বুল্লে শাহ : এক মরমি কবি

মাহমুদুর রহমান | Mar 21, 2021 03:48 pm
বুল্লে শাহ

বুল্লে শাহ - ছবি সংগৃহীত

 

আমাদের একজন হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন। দেশের অনেক তরুণ-তরুণী, মধ্যবয়সী, প্রৌঢ় কখনো-না-কখনো তার লেখায় বুঁদ হয়েছেন। তার আগে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সুখে-দুঃখে বাঙালির আশা-ভরসার এক জায়গা। তার গানে, প্রাণে সুখ জাগে, প্রেরণা মেলে। আবার কখনো বা ভিজে ওঠে দু’চোখ। আর তারও আগে ছিলেন লালন ফকির। তিনি সাধক ছিলেন, নাকি প্রেমিক- তা এখনো বুঝে উঠতে পারি না। কিংবা প্রেমের আরেক নাম সাধনা।

দেশ-কাল কিংবা বলা যায় সব ভাষায়ই হয়তো একজন লালন থাকেন। লোক-মানসের কথাগুলো তুলে আনেন বলে তাদের কথাগুলো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। আর তাই লিপিবদ্ধ না হয়েও তাদের কাজগুলো বেঁচে থাকে কালোত্তীর্ণ হয়ে। আজ তেমন এক লালনের কথা বলি। তিনি পাঞ্জাবের সাধক সৈয়দ আবদুল্লাহ শাহ্ কাদরি ‘বুল্লে শাহ্’ বা ‘বুল্লা’ শাহ্। বুল্লে শাহ্ হিসেবে তিনি সর্বাধিক পরিচিত আর তার কাব্যের ভক্তদের কাছে তিনি ‘বুল্লেয়া’।

আবদুল্লাহ কাদরির জন্ম ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে। জীবনকাল, পলাশীর যুদ্ধ অর্থাৎ ১৭৫৭ পর্যন্ত। পাঞ্জাবের উচ প্রদেশের এই মরমি সাধকের কবিতা সেখানে ঠিক লালনের গানের মতোই হৃদয়তন্ত্রীতে নাড়া দেয়। মানুষের মন আর মরমি কথাই তার কবিতার বিষয়বস্তু। কখনো তিনি মানুষকে দেখেছেন, কখনো আল্লাহ্কে। আর সেই দেখা এবং তার অনুভূতি তিনি কবিতায় প্রকাশ করেছেন যা পরে গান হয়ে ছড়িয়েছে মানুষের মাঝে।

বুল্লে শাহ্ পাঞ্জাবের ভাওয়ালপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। বর্তমানে ভাওয়ালপুর পাকিস্তানে অবস্থিত। তার পিতার নাম শাহ মুহাম্মদ দরবেশ। তিনি পেশায় ছিলেন শিক্ষক। বুল্লে শাহ্র পূর্বপুরুষরা বুখারা থেকে এসেছিলেন। ধারণা করা হয়, তার পূর্বপুরুষরা নবী মুহাম্মদের সা:-এর বংশধর। তিনি যখন ছয় মাস বয়সের ছিলেন, তখন তার পরিবার মালাকওয়াল এ বসবাস শুরু করেন। বুল্লে শাহ্, মাওলানা মইনুদ্দিনের কাছে শিক্ষা নেন এবং পরবর্তীতে শেখ এনায়েত কাদরির শিষ্য হন।

বুল্লে শাহ্র কবিতাগুলো ‘কাফি’ ঘরানার। কাফি মূলত পাঞ্জাবি ঘরানার রাগ, সিন্ধি এবং সিরাকি কবিতা। পাঞ্জাব এবং সিন্ধে এ ধরনের কবিতার চল রয়েছে। মুর্শিদ তথা গুরু বা পথ প্রদর্শক এবং মুরিদ তথা অনুগামীর মধ্যে কথোপকথন নিয়ে এই কবিতা রচিত হয়। এই মুরিদ কখনো মানুষ আর মুর্শিদ হলেন স্বয়ং ঈশ্বর। আবার কখনো প্রেমিক-প্রেমিকা। কাফি শুধু সুফি, সিন্ধি এবং পাঞ্জাবিদের দ্বারাই ব্যবহৃত হতো না। বরং শিখ গুরুরাও কাফি লিখতেন। সে সময়ে দরগাহ বা খানকায় এগুলো আবৃত্তি করা হতো। ক্রমে ক্রমে মানুষের মুখে বেঁচে থেকে এক সময় গানে পরিণত হয়।

