ইসলামে যেভাবে হয়েছিল রোজার সূচনা

মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম | Apr 06, 2021 03:31 pm
ইসলামে যেভাবে হয়েছিল রোজার সূচনা

ইসলামে যেভাবে হয়েছিল রোজার সূচনা - ছবি সংগৃহীত

 

ইসলামের মৌলিক ইবাদতসমূহ তথা নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, জিহাদ ইত্যাদি মহানবী সা:-এর মাদানি জীবনে ফরজ হয়। নামাজ হিজরতের ১১ মাস পূর্বে রজবের ২৭ তারিখে মেরাজের রাতে ফরজ হয়, তবে পড়ার নির্দেশ হয় প্রথম হিজরিতে। জিহাদ ফরজ হয় প্রথম হিজরিতে, রোজা ও জাকাত ফরজ হয় দ্বিতীয় হিজরিতে, হজ ফরজ হয় অষ্টম, মতান্তরে নবম হিজরিতে। এসব বিধান মদিনায় ফরজ হওয়ার রহস্য হলো- ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়া ব্যতীত মানুষ তা পালন করবে না। ইসলামী সরকার মুসলিম প্রজাদেরকে এসব বিধান পালন করতে বাধ্য করবে। তাই দেখা গেছে মদিনায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রে বেনামাজী, রোজা বর্জনকারী, জাকাত অস্বীকারকারী এবং ফরজ হজ বর্জনকারী কেউ ছিলেন না।

আল্লাহ তায়ালা রোজার বিধান ফরজ করার ক্ষেত্রে প্রথমত সান্ত্বনামূলক বাণী পেশ করছেন। যেমন তিনি ইরশাদ করেছেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে (রোজা) তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল (সূরা আল বাকারা-১৮৩)। রোজা ফরজ করার সাথে এ সান্ত্বনাও দেয়া হয়েছে যে রোজা একটু কষ্টকর হলেও এ বিধান নতুন নয় বরং পূর্বেও সব উম্মতের ওপর তা ফরজ ছিল। তারা যেহেতু রোজা পালন করতে পেরেছে, তোমরাও পারবে। রোজাকে ভয় করবে না, কষ্টকর মনে করবে না।

রোজার সূচনা : রোজা ইসলামের একটি অন্যতম রুকন বা স্তম্ভ। যারা নফসের গোলাম ও খেয়াল-খুশির পূজারী, তাদের জন্যে রোজা অত্যন্ত কষ্টকর। তাই এ বিধানটি খুবই জোরালো শব্দে বর্ণনা করা হয়েছে। হজরত আদম আ: হতে অধ্যাবধি এ বিধান বরাবর চলে আসছে। হজরত আদম আ: জান্নাত থেকে বের হওয়ার পর তাঁর নূরানী চেহারা নষ্ট হয়ে যায়। তখন ফেরেশতাগণ আল্লাহ তায়ালার নিকট তাঁর চেহারা সুন্দর করে দেয়ার জন্য আবেদন করেন। আল্লাহ তায়ালা তখন প্রতি মাসে তিনটি রোজা রাখার নির্দেশ দেন এবং বলেন, এতে তাঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে যাবে। পূর্ববর্তী প্রত্যেক নবীর শরিয়তে চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজার বিধান ছিল। এ রোজা আইয়্যামে বীজের রোজা নামে পরিচিত। মুফাফসির দাহহাক বর্ণনা করেছেন, হজরত নূহ আ: থেকে শেষনবী হজরত মুহাম্মদ সা: পর্যন্ত প্রত্যেক নবীর যুগেই প্রতি মাসে তিনটি করে রোজা রাখার বিধান ছিল। এক মাস রোজার বিধান দেয়া হলে মাসিক তিন দিন রোজা রাখার বিধান রহিত হয়ে যায় (ইবন কাছির)। ইহুদিরা আশুরার রোজা রাখত। মহানবী সা: মদিনায় হিজরতের পর তা দেখে মুসলমাদেরকে আশুরার রোজা রাখার নির্দেশ দেন। তবে তাদের বিপরীত করার অর্থাৎ তারা রাখে একদিন, মুসলমানদের দু’দিন বা তিন দিন রাখার আদেশ করেন। হজরত দাউদ আ: একদিন রোজা রাখতেন, একদিন ভঙ্গ করতেন। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বে শেষনবীর উম্মাতের ওপর আশুরা ও আইয়্যামে বীজের রোজার বিধান ছিল। পরে এর পরিবর্তে রমজানের রোজা ফরজ করা হয়।

