মাহিরা

শাওন আসগর | Mar 20, 2021 01:38 pm
মাহিরা

মাহিরা - ছবি সংগৃহীত

 

মাহিরার বয়স মাত্র বারো মাস। অথচ তাকে নিয়েই গল্পটি। গল্পটি একটি দীর্ঘ উপন্যাসও হতে পারে। কারণ এটি দীর্ঘতর ঘটনার প্রবাহে আবর্তিত জীবনের এক পরিক্রমার অংশ। তো মাহিরা আমার হৃদয়ের ভেতর একটি বেদনার স্মৃতি হয়ে অনেক দিন যাবৎ আটকে ছিল বলেই আজ তাকে নিয়ে লিখছি।

সন্ধ্যা হয়েছে বেশ আগেই। ঘরের মিডল চায়ের টেবিলটি সরানো হয়েছে এক পাশে। ছোট্ট কক্ষটিতে সবার বসতে কষ্ট হবে বলে এই ব্যবস্থা। টেবিলে রাখা সিরামিক শোপিস, ছোট্ট ফ্লাওয়ার ভাস আর পিতলের রিকশাটি সরানো হয়েছে। জানালার পর্দা পুরোটাই ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে যেন বাইরের আলো আসে ঘরে। কারণ এখন ভর সন্ধ্যা মাত্র, তাতেও বিদ্যুতের লোডশেডিং চলছে বা কোথাও কোনো কাজ করছে কর্মীরা। পশ্চিম পাশের খালিস্থানে প্লাস্টিকের মোড়া এনে বসেছে দুইজন। রাস্তার ভ্যান ব্যাটারিচালিত রিকশা আর লোকজনের কণ্ঠস্বর হইচই শোনা যাচ্ছে। পথের ধারে বাসা। তাই রাত দুটো-তিনটে পর্যন্তও চলে এই বিড়ম্বনা। কখনো কখনো কোথা থেকে কয়েকটা কুকুর জড়ো হয়েও ঘেউ ঘেউ করতে থাকে একটানা। তখন বড় খালার খুব কষ্ট হয়। তিনি তার এবাদত বা ঘুম কোনোটাই ঠিকমতো করতে পারেন না।

সবাই সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। সবারই মন খারাপ, কেউ কেউ উত্তেজিত, কারো চোখে মুখে তীব্র ক্ষোভ। শাকিল মরেই গেলো করোনায়। তবু তার জন্য পরিবারের অনেকের হৃদয়েই বেদনার ছোঁয়া লাগেনি, এর কারণ শাকিলের বিয়ে-সংসার।
যখন মানুষ টেলিভিশন ফেসবুক ইউটিউব থেকে তথ্য পায় দেশের মানুষ খাবার পাচ্ছে না, ত্রাণের খাবারও লুটপাট হয়ে যাচ্ছে। আটা নেই পেঁয়াজ নেই চাল নেই তেল নেই চিনি নেই। অথচ সরকার সবই দিয়েছে পর্যাপ্ত। তবু চার দিকে শুধু নেই নেই নেই। রাজশাহীতে নেই খুলনায় নেই সিরাজগঞ্জে নেই মেহেরপুরে নেই বরিশালে নেই কুষ্টিয়ায় নেই সিলেটে নেই কুমিল্লায় নেই টাঙ্গাইলে নেই চট্টগ্রামে নেই রসুলবাগে শহীদনগর ইসলামবাগে নেই। সবখানেই গরিবের জন্য কিছু নেই। খেটে খাওয়া বিত্তহীন প্রতাপহীন অরাজনৈতিক মানুষের জন্য কিছু নেই। আছে, আছে, সবই আছে, মাছ গোশত তেল চাল সবজি আটা পেঁয়াজ ধনেপাতা মরিচ মিষ্টি কুমড়ো দুধের টিন। সব আছে সব : প্রতি জেলায় ‘তাহাদের’ ঘরে! দরিদ্ররা কোথায় যাবে, কী করবে? সরকার যা দিয়েছে তার কোনো সুষ্ঠু বণ্টন নেই। লুটেরারা সব ত্রাণ লুটে নেয়। সমাজের যেসব কাছের বা নিজেদের, তাদের নামে ত্রাণের স্লিপ পর্যন্ত গায়েব করে দিচ্ছে।

শাকিলতো সমাজের অংশই। সেতো দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করেই বড় হয়েছে, মরেও গেছে। আসলে প্রকৃতি বা ঈশ^র মানুষকে কোনো স্থায়ী সুখ এনে দেয় না, একটু অপূর্ণতা রেখেই যায়। সুখ সম্পদে নয়, সুখ প্রেম ভালোবাসায় সুসম্পর্কে। শাকিলের সেই প্রেম বা ঘর নিয়েই সব যত ঝামেলা হলো। আর এসবই আজকের এই আলোচনা সভার বিষয়বস্তু। অবস্থা প্রায় এমনই যে শাকিল মরে যাওয়াতেই অনেকের শান্তি।