আরব থেকে মুসলিমরা খাইবার পাস পেরিয়ে সিন্ধুর এ পারে আসার পর থেকেই ভারতের সংস্কৃতি বদলাতে শুরু করে। আর সে বদলের অন্যতম প্রধান ধারক হয়েছিল পাঞ্জাব। পঞ্চ-নদ বিধৌত শ্যামল এই অঞ্চলের মানুষ গানে গল্পে সময় পার করত। ফলে তাদের গড়ে উঠেছিল লোকগল্পের এক ভাণ্ডার। পরে মুসলমান আগমনের পর পাঞ্জাবের মানুষ তাদের সংস্পর্শে আসে। প্রথমে মুসলিম এবং পরবর্তীতে সুফি দর্শনের সাথে পরিচিত হয় পাঞ্জাব।
এ কারণেই অনেক সাধকের পরিচয় খুঁজতে গিয়ে পাঞ্জাবের সাথে তাদের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। লোকগল্পের আধার পাঞ্জাবের কবিরা তাদের প্রচলিত প্রেমকাহিনী নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন আর তার মাঝেই রেখে গেছেন গভীর মর্মবাণী। কাফি ঘরানার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি বোঝা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এখানে প্রেমের কথার মধ্যে দিয়ে মরমি বাণী, ঈশ্বরের নিকটবর্তী হওয়ার কথা বলেছেন কবিরা। ঈশ্বর বা আল্লাহর প্রতি বুল্লে শাহ্র মনোভাব কী ছিল তার কবিতায় তিনি লিখেছেন,

‘মাটিকে ধোঁকা দিয়ো না, জাত পাতের কথা বলো না
আমিও মাটি তুমিও মাটি, জাত কেবল খোদার খাঁটি’

তাই বুল্লে শাহ্ প্রিয় হয়েছেন সবার কাছে। একদিকে প্রেমিক প্রেমিকারা তার কবিতায় নিজেদের কথা খুঁজে পেয়েছে, তেমনি ধর্মভীরু মানুষ পেয়েছে আল্লাহকে। তবে বুল্লে শাহ্ শুধু কবিতাই লেখেননি। তিনি ছিলেন একজন মানবতাবাদী এবং দার্শনিক। মানবতা এবং দর্শনের প্রচারও তিনি করেছেন। তার সময়কালে একবার মুসলিম ও শিখ দাঙ্গা শুরু হয়। দু-পক্ষেই বিপুল মানুষ নিহত হচ্ছিল। একবার একদল শিখ কয়েকজন মুসলিমকে হত্যা করে। তার প্রতিশোধ হিসেবে মুসলিমরাও একজন নিরীহ শিখকে হত্যা করে। মুসলিম হলেও বুল্লে শাহ নিরীহ শিখ হত্যার বিরোধিতা করেন। তিনি দু’হাত তুলে বলেন, ‘সন্ত্রাস কখনেই সন্ত্রাসের জবাব নয়।’

বুল্লে শাহ্-র কবিতায় এই মানবপ্রেম আছে। সাথে আছে আল্লাহর গুণগান। আল্লাহর প্রতি প্রেম আর ভালোবাসা নিয়ে রচিত কবিতাগুলো আবার নির্দ্বিধায় পুরুষ এবং রমণীর প্রেমের গীত হিসেবে দেখা যায়। বুল্লে শাহ্ একদিকে যেমন ছিলেন আল্লাহর প্রেমিক তেমনি পার্থিব প্রেমিকদেরও তিনি ছিলেন বন্ধু। যেমনটা উল্লেখ করা হয়েছে, তার গানে মিশে আছে পাঞ্জাবের লোকগাথা। ‘হীর রাঞ্ঝা’, ‘মীর্জা সাহেবা’কে নিয়ে রচিত হয়েছে বুল্লে শাহ্র গান-কবিতা। আবার তার কবিতাতে কখনো এসেছে গভীর জীবনদর্শন। বুল্লাহ্ বলেন, ‘প্রেমের বিষ কখনো মানুষ বুঝে পান করে না। না বুঝে পান করাতেই সে বিষে আনন্দ।’

বুল্লে শাহ্র মরমী শিক্ষক বা গুরু ছিলেন শাহ্ এনায়েত কাদরী। তার কাছেই বুল্লে শাহ্ সুফিবাদ এবং ধর্মের নানা তত্ত্ব শেখেন। অন্য সুফিদের মতো এনায়েত কাদরীও আল্লাহর পাশাপাশি মানুষকে ভালোবাসতেন। মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপন করতে চাইতেন। বুল্লে শাহ্ গুরুর কাছ থেকে তাই শিখেছিলেন। এনায়েত কাদরীর কথা তিনি বারবার লিখেছেন নিজের কবিতায়। তিনি লেখেন, ‘শাহ্ এনায়েত আমার পীর, তিনি এসে আমার মনের সব দ্বিধা দূর করলেন।’

বুল্লে শাহ্র নাম আধুনিক মানুষের কাছে প্রথমে আসে ১৯৯০ সালে যখন পাকিস্তানি ব্যান্ড ‘জুনুন’ তার ‘বুল্লা কি জানা’ কবিতাটিকে গানে পরিণত করে। ২০০৪ সালে রাব্বি শেরগিল তার প্রথম অ্যালবাম ‘রাব্বি’তে এই গানটি নতুন করে গেয়েছিলেন যা ২০০৫ সালে টপচার্টে ছিল। এরপর অনেকেই বুল্লে শাহকে খুঁজে বের করেন বা আবিষ্কার করেন। তার কবিতাগুলো থেকে নতুন করে তৈরি হয় গান। কিছু কবিতা বিকৃত হয়নি এমনো না। কিন্তু বুল্লে শাহ্ নতুন করে আবার মানুষের কাছে পরিচিত হয়েছেন।

