আমপাংয়ের রাফখাতা

খালিদ এম শাহীন | Mar 21, 2021 03:39 pm
আমপাংয়ের রাফখাতা

আমপাংয়ের রাফখাতা - ছবি সংগৃহীত

 

হাওয়াই জাহাজের হেলানো চেয়ায়ে মাথা এলিয়ে দিয়ে খানিক তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে আছি। টুংটাং শব্দ শুনে কান খাড়া হলো। এমন শব্দের সাথে আগে থেকে পরিচিত কমলাপুর রেল স্টেশনের সুবাদে। ট্রেন এলে, ছেড়ে দিলে, দেরি হলে কিংবা এ জাতীয় যেকোনো ঘোষণার শুরুতে দৃষ্টি আকর্ষণী সুরেলা ঘণ্টা ধ্বনি। আজ জানলাম হাওয়াই জাহাজেও একই ধরন।

জীবনে প্রথম বাতাসে ভাসছি। উত্তেজনা সারা শরীর ও মনজুড়ে। কত জল্পনা কল্পনা পেরিয়ে অবশেষে এই বিশাল পাখির পেটে বসে আছি। কৌতূহলী চোখ আর কান সবকিছুতেই সাড়া দিচ্ছে দ্রুত।

এই মুহূর্তে তেমনই আমার কান খাড়া হয়ে আছে। কি বলছে । কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সৈয়দ মুজতবা আলীর কাহিনীতে পড়েছিলাম গ্যাক গ্যাক করে ইংরেজি বলার গল্প। সব কেবিন ক্রুরা মনে হয় গ্যাক গ্যাক করে ইংরেজি বলে। বুঝলে বুঝো না বুঝলেও সমস্যা নেই। আমি কেবলই শেষ বাক্যটা শুনলাম।
‘ওয়েলকাম টু কুয়ালালামপুর।’

চার ঘণ্টার যাত্রা তাহলে শেষ হওয়ার পথে। সেই রাত সাড়ে ১২টায় বোর্ডিং শেষ করে বসা। আসলে বসা আরো আগে থেকেই। লাউঞ্জে বসে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের ঘুম কাতুরে চোখ পিট পিট করছে। কারো কোলের সন্তান ঘুমে ঢলে পড়ছে। সেই সাথে হাই তুলছে সন্তানের মা-ও। দু-তিনজন মিলে অনুচ্চ স্বরে ব্যবসায়িক আলাপ সারছে। কারো কারো চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝা যায় সম্ভবত চাকরীর সন্ধানে মালয়েশিয়া গমন। কাতর চোখে অজানা আশা আর আশঙ্কার মিশেল। ইমিগ্রেশন চেক পয়েন্টের এপারে সদ্য বিবাহিত উর্বশীর স্বামী বিদায় দিতে এসে ভাইয়ের কাঁধে ভর দিয়ে বাঁধভাঙা কান্নায় আরো কারো কারো খারাপ লেগেছে হয়তো। প্রত্যেকটি ভ্রমণ পথেই এ এক সাধারণ চিত্র। এয়ারপোর্টে এই চিত্র আরো করুণ, আরো হৃদয় বিদারক। সেই কষ্ট দমানোর জন্যই কি না শক্ত করে সিটবেল্ট বেঁধে বসে আছি।

বসে থাকা ছাড়া খুব কিছু করারও নেই। ইতোমধ্যে ধাতস্থ হয়ে গেছি। শুরুতে বেশ অস্বস্তি লাগছিল। বিমান ওড়ার আগে যে দৌড় দেয় তাতে শরীরের মধ্যে শির শির করছিল। ওঠার সময়ও কয়েকবার ডানে বায়ে হেলে পড়ার উপক্রম। তারপরে আস্তে আস্তে সবকিছু স্বাভাবিক হয়। যাত্রীরাও একটু আয়েশ করে বসে। কেউ পত্রিকায় চোখ বুলায়, কেউ কম্বল ঢেকে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করে; জানালার পাশে থাকা যাত্রীরা চেয়ে থাকে বাইরের দিকে। গভীর রাতের আঁধার ভেদ করে কিছু দেখতে ব্যর্থ হয়ে আবার মনোযোগ দেয় অন্য কাজে। এক ফাঁকে অন্য অনেকের দেখাদেখি একটি হেড ফোন চেয়ে নিয়ে কানে গুঁজে নিলাম। হাতলের পাশে থাকা বাটন টিপে চ্যানেল ঘুরাচ্ছি। মূল স্ক্রিনে তখন মালয়েশিয়া বিষয়ক তথ্যচিত্র চলছে। আমার পাশে বসা ভদ্রলোক প্রায় সমবয়সীই হবেন। অথবা একটু বড়। ভাবসাবে মনে হচ্ছে কোনো কাজে মনোযোগ নেই। কোনো কিছুর অপেক্ষায় আছেন। কিসের অপেক্ষা সেটা বুঝলাম পরে।

