ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেভাবে শাসক হয়ে ওঠে

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু | Apr 15, 2021 02:53 pm
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেভাবে শাসক হয়ে ওঠে

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেভাবে শাসক হয়ে ওঠে - ছবি : সংগৃহীত

 

(গত সংখ্যার পর)

যদিও ইস্ট ইন্ডিয় কোম্পানির সব বাণিজ্যিক পুঁজি স্থায়ীভাবে ব্রিটিশ রাষ্ট্রকে তার প্রয়োজনে ঋণ হিসেবে দেয়ার এখতিয়ার দেয়া হয়েছিল, কিন্তু কোম্পানি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারের সাথে সম্পর্ক আইনানুগভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাখত। কোম্পানি জোরের সাথে এবং সফলভাবে যুক্তি প্রদর্শন করেছে যে, ১৭৬৫ সালে শাহ আলম কর্তৃক স্বাক্ষরিত দলিল, যা দিওয়ানি নামে পরিচিত- সেটিই কোম্পানির বৈধ সম্পত্তি, রাজমুকুট নয়, যদিও ব্রিটিশ সরকার ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আহরিত ভূখণ্ড ও সম্পদ রক্ষার জন্য নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছিল। কিন্তু যেসব পার্লামেন্ট সদস্য এই আইনগত অবস্থান বহাল রাখার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, তারা আসলে নিরপেক্ষ ছিলেন না- তাদের প্রায় এক চতুর্থাংশের কাছে কোম্পানির শেয়ার ছিল, রাজার পক্ষ থেকে যেগুলো কিনে নেয়া হলে শেয়ার মূল্য বহু গুণ বৃদ্ধি পেতে পারত। একই কারণে বিদেশী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে কোম্পানিকে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তাই ব্রিটিশ বৈদেশিক নীতির প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়।

চিত্রে লেনদেনের যে দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, অনিবার্যভাবে সেটির বিপর্যয়কর পরিণতি হওয়ার কথা। সব করপোরেশনের বেলায় এখন যা ঘটে, তখনো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষেত্রেও তাই ছিল, অর্থাৎ শেয়ার হোল্ডারদের কাছে তাদের জবাব দিতে হতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দখলকৃত এলাকায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার কোনো দায় গ্রহণ না করে অথবা দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণ সাধনের কোনো উদ্যোগ না নিলেও কোম্পানির শাসন খুব দ্রুত বাংলাকে সোজা অবাধ লুণ্ঠনের ক্ষেত্রে রূপান্তরিত এবং লুণ্ঠিত সম্পদ দ্রুততার সাথে পশ্চিমের দিকে স্থানান্তর শুরু করে।

দীর্ঘ দিন থেকেই বেঙ্গল ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং ১৭৬৯ সালের দুর্ভিক্ষের কারণে চরম বিপর্যস্ত অবস্থায় নিপতিত ছিল; তার ওপর উচ্চহারে কর আরোপের ফলে বেঙ্গলের সার্বিক পরিস্থিতি শোচনীয় হয়ে উঠেছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির খাজনা আদায়কারীদের জবরদস্তিমূলক খাজনা আদায়ের প্রক্রিয়াকে বর্তমানে অবশ্যম্ভাবীভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে বর্ণনা করা হয়। বেঙ্গলের সম্পদ দ্রুত নিঃশেষিত হয়ে ইংল্যান্ডে চলে যায়; তাঁতি ও কারিগরদের তাদের নতুন প্রভুরা আরো অনেক দাসের মতো বলপূর্বক দাসে পরিণত করে। বেঙ্গল থেকে লুণ্ঠিত সম্পদের বেশির ভাগ সরাসরি যেত ক্লাইভের পকেটে। তিনি ব্রিটেনে ফিরে আসেন তার বিপুল ব্যক্তিগত সম্পদ নিয়ে, ওই সময়ে যার মূল্য ছিল দুই লাখ ৩৪ হাজার পাউন্ড স্টার্লিং, যা তাকে একককভাবে ইউরোপের সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত করেছিল। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর যে বিজয়ের পেছনে যুদ্ধকৌশল ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো ছিল ষড়যন্ত্র, ভুয়া চুক্তি, মহাজন ও ঘুষ। বেঙ্গলের পরাজিত শাসকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোষাগারে যে পরিমাণ সম্পদ হস্তান্তর করেছিলেন তার পরিমাণ কিছুতেই ২৫ লাখ পাউন্ড স্টর্লিংয়ের কম হবে না- যা ওই সময়ের বিচারে অবিশ্বাস্য পরিমাণের অর্থ ছিল। এ নিয়ে কোনো বড় বিতর্কের প্রয়োজন পড়ে না। বাংলার কোষাগারের সমুদয় সম্পদ একশ’টি নৌকায় বোঝাই করে মুর্শিদাবাদে বাংলার নওয়াবের প্রাসাদ থেকে গঙ্গা নদীর ভাটির দিকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায় কোম্পানির সদর দফতর ফোর্ট উইলিয়ামে। এর একটি অংশ পরবর্তীতে পোইস ক্যাসেল পুনর্নির্মাণের জন্য ব্যয় করা হয়।

