বিদ্যুৎকন্যা

রাহেনুর ইসলাম | Mar 07, 2021 02:48 pm
বিউটি রানী

বিউটি রানী - ছবি সংগৃহীত

 

বিউটি রানী। একজন তীরন্দাজ। কুন্দপুকুরের এক মেয়ে। ভারতের শিলং ও গুয়াহাটিতে সাউথ এশিয়ান গেমসের আসর বসেছিল ২০১৬ সালে। বিউটি সেখানে রূপার পদক জিতেছিলেন। খুশিতে আটখানা হয়েছিল কুন্দপুকুর। স্থানীয় চেম্বার অব কমার্স সংবর্ধনা দিতে চাইল। কিন্তু ফোনে পাওয়া যাচ্ছিল না তাকে। খবর পাওয়া গেল বিউটির ফোনে চার্জ নেই। কেন নেই? অনুসন্ধানী দল বার্তা পাঠাল, বিউটিদের বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎ তো পুরো কুন্দপুকুরেই নেই। বিউটির আর কী দোষ!

অবশেষে বিউটি যখন সংবর্ধনা মঞ্চে পৌঁছলেন তখন অনেকটা সময় গড়িয়ে গেছে। একপর্যায়ে বিউটিকে কিছু বলতে বলা হলো। তিনি বললেন, ‘সবাই বলে আমি গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেছি। কিন্তু প্রত্যন্ত এই গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। সন্ধ্যার পর অন্ধকারে ডুবে যায় পুরো গ্রাম। সম্ভব হলে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করবেন।’

উপস্থিত কর্তাব্যক্তিরা ব্যাপারটি গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন বললেন। বিউটি অবশ্য ধরে নিয়েছিলেন আর দশটা প্রতিশ্রুতি যেমন বাতাসে উড়ে যায়, এটিও তেমনই হবে। কিন্তু কিছুদিন পরই বিউটির বাবা দীপু রামের মোবাইল সেট বেজে ওঠে। পল্লী বিদ্যুতের কর্মীরা বলেন, ‘দাদা, আপনার মেয়ের চাওয়ায় বিদ্যুৎ যাচ্ছে কুন্দপুকুরে, বাড়িতে আসেন।’
দীপু রাম একজন দরজি। নীলফামারী টাউন ক্লাবের উল্টো দিকে তার ছোট্ট দোকান। খবর শুনে চোখ পানিতে ভরে যায় তার। কুন্দপুকুর শাহপাড়ার পাঁচ বাড়ির মধ্যে সবার আগে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয় বিউটিদের বাড়িতে। এরপর ধীরে ধীরে পায় গ্রামের ২৬ বাড়ির সবাই। গাঁ আলোয় ভরলে বিউটির খুশিতে কান্না পেয়েছিল। বলেছেন, ‘গ্রামের সবাই খেটে খাওয়া মানুষ। বিদ্যুৎ সংযোগ আনতে যে টাকা জমা দিতে হয়, সেটা সংগ্রহ করা আমাদের জন্য অসম্ভব ছিল। আমার চাওয়াতে যে সত্যি সত্যি বিদ্যুৎ আসবে ভাবিওনি।’

সেই থেকে কুন্দপুকুর বিউটির গ্রাম। তাকে লোকে ডাকে বিজলি বিটিয়া বা বিদ্যুৎকন্যা। এখন কুন্দপুকুর জেগে থাকে অনেক রাত অবধি। দূরে গিয়ে সদাই কিনে আনতে হয় না। স্থানীয়ভাবেই গড়ে উঠেছে কিছু দোকান। মুরগির খামার করার কথাও ভাবছেন সুধাংশু রায় নামের একজন। বললেন, ‘বিউটি মেয়েটা আরো সফল হোক, এই আশীর্বাদ করি। ওর জন্য বিদ্যুৎ পেয়েছি। মুরগির খামার করার পুঁজি জোগাচ্ছি এখন।’

স্কুলে ভলিবল, হ্যান্ডবল, ফুটবল খেলতেন বিউটি। ২০০৭ সালে নীলফামারী জেলা স্টেডিয়ামে নতুন প্রতিভার খোঁজে অ্যার্চারি ফেডারেশন থেকে পাঠানো হয় ভারতীয় এক কোচকে। বিউটির স্কুলের গেমস টিচার ভুবন মোহন তরফদার জোর করেই নিয়ে যান বিউটিকে। সাত দিনের সেই ক্যাম্পে শুরুটা রাবার টেনে। হাত ব্যথা হয়ে যাওয়ায় একদিন পালাতেও চেয়েছিলেন বিউটি। ভুবন মোহন ধমক দিয়ে ও বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফেরান। এরপর ধরিয়ে দেয়া হয় বাঁশের ধনুক! অ্যার্চারির হাতেখড়ি সেটা দিয়েই। শেষ দিন ১৫ মিটার দূরত্বের টুর্নামেন্টে ভালো করায় ডাক পড়ে ঢাকায়।

