বিভেদের রাজনীতি ও বাস্তবতা

হারুন জামিল | Apr 13, 2021 01:15 pm
বিভেদের রাজনীতি ও বাস্তবতা

বিভেদের রাজনীতি ও বাস্তবতা - ছবি : সংগৃহীত

 

বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভক্তি পুরনো। এদেশের মানুষের মানসিকতা এবং চিন্তাধারা দু’শিবিরে ভাগ হয়ে আছে। একভাগে আছে সম্প্রসারণবাদী শক্তির ঘোর বিরোধিতা আর অন্যভাগে আছে আপসকামিতা। রাজনৈতিক শক্তির এই বিভক্তি গোটা সমাজব্যবস্থার ওপর এমন প্রভাব ফেলেছে যা আমাদের চিরায়ত দর্শন, সংস্কৃতি, ইতিহাসকে আচ্ছন্ন করে আছে। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রতিটি মানুষের সহজাত। এ জন্য যে চেতনা সে ধারণ করে তা শিখিয়ে দেয়ার কোনো বিষয় নয়। এটি মৌলিক মানবীয় বৈশিষ্ট্য। মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। সে চিন্তা করতে চায় তার নিজের মতো। প্রত্যেক মানুষের চিন্তাশীলতা, সৃজনশীল শক্তি নিজের মতো হয়। বিচিত্র এই পটভূমিতেই সমাজ রাষ্ট্র কাঠামো টিকে থাকে। মানুষ এগিয়ে যায়। যে যূথবদ্ধ সমাজে আমরা বাস করি বৈচিত্র্য সত্ত্বেও দেশপ্রেম, দেশাত্মবোধ, নাগরিক কর্তব্য এসব একই রকম হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখি? একই ভাষার মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের চেতনা নিয়ে এখন প্রশ্ন ওঠে। যে প্রশ্নের নিষ্পত্তি কঠিন। কোনো সমাজ কিংবা রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে বিভাজন রেখা তৈরি হলে- মতপার্থক্য যুক্তির সীমা অতিক্রম করলে সেখানে হিংসার জন্ম হয়। এই হিংসা কিংবা ক্রোধ থেকে তৈরি হওয়া বিভাজন দূর করা যায় না। একবিংশ শতকে সভ্য সমাজে এসে আমরা বিভাজনের এই কঠিন এবং দুরতিক্রম্য পরিস্থিতির মুখে এসে দাঁড়িয়েছি।

দেশে রাজনৈতিক দল আছে। বাস্তবে কোনো রাজনীতি নেই। সরকার উন্নয়নের দিকে যতটা মনোযোগী রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক বিস্তারে ততটা নেই। সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংসদ একটি রাষ্ট্রের সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশেও একটি সংসদ আছে। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার আছে। সংবিধানসম্মতভাবে প্রতি দু’মাস অন্তর সংসদের অধিবেশন বসে। সেখানে আইন পাস হয়। আইন প্রণেতারা যান। কিন্তু ক’জন সেসব খবর রাখেন? গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় স্তম্ভ সংসদ। সেখানে চর্চা হবে গণতন্ত্র নিয়ে। মানুষের অধিকার, সঙ্কট নিয়ে। আইনের বিধান নিয়ে আলোচনা হবে। এটাই রীতি। এটাই আমরা যুগ যুগ ধরে দেখে আসছি। প্রাণবন্তু সেসব আলোচনায় ফুটে উঠবে রাষ্ট্রের চিত্র। কিন্তু তা কতটা হচ্ছে? রাজনৈতিক দলগুলোর ভারসাম্যমূলক প্রতিনিধিত্বের অভাবে সংসদ এখন কার্যত আকর্ষণহীন হয়ে পড়েছে। এই সংসদের প্রতি মানুষের নজর খুবই কম। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো টিকে থাকে হাজারো মতের সম্মিলনে। একটি সমাজে মতের পার্থক্য থাকবেই। একই সাথে থাকবে শ্রদ্ধাবোধ ও সম্মানবোধ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি এখন বিদায় নিতে চলেছে। এখন এমন প্রচারণা দেখা যায় যে এই দেশটির যেন কোনো অতীত নেই। এর সবটাই যেন বর্তমান। এই দেশের স্বাধীনতা এর অতীত ইতিহাস আমাদের পূর্বপুরুষদের আত্মত্যাগের গৌরবদীপ্ত কাহিনী আছে। কিন্তু এসব নিয়ে এখন আর তেমন আলোচনা হয় না। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে থাকে বহু মানুষের গৌরবগাথা। সেসব গৌরবের কাহিনী শুনেই জাতীয় চেতনার জন্ম হয়। ঘুমন্ত জাতি জেগে ওঠে সেসব গৌরবের কাহিনী শুনে। ইতিহাস বড্ড নির্মোহ। সে আপন গতিপথ রচনা করে নিজের মতো করে। কেউ সেখানে জোর করে কিছু চাপাতে চাইলে হয় না।