পোইস এ ক্লাইভ ও শাহ আলমের চিত্রটিকে রহস্যময়ভাবে প্রতারণামূলক বলে মনে হয়। শিল্পী বেঞ্জামিন ওয়েস্ট কখনো ভারতে যাননি। এমনকি এক সময় একজন চিত্র সমালোচক উল্লেখ করেছেন যে, চিত্রের পটভূমিতে একটি মসজিদের গম্বুজকে ‘আমাদের পবিত্র সেন্ট পলের গম্বুজের’ সাথে সন্দেহজনকভাবে অত্যন্ত জোরালো সাদৃশ্যময় হিসেবে দেখানো হয়েছে। বাস্তবে কোনো জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি। অত্যন্ত একান্তে, ক্লাইভের তাঁবুর ভেতরে হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, যে তাঁবুটি টানানো হয়েছিল কোম্পানির সদ্য দখল করা এলাহাবাদে অবস্থিত মোগল দুর্গের কুচকাওয়াজের মাঠে। শাহ আলম যে রেশমি সিংহাসনে উপবেশন করেছেন, বাস্তবে সেটি ছিল ক্লাইভের হাতলওয়ালা চেয়ার, যেটি এ অনুষ্ঠান উপলক্ষে ফুলশোভিত একটি চাদরে ঢাকা ক্লাইভের ডাইনিং টেবিলের ওপর স্থাপন করা হয়েছিল।

পরবর্তীতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এই দলিলকে ‘এলাহাবাদের চুক্তি’ নামে মর্যাদা দান করে, যদিও চুক্তির শর্তগুলো নির্দেশ করেছেন খোদ ক্লাইভ এবং ভীতসন্ত্রস্ত্র শাহ আলম শর্তগুলোতে শুধু তার সম্মতি দান করেছেন। সমসাময়িক মোগল ইতিহাসবিদ গোলাম হুসাইন খান লিখেছেন, ‘এত বড় আকারের একটি ব্যবসার ক্ষেত্রে অন্য যেকোনো সময়ে বিচক্ষণ দূত ও যোগ্য মধ্যস্থকারী প্রেরণ এবং বহু আলাপ-আলোচনা ও উজিরদের সাথে শলাপরামর্শের প্রয়োজন হতে পারত, তা একটি গর্দভ বা ভারবাহী পশু কিংবা একটি গরুর মাথা বিক্রয়ের জন্য সাধারণত যে সময় লাগে তার চেয়েও কম সময়ে তা সম্পন্ন করা হয়েছে।’
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দীর্ঘকাল থেকেই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে ছিল। যে বাণিজ্য রোমান যুগ থেকে পাশ্চাত্য থেকে প্রাচ্যমুখী ছিল কোম্পানি তা প্রায় এককভাবে বাণিজ্যের ভারসাম্য ঘুরিয়ে তাদের অনুকূলে নিয়ে আসে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আফিমের বাণিজ্য নিয়ে যায় চীনে এবং পর্যায়ক্রমে ‘আফিম যুদ্ধ’ লড়ে হংকং এ তাদের ঘাঁটি গড়ে তোলে এবং তাদের লাভজনক মাদক বাণিজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। তারা চীনে উৎপাদিত চা পশ্চিম দিকে পরিবহন করে নিয়ে যায় ম্যাসাচুসেটসে, যেখানে বোস্টন বন্দরে চা এর স্তূপ গড়ে ওঠে এবং আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধেও এই বাণিজ্য বড় ভূমিকা রাখে। আমেরিকান দেশপ্রেমিকদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ভীতি কাজ করেছে যে, যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে পার্লামেন্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে আমেরিকায় লুণ্ঠন পরিচালনার জন্য লেলিয়ে দেবে, যা তারা ভারতের ক্ষেত্রে করেছে। ১৭৭৩ সালে দেশপ্রেমিক জনডিকিনসন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চা কে ‘অভিশপ্ত আবর্জনা’ বলে বর্ণনা করেছেন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে এই বলে তুলনা করেছেন যে, কোম্পানির সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ কর্তৃপক্ষ আমেরিকাকে ‘ইঁদুরের মতো গ্রাস’ করবে। তিনি আরো বলেন, ‘প্রায় দেউলিয়া হয়ে পড়া এই কোম্পানিটি বেঙ্গলে নজিরবিহীন বর্বরতা, চাঁদাবাজি চালিয়ে একচেটিয়া দখল কায়েম করেছে এবং এখন তারা আমেরিকার দিকে তাদের দৃষ্টি ফেলেছে তাদের ‘ধ্বংসাত্মক মেধা, নিপীড়ন ও নিষ্ঠুরতা প্রয়োগের নতুন একটি ক্ষেত্র হিসেবে।

ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি যখন ১৮০৩ সালের মধ্যে মোগল রাজধানী দিল্লি দখল করে এবং এখানে বিধ্বস্ত প্রাসাদে দৃষ্টিহীন সম্রাট শাহ আলমের অন্ধত্বের সুযোগ নিয়ে কোম্পানি প্রায় দুই লাখ বেসরকারি নিরাপত্তা রক্ষীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করে, যে সংখ্যা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর আকারের চেয়ে দ্বিগুণ এবং তারা এশিয়ায় অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে অধিক আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ওঠে।

ইউরোপের প্রান্তসীমায় প্রত্যন্ত এক দ্বীপের কিছু সংখ্যক লোক এখন সমগ্র উত্তর ভারতের রাজ্যগুলোর ওপর শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে, যা পশ্চিমে দিল্লি থেকে পূর্বদিকে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রায় সমগ্র পূর্ব উপকূল কোম্পানির হাতে ছিল এবং একই সাথে গুজরাট থেকে কেপ ক্যামেরুন পর্যন্ত কৌশলগত সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর ওপরও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। চল্লিশ বছরের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে তারা নিজেদের প্রায় সমগ্র উপমহাদেশের প্রভুতে পরিণত করে, যে এলাকার জনসংখ্যা ছিল পাঁচ থেকে ছয় কোটি এবং তারা এত বিশাল এক সা¤্রাজ্য হাতে পেয়েছিল, যেখানে অত্যন্ত ছোট প্রাদেশিক নওয়াব ও গভর্নররা বড় বড় এলাকা শাসন করতেন, যে এলাকাগুলো আকার ও জনসংখ্যায় ইউরোপের বৃহৎ দেশগুলোর চেয়েও বড় ছিল।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন ডাইরেক্টরের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, ‘কোম্পানি প্রাচ্যের যেকোনো স্থানে যুদ্ধ বা শান্তি প্রতিষ্ঠা করার ক্ষমতাসম্পন্ন সাম্রাজ্যের মধ্যে এক সাম্রাজ্য।’ কোম্পানি এই পর্যায়ে একটি ব্যাপকভিত্তিক ও সেই যুগের জন্য অত্যাধুনিক প্রশাসন ও সিভিল সার্ভিস সৃষ্টি করে, লন্ডনের বন্দর ও আশপাশের আবাসিক এলাকার অনুরূপ স্থাপনা সুবিধা তৈরি করে এবং এসব স্থান থেকে ব্রিটেনের প্রায় অর্ধেক বাণিজ্য পরিচালনা করে। বিস্ময়ের কিছু নেই যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ সময় নিজেদের বিশ্বের সেরা বণিক সমাজ হিসেবে উল্লেখ করতে শুরু করে।