রোজার উদ্দেশ্য : রোজার মুখ্য উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া অর্জন। (সূরা বাকারা- ১৮৩) তাকওয়া হলো এমন এক সদাসতর্ক মানসিক অবস্থা যা কাঁটাময় পথে পথিককে বাঁচাতে সাহায্য করে। তাকওয়া থাকলে মানুষ সব নিষিদ্ধ ও মন্দ কাজ থেকে বেঁচে থাকবে এবং সব আদিষ্ট কাজ পালন করবে। রোজা বিভিন্নভাবে তাকওয়া সৃষ্টি ধরে। প্রথমত, রোজা হলো লৌকিকতা মুক্ত ইবাদত। দ্বিতীয়ত, রোজা দ্বারা প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ ও সংযমের প্রশিক্ষণ হয়। তৃতীয়ত, রমজান মাসের চব্বিশ ঘণ্টা চলে ইবাদতের অনুশীলন। চতুর্থত, রোজার মাধ্যমে প্রবৃত্তি ও কামনা বাসনা দুর্বল হয়। পঞ্চমত, রোজা একটি সংবেদনশীল সমাজ গঠনে সাহায্য করে; কারণ, সারাদিন উপবাস থেকে রোজাদার গরিব-দুঃখীর কষ্ট বুঝতে সক্ষম হয়। তাকওয়ার বৈশিষ্ট্য ছয়টি। ১. সত্যের সন্ধান ২. সত্য গ্রহণ ৩. সত্যের ওপর সুদৃঢ় ও সু-প্রতিষ্ঠিত থাকা ৪. আল্লাভীতির মহানস্বভাব সৃষ্টি করা ৫. দায়িত্ব সচেতনতা ৬. আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতার ভয় নিয়ে সব কাজ সম্পাদন করা।

মুসাফির ও রুগ্ন ব্যক্তির জন্য অবকাশ : আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের ওপর যা কিছু ফরজ করছেন, তাতে বান্দাদের দুর্বলতার প্রতিও তিনি লক্ষ রেখেছেন। ফলে মুসাফির ও রুগ্ন ব্যক্তিদের প্রতি এ অনুগ্রহ করেছেন যে, তারা সফর কিংবা অসুস্থ অবস্থায় রোজা না রেখে অন্য সময় তথা সফর থেকে ফিরে এলে এবং অসুস্থতা কেটে গেলে রোজা রাখতে পারবে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, আর কেউ পীড়িত থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূরণ করতে হবে। (সূরা বাকারা-১৮৪) এতে সে ব্যক্তি আল্লাহর দেয়া অনুকম্পাও ভোগ করল এবং আল্লাহর ফরজও পালন করল এবং রোজার মহামূল্যবান পুণ্য থেকেও বঞ্চিত হলো না।

তাফসিরে ইবনে কাছিরে রয়েছে- রোজার অবস্থার পরিবর্তন হয় তিন বার। প্রথমত, রাসূল সা: মদিনায় এসে প্রতি মাসে তিনটি রোজা ও আশুরার রোজা রাখতেন। দ্বিতীয়ত, রোজা ফরজ করা হয়। তবে রোজা রাখা ও না রাখার ইখতিয়ার দেয়া হয়। তৃতীয়ত, সুস্থ ব্যক্তিদের ওপর রোজা আবশ্যক করা হয়।

কুরআন নাজিলের বার্ষিকী : রমজান হলো সেই মাস, যাতে কুরআন নাজিল হয়েছে। (বাকারা-১৮৫)। রমজান হলো কুরআন নাজিল হওয়ার বার্ষিকী। কুরআন নাজিল হওয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এ মাসে ঘটেছে বলেই দীর্ঘ এক মাসব্যাপী এর বার্ষিকী পালন করা হয়। এ বার্ষিকী পালনের জন্য যেসব অনুষ্ঠানাদি রাখা হয়েছে, তার সামষ্টিক ফল হলো তাকওয়া। মুসনাদ আহমদ গ্রন্থে হজরত ওয়াসেলা ইবন আসকা থেকে বর্ণিত আছে যে, মহানবী সা: বলেছেন, হজরত ইবরাহিম আ:-এর সহিফা পহেলা রমজান, তাওরাত ৬ রমজান, যবুর ১২ রমজান, ইঞ্জিল ১৩ মতান্তরে ১৮ রমজান এবং কুরআন মজিদ ২৪ রমজান নাজিল হয়। (ইবন কাছির)

