সুলতানা রাজিয়া : দিল্লি সালতানাতের একমাত্র নারী সুলতানা

ওহিদুল ইসলাম | Apr 11, 2021 06:03 pm
সুলতানা রাজিয়া

সুলতানা রাজিয়া - ছবি : সংগৃহীত

 

কয়েকটি তুর্কি ও আফগান রাজবংশ ৩২০ বছর দিল্লি শাসন করেছে। পানিপথের যুদ্ধে মোগল সম্রাট বাবরের বিজয়ের আগে পর্যন্ত ক্রমানুসারে মামলুক বা দাস সালতানাত, খিলজি সালতানাত, তুঘলক, সৈয়দ ও লোদি রাজবংশের শাসনে পরিচালিত হয় দিল্লি যেগুলো সামষ্টিকভাবে দিল্লি সালতানাত নামে পরিচিত। ৩২০ বছরে একমাত্র মহিলা সুলতানা ছিলেন সুলতানা রাজিয়া। মাত্র চার বছরের শাসনে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ক্ষমতাচ্যূত হয়েছিলেন, সুযোগ কাজে লাগিয়ে আবার ক্ষমতায় আরোহণ, বারবার যুদ্ধ, জয়, পরাজয় ও অবশেষে করুণ মৃত্যুর শিকার হয়েছিলেন।

১১৯২ খ্রিস্টাব্দে গজনীর সুলতান মুহাম্মদ ঘুরি তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বিরাজ চৌহানকে পরাজিত করার হিন্দুস্তানের পতন ঘটে এবং তিনি তার বিশ্বস্ত সেনাপতি কুতুবউদ্দীন আইবেককে দিল্লি নিয়ন্ত্রণের জন্য রেখে গজনিতে ফিরে যান। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে মাগরিবের নামাজ আদায়রত অবস্থায় সুলতান মুহাম্মদ ঘুরিকে হত্যা করে খাক্কাররা। অত্যাচারী হিন্দু খোকার উপজাতি পাঞ্জাবে প্রচুর হত্যা, লুটপাট ও নিযাতন করত এবং সুলতান মুহাম্মদ শিহাবউদ্দীন ঘুরি তাদের নির্মমভাবে দমন করে অত্যাচারিত মুসলমানদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এজন্য মুহাম্মদ ঘুরির প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল খাকাররা। তার মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য চার ভাগে বিভক্ত হয়ে চার গুরুত্বপূর্ণ সেনাপতি দায়িত্ব পান এবং দিল্লির ক্ষমতায় আরোহণ করেন সেনাপতি কুতুবউদ্দিন মুহাম্মদ আইবেক। লাহোরে ১২১০ সালে পোলো খেলার সময় ঘোড়ার পিঠ হতে পড়ে ইন্তেকাল করেন দিল্লি সালতানাতের প্রথম সুলতান কুতুবুদ্দীন আইবেক।

আইবেকের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন আরাম শাহ। কিন্তু রাজদরবারের অভিজাত আমলাদের কাউন্সিল ‘চিহালগানি’ আরাম শাহের উপর নাখোশ ছিল। তারা কুতুবউদ্দীন আইবেকের জামাতা সামশুদ্দিন ইলতুতমিশকে সিংহাসনে আরোহণ করার আহবান জানান। দিল্লির কাছে জুদ নামক এলাকায় ইলতুতমিশের বাহিনীর সাথে আরাম শাহের বাহিনীর যুদ্ধ হয়। আরাম শাহ পরাজিত হন, দিল্লির নতুন সুলতান হন ইলতুতমিশ। ১২১১ খ্রিস্টাব্দ হতে ১২৩৬ ‍খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লি শাসন করেন ইলতুতমিশ। তিনি জীবিত থাকা অবস্থাতেই বড় ছেলে মৃত্যুবরণ করেন। এজন্য পরবর্তী সন্তান সুলতানা রাজিয়াকে দিল্লি সালতানাতের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান তিনি এবং এজন্য যুদ্ধবিদ্যা, কূটনীতিসহ প্রয়োজনীয় বিষয়ে পারদর্শী করে তোলেন কন্যাকে।