হোস্টেজ খাবার নিয়ে হাজির। খাবারের পর পানীয়। ভদ্রমহোদয় একটু এদিক ওদিক করে হুইস্কির দিকে হাত বাড়ালেন। সে এক মজার দৃশ্য। অল্প একটু পান করে তার মন ভরেনি। আরেকটু লাগবে। মুখ দিয়ে হুইস্কি বলতে শরম পাচ্ছেন অন্যরা শুনে ফেলেন কি না, আকারে ইঙ্গিতে বোঝাচ্ছেন ওই যে একটু আগে যেটা খেয়েছি। এয়ার হোস্টেজও মনে হয় দুষ্টু আছে, তার মুখ দিয়ে নাম শুনে তবে যাবে। বলতে পারছে না দেখে স্মরণ করিয়ে দিলো হুইস্কি কি না! এবার ভদ্রলোক খুব আস্তে করে মাথা ঝুলায়। হোস্টেজ আবার দিয়ে গেল, ভদ্রলোক আবার পান করে পরিতৃপ্ত হলেন। পুরো ঘটনাটা ছোটখাটো নাটকের মতো উপভোগ করলাম। এই নাটকগুলো প্রতিনিয়তই আমাদের চারপাশে ঘটে চলছে, কেউ দেখে, কেউ দেখে না।

আমার হুইস্কি সমস্যা নেই, সুতরাং টেনশন করারও নেই। তবে আমাকেও খানিকটা নাটক করতে হয়েছে । কৈশোরে দেখা মিস্টার বিনের মতো। খাবারের ট্রলি নিয়ে আসা হোস্টেজদের সেই গ্যাক গ্যাক ইংলিশ তো কিছু বুঝি না। লেম অর চিকেন? প্রশ্নের জবাবে মুখে হাসি ফুটিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে এমন ভাব করলাম যে আরে মিয়া এটা কোনো জিজ্ঞাসার বিষয় নাকি। মেহমানদারী করবা যা দিবা তাই খুশি।

চোখ মেলেছি, জুড়াবো হৃদয়

থির থির কাঁপুনিতে বোঝা যাচ্ছে বিমান মেঘের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে রানওয়ের সন্ধানে মাথা নুইয়ে দিয়েছে। যেন খুনসুটির পালা শেষ। এবার আমায় যেতে দাও। বিশ্বকবির শব্দগাঁথায় যেভাবে বাতাসের ঝাপটায় আপাত উড়তে থাকা তালগাছের বাড়ি ফেরার তাড়া আসে।

তারপরে হাওয়া যেই নেমে যায়
পাতা কাঁপা থেমে যায়
ফেরে তার মনটি-
যেই ভাবে মা যে হয় মাটি তার,
ভালো লাগে আরবার
পৃথিবীর কোনটি।

এতক্ষণের ঝিম মারা অবস্থার শেষে যাত্রীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য, খানিক ব্যস্ততাও বটে। ব্যাগ-বস্তা নিয়ে পারলে এখনই দৌড় দিতে প্রস্তত বাঙালি। হোস্টেজরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন এখনো সময় আসেনি, বরং সিটবেল্ট বেঁধে সোজা হয়ে বসে থাকুন। এই হুলুস্থুলের মধ্যেই বিমান ঠক করে রানওয়েতে পা ঠেকাল। তারপরে নাক ঠেকিয়ে দৌড় প্রতিযোগিতায় যেন প্রথম হওয়ার লক্ষ্যে ঊর্র্ধ্বশ^াসে ছুটে একসময় ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল। আমরা বেরিয়ে পড়লাম। সুবহে সাদেকের মনোমুগ্ধকর সময় পেরিয়ে ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে কুয়ালালামপুরের আনাচে-কানাচে। এয়ারপোর্টের ধাতব কাঠামো আর কাচের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে সে আলোর ছিটে ফোঁটা এসে গায়ে পড়ছে।

কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহৎ বন্দরগুলোর একটি। ১৯৯৮ সালে এটি চালু হয়। জাপানি স্থপতি কিশো কুরোকাওয়ার নকশায় চমৎকার স্থাপত্যের প্রকাশ ঘটেছে। মালয়েশিয়ান ইসলামী ঐতিহ্য এবং দেশটির বিস্তৃত সবুজ বনভূমির বিমুর্ত প্রকাশ ঘটিয়েছেন স্টিল ট্রাসের বৃক্ষ সদৃশ কাঠামো এবং এর উপরে গম্বুজ আকৃতির ছাউনির সংযোজনে। প্রচুর কাচের ব্যবহার করেছেন ফলে প্রাকৃতিক আলোর আধিক্য তৈরি করেছে। কুরোকাওয়ার আলোর খেলা দেখতে দেখতে তাই দেরি করে ফেলেছি। দৌড়িয়ে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে গিয়ে দেখি লাইন খালি। পাসপোর্ট ভিসা জমা দিয়ে আবার কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে আছি।

-কি কাজে আগমন?
: বেড়াতে এসেছি, বোনের বাসায় যাবো।
-কয় দিনের ট্যুর?
: ১০ দিন।

আর কোনো কথা নেই। একবার কম্পিউটার, একবার পাসপোর্ট, একবার আমার চেহারা, বার কয়েক এটা সেটা দেখতে লাগল। আমি দেখছি অফিসারের মুখ। মালয়দের চেহারার ধরন আমাদের থেকে ভিন্ন। নাকটা একটু বসানো, চোখগুলো খানিকটা কুতকুতে। লম্বা তবে হালকা গড়নের অফিসার শেষ পর্যন্ত আমাকে ছাড়পত্র দিলেন। লাগেজ বেল্টে এসে দেখি একদম খালি। বুঝলাম এতো আর বাংলাদেশ নয় যে যাত্রীরা এসে বসে থাকবে আর ব্যাগেজ আসবে আধঘণ্টা পরে! বরং কুরোকাওয়ার আলোর খেলা আর নীল কোট প্যান্ট পরা মালয়দের হা করে দেখতে গিয়ে যেটুকু দেরি করে ফেলেছি সেটুকু দেরি সহ্য হয়নি পোর্ট কর্মীদের। ব্যাগেজ আরেক যায়গায় সরিয়ে রেখে বেল্ট রেডি নতুন ফ্লাইটের ব্যাগেজের জন্য। ওদিকে বাইরে ভাইয়া দাঁড়ানো। সব গুছিয়ে কুয়ালালামপুরের গা ঘেঁষা সেরি কেম্বাংগানের পথে। প্রায় ৪০ কিলোমিটারের পথ পড়ে রয়েছে এখনো মঞ্জিলে পৌঁছতে।

সুলামা, হারি রাই

মালয়েশিয়ায় বাঁদর আছে এ রকম কোনো তথ্য আগে পাইনি। শুনেছিলাম পাম অয়েলের জন্য মালয়েশিয়া বিখ্যাত। বিমানবন্দর থেকে আমপাংয়ের ৪০ কিলোমিটা পথের পাশে অনুচ্চ টিলা আর সবুজ পাম গাছের সারি তার প্রমাণ দিয়েছে। তবে বাঁদরের গল্প অন্য রকম। ছোটবেলায় অতিমাত্রায় দুষ্ট, এলোমেলো কিংবা ঘাড়ত্যাড়া পিচ্চিপাচ্চা বালকেরা বান্দর, ত্যান্দর, ভাল্লুক, উল্লুক ইত্যাদি নানা উপাধিতে ভূষিত হতো। আমার আপা বিদেশ বিভুঁইয়ে সে চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। তার পোষ্য যে বাঁদরের লাফালাফিতে ঘুম ভেঙেছে তার নাম ‘আনা’। সাথে আছে ছোট্ট ‘রু’। আমার রুমে আনা আর রু’য়ের ননস্টপ কথামালা আর পাখির মতো এডাল থেকে ওডালে ঝাঁপাঝাঁপি আমাকে বিছানা থেকে উঠিয়ে ছাড়ল। আনা এবং রু চেহারায় ভিন্ন না হলে সবাই এ বাসার সদস্যই মনে করত। মায়ের চেয়ে আন্টিই তার কাছের। সবসময় রান্নাঘরের বৈয়মে অনেক কিছু সাজিয়ে রাখতে হবে। আবার চাওয়া মাত্রই সেটি খুলে দিতে হবে তার সামনে। বাংলাদেশী মায়েদের সমস্যা তাদের সন্তানরা খেতে চায় না। মালয়েশিয়ান আনার আম্মুর সমস্যা আনাকে খাওয়া থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না। ননস্টপ কথার সাথে তার ননস্টপ খাওয়া চলতে থাকতে হবে। ‘আনা’র বয়স যদি ছয় বছর হয় তাহলে ‘রু’ আড়াই বছর। ‘ইশ’ ওদের খালাতো ভাই, একই বাসায় থাকে। উভয়ের আম্মুই সকাল হলে বেরিয়ে যায় কাজে। পাশের বাঙালি আন্টির পরম যত্নে ওরা হেসে খেলে দিন পার করে।