রোজার মাহাত্ম ও মর্যাদা জ্ঞাতব্যক্তি যখন পীড়া ও সফরের কারণে রোজা পালন করতে পারে না, তখন তার অন্তরে এ অনুশোচনা সৃষ্টি হয় যে, আমি আল্লাহর হুকুম পালন করতে পারিনি এবং রোজার অমূল্য বরকত ও রহমত থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আল্লাহ তায়ালা বান্দার এ অনুশোচনা ও এ দুঃখ দূরীভূত করার জন্য এ সহজ পন্থার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন যে, তোমরা অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করতে পারবে এবং আল্লাহর হুকুম পালনের সৌভাগ্য অর্জন করতে সক্ষম হবে।

পানাহার ও স্ত্রীসঙ্গমের শেষ সময় : আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘আর তোমরা পানাহার করো, যতক্ষণ না রাত্রির কালো রেখা হতে সাদা রেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রকাশিত হয়। তারপর তোমরা রাত পর্যন্ত রোজা পূর্ণ করো। (সূরা বাকারা-১৮৭) এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা রোজাদারের জন্য রাত থেকে সাহরির শেষ সময় পর্যন্ত স্ত্রী সঙ্গম সহপানাহার করা মোবাহ করেছেন। এটাকেই কালো সুতা থেকে সাদা সুতা উদ্ভাসিত হওয়া বলা হয়েছে। হজরত সহল ইবন সা’দ বলেন, যখন ‘ওয়াকুলুওয়াশরাবু’ (আর খাও ও পান করো) নাজিল হয়, তখন ‘মিনাল ফাজরে’ নাজিল হয়নি। ফলে যখন লোকেরা রোজা রাখত, তখন তাদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের দু’পায়ে কালো সুতা ও সাদা সুতা বেঁধে রাখত এবং উভয় সুতার পার্থক্য যতক্ষণ পর্যন্ত স্পষ্টরূপে দেখা না যেত, ততক্ষণ পর্যন্ত পানাহার করতে থাকত। তারপর আল্লাহ তায়ালা ‘মিনাল ফাজরে’ (ভোরের আলো) অংশটুকু নাজিল করেন।

এতে সবাই জানতে পারল যে, এর অর্থ রাত ও দিন। ইমাম আহমদ (রহি) বলেন, আমাকে হিশাম, তিনি হেসীনশাবী থেকে, তিনি আদী ইবন হাতেম থেকে বর্ণনা করেন, হজরত আদী বলেন যখন এ আয়াত নাজিল হয় তখন আমি কালো ও সাদা দুটো সুতা নিয়ে আমার বালিশের নিচে রেখেদিলাম। আমার কাছে যখন কালো থেকে সাদার পার্থক্য পরিষ্কার হয়ে উঠত, তখন আমি পানাহার বন্ধ করতাম। সকাল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সা:-এর খেদমতে গমন করলাম এবং যা করেছি তা সবই ব্যক্ত করলাম। অতঃপর রাসূল সা: বললেন, তোমার বালিশ তো বিরাট লম্বা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো, রাতের অন্ধকার থেকে দিনের আলো ফুটে ওঠা।

হজরত আদী ইবন হাতেম র: থেকে আরো বর্ণিত আছে তিনি বলেন, আমি একটি সাদা সুতা ও একটি কালো সুতা ধারণ করতাম। কোনো কোনো রাত এমন হতো যে সাদা ও কালো ভালোভাবে দেখা যেত না। হজরত আদী রা: আরো বলেন, আমি একদা রাসূল্লাহ সা: নিকট আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! সাদা সুতা ও কালো সুতা কী? এটা আসলেই কি দুই প্রকার সুতা? রাসূল সা: বলেন, তুমি যদি দুই প্রকারের সুতা দেখে থাকো, তাহলে নিশ্চয় তুমি লম্বা গর্র্র্র্র্র্র্র্দান বিশিষ্ট সেজেছ। তারপর বললেন, না বরং তা হলো রাতের অন্ধকার ও দিনের আলো (তাফসিরে ইবন কাছির)

লেখক : প্রধান ফকিহ, আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদ্রাসা, ফেনী


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us