পাড়া-প্রতিবেশীদের কেউ কেউ সাহস জুগিয়েছেন। ‘ত্যাড়াব্যাঁকা’ কথাও শুনিয়েছেন অনেকে। কমলাপুর স্টেডিয়ামে কোচ নিশীথ দাসের অধীনে শুরু হয় অনুশীলন। একটি টুর্নামেন্টে চতুর্থও হন। সেরা সেই চারজনকে ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় অ্যার্চারি ফেডারেশন। এরপর দিন দিন তিনি হয়ে ওঠেন জাতীয় দলের নিয়মিত খেলোয়াড়।
২০১৭ সালে আইএসএসএফ ইন্টারন্যাশনাল সলিডারিটি ওয়ার্ল্ড অ্যার্চারির প্রথম আসরে জোড়া সোনা জিতেছিলেন বিউটি। একটি দলগত, আরেকটি মিশ্র রিকার্ভে। শিলং গেমসের সাফল্য ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন সেবার। এরপর গত বছর কাঠমান্ডু গেমসে জিতেছিলেন সোনা। মেয়েদের রিকার্ভে (নিচের দিকে বাঁকানো) দলগত ইভেন্টে ছিল এই সাফল্য। দেশে ফিরে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপেও ছড়িয়েছেন আলো। রিকার্ভের নারী এককে জিতেছেন সোনা, যা এই ইভেন্টে তার টানা পঞ্চম।

বাবা দীপু রাম রায় আর দুই ভাই সুবাস চন্দ্র ও নারায়ণ রায় মিলে চালান ছোট্ট দরজি দোকান। তাতে টেনেটুনে চলে যায় খাওয়া-পরার খরচ। অ্যার্চারির সাফল্যে বিউটি সরকারের তরফ থেকে দুইবারে আড়াই লাখ টাকা পান। সেই টাকায় তুলেছেন দু’টি আধাপাকা ঘর। ভাতাভিত্তিক চুক্তিতে বিউটি ছয় বছর চাকরি করেছেন বাংলাদেশ আনসারে। কিন্তু চাকরি স্থায়ী হয়নি। বাধ্য হয়ে আনসার ছেড়ে নাম লিখিয়েছেন তীরন্দাজ সংসদ ক্লাবে। সেখানে শুরুতে যা ভাতা পেতেন সেটা দিয়ে চলে যেত টেনেটুনে। করোনা মহামারীতে এখন বন্ধ সেই বেতনও! করোনার সময়ে ক্লাব অন্য খেলোয়াড়দের মতো তাকেও ছেড়ে দেয়। অ্যার্চারি ফেডারেশন অবশ্য কিছু সহায়তা দিয়েছে। সাহায্য করেছিল যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ও। তবে পরিমাণে খুব বেশি নয়। সেই মার্চের পর থেকে এখন আট মাস হতে চলল। ওই সহযোগিতায় কতটা চলে। দীপু রাম বললেন, ‘মাঝে মধ্যে মনে হয় বিউটির জেতা সোনা-রূপার পদকগুলো ফেলে দিই। এগুলো দেখলে কষ্ট বাড়ে আরো। বিউটির সাথে খেলে কয়েকজন সংসার চালিয়েছেন বাড়ির হাঁস-মুরগি বিক্রি করে। আমাদেরও তো প্রায় একই অবস্থা।’

বাংলাদেশ অলিম্পিক ফেডারেশনের কোষাধ্যক্ষ ও অ্যার্চারি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রাজিব উদ্দিন চপলের কাছ থেকে জানা গেল করোনা মহামারীতে বিউটির মতো অন্য অ্যার্চারদের জীবন সংগ্রামের পুরো ছবিটা, ‘আমাদের দেশে অ্যার্চারির ২৬টি ক্লাব। খেলোয়াড়দের বছরজুড়ে বেতন দেয়ার সামর্থ্য ওদের নেই। ক্লাবগুলো যারা চালান করোনায় সবারই ব্যবসায় মন্দা। খেলোয়াড়দের না ছেড়ে উপায় কী? এ সময়ে খেলোয়াড়রা কষ্ট করেছেন, এটা সত্যি। আমরা চেষ্টা করেছি নানাভাবে তাদের সহায়তা করতে। বিভিন্ন সার্ভিসেস দলে তাদের চাকরির চেষ্টাও করছি আমরা। স্থায়ী চাকরি পেয়ে গেলে অ্যার্চারিতে আরো মনোযোগ দিয়ে অনুশীলন করতে পারবেন সবাই।’


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us