মালয় পুরুষদের চেয়ে নারীরাই বেশি পরিশ্রমী। সকাল হলেই গাড়ি ছুটিয়ে দূর-দূরান্তে ছুটে যায়। কেউ অফিসে, কেউ দোকানে, কেউ রেস্তোরাঁয়। প্রত্যেক ঘরেই গাড়ি থাকা জরুরি। যারা একটু নিম্নবিত্ত তাদেরও অন্ততপক্ষে বাইক থাকবে। সকাল হওয়া মাত্রই সারি সারি গাড়ির ছুটে চলার দৃশ্য। তারপর যেন একটু ঝিমিয়ে পড়ে পাড়া। তবে ‘আনা’, ‘রু’ আর ‘ইশে’র সান্নিধ্যে আমার চারপাশটা জেগে থাকে। আমি বাংলা ছাড়া মালয় কিছু বুঝি না, নানা অঙ্গভঙিতে ভাব বিনিময়ের চেষ্টা চলে। সে কি বোঝে জানি না, উল্টো আমাকে নানা জিনিস বুঝাতে চায়। একসময়ে ব্যর্থ হয়ে বিরক্তিতে চেহারা লাল হয়ে যায়। মেজাজ খারাপ করে অন্য কাজে মন দেয়। আমি মনোযোগ দেই টিভির পর্দায়।

সুলামা হারি রাই। বিভিন্ন অনুষ্ঠান আর বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে সুরেলা বাক্যটি শুনতে শুনতে আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। শব্দটির অর্থ, সালাম, ঈদ মোবারক এই টাইপের কিছু হবে। ঈদ পার হয়েছে বেশি দিন হয়নি। সেই আনন্দের রেশ মিডিয়ায় এখনো পুরোপুরি কাটেনি। মালয়েশিয়ার আদি জনগোষ্ঠী মুসলিম ধর্মাবলম্বী। সারা পৃথিবীর মতো এখানেও ঈদ আনন্দের উৎস হয়ে আসে এবং বেশ একটু সময় নিয়েই চলতে থাকে। গল্পে গল্পে জানলাম ঈদের সময়ে পুরুষ এবং নারী যথাক্রমে ‘বাজু মেলায়ু’ এবং ‘বাজু কুরুং’ নামে পরিচিত ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরতে পছন্দ করে। মাসব্যাপী চলে নানা উৎসব। হারি রাইয়ের সাথে চলে বিভিন্ন স্বাদেও পারিবারিক এবং সামাজিক অনুষ্ঠান।

