : এ কেমন দেশ!

প্রফেসর ড. এম এ মান্নান | Jan 15, 2021 04:39 pm
পাপুয়া নিউ গিনি : এ কেমন দেশ!

পাপুয়া নিউ গিনি : এ কেমন দেশ! - ছবি : সংগৃহীত

 

আমার সাথে যখন সাক্ষাত হয় তখনো তার নামের সাথে ‘স্যার’ উপাধি যুক্ত হয়নি। তিনি হলেন, স্বাধীন পাপুয়া নিউগিনির (পিএনজি) প্রথম প্রধানমন্ত্রী স্যার মাইকেল সুমারে। দীর্ঘ ১৭ বছর দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পদে ছিলেন তিনি। অবসর নিয়েছেন তাও বেশি দিন হয়নি, ২০১৭ সালে। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। স্কুলশিক্ষক থেকে রাজনীতিবিদ হওয়া অত্যন্ত জনপ্রিয় এই লোকটি আমার সমবয়সী। আমি তখন সবেমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি শেষ করে ‘ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, লেহের অর্থনীতি বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে যোগ দিয়েছি। ১৯৭৪ সালের শেষ দিকের কথা। ইউনিভার্সিটিতে অনেকগুলো থিঙ্কট্যাংক ছিল। সেখানে অনেক বিষয়ে সেমিনার সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হতো। সুমারে প্রায়ই ওই আলোচনা শুনতে বা অংশ নিতে আসতেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা খ্যাতনামা পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বরের আগ পর্যন্ত পিএনজি ছিল অস্ট্রেলিয়ান টেরিটরি। ফলে প্রচুর পয়সা দিয়ে পণ্ডিত ব্যক্তিদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হতো। ভারতীয় ও শ্রীলঙ্কান অধ্যাপক ছিলেন। আমি বাংলাদেশী। তবে আমার রিক্রুটমেন্ট হয়েছিল আমেরিকা থেকে এবং এক্ষেত্রে আমার পিএইচডির অধ্যাপকরা যে অকল্পনীয় সহায়তা করেছিলেন তার ইতোপূর্বে আমার লেখায় উল্লেখ করেছি।

সারা বিশ্ব থেকে শিক্ষাবিদ রিক্রুট করায় ইউনিভার্সিটিতে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বেশ ভালো পরিবেশ ছিল। আমি বলব, পিএনজির বছরগুলো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল। এই দ্বীপ দেশটি আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে তিনগুণের বেশি বড়। অথচ জনসংখ্য এক কোটিরও কম (২০২০ সালের হিসাব)। দেশটি নিরক্ষ রেখার ওপর ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত। বলতে গেলে রোজই ভূমিকম্প হতো। এটাই ছিল স্বাভাবিক। বরং কোনোদিন ভূমিকম্প না হওয়াটা অস্বাভাবিক মনে হতো। বাড়িগুলো প্রধানত কাঠের তৈরি এবং মাচার ওপর নির্মিত। এমন ঘন সবুজ প্রকৃতি চোখে না দেখলে কল্পনা করা দুঃসাধ্য। দিনে প্রখর রোদ, আর রাতভর বৃষ্টি। অদ্ভুত মোহনীয় পরিবেশ।

আমি দেশটির অদ্ভুত সামাজিক ব্যবস্থা দেখেছি। শহরে ‘বার্নস ফিলিপ’-এর মতো বিশ্বখ্যাত সুপার মার্কেট। অথচ পাঁচ মাইল দূরে গেলেই মনে হবে আদিম যুগে এসে পড়েছি। মানুষ ১০ সংখ্যার ওপর গুণতে পারে না। আমি যখন যাই তখনো নরখাদক অবস্থা থেকে সেখানকার সমাজের পুরোপুরি উত্তরণ ঘটেনি। দেশটির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলবার্ট মাওরি কিকিও একসময় নরখাদক ছিলেন বলে শুনেছি। গোত্রে গোত্রে তীর-ধনুক দিয়ে লড়াই হয়। কয়েক মাস ধরে লড়াই চললেও দুই-একজনের বেশি প্রাণহানি ঘটে না। আধুনিক সভ্য মানুষের মতো ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্র ব্যবহার করতে তারা শিখেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয়রা ছাড়াও আশেপাশের অনেক মিলিনেশিয়ান ও পলিনেশিয়ান দেশ/টেরিটরি থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসত।