শান্তিতেই তারা ছিল। তাদের খুব অর্থবিত্ত বা নামের খ্যাতি ছিল না। খুব সাধারণ মধ্যবিত্তের চেয়ে আরো একটু নিচের স্তরের জীবন নির্বাহের অধিকারী ছিল তারা। কিন্তু ওই হিন্দু মেয়েটির পাল্লায় পড়ে তাদের এখন সবই গেলো। তাদের নিঃস্ব^ হওয়ার কথা ছিল না। একটি ঠুনকো প্রেমে, তাও আবার নিজের ধর্মকর্মের বাইরে গিয়ে একটি সিম্পল হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করে বসলো পিতৃহারা শাকিল রানা। ঘটনাটি ঘর ছেড়ে যখন বাইরে গেলো, যখন অনেকেই বলাবলি করল শাকিল কাজটা একদম ভালো করেনি, এই শহরে কি মেয়ের অভাব হয়েছে যে শাকিল গার্মেন্টের কর্মী, তাও হিন্দু এবং খুব রূপসীও নয়, তাকেই বিয়ে করতে হবে। শাকিলকে পস্তাতে হবে, অত সোজা নয় জীবন, তাকে হিসাব দিতে হবে আল্লাহর কাছে। না পাবে বেহেশত, না হলো দোজখ।

এসব আলোচনার ডালপালা কেবল মহল্লাই নয় তা আরো দূরে আরো দূরে লাবণ্যর বাবা-মার ঘরেও আগুন ছড়াতে থাকে। কিন্তু প্রেম ভালোবাসা অতোসব যুক্তিতর্ক ভয়ভীতি মানে না। ওসব নিয়ে ভাবলে প্রেম হবে না, সম্পর্ক হবে না, জীবন হবে না কারো। যে ত্যাগ করতে পারল না সে প্রেমিক হয় কী করে। যে কাঁদতে পারল না সে প্রেমিক হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। যারা অপেক্ষা করতে পারল না তাদের প্রয়োজন কী ওসব ভালোবাসার! যারা সময় শরীর অর্থ বিলিয়ে দিতে পারল না তাদের প্রেমের সার্থকতা কোথায়! শাকিল এসব কথা খুব মনে রেখেছে।

সে ছেলেবেলা থেকে বাবাকে পায়নি। বিশ বছর হলো বাবা নিখোঁজ। বাবার আশা সবাই ছেড়ে দিলো। শাকিল ছাড়েনি। তার ধারণা, বাবা একদিন ফিরে আসবে। মা বাবার চিন্তায় অসুখ বাঁধিয়ে রাখলো যখন, তখন একমাত্র বড় খালার মালিবাগ বাসায় থেকেই শাকিল লেখাপড়া করে কোনোরকম ডিগ্রিটা পাস করল। সবাই যখন চাকরির জন্য হন্যে হয়ে জুতার তলা খসাচ্ছে। শাকিল তখন সহজেই একটি চাকরিও জোগাড় করে ফেলল। তাও নিজের চেষ্টায়। বারো হাজার টাকা বেতন। কম নয় তখন।

সব হোঁচট খেলো গার্মেন্টের লাবণ্যকে নিয়ে। সাধারণ মেয়ে অথচ তার কী ধার! কী কথামালা, কী তার দায়িত্ববোধ! সিফট সুপারভাইজার হওয়ার কারণে লাবণ্যকে প্রায়ই শাকিলের কাছে আসতে হয়। কাছে এলেই সম্পর্ক বাড়ে। কাছে এলে মায়ার বাঁধন হয়। কাছে এলেই তো সম্পর্কের বোধ শাণিত হয়। কাছে এলেই প্রেম হয়.. ?
হয়েছে তাই। লাবণ্যকে নিয়ে কাছাকাছি অতঃপর সংসার।

সংসার হলেই কি সবাই সুখি হয়? হয় না। শাকিলের মা ও পরিবারের অন্যসব লোকজন মানতে পারেনি। বাড়ির সবাই ছিঃছিঃ দিয়ে তাড়িয়ে দিলো ওদের। সমাজের কাছে শাকিলের ভিন্ন পরিচয়।

আর যে খালার কাছে মানুষ হলো, বড় হলো তখন খালাও আগের মতো নেই। তিনি তখন মক্কা থেকে হজ করে ফিরেছেন। খালাকেও ভয় হলো শাকিলের। কোথায় যাবে তাহলে... রসুলবাগ। পুরনো ঢাকায় ছোট্ট দুরুমের বাসা নিয়ে ঢুকে পড়ল। লাবণ্য আর তার নিজের বেতনে চলে যাবে দিনকাল। তারপর ধীরে ধীরে সবই ঠিক হয়ে যাবে। লাবণ্যকে বলা হলো, লাবণ্য একবছর কষ্ট করো সব পালটাইয়া দিমু। তোমাকে কষ্ট করতে দিমু না। এখন চাকরিটা ছাড়ার দরকার নাই। আমি ঠিকই আরেকটা পথ বার করমু। মনে রাখবা আমার বাবা ছিল না। মা ছিলেন অসুস্থ। ছোট বেলা থেকেই আমি সংগ্রামী মানুষ। আমি হারতে শিখি নাই।