বুল্লে শাহ্র কবিতা থেকে বলিউডেও প্রচুর গান হয়েছে। তার কিছু কিছু জানলে অনেকেই হয়েতো অবাক হবেন। ‘মেরা পিয়া ঘর আয়া’ বুল্লাহ্র সৃষ্টি। যেকোনো অনুষ্ঠানে রুনা লায়লা একটা গান গেয়েই থাকেন। ‘দমা দম মাস্ত কালান্দার’। এটি বুল্লে শাহ্র কবিতা, যা থেকে কাওয়ালি গাওয়া হয় এবং বুল্লে শাহ্ এটি শাহবাজ কালান্দার নামক আরেকজন সুফি সাধকের সম্মানে লিখেছিলেন। ২০১০ সালে মুক্তি পাওয়া মণি রত্নমের ‘রাবণ’ সিনেমার ‘রাঞ্ঝা রাঞ্ঝা’ গানের রচয়িতা বুল্লে শাহ্। আর তারই রচিত পাঞ্জাবি কবিতা ‘তাহাইয়া তাহাইয়া’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই গুলজার, এ আর রহমান এবং মণি রত্নম কালজয়ী গান ‘ছাইয়া ছাইয়া’ তৈরি করেন।

বুল্লে শাহ্কে ধারণ ও তার কবিতা থেকে গান গেয়ে যারা তাকে অমর করে রেখেছেন, তাদের মধ্যে আবিদা পারভিন এবং সাই জহুরের নাম সর্বাগ্রে আসে। এছাড়াও নুসরাত ফতেহ্ আলী খাঁ, সাবরি ব্রাদার্স, ওয়াদালি ব্রাদার্সের নাম বলতে হয়। এরা অবশ্য বহুদিন ধরেই কাওয়ালিতে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন বুল্লে শাহকে। কোক স্টুডিওর গুনে আধুনিক মানুষের মনেও তিনি ছাপ ফেলছেন। এমনকি বাণিজ্যিক ধারায় জোহর পরিচালিত ‘অ্যায় দিল হ্যাঁয় মুশকিল’ সিনেমায় ‘বুল্লেয়া’ শীর্ষক গানে এই বুল্লে শাহ্র কথাই বলা হয়েছে এবং তাকে ‘প্রেমিকের বন্ধু’, ‘পথ প্রদর্শক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

কিন্তু এখানে একটি সমস্যা এসে দাঁড়ায়। বুল্লে শাহ্ সুফিমার্গের সাধক হওয়ার কারণে তার লেখা কবিতাগুলো অনেকেই বুঝতে পারে না। আবার অনেকে বুঝেও তা ভুলভাবে ব্যবহার করে। সুফিরা মূলত আল্লাহর প্রতি তাদের প্রেম নিবেদন করেন। কিন্তু বর্তমানে সেসব কবিতাকে প্রেমিকার প্রতি উপস্থাপন করা হয়। আবার সূক্ষ্ম কথার কারণে তাদেরকে ইসলাম পরিপন্থী বা ধর্মের পরিপন্থী মনে করে অনেকে। যেমন বুল্লে লিখেছেন,

‘মক্কা গিয়ে হাজারবার প্রার্থনা করে কী হবে
গয়া-কাশীতে গিয়েই বা কী হবে?
মন থেকে আমিত্ব দূর না হলে কোন প্রার্থনার কী দাম থাকে?’

আমিত্বকে দূর করে খোদার কাছে নিজেকে সমর্পণ করা সুফিবাদের অন্যতম মূল কথা। কিন্তু সেকালে অনেকেই এসব কথা বুঝতে চাইতেন না। এমনকি বুল্লে শাহ্র মৃত্যুর পর তাকে মুসলিমদের কবরস্থানে দাফন করার ক্ষেত্রেও গোঁড়া মুসলিমদের কাছ থেকে বাধা এসেছিল। যুগে যুগে অনেক সাধকের ক্ষেত্রেই এমন হয়েছে। বুল্লাও ব্যতিক্রম নন।

লালন গেয়েছিলেন, ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে?’ একই রকম প্রশ্ন উঠেছিল এই মহান সাধক বুল্লে শাহ্র বেলায়ও। কিন্তু বুল্লে শাহ্ কিংবা লালনরা কোনো নির্দিষ্ট জাত, সময় আর দেশের হন না। তারা সব জাতের, সময়ের, দেশের। তাই মৃত্যুর বহু বছর পরও তারা বেঁচে থাকেন এবং ভিন্ন ভাষা, ভিনদেশী হলেও তাকে চিনতে আমাদের কষ্ট হয় না। তাই রাব্বি শেরগিলের গলায় বুল্লার গান শুনে তাকে লালনের পাশে দেখি।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us