ভাঁজ করা টাকা

নুসরাত রীপা | Mar 01, 2021 02:17 pm
ভাঁজ করা টাকা

ভাঁজ করা টাকা - ছবি : অন্য এক দিগন্ত

 

ময়লার ব্যাগ হাতে নিয়ে দরজা খুলে সাহিদা গলা উঁচিয়ে বলল, খালা, দরজাটা বন্ধ করে দ্যান। আমি যাচ্ছি।

বিছানায় শুয়ে টিভি দেখছিল বৈশাখী। বলল, মাত্রই তো এলে। কাজ শেষ তোমার?

হ। সব শেষ। শুধু রান্নাঘরের বারান্দা আর টাবটা ধুই নাই। একটু কাজ আছে, তাই যাইতেছি গা, কাইল আইসা ধুইয়া দিমু--- বলতে বলতে খট করে ছিটকিনি খোলার আওয়াজ ভেসে আসে। খালা, গেলাম কইলাম- সাহিদার অস্থির কণ্ঠ শোনা যায়।

কী এত তাড়া বুঝি না বাপু। দরজাটা লাগানো পর্যন্ত দাঁড়ানো যায় না- বিরক্ত কণ্ঠে বিড়বিড় করতে করতে বৈশাখী বিছানা থেকে নামে।

আজকাল গার্মেন্ট ছাড়াও নারীদের উপার্জনের অনেক পথ হয়েছে। এনজিওগুলো তো নারীদের স্বাবলম্বী করার জন্য নানা রকম প্রশিক্ষণ, অর্থায়ন, ঋণদানসহ নানান প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। নিজে উপার্জনের আনন্দ আর সেই সাথে স্বাধীনতার সুখ, আজকাল তাই গৃহকর্মী তো পাওয়াই যায় না। আর যদি বা পাওয়া যায় তাদের রীতিমতো হুজুর হুজুর করে রাখতে হয়। নানা রকম বায়নাক্কা মেটানোর পরও কথায় কথায় কাজ ছেড়ে দেয়ার হুমকি দিতে ছাড়ে না।
রনজনের সাথে বৈশাখীর বিয়ে হয়েছে সাত আট মাস হতে চলল। বাচ্চা কাচ্চা নেয়ার চিন্তা এখনো করেনি।

বৈশাখীর মাস্টার্সই শেষ হয়নি। যদিও দুইজন মাত্র মানুষ কিন্তু বাসার সব কাজ একা সামলানো বৈশাখীর পক্ষে কঠিন। স্থায়ী বুয়া রাখার চেষ্টা করেছিল। মাসে ১০ হাজার প্লাস বেতন এবং অন্যান্য চাহিদা শুনে আর রাখা সম্ভব হয়নি। রনজনের নতুন চাকরি। কতই বা বেতন। কাজের লোকের পেছনে ১০ হাজার টাকা এক মুঠোয় দিয়ে দিতে বুকে লাগে। অগত্যা ঠিকে বুয়াই ভরসা। কিন্তু বললেই কী আর মেলে। আর তাদেরও কত যে বাহানা। সপ্তাহে এক দুদিন কামাই দেয়াটা নিতান্তই মামুলি ব্যাপার। তার ওপর আজ হাতে সময় নাই তাই এটা করতে পারবে না, কাল ২০০ টাকা চাই জরুরি দরকার, কোনো কোনো দিন হাঁড়িতে বাসি খাবার, তরকারি লেগে থাকে, সেভাবেই ধুয়ে চলে যায়, বললেই তো কাজ ছাড়ার হুমকি।

তো এভাবেই গত ছয় মাসে কয়েকজনের পর সাহিদার নিয়োগ। অন্যদের সাথে খুব তফাত নেই। তবে কাজ পরিষ্কার। কিন্তু বড্ড বাচাল। শুরু করলে আর থামে না। তবু চলছে তো। বৈশাখীকে একা হাতে পড়াশোনা, ঘর সংসার সব সামলাতে হচ্ছে না, এটাই রক্ষে।

বাইরের দরজা বন্ধ করে রান্নাঘরে ঢুকল বৈশাখী। পুরো মেঝে মাটি দিয়ে লেপে গেছে এমন দেখাচ্ছে। রান্নাঘরের পাশের বারান্দাটায় গত দিনের সবজির পাতা ডগা ছড়িয়ে আছে। ওই অবস্থায় পা টিপে হেঁটে হেঁটে চুলোয় চায়ের পানি চাপিয়ে দিয়ে ঘরে এলো বৈশাখী। কাল খালাকে একটা বকা দিতে হবে। না থাকলে না থাকবে। এভাবে নোংরা করে যাওয়ার কোনো মানে হয়!