মার্চ মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হলো। বাংলাদেশ তার জন্মের ৫০ বছর অতিক্রম করেছে। এ রাষ্ট্রের জন্মের সাথে যাদের ত্যাগ জড়িয়ে আছে তাদের অনেকেই এখন বেঁচে নেই। যারা এখনো আছেন তাদের অনেককেই দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখি। যে শোষণমুক্ত সাম্যের চেতনা নিয়ে মাতৃভূমিকে মুক্ত করেছিলেন মুক্তিপাগল বাঙালি তাদের সে চেতনা আজ কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে? এ এক বিরাট প্রশ্ন। সন্দেহ নেই যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রনির্ঘোষ ঘোষণায় এদেশের মানুষ স্বাধীনতার চেতনা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ইতিহাস সৃষ্টির আগেও বাঙালির বঞ্চনার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। আওয়ামী লীগ এদেশের মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার যে মূলমন্ত্র তৈরি করেছিল তা ছিল স্বাভাবিক পরিণতি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকেই এক রাষ্ট্র কাঠামোর চেতনা ক্ষয়ে গিয়েছিল। যা স্বাধীন বাংলাদেশকে অনিবার্য করে তোলে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর মহানায়ক ছিলেন। তাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কল্পনাও করা যায় না। বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করতে হবে স্বাধীনতার স্থপতি ও মহানায়ক হিসেবে। কেউ স্বীকার করুক আর নাই করুক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস আর বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস অভিন্ন। কিন্তু সমস্যা হলো, সাফল্যের ইতিহাসের অংশীদার সবাই হতে চায়। ব্যর্থতার দায় কেউ নিতে চায় না। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকে সার্বজনীন মূল্যায়নের ধারায় না গিয়ে এই মহান ব্যক্তিত্বকে যখনই গণ্ডিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছে তখনই সমস্যা তৈরি হয়েছে। এই তালগোল পাকানোর চর্চা এখনো চলছে।

সময় বদলে গেছে। পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের মিতালি ছিল মাত্র ২৩ বছর। এখন এদেশের বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। এখন আর অতীত নিয়ে চর্চার সময় নেই। ৫০ বছর বয়সী প্রজন্মের যারা তারাও এখন প্রবীণ হওয়ার পথে। পূর্ববর্তী প্রজন্ম প্রবীণ। ইতিহাসের যারা প্রত্যক্ষদর্শী তাদের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। এমন একটি সমাজে বিভেদের ভেদ রেখা থাকবে কেন? কিন্তু বাস্তবতা হলো বিভেদের ভেদরেখা এখনো বিদ্যমান।

দেশে রাজনৈতিক দল অনেকগুলো থাকলেও মূলত এর দুটি ধারা। একটির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। আরেকটি বিএনপির নেতৃত্বাধীন। ভিন্ন ধারা যা আছে শেষ বিচারে তারা একে অপরের সহযাত্রী। আওয়ামী লীগ ১২ বছর ধরে দেশ পরিচালনা করছে। সঙ্গত কারণেই তাদের আত্মবিশ্বাস মনোভঙ্গি দৃঢ়তা এখন তুঙ্গে। দেশ পরিচালনায় তারা দীর্ঘ সময় থাকলেও তাদের রাজনীতির অভ্যন্তরীণ শক্তি ক্ষয়ে যাচ্ছে বলেই মনে হয়। এর বড় কারণ একটি দল দীর্ঘ সময় দেশ পরিচালনা করলে তাদের মধ্যে অহমিকার জন্ম হয়। তারা নিজের ভুল ধরতে পারে না। নিজের ভুল বুঝতে হলে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন প্রতিপক্ষকে আমন্ত্রণ জানানো। কিন্তু দীর্ঘ দিনেও এদেশে সে সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। এছাড়া কথায় কথায় রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ অন্যের প্রতি হিংসার যে মনোভাব প্রকাশ করেন তা থেকে প্রতিহিংসার জন্ম হয়। সহনশীলতা তৈরি হয় না। সহনশীল পরিবেশ না থাকলে সেখানে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা হয় না। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে এবং ভবিষ্যতে হয়তো আরো হবে। কিন্তু কাঠামোগত এই ত্রুটি রেখে সে অগ্রসরতা টেকসই হবে না।