অধ্যাপকদের মধ্যে অনেক ভারতীয় ছিলেন। ভারতীয় অধ্যাপকরা ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। আমি ছিলাম মুসলিম। প্রতিদিন বিকেলে আড্ডা দিতে একেকজনের বাড়িতে হাজির হতাম। কখনো গানের আসর বসত। অনেক মারাঠি গান শুনেছি। সেখানে খুবই সৌহার্দ্যপূর্ণ একটি পরিবেশ ছিল। ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে ভালোবাসার বন্ধনে যে আবদ্ধ হওয়া যায় সেটা আমি ওই পরিবেশে কয়েক বছর থেকে ভালোভাবে আত্মস্থ করেছি। পারস্পরিক মেলামেশায় বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে কত অন্তরঙ্গ পরিবেশ তৈরি হতে পারে তা আমি ওখানে দেখেছি। আমার সেই সময়ের সহকর্মীদের অনেকে এখনো আমাকে টেলিফোন করে। তারা এখন সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে আছে। এমনই পরিবেশে স্যার মাইকেল সুমারের সাথে আমার পরিচয়। সাদা দিলের মানুষ বলতে যা বুঝায় তার প্রতিমূর্তি ছিলেন সুমারে। উদারতা, ভদ্রতা কাকে বলে; মানবিক গুণে কেউ কতটা গুণান্বিত হতে পারে তা আমি এই লোকটির মধ্যে দেখেছি। দুঃখের বিষয়, আমি নিজের দেশে এমন কাউকে পাইনি। সত্যিকার অর্থে বন্ধুত্ব বলতে যা বুঝায় এমন কিছু এখানে কারো সাথে গড়ে ওঠেনি। তাই বলে কারো সাথে আমার বিরোধও নেই।

সুমারের সাথে আমার প্রথম কথা হয় ইউনিভার্সিটিতে, আমার ডিপার্টমেন্টেই। তবে এর একটি প্রেক্ষাপট ছিল। আমাদের দেশে ছাত্ররা লেখাপড়া শিখে শহরমুখী হয়। কিন্তু ওদের কাছে অর্থ-সম্পদের বদলে জীবনের প্রধান লক্ষ্য হলো সামাজিক মর্যাদা অর্জন। আদি কমিউনিজম বলতে যা বোঝায় সে রকম একটি সমাজব্যবস্থা বিরাজ করছিল সেখানে। আমার দেখা জগত থেকে পিএনজির মানুষের আচরণ সম্পূর্ণ আলাদা। শিখলাম স্বার্থপরতা মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য নয়। আমি সেখানে একটি ‘এনলাইটেনড সোস্যালিজমের’ রূপ দেখতে পেলাম। আমি ক্লাসিক্যাল ইকোনমিকসের ছাত্র ছিলাম। ইসলামিক ইকোনমিকস নিয়েও লেখালেখি করেছি, যাতে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। আমি গ্রামে বড় হয়েছি। ফলে ওদের সংস্কৃতি বুঝতে আমার খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। ছাত্রদের পড়াতে গিয়ে দেখি আমার মনে হলো ওদেরকে আমার কথা বুঝাতে পারছি না। ছাত্ররা যে কম মেধাবী ছিল তা নয়, ওরা আমার কথা রিপিট করছে, অর্থনীতির তত্ত্ব খাতায় অবলিলায় লিখেও দিচ্ছে কিন্তু ভবিষ্যৎ লক্ষ্য কী জানতে চাইলে যখন তারা বলে- গ্রামে ফিরে যাবে, তখন আমি আকাশ থেকে পড়ি। বলে কী! তখনই ওই সমাজ ও ওখানকার নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস সম্পর্কে জানার কৌতূহল বেড়ে যায়। আমার স্থানীয় বাজার দেখার শখ হলো।

আমার এক স্টুডেন্টকে নিয়ে গেলাম। দেখি ওরা ১০ সংখ্যার ওপরে গুনতে পারে না। কেউ কিছু চাইলে এমনিতেই দিয়ে দিচ্ছে। আরো প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে দেখি মানুষ তখনো চকমকি পাথর ঠোকাঠুুকি করে আগুন জ্বালায়। আমার বিস্ময় ও ভাবনাগুলো নিয়ে তখন অস্ট্রেলিয়ার নামকরা পত্রিকাতে ‘পোস্ট কুরিয়ার’ লেখা শুরু করি। এতে আমার কথা ছিল এটা বাজার অর্থনীতির সমাজ নয়। পশ্চিমা শিক্ষা চাপিয়ে দিয়ে এখানে ইচ্ছাকৃতভাবে একটি সঙ্ঘাত ও সঙ্কট সৃষ্টি করা হচ্ছে। যা এখানকার আদি সামজতন্ত্রকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এখানকার মানুষ সম্পদের শেয়ার করে আনন্দ পাচ্ছে এবং সেটিই তার কাজের প্রেরণা ও প্রণোদনা। এটা বিনষ্ট করা ঠিক হচ্ছে না। একটি লোক বিদেশ থেকে এসে ওদের পক্ষে লেখালেখি করছে, ওদের সমাজব্যবস্থাকে ভালো বলছে, সেখানে পশ্চিমা অর্থনীতি বিস্তারের সমালোচনা করছে... এগুলো আমার সম্পর্কে অনেকে মধ্যে কৌতূহলের সৃষ্টি করে। আমি পলিনেশিয়ান ও মিলিনেশিয়ান অর্থনীতি নিয়েও লিখি। এ বিষয়ে আমার লেখা ইউনেস্কো থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

