সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ : সাংস্কৃতিক, স্বাতন্ত্র্য ও শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্ন

সরদার আবদুর রহমান | Mar 18, 2021 02:14 pm
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ - ছবি সংগৃহীত

 

ভারতের প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে শুধু সফল কথাশিল্পী বা লেখক বিবেচনা করা সঠিক হবে না। তিনি তার চিন্তাধারায় প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রটিকে বিশেষ স্থান দিয়েছেন। লেখক ও শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নেও তিনি নিজস্ব চিন্তাভাবনা তুলে ধরেছেন যা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।
বলাবাহুল্য, আজকাল একশ্রেণীর সঙ্কীর্ণবাদী লেখক শিল্প-সাহিত্যকে ‘রাজনৈতিক আদর্শের’ নিরিখে এমনভাবে ঘিরে ফেলতে চায় যে, কোনো একজন লেখক যতই ‘মৌলিক’ হন না কেন তাকে লোকচক্ষুর আড়ালে ঠেলে দিতে চেষ্টার অন্ত রাখেন না। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ একজন মৌলিক লেখক, আবার সেই সঙ্কীর্ণতার বৃত্তেও বন্দী নন।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ১৯৩০ সালের ১৪ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার খোশবাসপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুবরণ করেন ২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর, কলকাতায়। দাফন করা হয় জন্মগ্রামে। প্রথম জীবনে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। কিশোর বয়সে রাঢ় বাংলার লোকনাট্য দল ‘আলকাপের’ সাথে যুক্ত হয়ে নাচ-গান-অভিনয়ে নিমজ্জিত হন। তিনি ছিলেন দলের ‘ওস্তাদ’ বা গুরু। নিজের দল নিয়ে ঘুরেছেন সারা পশ্চিমবঙ্গ, বিহার-ঝাড়খণ্ডে। তাই পরবর্তী জীবনে কলকাতায় বাস করলেও নিজেকে কলকাতায় প্রবাসী ভাবতেই ভালোবাসতেন। সুযোগ পেলেই মুর্শিদাবাদের গ্রামে পালিয়ে যেতেন। সেই পলাতক কৈশোর তার চরিত্রের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। ঘুরতেন রাখাল বালকের মাঠে, হিজলের বিলে, ঘাসবন ও উলুখড়ের জঙ্গলে সেই মায়াময় আদিম স্যাঁতসেতে জগতে। এক্ষেত্রে কবি নজরুল ইসলামের কিশোর জীবনের সাথে তার কিছু মিল পাওয়া যায়।

তার লেখালেখি শুরু স্কুল জীবনেই। লেখকজীবনের প্রথম দিকের অপূর্ব উপন্যাস ‘প্রেমের প্রথম পাঠ’। অসংখ্য ছোটগল্পের জন্য বিশ্বসাহিত্যের দরবারে তিনি স্থায়ী আসন পেয়েছেন। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে একঝাঁক লেখক বাংলা সাহিত্যে উদিত হন। এদেরই সাথে আবির্ভাব ঘটে সিরাজের। তবে তার অভিজ্ঞতা ছিল বিপুল, তার বিচরণক্ষেত্র ছিল দ্বারকা নদীর অববাহিকায় আদিম প্রবৃত্তিতে ভরা নারীপুরুষ ও উন্মুক্ত প্রকৃতি। মুস্তাফা সিরাজ কলকাতায় পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন ষাটের দশকের শুরুতে। দীর্ঘদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে চাকরি ও লেখালেখি সমানতালে চালিয়ে গেছেন। তার জ্ঞান ও অধীত বিদ্যাগুলো তাকে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী হিসেবে বিদ্বানসমাজে প্রতিষ্ঠিত করে। ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, বিজ্ঞান, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বÑ সব বিষয়েই গভীর জ্ঞান তাকে পণ্ডিতমহলে পরিচিত করে তোলে। তার গল্প ও একাধিক গ্রন্থ ভারতের সমস্ত স্বীকৃত ভাষায় অনূদিত হয়েছে; ইংরেজিতে তো বটেই, বিশ্বের বহু ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। সবমিলিয়ে তিনি দেড় শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা।