অনেকটা সাম্প্রতিককালের বৃহদাকার করপোরেশনগুলোর মতোই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেদের হঠাৎ করেই বিপুল ক্ষমতার অধিকারী করে তোলার পাশাপাশি অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার নাজুক পরিস্থিতি মোকাবেলার আশঙ্কা থেকে মুক্ত ছিল না। দিওয়ানি প্রদানের মাত্র সাত বছর পর, বিশেষ করে বেঙ্গলের কোষাগারের সম্পদ আহরণের পর কোম্পানির শেয়ার মূল্য রাতারাতি দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল, ঠিক তখনই বেঙ্গলকে লুণ্ঠন ও দুর্ভিক্ষের কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্ফিত বেলুন ফেটে যায় এবং কাক্সিক্ষত ভূমি রাজস্বে বিপুল পরিমাণে ঘাটতি পড়ে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেনার পরিমাণ বেড়ে ১৫ লাখ পাউন্ড স্টর্লিংয়ে ওঠে এবং ইংল্যান্ডের রাজার কাছে অপরিশোধিত করের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ লাখ পাউন্ড স্টার্লিং। এ ঘটনা যখন ব্রিটেনে জানাজানি হয়, তখন ইউরোপজুড়ে প্রচলিত ডোমিনোজ খেলার ঘরের মতো ত্রিশটি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ে।

একটি দৃশ্য, যা এখনকার দৃশ্যের মতোই ভয়ঙ্কর বলে মনে হয়, তা হলো এই করপোরেশনগুলো নিজেদের স্বচ্ছ প্রমাণ করে এবং তারা তাদেরকে উদ্ধারের জন্য সরকারের দ্বারস্থ হয়। ১৭৭২ সালের ১৫ জুলাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডাইরেক্টররা ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের কাছে চার লাখ পাউণ্ড স্টার্লিং ঋণের জন্য আবেদন করেন। পনের দিবস পর তারা পুনরায় ব্যাংকে যান এবং অতিরিক্ত তিন লাখ পাউন্ড স্টার্লিং ঋণের আবেদন জানান। ঋণ দেয়ার জন্য ব্যাংক মাত্র দুই লাখ পাউ- স্টার্লিং জড়ো করতে সক্ষম হয়। আগস্ট মাসের মধ্যে ডাইরেক্টররা সরকারের সাথে দেন-দরবার শুরু করেন যে, প্রকৃতপক্ষে তাদের অতিরিক্ত ১০ লাখ পাউন্ড স্টার্লিং প্রয়োজন, যা পরিমাণের দিক থেকে নজীরবিহীন। এডমন্ড বার্কের পরের বছরের রিপোর্ট অনুযায়ী, তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অর্থনৈতিক সঙ্কটের উল্লেখ করে আভাস দেন যে, ‘কোম্পানির এ সঙ্কট আটা-পেষার চাকির মতো সরকারকে অতল রসাতলে টেনে নিয়ে যেতে পারেÑ এই অভিশপ্ত কোম্পানি শেষ পর্যন্ত বিষাক্ত সাপের মতো দেশের ধ্বংস সাধন করবে, যা তারা তাদের বুকে ধারণ করে রেখেছে।’

কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এত বিরাট একটি কাঠামো ছিল, যা সহজে ব্যর্থ হওয়ার মতো নয়। অতএব পরের বছর, অর্থাৎ ১৭৭৩ সালে বিশ্বের প্রথম আগ্রাসী বহুজাতিক করপোরেশনকে ইতিহাসে সর্বপ্রথম ব্যাপকভিত্তিক সহযোগিতার মাধ্যমে উদ্ধার করা হয় - এটি ছিল কোনো জাতিরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ধ্বংসের মুখে উপনীত একটি করপোরেশনকে রক্ষার প্রথম দৃষ্টান্ত এবং এর বিনিময়ে রাষ্ট্র সেই করপোরেশন থেকে শুধু আহরণ করেছে এবং সেটিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার গ্রহণ করেছে। এভাবেই লন্ডনভিত্তিক একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বিশাল উপমহাদেশে ১৭৫৬ সাল থেকে ১৮০৩ সালের মধ্যে নিজেদেরকে প্রচণ্ড ক্ষমতাধর মোগল সা¤্রাজের অধিশ্বর হিসেবে স্থলাভিষিক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে কোম্পানি কীভাবে তার প্রধান প্রতিপক্ষ- বেঙ্গল ও অযোধ্যার নওয়াবদেরকে, টিপু সুলতানের মহীশূর সালতানাত ও বিশাল মারাঠা কনফেডারেসিকে পরাস্ত করে সম্রাট শাহ আলমকে কোম্পানির পক্ষপুটে নিতে সক্ষম হয়েছিল। শাহ আলমের অদৃষ্টে ছিল তার জীবনের পঞ্চাশ বছর ধরে ভারতের ওপর কোম্পানির একটির পর একটি হামলা এবং একটি সাধারণ বাণিজ্যিক কোম্পানি থেকে পরিপূর্ণ রাজ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠা প্রত্যক্ষ করা। বাস্তবিক পক্ষে শাহ আলমের জীবনকালকে এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা বিবরণীর মেরুদন্ড বলা যেতে পারে।