লিফট না ধরে সিঁড়ি দিয়েই নয় তলা থেকে প্রায় ছুটতে ছুটতে নিচে নেমে আসে সাহিদা। গ্যারেজের বাম পাশে ময়লার ড্রামে হাতের প্যাকেটটা ফেলে সেখানে দাঁড়িয়েই শাড়িটা একটু ঝেড়েঝুড়ে পরতে পরতে আড় চোখে দারোয়ান কাদেরালীকে দেখে।

কাদেরালী গেটের পাশে রাখা চেয়ারটায় হাত পা মুড়ে বসে ঝিমোচ্ছে। দিনের এই সময়টায় সবাই যার যার গন্তব্যে বেরিয়ে যায়। কাদেরালীর গেট খোলা লাগানোর ঝামেলাটা এ সময় থাকে না। সে বসে বসে ঝিমোয়। আর প্রায়ই কোনো না কোনো অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কিছু না কিছু নাস্তা পাঠায়, কাদেরালী বসে বসে সেগুলো খায়।
আজ এখনো কোনো বাসা থেকে কিছু আসেনি। কাদেরালী তাই বেকার বসে বসে ঝিমোচ্ছে।
সাহিদার শাড়িখানা ঝেড়েঝুড়ে পরার মূল উদ্দেশ্য হলো কাদেরালীকে বোঝানো যে সে খালি হাতেই এ বাসা থেকে বের হয়েছে। কিছু চুরি টুরি করেনি। আগামীকাল থেকে সাহিদা আর এ বাসায় আসবে না। গেল মাসের বেতন তো গতকাল পেয়েই গেছে। কাজেই এ বাসার কাজে না এলে তার কোনো ক্ষতি হবে না।
কিন্তু কাদেরালীকে চোখ বুঁজে থাকতে দেখে সাহিদা বোঝে তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি। সে দ্বিতীয়বার শাড়িটা নতুন করে পরতে পরতে কাদেরালীকে ডাক দেয়, ওই কাদের বাই। গুমাও নি!

কাদেরালী চোখ বুঁজেই বলে, কী কইবে কও।

বাড়ি টাড়ি যাইবা কবে?

ঠিক নাই।
সাহিদার শাড়ি পরা হয়ে যায়। কাদেরালী চোখ বুঁজেই থাকে। সাহিদা মনে মনে বিরক্ত হয়। কৌশলে বুকের ভাঁজে রাখা টাকাগুলো একবার দেখে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে।

এ সময় আর একটা বাসায় ঘর মোছা আর কাপড় কাচার কাজ করে সাহিদা। কিন্তু এখুনি সে ওই বাসায় যাবে না। প্রথমে বস্তিতে যাবে। নিজের ঘরে।

অস্থির পায়ে বস্তির দিকে হাঁটতে হাঁটতে ব্লাউজের ভেতর লুকিয়ে রাখা টাকার চেহারাটা ভাবতে থাকে সাহিদা। ভাঁজ করা টাকাটা বেশ পুরু! আট-দশটার কম হবে না। ভাগ্য যে কখন কোনদিক দিয়ে খুলে যায় কেউ বলতে পারে না।
রোজকার মতো কাপড় কাচা আর রান্না ঘরের কাটাকুটি শেষ করে ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিল সাহিদা। দুইজন মানুষের বাসা হলে কী হবে! ঘর অনেক গুলো। স্বামী-স্ত্রীতে যে রুমে থাকে সেটি ছাড়াও আরো দুটো বেডরুম আছে। সাহিদা নিজের পছন্দমতো এক একদিন এক একটা ঘরে আগে ঝাড়ু দেয়। গত দুই মাসেই জানা হয়ে গেছে বাড়ির কর্ত্রী বৈশাখী ভীষণ রকম অলস। সাহিদাকে দরজা খুলে দিয়েই সে বিছানায় শুয়ে টিভি দেখতে নয়তো মোবাইল টেপাটেপি করতে লেগে যায়! সাহিদা বাসায় ঢুকে প্রথমে দুই কাপ চা বানায়। একটা নিজের একটা বৈশাখীর জন্য। বৈশাখী শুধু চা-ই খায়। সাহিদা কেবিনেট থেকে বয়াম বের করে নিজের পছন্দমতো বিস্কিট বা চানাচুর কী নিমকি নিয়ে নেয়। কোনো কোনোদিন মোড়ের দোকান থেকে ১২ টাকা দিয়ে দুটো পরটা কিনে নিয়ে আসে। পরে চা দিয়ে খায়!
বৈশাখী সাহিদার কাজের সময় সামনে থাকে না। কেবল কাটাবাছার জন্য প্রয়োজনীয় মাছ গোশত বা তরিতরকারী নামিয়ে দিয়ে যায়। ব্যস।