তার লেখা ‘তৃণভূমি’ উপন্যাসে কান্দী মহকুমার এক বৃহৎ অঞ্চল ধরা আছে। ‘উত্তর জাহ্নবী’ উপন্যাসে ধরা আছে এক বিশেষ সময় ও সমাজের কথা, যা বাংলা সাহিত্যে অনাস্বাদিত। আর ‘অলীক মানুষ’ এক বিস্তৃত ভুবনের কাহিনী- যা এক মুসলিম পীর বা ধর্মগুরুর বংশজাত পুরুষের আত্মানুসন্ধান; ব্রিটিশের রাজত্বের শেষ ভাগে এক পরিবর্তনীয় সময়ের নিখুঁত স্থির ছবি। এই অলীক মানুষ তাকে ভিন্ন লেখকের মর্যাদার চূড়ান্ত শিখরে উন্নীত করে। ক্ষুদে ও কিশোর পাঠকদের দাবি মেটাতে তিনি সৃষ্টি করেন ‘গোয়েন্দা কর্নেল’ নামে এক রহস্যময় চরিত্র।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান ছিল প্রবল। সংবাদপত্রে চাকরি করলেও কোনো মালিক গোষ্ঠীর কাছে মাথা নিচু করেননি। লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকদের প্রতি ছিল তার সস্নেহ পক্ষপাত। মিডিয়ার আলো ও প্রচারের প্রতি তার আকুলতা ছিল না। আত্মসম্মানবোধ নিয়ে প্রায় একা উন্নত গ্রীবায় ছোট ফ্ল্যাটে জীবন কাটিয়ে গেছেন। মাথা উঁচু করে থাকার দর্পী মনোভাবের জন্য অনেক মনোকষ্ট পেতে হলেও কখনো দমে যাননি। তবে পাঠকের সাথে সম্পর্ক ছিল মধুর। তার ব্যবহারে ও আচরণে ছিল পরিশীলিত ভদ্রতা ও আন্তরিকতা।
‘অলীক মানুষ’ উপন্যাসটি ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্কিম পুরস্কার, ভুয়ালকা পুরস্কারে সম্মানিত। তার ‘অমর্ত্য প্রেমকথা’ বইয়ের জন্য জন্য পেয়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত নরসিংহদাস স্মৃতিপুরস্কার। এ ছাড়া ১৯৭৯ সালে পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার। এর বাইরেও বিভূতিভূষণ স্মৃতিপুরস্কার, সুশীলা দেবী বিড়লা স্মৃতিপুরস্কার, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুরস্কার, শরৎচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার ইত্যাদি আরো অনেক পুরস্কার তিনি তার সামগ্রিক সাহিত্য-কৃতিত্বের জন্য পেয়েছেন। তার অনেক কাহিনী চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে, যেমন- ‘কামনার সুখ দুঃখ’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘শঙ্খবিষ’, ‘নিশিমৃগয়া’, উত্তমকুমার অভিনীত ‘আনন্দমেলা’। এই স্কুল পালানো মানুষটিই পেয়েছিলেন সাম্মানিক ডক্টরেট।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের চিন্তাধারায় বামপন্থী চেতনা প্রবাহিত হলেও একশ্রেণির বামপন্থী মানুষের মতো ‘ধর্মবিদ্বেষী’ ছিলেন না কখনো। তার এই বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ দেখা যায় বিভিন্ন প্রবন্ধে। তিনি আপন সংস্কৃতি ও শেকড়কে কখনো অস্বীকার করেননি। বরাবরই তার লেখার কেন্দ্রে চলে এসেছে প্রান্তিক মানুষের জীবনযাপন আর ধর্মের সহজিয়া প্রবণতার কথা। যেমন একসময় আলকাপের সাথে দিন কাটানোর অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে মায়া মৃদঙ্গ উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে। আর বাংলার সুফি, পীরদের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস একাকার হয়ে যায় চতুরঙ্গ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত অলীক মানুষ উপন্যাসে। অলীক মানুষের হাত ধরেই ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে আসে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার। কিন্তু আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করলেও এই পত্রিকাটি কখনো সৈয়দ সিরাজের কোনো উপন্যাস প্রকাশ করেনি। এটি সাম্প্রদায়িক চেতনাজাত কোনো ঘটনা কি না জানা যায়নি।