এই যখন অবস্থা তখন একদিন শুনতে পেলাম দেশের প্রধানমন্ত্রী মাইকেল সুমারে বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে আসছেন। তিনি এলেন। একেবারে সাদাসিধা পোশাক ও ভঙ্গিতে। তিনি আমাদের ডিপার্টমেন্টে এসে সরাসরি আমাকে বললেন, ড. মান্নান, আমি তোমাকে চিনি। তুমি তো লেখালেখি করো। আমাদের পক্ষ থেকে তুমি লেখালেখি চালিয়ে যাও। তিনি কিছুক্ষণ থেকে চলে গেলেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন ড. স্যান্ডোবার। বাংলাদেশের বুয়েটের এক শিক্ষকের সাথে তিনি একসাথে ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করেছেন। সেই সুবাদে আমার সাথেও বেশ খাতির হয়ে যায়। সুমারে চলে যাওয়ার কয়েক দিন পর স্যান্ডোবার এসে আমাকে জানালেন, আমাকে পিএনজির শিক্ষা বোর্ডের সদস্য মনোনীত করা হয়েছে। আমাকে কারিকুলাম কমিটির সদস্য করা হলো। এরপর মাইকেল সুমারের সাথে আমার বন্ধুত্ব তৈরি হয়। আমার বাসায়ও তিনি এসেছেন।

কারিকুলাম কমিটিকে আমি বুঝানোর চেষ্টা করি যে, তোমরা আর যা-ই করো পশ্চিমা অর্থনীতি মন-মগজে ঢুকিও না। ছাত্রদের এই দেশের উপযোগী শিক্ষা দাও। আমি বলেছি, পশ্চিমা অর্থনীতি শিক্ষার পেছনে ছুটে ছুটে ক্লান্ত হওয়ার চেয়ে জীবনধর্মী অর্থনীতির শিক্ষা দেয়া উচিত হবে। এই চেতনা আমাদের সমাজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

পিএনজির অধিবাসীরা মূলত প্রকৃতি পূজারি (ফোক রিলিজিয়ন)। অথচ এই সমাজে আমি পাঁচটি বছর কাটিয়েছি। সেখানে বাস করতে আমার অসুবিধা হয়নি। কারণ সবাইকে আমি যেমন মানুষ হিসেবে দেখেছি, তারাও আমাকে মানুষ হিসেবে দেখেছে। ভিন্ন ধর্মের মানুষের সাথে মিশে আমার ধর্মবিশ্বাস ছুটে যায়নি বরং আরো শক্তিশালী হয়েছে। এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে আমি শুধু ভালোবাসাই পেয়েছি। মাইকেল সুমারে আমাকে অস্ট্রেলিয়ার একটি শিক্ষা বিষয়ক সেমিনারে তার দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পাঠান। এতে বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দেন। সেখানে ভারতীয় প্রতিনিধি আমার জাতীয়তা নিয়ে কৌতূহলী ছিলেন। কারণ আমার দৈহিক গড়ন ও গাত্রবর্ণ পাপুয়াদের মতো ছিল না। ওই অঞ্চলে দুই জাতির লোক ছিল...পলিনেশিয়ান ও মিলিনেশিয়ান। পলিনেশিয়ানদের গাত্রবর্ণ কালো, আর মেলিনেশিয়ানদের সাদা। পিএনজির লোকজন পলিনেশিয়ান। আলাপ প্রসঙ্গে ওই ভারতীয় প্রতিনিধি জানতে পারলেন, আমার দেশ বাংলাদেশ। একজন বাংলাদেশী হয়ে কিভাবে পিএনজির প্রতিনিধিত্ব করছি তা ভেবে অবাক হন তিনি। পিএনজি থেকে আমি জেদ্দায় ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকে (আইডিবি) যোগদান করি। ফলে ব্যাংকের প্রোফাইলে আমালে আদি নিবাস পাপুয়া নিউগিনি বলে ধরা হয়। এতে লাভ হয় যে প্রতি বছর পাপুয়া নিউগিনি যাতায়াতের জন্য আমি প্রথম শ্রেণীর প্লেনভাড়া বা সমপরিমাণ অর্থ পেতাম। সৌদি আরব থেকে সেখানে যেতে হলে প্রায় অর্ধেক পৃথিবী ঘুরতে হতো। সেই সুবাদে আইডিবিতে ১৪ বছরের চাকরিকালে পৃথিবীর অন্তত ৫০টি দেশ ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল। তবে মাইকেল সুমারের দেশের মতো আদিম প্রাকৃতিক পরিবেশ আর একটাও দেখিনি।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা

hmct2004@yahoo

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us