মেরাজের রজনী : গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য

উম্মেহানি বিনতে আবদুর রহমান | Mar 08, 2021 02:58 pm
মেরাজের রজনী : গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য

মেরাজের রজনী : গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য - ছবি সংগৃহীত

 

নিস্তব্ধ এক রাত, বিশাল আকাশের বুকে মিটি মিটি তারার আলো। গোটা পৃথিবী যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ঠিক এমন এক মুহূর্তে হাবিবে রাসূল সা: নিজ ঘরে কিংবা কাবা শরিফে শুয়েছিলেন, তিনি দেখলেন জিবরাইল আ: ওপর থেকে তাঁর দিকেই আসছেন। সে শোকের বছরের ত্রিমুখী অভিজ্ঞতায় নবী সা:-এর হৃদয় ছিল দুঃখভারাক্রান্ত। বাবা-মা এবং দাদার পর যিনি অভিভাবকের শীতল ছায়ায় আবৃত করে রেখেছিলেন সেই চাচার মৃত্যুতে রাসূল সা: যখন ছিলেন বেদনার চরম এক অবস্থায়, ঠিক সে সময়েই প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা রা:-এর পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার অপূরণীয় বেদনা তাঁর অন্তরে দুঃখের ক্ষত বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে তায়েফের হৃদয়বিদারক ঘটনাটি তাঁকে বেদনাহত করে তুলছিল। একের পর এক কঠিন পরীক্ষার পর রাসূল সা:-এর জন্য আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা সান্ত¡না ও উপহার স্বরূপ এমন একটি বিস্ময়কর যাত্রার অভিজ্ঞতা রেখেছিলেন যা মানব ইতিহাসে দ্বিতীয় কারো পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি।

মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনের দু’টি সূরায় মেরাজ নিয়ে আলোচনা করেছেন। একটি সূরা ‘ইসরা’, অপরটি হলো সূরা ‘নাজম’। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত রয়েছে, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতের বেলা ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছিলাম যেন আমি তাকে আমার নিদর্শনাবলি দেখাতে পারি। নিশ্চয়ই তিনি অধিক শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ (১৭:১)

মেরাজের প্রস্তুতি : হজরত মালিক ইবনে সাসা রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেন, ‘একসময় আমি কাবা ঘরের হাতিমের অংশে ছিলাম, আবার অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে (রাসূল সা: বলেন) হিজরে শুয়েছিলাম। ফেরেশতা আমার কাছে এলেন এবং আমার হলকুমের নিচ থেকে নাভি পর্যন্ত চিরে ফেললেন। তারপর আগন্তুক আমার হৃৎপিণ্ড বের করলেন। এরপর আমার কাছে একটি সোনার পাত্র আনা হলো যা ঈমানে পরিপূর্ণ ছিল। তারপর আমার হৃৎপিণ্ডটি ধৌত করা হলো এবং ঈমান দ্বারা পরিপূর্ণ করে যথাস্থানে আবার রেখে দেয়া হলো।’ (বুখারি) উলামায়ে কেরামের বর্ণনানুসারে আগের মতো আবারো রাসূল সা:-এর হৃৎপিণ্ড জমজমের পানি অথবা ঈমান দিয়ে ধুয়ে ফেলার কারণ ছিলÑ হাবিবে রাসূল সা:-এর মনটাকে শক্ত করা, কারণ তিনি আল্লাহর সৃষ্টির এমন সব নিদর্শন দেখতে যাচ্ছিলেন যার ক্ষুদ্রাংশ দেখলেও একজন মানুষ নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারে।

আসমানি যাত্রা : ‘ইসরা’ ধাতু থেকে ‘আসরা’ শব্দটি উৎসারিত। এর আভিধানিক অর্থ- ‘রাতে নিয়ে যাওয়া’ ইসরা শব্দের আভিধানিক অর্থ রাতে ভ্রমণ। আর সফরটি রাতের একাংশে সম্পাদিত হয়েছে বিধায় ঘটনাকে ইসরা বলা হয়। ‘উরজুন’ ধাতু থেকে মেরাজ শব্দ উদগত হয়েছে, এর শাব্দিক অর্থ সিঁড়ি।

আল্লামা ইবনে কাসির রহ: ঘটনার বর্ণনা এভাবে করেন, রাসূল সা: এসে হাতিমে কাবায় ঘুমিয়ে যান, জিবরাইল ও মিকাইল আ: পুনরায় রাসূল সা:কে জাগিয়ে দেন এবং ‘জমজম’ কূপের পাশে তাঁকে নিয়ে আসেন। সেখানে রাসূল সা:-এর বক্ষ বিদারণ করে পবিত্র জমজমের পানি দিয়ে তাঁর বক্ষ মোবারক ধৌত করেন। অতঃপর একটি আরোহণের জন্য বোরাক নামক এক প্রাণী আনা হয়। রাসূল সা: সে বাহনে আরোহণ করেন। বোরাক বাতাসের গতিতে চলছে, যাত্রাপথে রাসূল সা: ইয়াসরিব নগরীতে উপস্থিত হন। জিবরাইল আ: রাসূল সা:কে পরিচয় করিয়ে দেন এটা ‘ইয়াসরিব’ উপত্যকা, আপনার হিজরতের স্থান। রাসূল সা: সেখানে অবতরণ করে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। বোরাক চলতে থাকে অনেক দ্রুতগতিতে এবং ‘তুর’ পর্বতের পাদদেশে সানাই প্রান্তরে উপস্থিত হয়। জিবরাইল রাসূল সা:কে পরিচয় করিয়ে দেন এটা তুর পর্বত। এখানে আল্লাহ পাক হজরত মুসা আ:-এর সাথে কথা বলেছিলেন, এখানেই মুসা আ: নবুওয়াত লাভ করেছিলেন। রাসূল সা: সেখানে অবতরণ করে দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। এভাবে বোরাক চলতে থাকে ক্রমেই ঈসা আ:-এর জন্মস্থান ‘বায়তু লাহাম’ ফিলিস্তিনে উপস্থিত হন।