সন্দেহ নেই বিএনপি এদেশের বড় রাজনৈতিক দল। জনগণের মধ্যে দলটির রয়েছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। স্বভাবগত দিক থেকে তারা কখনোই উগ্র নয়। বিএনপি একটি উদারনৈতিক রাজনৈতিক দল। অনেকে একে একটি ফোরাম বলেও তাচ্ছিল্য করেন। বিএনপির নেতাকর্মীরা মারমুখী কিংবা পোড় খেয়ে পোক্ত ছিলেন না। কিন্তু সময়ের পালাবদলে দলটির নেতাকর্মীরাই এখন অনেক পোক্ত হয়েছেন।

বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়ে দলটির নেতাকর্মীরা এখন অনেক পরিপক্বতা অর্জন করেছেন। এমন এক প্রেক্ষাপটে তাদেরকে শুধুমাত্র কথার মার দিয়ে দমিয়ে রাখার কৌশল খুব একটা কাজে আসবে বলে মনে হয় না। যেভাবেই বিএনপির সৃষ্টি হোক না কেন প্রেক্ষাপট ছিল বলেই বিএনপি আজো টিকে আছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কার্যত এখনো বন্দী। শর্তসাপেক্ষে তার কারাদ- স্থগিত হলেও তিনি মুক্ত নন।

বিশাল এই দলের নেতাকর্মীদের বিপুল সংখ্যক মামলা মোকদ্দমায় জর্জরিত। এক যুগের বেশি ক্ষমতার বাইরে থেকে তাদের মধ্যেও তৈরি হয়েছে ভিন্ন মনোভাব। এদেশে জাতীয়তাবাদী চেতনা হিসেবে যে ধারাটি বিদ্যমান বিএনপি সে ধারার ঐক্যের প্রতীক। বেগম খালেদা জিয়া কিংবা বিএনপির এই চেতনার ধারাকে খাটো করে দেখার কোনো উপায় নেই। জেল জুলুম মামলা মোকদ্দমায় জর্জরিত হয়েও দলটির নেতাকর্মীরা এখনো টিকে আছেন। রাজনৈতিক চেতনার দিক থেকে দৃঢ়তা না থাকলে সেটা সম্ভব হতো না। নেতৃত্বের দিক থেকে বিএনপি এখন পিছিয়ে আছে। নবীন প্রবীণের মিশেলে বিএনপি এতকাল একটি অজেয় শক্তি হিসেবেই কাজ করেছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দূরদৃষ্টি এখানেই যে তিনি আওয়ামী লীগের বিপরীত স্রোতের এমন একটি দল তৈরি করেছিলেন যা এদেশের বিপুল মানুষ গ্রহণ করেছিল। সময়ের চাহিদা পূরণে সবাইকে নিয়ে চলার এবং জাতিকে একতাবদ্ধ করতে এই সিদ্ধান্তের কোনো বিকল্প ছিল না। এখন যারা এটিকে নেতিবাচকভাবে দেখেন তাদের অনেকেই এককালে এর প্রশংসা করেছেন। রাজনীতি বড় বিচিত্র। তাদের অনেককেই আবার এখন এসবের সমালোচনায় মুখর হতে দেখি। বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতার যে চিত্র এর অভ্যন্তরীণ যে শক্তি তাকে বিকশিত করতে হলে অতীতাশ্রয়ী রাজনীতির অবসান ঘটাতে হবে। ইতিহাসে যার যতটুকু প্রাপ্য তা দিতে হবে। কাউকে খাটো করে কাউকে বড় করা যাবে না। বেগম খালেদা জিয়া গণমানুষের কাছে জনপ্রিয়। জনগণের কাছে তিনি তার রাজনীতি তুলে ধরতে পারলে তাতে ক্ষতি নেই। বরং তা বাংলাদেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ রাজনীতির যে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলবে তাতে লাভবান হবে সবাই।

এ লেখা যখন পাঠকের হাতে পৌঁছাবে তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীরা তাদের সফর শেষ করে নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছেন। বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির প্রশংসা করে তারা বক্তব্য রেখেছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বগুণের প্রশংসা করে তারা বলেছেন, বাংলাদেশ সফলভাবে এগিয়ে যাবে। এসবই আশার কথা। আমরা খুবই খুশি হই প্রতিবেশী দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের কাছ থেকে এসব কথা শুনে। দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই উৎসব রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে। এটাও আনন্দের। কিন্তু এই আনন্দ আরো সুন্দর হতো যদি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো একসাথে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে পারতেন। দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। তারা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে ভিন্নভাবে। সেখানেও আওয়ামী লীগ কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে নেই কোনো অংশগ্রহণের ছোঁয়া।

বিস্ময়কর হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটাই বাস্তবতা। যে সাম্য ঐক্যের চেতনায় ১৯৭১ সালে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল সে ঐক্য আজো অধরাই রয়ে গেছে। বিভাজনের এই ভেদরেখা থেকে কবে মুক্তি মিলবে বা আদৌ মিলবে কিনা কে জানে!


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us