ছয় মাসের মাথায় শাকিল গুলশানে একটি ভালো পোশাকের দোকানে বিশ হাজার টাকার বেতনে সেলসম্যান হিসেবে চাকরি পেলেও লোক সমাগম থাকা ও অনেক রাত পর্যন্ত কাজের চাপে এক মাসেই তাকে করোনায় পেলো। দিনে দিনে হাসপাতালে থেকে শাকিল মূলত পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। আসলে সব সময় জেতা যায় না। সব মাঠে সব পরিশ্রমেও কিছু কিছু মানুষকে পরাজয়ের সাথেই আপোস করতে হয়। তেমনি শেষ পর্যন্ত শাকিলের হলো না। হলো না সংগ্রামী যুবকটির জীবন যুদ্ধে বিজয় দেখা। লাবণ্য হলো, সন্তান হলো, মাহিরা হলো, ঘর হলো। কিন্তু করোনা এসে শাকিলকে খুব ঠকাল। তাকে কেড়ে নিলো লাবণ্যর কাছ থেকে, মাহিরার কাছ থেকে।
কোথায় যাবে লাবণ্য-মাহিরা। একজন মুসলমান ছেলের সাথে জীবনের গাঁটছড়া বাঁধার কারণে লাবণ্যকে সবকিছু হারাতে হয়েছে। বাবা-মা আত্মীয়রা কেউ তাকে গ্রহণ করেনি। সব যখন অন্ধকার ঘোর কালো, যখন তার চলার পথে ধুলো আর শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি, যখন অমসৃণ পিচ্ছিল সড়ক থেকে সে খাদে পড়ে যাওয়ার উপক্রম তখন বড় খালা ডেকে পাঠালেন তাকে।

আজ সেই আলোচনা। আজ কথা হবে মাহিরা লাবণ্যকে নিয়ে। লাবণ্য মাহিরাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। একমাত্র তার চোখেই পানি। তার চোখে স্বপ্ন ভাঙ্গা ধুলার পলেস্তারা। লাবণ্য যেন লাবণ্য নেই, তার সব লাবণ্য করোনা কেড়ে নিয়েছে। বাবা-মা, সমাজ আর ধর্মও তার সর্বনাশ করেছে।

সবাই যে কথা উচ্চারণ করছে ঝাঁঝালো ও কর্কশ ভাষায় তার সারমর্ম হলো, এই বাড়িতে লাবণ্য আর মাহিরার কোনো জায়গা হবে না। কিন্তু বড় খালা অবতার হয়ে নামলেন। তার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা সমাজজ্ঞান ধর্মজ্ঞান তাকে আরো তীক্ষè করে। তার ভেতর হজের যে আবহ এখনো রয়েছে সেখানেও কি এক প্রবল যুক্তিতর্ক ধাক্কা খায়। নতুন করে অনেক দিন পর আজ এক ঝড় বয়ে যায়। যে শাাকিল তার জন্মদাতা বাবাকে পায়নি বিশ বছর, যে অনাদরে অবহেলায় বেড়ে উঠেছে তার মতোই মাহিরাও সেই ভাগ্যবরণ করবে? মাহিরা যে বাবাকে হারালো মাত্র বারো মাসেই।

বড় খালার ভেতর টর্নেডো হয়, সুনামি হয়, লাবণ্য হিন্দু আর শাকিল মুসলমান হলেও মাহিরাকে সে কোথায় স্থান দেবে? মাহিরা কোন ধর্মের, কোন বিশ্বাসের কোন ধ্যানের...এই প্রশ্ন বার বার ঘুরপাক খেতে থাকে বড় খালার মনে। অনেক ভাবনার জট তাকে বিষণ্ন করলেও তিনি আরো কঠিন, আরো দৃঢ় হন মনে মনে। সব যুক্তিতর্ক থেকে নিজের মনকে পরিত্রাণ দেন আজ। তার মনে জাগে শুধুই দরদমাখা এক মানবিক মায়াজাল। মাহিরাকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা তাকেই করতে হবে বলে তিনি অনুভব করেন।

এক অলৌকিক ধ্যানমগ্নতায় তার মন ও মগজ পরিপূর্ণ হয়। তারপর ধীরে ধীরে একবার সবার দিকে তাকান। তার চোখে শাসকের ভাষার চেয়ে নির্ভরতা আর মানবিক ভাষা শাণিত হয়। ভরাট কণ্ঠে তিনি বলেন, ওরা মানুষ। মাহিরা লাবণ্য এখানেই থাকবে আমার কাছে।

তখনই বিদ্যুৎ ফিরে আসে। পুরো ঘর সোনারঙ জোসনার আলোয় ভরে ওঠে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us