সাহিদা নিজের মতো ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিল। ড্রইং রুম ঝাড়ু দিয়ে গেস্ট রুমে ঢুকতেই ওর চোখে পড়ে বিছানার কোণে একটা ভ্যানিটিব্যাগ রাখা। ব্যাগটির সব চেন খোলা। এবং ডানদিকের একটা পকেট থেকে সবুজ রঙের কাগজ উঁকি দিচ্ছে।

সবুজ রঙের কাগজ একটা নয়, বেশ পুরু তার আকৃতি। সেদিকে চোখ পড়তেই সাহিদার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করতে শুরু করে।

অনেকদিন হয় বাচ্চাগুলো গরুর গোশত খাওয়ার বায়না করছে। যে বিছানাটায় তারা স্বামী-স্ত্রীতে তাদের তিন সন্তান নিয়ে রাত্রিযাপন করে, সস্তার খাট, একটা পা ভাঙা আজ বছর গড়াতে চলল। রাস্তা মেরামতের জন্য রাখা ইট চুরি করে এনে সেগুলো একটার ওপর একটা সাজিয়ে পায়ের কাজ সারা হচ্ছে। কিন্তু বাচ্চা-কাচ্চা একটু লাফালাফি করলেই সেই পা ধসে যায় যখন তখন! সাহিদার স্বামী চোখে কম দেখে। ডাক্তার বলেছে, তার চোখের চিকিৎসা করাতে অনেক টাকা প্রয়োজন। তারপরও ভালো হবে কী না ঠিক নেই। তাগড়া জোয়ান লোকটা চোখের সামনে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সে ব্রিজের নিচে পত্রিকা নিয়ে বসে। লোকজন দুই-চারটে যা কেনে ওই লাভ। কয়দিন বাদে ঐটুকু আয়ও সে করতে পারবে না। স্বামী এখনো যেটুকু দেখে আবছা আবছা সাহিদার তাতেই বড় সখ স্বামীকে নিয়ে একদিন সিনেমা দেখবে। এই জীবনে দারিদ্র্য তো তার কোনো সখই পূরণ হতে দেয়নি। জন্ম থেকেই অভাব আর অভাব।

ভাঁজ করা টাকাগুলো দেখে সাহিদার মনের মধ্যে নানান কথা উঁকি দিতে থাকে। চুরি করা পাপ না পুণ্য এটা তার মাথায় বা ভাবনায় আসে না। ভাবনাজুড়ে কেবল একটা কথাই ঘুরতে থাকে এরকম কয়েকটা নোট পেলে কয়েকটা খায়েশ পূরণ হয় তার।

দুই-দুবার হাত বাড়িয়েও সরে আসে সাহিদা। সাহস পায় না ব্যাগের পকেটে উঁকি দিয়ে থাকা অল্প স্বল্প টাকা কয়টায় হাত দিতে।

সাহিদা বুকের ভেতর ঢাকের বাদ্যি নিয়ে সবগুলো ঘর ঝাড়ু দিয়ে ফেলে। তারপর মুছেও ফেলে ঘরগুলো, কী একটা ঘোরের ভেতর।