১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে সালমান রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ উপন্যাস প্রকাশিত হলে দ্রুততম সময়ে ভারতে এটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। কেউ কেউ বলেন, এই উপন্যাসে কৌশলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র রাজিব গান্ধী ও তার বন্ধু চলচ্চিত্র অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনকে হেয় প্রতিপন্ন করার ফলস্বরূপ এটি নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এবিষয়ে যে সমালোচনামূলক প্রবন্ধ রচনা করেন তাতে তিনি রুশদির এই গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্য নিয়ে তাকে তুলোধুনা করেন। সম্ভবত তিনিই প্রথম বাঙালি লেখক যিনি এ প্রসঙ্গে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপনে সক্ষম হন।

লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এ সংক্রান্ত তার একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘সম্প্রতি সলমন রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ উপন্যাসটি ভারত সরকার নিষিদ্ধ করায় দেশজুড়ে গেল-গেল রব উঠেছে। শিল্প সাহিত্যের স্বাধীনতা নিয়ে এদেশে এই প্রথম এমন মুক্তকচ্ছ হইচই এবং সত্যিই এই প্রতিবাদ বেনজীর। কিছু পত্রিকা শিল্পসাহিত্যের অবাধ স্বাধীনতাকে মৌলগণতান্ত্রিক অধিকার সাব্যস্ত করে সম্পাদকীয় ফেঁদেছেন এবং এই মওকায় তথাকথিত মুসলিম মৌলবাদীদেরও একহাত নিয়েছেন। মজার কথা, খুব কম লোকই মূল বইটি পড়েছেন। বাকিদের অল্পাংশ বিদেশী পত্রিকার রিভিউ পড়ে নাচছেন। তবে এ-ও লক্ষ্য করার মতো ঘটনা, বইটির পাঠকদের মধ্যে যারা হিন্দু তার স্যাটানিক ভার্সেস উপন্যাসে দোষের কিছু দেখছেন না। কিন্তু যারা মুসলিম, তাদের কাছে এ উপন্যাস ইসলাম ধর্ম ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ কুরআন এবং পয়গম্বর-জায়াদের প্রতি অশালীন ও নিন্দাত্মক বৃত্তান্ত শুধু নয়, সমস্তটাই বিকৃত মানসিকতার পরিচায়ক। প্রসঙ্গত এ-ও উল্লেখ্য, অমুসলিমদের মধ্যে একমাত্র খুশবন্ত সিং-ই বইটির নিন্দা করেছেন।’ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বলেন, ‘এই বইয়ের কথাবস্তু (যে আঙ্গিকে পরিবেশিত হোক না কেন) একান্তভাবে ভারতীয় পাঠক ছাড়া অন্যত্র তত বোধ্য হবে না। কারণ কথাবস্তুতে যে-সব টার্ম এবং প্রসঙ্গ অহরহ প্রয়োগ করা হয়েছে তা অভারতীয়দের কাছে অপরিচিত। তবে পয়গম্বর এবং ফেরেশতা তথা ‘জাহেলিয়া’ ভূখণ্ডের সমস্ত বৃত্তান্ত শুধু মুসলিমরাই বুঝবেন। অমুসলিমদের কাছে বড়জোর এই অংশগুলো আরব্য উপন্যাসের মতো মুখরোচক মনে হবে। আবার এটুকুও আঁচ করতে পারবেন যে মুসলিমদের রুশদি খুব জব্দ করেছেন।’