১২৩৬ সালের এপ্রিলে দিল্লি সালতানাতের মুকুট পরে সিংহাসনে আসীন হন সুলতানা রাজিয়া। কিন্তু রাজদরবারের প্রভাবশালী কাউন্সিল ‘চিহালগানি’ মেনে নিতে পারে না সুলতানা রাজিয়াকে। পদচ্যূত হন রাজিয়া এবং তার সৎ ভাই রোকনুদ্দীন ফিরোজ ক্ষমতায় আসীন হন। কিন্তু রোকনুদ্দীন ছিলেন মদ্যপ ও নারী সংস্রবের জন্য লালায়িত। নর্তকী আর গায়িকাদের সান্নিধ্যই তার পছন্দ ছিল বেশি রাজদরবারের চেয়ে। ‘চিহালগানি’ আবার তাকে ক্ষমতাচ্যূত করে এবং মৃত্যুদণ্ড দেয়। সুযোগ কাজে লাগান সুলতানা রাজিয়া।

দিল্লির জনগণের সমর্থন নিয়ে আবারো ক্ষমতায় আসেন। চিহালগানির অভিজাত সদস্যরা তাকে পছন্দ না করলেও পরিস্থিতির চাপে এবার সমর্থন দিতে বাধ্য হয়। ক্ষমতায় এসে সুলতানা রাজিয়া চিহালগানি কাউন্সিলের ক্ষমতা হ্রাস করার চেষ্টা করেন। তবে সেটা বুমেরাং হয়ে যায়। রাজদরবারের সাথে আবারো বিরোধ বাঁধে সুলতানার। তার ব্যক্তিগত উপদেষ্টা সিদি জামালউদ্দীন ইয়াকুতের সাথে অবৈধ প্রণয় আছে বলে মিথ্যা রটিয়ে দেয়া হয়। রাজ্যজুড়ে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রশাসকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। লাহোরের গভর্নর বিদ্রোহ ঘোষণা করলে শক্তভাবে দমন করেন সুলতানা। এরপর বাথিন্দার গভর্নর ইখতিয়ারুদ্দিন আলতুনিয়া বিদ্রোহ করেন ও তার প্ররোচনায় প্রায় সকল প্রদেশের শাসকরা বিদ্রোহ করে বসে এবং প্রধান কাজীর শরণাপন্ন হয়। কাজী সুলতানা রাজিয়াকে পদচ্যূত করেন।

এবার ক্ষমতা ন্যস্ত হয় ইখতিয়ারুদ্দিন আলতুনিয়ার ওপর। সুলতানা রাজিয়া ক্ষমতাচ্যূত হয়ে পর্দার আড়ালে চলে গেলেও সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। গোপনে শক্তি সঞ্চয় করে তিনি আলতুনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু সুলতানা পরাজিত হন। তার সেনাপতি সিদি জামালউদ্দীন ইয়াকুত নিহত হন, তিনি বন্দী হন। মৃত্যুই ছিল তার শাস্তি। তবে কূটনীতি প্রয়োগ করেন সুলতানা। ইখতিয়ারুদ্দিন আলতুনিয়াকে তিনি বিয়ের প্রস্তাব দেন এবং যথারীতি বিয়ে হয়। কয়েক মাস পরেই আবার চিহালগানি আলতুনিয়াকে ক্ষমতাচ্যূত করে ক্ষমতায় বসায় রাজিয়ার ভাই মুয়িজুদ্দিন বাহরাম শাহকে। কয়েক বছর নীরবে শক্তি সঞ্চয় করেন আলতুনিয়া ও সুলতানা রাজিয়া। তাদের সম্মিলিত শক্তি ১২৪০ সালে একযোগে হামলে পড়ে মুয়িজুদ্দিনের বিরুদ্ধে। কিন্তু ভাইয়ের রাজকীয় বাহিনীর কাছে দুজনেই চরমভাবে পরাজিত হন। এরপর উত্তর ভারতে পালিয়ে যান সুলতানা।

শক্তি সঞ্চয় করে হরিয়ানা রাজ্যের কাইঠালে আবারো দিল্লির সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার পিছু ছাড়ে না। এবারো পরাজিত হন। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় এক কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় প্রার্থী হন। কৃষকের ঘরে যখন ঘুমিয়ে পড়েন তখন তার শরীরের মূল্যবান রত্ন, অলঙ্কার দেখে লোভে পেয়ে বসে কৃষককে। মূল্যবান রত্নের লোভে ঘুমন্ত সুলতানাকে হত্যা করেন কৃষক। আর এভাবেই শেষ হয় দিল্লি সালতানাতের একমাত্র সুলতানার জীবন উপাখ্যান।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us