আমার চোখ টিভি পর্দায় থাকলেও ঠিকই টের পাচ্ছি একজন পিঁপড়ার মতো বেয়ে আমার পিঠে উঠে যাচ্ছে। রু ছাড়া আর কে হবে! এখনো তার স্কুলজীবন শুরু হয়নি। আনার স্কুল থাকলেও হারি রাই শেষ করে এখনো স্কুলের চাপ পুরোপুরি শুরু হয়নি। আনারা তাই মুক্ত বিহঙ্গেও মতো ক’দিন উড়ে বেড়াচ্ছে। সকাল, দুপুর, বিকেল সুযোগ পেলেই ছুটে আসে। আনার পেছনে পেছনে রু চলে আসে হাঁটিহাঁটি পায়ে ইশকে সঙ্গী করে। সময় সময়ে বিদেশী আঙ্কেলের খোঁজখবর নেয়ার সামাজিকতা সে ইতোমধ্যে রপ্ত করেছে। সন্ধ্যা হলেই বাড়ি ফিরে তাদের আম্মুরা, ডেকে নিয়ে পড়ার টেবিলে। সে আর কতক্ষণ, টেবিলের সময় পার করেই আবার ছুটে আসে। মেঝেতে গ্লাসের পানি ফেলে, টিপয়ের ফুলদানি উল্টিয়ে, সোফার কুশনে চকলেটের আঠা মাখিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে পুরো ঘর। রাত এলে একপ্রকার জোর করেই তিন ভাই বোনকে পাঠাতে হয় তাদের বাসায়। বিরস বদনে ওরা বৈঠকখানার চৌহদ্দি পার হয়। আমি ততক্ষণে নরম বিছানায় শুয়ে কম্বল মুড়ি দিতে দিতে দিন শেষের সম্ভাষণ জানিয়ে হাত নাড়ি। ... সুলামা, হারি রাই!

বারান্দায় সবাক বিকেল

কুয়ালালামপুরের গা ঘেঁষে ছোট শহর সেরি কেম্বাংগান। মালয়েশিয়ার অন্যতম রাজ্য সেলাংগরের অন্তর্গত। অনেকগুলো রাজ্য নিয়ে গঠিত মালয়েশিয়ার কাঠামো। এদের মধ্যে সেলাংগর রাজ্যই সর্ববৃহৎ। রাজধানী কুয়ালালামপুর, প্রশাসনিক শহর পুত্রজায়া এই সেলাংগরেরই অংশ ছিল। পরে এদেরকে আলাদা কেন্দ্রশাসিত হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়। শহরজুড়ে প্রচুর বাংলো টাইপের বাড়ি। পাহাড় কেটে সমান করে নতুন নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে। শহরের এই অংশ জনসংখ্যা মাঝামাঝি ধরনের। একটা সময় প্রচুর রাবার বাগান এবং হিংস্র জন্তুর অভয়ারণ্যে ঘেরা ছিল বলে জানা যায়। বাগান এবং খনি শ্রমিকরাই বাস করত। ১৯৫০-এর পরে ব্রিটিশ সরকারের আমলে ৫০টি প্লট তৈরি করা হয়, যেখানে প্রথম ডুপ্লেক্স টাইপের কিছু বাড়ি তৈরি হয়। মালয়েশিয়ান চাইনিজরাই এখানকার প্রথম অধিবাসী।

১৯৯৮ সালে কমনওয়েলথ গেমস উপলক্ষে আরো বেশ কিছু অবকাঠামো তৈরি হয় ফলে জনসমাগমও বাড়ে। বর্তমান জনসংখ্যা দেড় থেকে দু’লাখ হবে। ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, পেশাজীবী, সরকারি চাকুরেদের মধ্যে যারা একটু নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করে তাদের নিয়েই ছিমছাম শহরের এ প্রান্ত। স্যাটেলাইট সিটি ‘পুত্রজায়া’ এবং ‘সাইবারজায়া’ দুটোই কাছাকাছি দূরত্বে। সেরি কেম্বাংগান শহরটি এখন ছোটখাটো ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। একসময় হস্ত ও কুটির শিল্পের জন্য বিখ্যাত হলেও এখন বিভিন্ন ভারী শিল্প কারখানা চলে এসেছে। এর মধ্যেই আবার বেশ কিছু পরিকল্পিত আবাসিক এলাকার অবস্থান।