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ আরো উল্লেখ করেন, ‘.... একটি বিশেষ ধর্মকে অকারণ কদর্য খিস্তিতে বিবৃত করার অভিসন্ধি নিয়েই আমার যত প্রশ্ন।’ এই নিবন্ধের উপসংহারে তিনি বলেন, ‘রুশদি ক্যামব্রিজে ইসলামোলজির ছাত্র ছিলেন। অধ্যাপনা করেছেন। তদুপরি তিনি জন্মসূত্রে মুসলিম। কাজেই তিনি ভালোই জানেন, মুসলিমরা তার পাঁচ বছর ধরে লেখা বইটি কিভাবে নেবে। একেই বলে জেনেশুনে বিষপান। শিল্পীর স্বাধীনতা অত্যন্ত বাঞ্ছিত। কিন্তু সব স্বাধীনতার মতো শিল্পী এবং শিল্পের স্বাধীনতার একটা সীমারেখা তো আছে। কোনো শিল্প যদি উদ্দেশ্যহীন রক্তপাত ঘটায়, তাকে কি শিল্প বলা যাবে? শিল্প-সাহিত্য যদি উন্নততর মানবসমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য রক্তপাতের কারণ হয়, তাকে সাদরে বরণ করব। কিন্তু রুশদির শয়তানের কাব্য একটি অভিসন্ধি প্রণোদিত অসৎ রাজনৈতিক প্ররোচণারই বিকলাঙ্গ জাতক।’ (সালমান রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস : সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট, জানুয়ারি, ১৯৮৯)।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ সাহিত্যকে কোনো বিশেষ সাংস্কৃতিক সম্প্রদায় বা গোত্রের একচেটিয়া সম্পদ হিসেবে ছেড়ে দেয়ারও পক্ষপাতি ছিলেন না। বিশেষ করে মুসলমানদের শিল্প-সাহিত্যে পশ্চাদপদতা এবং তার উপকরণ নিয়ে তিনি যথেষ্ট উদ্বেগ দেখিয়েছেন। তার লেখা একটি সম্পাদকীয়তে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে কলকাতার হরফ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘গল্প সংকলন’-এর ভূমিকা লিখেন তিনি। এতে তিনি বলেন, ‘মানুষের জীবনের সামগ্রিক বাস্তবতার মধ্যে ধর্ম এমন একটা বাস্তবতা যা কোনোভাবেই আমরা অস্বীকার করতে পারি না- তা ব্যক্তিগতভাবে যতই ধর্ম মানি বা না মানি। এখন লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে সাহিত্য, শিল্পকলা এবং সামগ্রিকভাবে সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায় তার গভীরতর উৎস হিসেবে ধর্ম জিনিসটা অবস্থান করছে। ভাষা, যা সাহিত্যর প্রধান অবলম্বন, তার মধ্যেও ধর্মের অনুরণন সব সময়েই অনিবার্য হয়ে ওঠে। কখনো প্রতীক হিসেবে কিংবা কখনো রূপক উপমা ইত্যাদি আলংকারিক বিন্যাসে ধর্মের ব্যঞ্জনা অনিবার্য হয়ে ওঠে। তাই কোনো লেখক যখন প্রকৃতপক্ষে মানুষের কথা লিখতে চেয়েই কলম ধরেন, তখন তার নিজের অগোচরে সেই মানুষের শুধু স্থানিক পরিচয় নয়, জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী-পরিবেশের পরিচিত্রণ অনিবার্যভাবে এসে যায়। তার মানে হরে-দরে সেই কথাটাই মেনে নিতে হচ্ছে যে, সাহিত্যের এমন একটা বাস্তবতা আছে যা সুনির্দিষ্টভাবে ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই গোষ্ঠীসত্তা থেকে উত্তরণেই সাহিত্যকে নিশ্চয়ই মহৎ করে তোলে বটে, কিন্তু সাহিত্যের বিশ্লেষণে ওই সব উপাদানকেও কোনোভাবে অস্বীকার করা যায় না।’