তখন তিনি সেখানে দুই রাকাত নামাজ পড়েন। এভাবে বিভিন্ন পয়গম্বরের স্মৃতিবিজড়িত স্থান অতিক্রম করে ‘বায়তুল মোকাদ্দাসে’ পৌঁছেন। বায়তুল মোকাদ্দাসে পৌঁছে পূর্ববর্তী সব নবী-রাসূলকে নিয়ে মসজিদে দুই রাকাত নামাজ পড়েন এবং তিনি নামাজের ইমামতি করেন। বায়তুল মোকদ্দাসে ইমামতির পর জিবরাইল আ:-এর সাথে ঊর্ধ্বাকাশে যাত্রা করলেন। মুহূর্তের মধ্যেই প্রথম আসমানের প্রবেশদ্বারে এসে উপস্থিত হন। সেখানে প্রথম নবী হজরত আদম আ:-এর সাথে সালাম-কুশল বিনিময় করেন। এভাবে সাত আসমানে অবস্থানকারী অন্যান্য নবী-রাসূলের সাথে সাক্ষাৎ করে সালাম বিনিময় করেন। এ সময় প্রত্যেক নবীই বিশ্বনবী সা:কে অভ্যর্থনা জানান।

সপ্তম আকাশের পর রাসূল সা: ‘সিদরাদুল মুনতাহা’ পর্যন্ত পৌঁছেন। তখন রাসূলে আকরাম সা: এমন ঊর্ধ্বে গমন করেন যে, ‘লাওহে মাহফুজে’ কলম চালনার আওয়াজ শুনতে পান। তখন জিবরাইল আ: বলেন, ‘আমার যাত্রাপথ এখানেই শেষ, এরপর আপনার সঙ্গ দেয়ার সাধ্য আর আমার নেই। অতঃপর রাসূল সা: আল্লাহর এত কাছে চলে যান যে, আল্লøাহ পাক তাঁর বন্ধুকে নিবিড় সান্নিধ্য দান করেন এবং এখানেই আল্লাহর দিদার লাভ করেন। একটি পর্দার আড়াল টেনে আল্লাহ তাঁর আত্মরূপ দর্শন করান তাঁর হাবিব মুহাম্মাদ সা:কে, সেখানে বিশ্ব নবীকে মহান আল্লাহপাক আপ্যায়ন করান। সেখানেই রাসূল সা: মহান রাব্বুল আলামিনের সাথে একান্ত আলাপের সৌভাগ্য লাভ করেন। এখান থেকে ৫০ ওয়াক্ত নামাজের পরিবর্তে উম্মতে মুহাম্মদির জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ উপহার নিয়ে আসেন। (সূত্র : ‘সিরাতে মোস্তফা’ ইদ্রিস কান্দলবি রহ.)

আল্লøাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘তাঁর দৃষ্টিভ্রম হয়নি এবং তিনি সীমা লঙ্ঘনও করেননি। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর পালনকর্তার মহান নিদর্শনাবলি অবলোকন করেছেন।’ (সূরা আন-নাজম : ১৭-১৮)

আসমানি যাত্রায় প্রাপ্ত সান্ত¡না ও অনুপ্রেরণা : রাসূল সা: তাঁর জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর অধ্যায় পার করার পর আসমানি যাত্রায় এমন সব নবীদের সাক্ষাত লাভ করলেন যাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সমস্যার মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলেন। প্রথমেই তাঁর দেখা হলো আদম আ:-এর সাথে, যাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল জান্নাতে বাস করার জন্য, কিন্তু আদম আ:কে জান্নাত থেকে চলে যেতে হয়। সেই প্রস্থান চিরস্থায়ী ছিল না, রব্বে কারিমের অনুগ্রহে আবার তিনি জান্নাতে ফিরে গিয়েছিলেন।

হজরত ঈসা আ: এবং ইয়াহিয়া আ:কে তাদের নবী জীবনের এক পর্যায়ে নিজেদের মানুষরাই হত্যা করতে চেয়েছিল, নিঃসন্দেহে এ পরিস্থিতি তাঁদের জন্য ছিল অনেক দুশ্চিন্তার।

একইভাবে হজরত ইউসুফ আ: যাকে আপন ভাইয়েরাই হত্যা করতে চেয়েছিল অতঃপর আল্লাহ তায়ালা সুনিপুণ কৌশলে তাঁকে রক্ষা করেছিলেন।

উপরিউক্ত ঘটনা যে সব নবীদের সাথে ঘটেছিল তাঁদের প্রত্যেকের সাথে বাস্তবিক সাক্ষাত লাভের অভিজ্ঞতায় রাসূল সা: সান্ত¡না এবং প্রেরণা পেয়েছিলেন।

লেখিকা : শিক্ষার্থী, আল কুরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us