আনা আর রু’য়ের মধুর যন্ত্রণা সঙ্গী করে সুরিয়া অ্যাপার্টমেন্টের ১০ তলার বারান্দায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি আর দেখছি ভিনদেশটাকে। অ্যাপার্টমেন্টের চার দিকে বেশ খোলা। পেছনের দিকটা কুয়ালালামপুরের সীমানা। সীমানাঘেঁষে উঁচু সবুজ পাহাড় দাঁড়িয়ে। পাহাড়ের উত্তর-পশ্চিম কোনের উপত্যকাসদৃশ সমতলে ইউনিভার্সিটি পার্থেনন ন্যাশনাল মালয়েশিয়ার সুদৃশ্য ক্যাম্পাস। পাশেই মাইনস ওয়েলনেস সিটি নামে একটি বিশাল হাউজিং স্টেটের অবস্থান। পরিকল্পিত আবাসন ছাড়াও এখানে ইন্টারন্যাশনাল এক্সিবিশন সেন্টার, রিসোর্ট, বিজনেস সেন্টার, শপিংমল, গলফ ক্লাব ইত্যাদি প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধার সমাহার ঘটানো হয়েছে। আছে বিশাল এক প্রাকৃতিক জলাধার। আবার অ্যাপার্টমেন্টের সামনে বড় রাস্তা পেরোলে সারি সারি বাংলো দাঁড়িয়ে। বড় ভবনের সংখ্যা কম। সুন্দর একটা ঝিরঝিরে বাতাস গা জুড়িয়ে দিয়ে যায়। দুপুরে বেশ গরম থাকে। সকালে আর বিকেলের পর থেকে আবার ঠাণ্ডা হতে থাকে। রাতে কাঁথা গায়ে দিতে আরাম। হঠাৎ হঠাৎ স্বল্পসময়ের নোটিশে ঝুর ঝুর করে বৃষ্টি নামা শুরু করে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের আবহাওয়া এমনই।

বারান্দা দিয়ে সামনে তাকালে ছোট ছোট সবুজ পাহাড়। পাহাড় কেটে সমান করে বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে। প্রশস্ত রাস্তা, পায়ে হাঁটার পথ। হাউজিং কোম্পানিগুলোকে অনুমোদন নেয়ার আগেই রাস্তাঘাট, ড্রেনেজ সিস্টেম, ইলেকট্রিসিটি, ওয়াটার সাপ্লাই সিস্টেম কমপ্লিট করে দেখাতে হয়। অনুমোদন পাওয়ার পর আসে বাড়ি বানাবার প্রশ্ন। ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে ভীষণ সতর্ক সরকার। অ্যাপ্যার্টমেন্টের সাথে শিশুপার্ক, গার্ডেন, সুইমিংপুল আছে। সবকিছুর সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। ভোক্তা একবার অভিযোগ করলে কোম্পানি ঝামেলায় পড়ে যায়।
একটা ছোট্ট হাউজিং এরিয়া থেকে ঘুরে এলাম। ভাইয়া এখানে কর্মরত। কোম্পানির মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ মিস শাকিলা সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। রিসেপশন এরিয়াতে খুব সুন্দর করে বিভিন্ন এরিয়া প্ল্যান এবং মডেল রাখা। ক্লায়েন্ট এলে খুব সহজেই পরিষ্কার ধারণা পেয়ে যাচ্ছে। তারপর ইচ্ছে হলে সশরীরে একবার ঘুরে আসছে। আমিও সুযোগটা কাজে লাগালাম। ঘুরে আসলাম আরেকটি নতুন হাউজিং প্রকল্প থেকে।

হাউজিং মানে সেই ছোট বাংলো টাইপের বাড়ি। সামনের লনজুড়ে সবুজের আস্তরণ। কোথাও ফুল ফুটে আছে গৃহকর্তা কিংবা কর্ত্রীর পছন্দমতো। এগুলোই মালয়েশিয়ার ট্রেডিশনাল ডুপ্লেক্স হাউজ। উপর তলায় তিনটি বেডরুম, নিচতলায় ড্রংয়িং-ডাইনিং, কিচেন, একটা ছোট সিঁড়ি দিয়ে দুই ফ্লোরের কানেকশন, সুন্দর ছিমছাম একটা ইউনিট। মা-বাবা, ভাইবোন নিয়ে সাজানো সুখের সংসার। প্যা..পু, ভ্যা..ভু নেই; নেই কোনো হইচই। ঘর থেকে বেরোলেই ছোট্ট খেলার মাঠ। গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে দুটো গাড়ি। সুতরাং একটু দূরে যেতে হলেও চিন্তা নেই। প্রতিটি রোডের দু’পাশে ১০টা ১২টা করে বাড়ি পাশাপাশি গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। বিকেলে বাসায় ফিরে একটু হাই হ্যালো, পোষা কুকুর নিয়ে ইভিনিং ওয়াক। কি মজার একটা দৃশ্য। আপাতদৃষ্টিতে এমন সুন্দর শান্তিময় জীবনের কোনো তুলনা হয় না। একটু আফসোস জাগে মনে মনে। সমগ্র পৃথিবীটা যদি এমন শান্তিময় হতো।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us