মুস্তাফা সিরাজ আরো উল্লেখ করেন, ‘বাংলা সাহিত্য হিন্দু সমাজের প্রযত্ন ও সাধনায় বিকশিত হতে পেরেছে। তাই মুসলিম লেখকদের প্রতি ক্ষেত্রবিশেষে তাদের শীতলতা বা উদাসীনতা থেকে গেছে, এটা অস্বীকার করে লাভ নেই। এর ফলে তরুণ কোনো মুসলিম লেখকের মনে হীনম্মন্যতা জেগে ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু এটাই তো তাদের একটা সংগ্রামের কারণ হওয়া উচিত। তবু সমস্যা থেকে যাবে। কারণ মুসলিম সমাজ-সংস্কৃতির যে একটা আলাদা কাঠামো আছে, সেই কাঠামোর পঙ্খানুপুঙ্খ পরিচিত্রণ হিন্দু পাঠকের কাছে অপিরিচিত মনে হতে পারে। ধরা যাক- মুসলিম জীবনভিত্তিক কোনো গল্প শৈল্পিক উৎকর্ষে উন্নীত, অথচ হিন্দু পাঠক সেই গল্পটি পড়ে মুগ্ধ হচ্ছেন না- এমনটা কি ঘটা সম্ভব? আমার তো মনে হয় শৈল্পিক ঔৎকর্ষ সাংস্কৃতিক ডিটেল্সের ব্যাপার; অপরিচিতকে পাঠকের মন ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। তবে সাংস্কৃতিক ডিটেল্স সম্পর্কে পাঠককে পরিচিত করার একটা দায়িত্ব কিন্তু লেখকেরই আছে। মুসলিম জীবনের দৈনন্দিন চিত্রে স্বাভাবিকভাবে আরবি-ফারসি-তুর্কি শব্দাবলির ব্যবহার আদব কায়দার প্রথা বা রীতি-নীতি হিন্দুদের কাছে অপরিচিত। প্রতিভাধর হিন্দু লেখকেরা হিন্দু জীবনের দৈনন্দিন ডিটেল্সকে সুদীর্ঘকাল ধরে সাহিত্যে বহুল ব্যবহার করায় মুসলিম পাঠকের কাছে তা অপরিচিত মনে হয় না।

কাজেই মুসলিম লেখকের অনুরূপ একটা দায়িত্ব থেকে গেছে। অর্থাৎ পরিমাণগত এবং গুণগতভাবে উৎকৃষ্ট সাহিত্য সৃষ্টির একটা বাড়তি দায়িত্ব মুসলিম লেখককে সব সময় মনে রাখতে হবে। অভিজ্ঞতায় দেখেছি একটা প্রতিযোগিতার মনোভাব না থাকলে চলে না। এটা আত্মসর্মপণ নয়, এটা অধিকার অর্জন।’ মুস্তাফা সিরাজ আরো বলছেন, ‘হিন্দু-সাহিত্য ও মুসলিম-সাহিত্য বলে কিছু হয় না। যা সাহিত্য তা সেরফ সাহিত্যই। কিন্তু সাহিত্যপাঠে মানুষের জীবনের এমন কতগুলো দিক ধরা পড়ে যা নির্বিশেষ নয়। রমজান মাসে রোজার শেষে সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ দেখার সময় একজন মুসলিমের মনে যে অনির্বচনীয় অনুভূতি জেগে ওঠে তা হিন্দুকে কতটুকু বোঝানো সম্ভব? পক্ষান্তরে শরৎকালে ঢাকের বাজনা শুনে একজন হিন্দুর মনে যে অনুভূতি জাগে, তাও বা মুসলিমদের কতখানি বোঝানো সম্ভব? অথচ সাহিত্য সেই চেষ্টাটাই করে থাকে। ব্যর্থতার দায়টা সাহিত্যিকের- সাহিত্যের নয়। সাহিত্যব্রতী মুসলিমের লড়াইয়ের শুরু এখান থেকেই।’

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ কি নিজেও তার সতীর্থ-সহযোদ্ধাদের কাছে উপেক্ষিত হয়েছেন? এই প্রশ্ন উঠছে, কারণ তার নিজের কর্মস্থল ও ক্ষেত্রে তাকে নিয়ে আলোচনা-আলোড়ন তেমন চোখে পড়ে না। হয়তো তাকে আড়ালেই ঠেলে দিতে চায় কেউ কেউ। যদিও তিনি মৌলিকতার কারণে সর্বভারতীয় স্বীকৃতি অর্জনে সক্ষম হয়েছেন।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us