কিন্তু অসংখ্য চাহিদার পোকা মস্তিষ্কে কিলবিল করতে থাকলে একসময় লোভের জয় হয়। কাঁপা কাঁপা হাতে টাকা কটা ব্যাগের পকেট থেকে একটানে তুলে ব্লাউজের ভেতর চালান করে দেয়ার পর সাহিদার মনে হতে থাকে ওর হাত পা বুঝি ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।

লোকের বাড়ি থেকে আলুটা, পেঁয়াজটা বা দুচার টুকরো মাছ সরিয়ে ফেলাটা সাহিদার জীবনে নতুন কিছু নয়। নতুন হলো এই প্রথম টাকা তুলে নেয়া। আর তাই টাকাটা তুলে নেয়ার পর ওই বাসায় মুহূর্তকালও থাকতে ওর ভয় করতে থাকে। ধরা পড়ার ভয়। যদি ধরা পড়ে যায়। টাকা পয়সার ব্যাপার বলে কথা, যদি মারধর করে বা থানায় দিয়ে দেয়। এসব ভয়ে একবার ভাবে টাকাটা জায়গামতো রেখে দেবে কিনা। কিন্তু গেস্ট রুমে যেতে হলে বৈশাখীর সামনে দিয়ে যেতে হবে। ঘর ঝাড়-মোছ শেষ। বৈশাখী যদি জিজ্ঞেস করে ঐ রুমে সাহিদা আবার কেন গেছে?
এসব নানা আবোলতাবোল চিন্তায় অস্থির হয়ে কাজ অসমাপ্ত রেখেই চলে এসেছে সাহিদা। ভাঁজ করা পুরু সবুজ রঙা চকচকে নোটের ছবি সাহিদার চোখের সামনে ভেসে ওঠে আবার।

বস্তি এখন খালি খালি। প্রায় সব ঘরের নারী পুরুষই কাজে গেছে। দুয়েকটা ঘরে যদি বা দুয়েকজন আছে তারা নিজেদের রান্নাবান্না নয়তো চিলতে রোদে পিঠ পেতে গল্পগুজবে ব্যস্ত। বাচ্চাগুলোকে সকালে ভাত-রুটি ভাগাভাগি করে খাইয়ে কাজে বেরিয়েছিল সাহিদা। ওরা কেউ ঘরে নেই। নিশ্চয়ই সমবয়সীদের সাথে খেলতে বেরিয়েছে। দরজার শেকল খুলে ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেয় সাহিদা। বিছানায় বসে বুকের কাছ থেকে সবুজ পুরুষ্টু ভাঁজের নোটটা বের করে আনে। অকারণেই একবার চারপাশে চোখ বোলায়। বন্ধ ঘর। টিনের ছিদ্র দিয়ে গোলাকার রোদ মেঝের ওপর সোনার মার্বেলের মতো ছড়িয়ে আছে। একটা দুটো তিনটে---। ঘরের বাইরে নারকেল গাছের পাতা বাতাসে দোল খেলে সেই রোদের গোলকগুলো জলের মতো ভেসে ওঠে। সেদিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হাতের টাকার ভাঁজ খোলে সাহিদা। সাতাশটা নোট। মানে সাড়ে চৌদ্দ হাজার টাকা!

বিনাপরিশ্রমে এতগুলো টাকা! সাহিদার খুশিতে নাচতে ইচ্ছা করে। সে দুটো পাঁচশ টাকার নোট আলাদা করে সরিয়ে রাখে। আজ রাতে গরুর গোশত রানবে। বাকি টাকাটা একটা পুরানা ন্যাকড়ায় জড়িয়ে ঘরের কোণে খুঁটির গায়ে গুঁজে রাখে। এ রকম অনেক কটা ন্যাকড়াই ঘরের এদিক-সেদিক ছড়ানো আছে। কেউ ফিরেও তাকায় না।

টাকাটা রেখে সাহিদা নিশ্চিন্ত মনে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। উত্তেজনায় ও খেয়াল করেনি খুঁটির পেছনের টিনটুকু বহু আগেই মরচে পড়ে গেছে। টাকা প্যাঁচানো ন্যাকড়াটা গোঁজার সময় টিনের ওই অংশটুকু ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছিল ঘরের পেছনেই পচা ডোবাটার থকথকে কাদা আর ময়লা আর্বজনার ওপর।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us