বর্তমানে এটি প্রতিষ্ঠিত দৃষ্টিভঙ্গি যে, আগের প্রজন্মের ইতিহাসবিদরা অষ্টাদশ শতাব্দী ভারতের ‘অন্ধকার যুগ’ ছিল বলে যে বর্ণনা করেছেন, প্রকৃত অবস্থা বরং তার বিপরীত ছিল। মোগল সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অবক্ষয়ের ফলে বরং উপমহাদেশের অন্যান্য অংশে অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের সূচনা হয়েছিল এবং সাম্প্রতিক অনেক গবেষণায় আমাদের এ সম্পর্কিত ধারণা আরো গভীর হয়েছে। আঞ্চলিকভাবে অর্থনৈতিক পুনরুত্থানের সকল জ্ঞানগর্ভ গবেষণায় যে তখনকার বিদ্যমান অরাজক পরিস্থিতির বাস্তবতাকে তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে তা নয়, যে অরাজকতা অষ্টাদশ শতাব্দীর অধিকাংশ সময়জুড়ে মোগল সা¤্রাজ্যের ক্ষমতার কেন্দ্রভূমি, বিশেষ করে দিল্লি ও আগ্রার চারপাশের এলাকাগুলোকে নিঃসন্দেহে বিক্ষিপ্ত করে ফেলেছিল। ফকির খায়ের উদ্দিন এলাহাবাদী লিখেছেন, ‘বিশৃঙ্খলা ও দুর্নীতি আর রাখঢাক করে রাখার মতো ব্যাপার ছিল না এবং ভারতের শান্তিপূর্ণ রাজত্ব পরিণত হয়েছিল নৈরাজ্যের আবাসে (দর আল-আমান-ই হিন্দুস্থান দর আল-ফিতান গাশত)। এক সময় মোগল রাজত্বের প্রকৃত সারবত্তা বলে আর কিছু ছিল না, এর অস্তিত্ব ছিল শুধু নামেমাত্র অথবা শুধু ছায়া।’

নৈরাজ্যের বাস্তবতা শুধু যে বিচ্ছিন্নভাবে ফকির খায়ের উদ্দিন ও গোলাম হুসাইন খানের মতো কয়েকজন মোগল ভদ্রলোকই লিপিবদ্ধ করে গেছেন তা নয়, ওই যুগের ভারতে আগত প্রতিটি পর্যটক তা তুলে ধরেছেন এবং আমার বিশ্বাস, তখন সংশোধনবাদ হয়তো বেশ এগিয়ে গিয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ভারতে ফরাসি ভাগ্যান্বেষী জিন ল’ এবং মোদেভ থেকে শুরু করে পোলিয়ার ও ফ্র্যাঙ্কলিন পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেক প্রত্যক্ষদর্শীর ভারত সম্পর্কিত মন্তব্যে বার বার ওই সময়ে সীমাহীন রক্তক্ষয় ও বিশৃঙ্খলা এবং ভারী সশস্ত্র প্রহরা ছাড়া দেশের অধিকাংশ স্থানে নিরাপদে চলাফেরা করা কঠিন ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এসব প্রত্যক্ষদর্শীই সর্বপ্রথম ভারতে মহা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বজায় থাকার ঘটনার বিবরণ সর্বসমক্ষে এনেছেন।

১৭৫০-এর দশক থেকে ১৭৭০-এর দশকের মধ্যে বহু যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অংশগ্রহণ এবং বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যাকে ব্যাপক লুণ্ঠনের ফলে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল সেজন্য দায়ী ছিল এই অভিশপ্ত কোম্পানি। তাদের সহিংসতা ক্রমে ছড়িয়ে পড়েছিল দিল্লিসহ সমগ্র উত্তর ভারতে এবং দাক্ষিণাত্যের দূরবর্তী সব এলাকায়।

ওই সময়ের ভঙ্গুর, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এবং অতি সহিংস সামরিক ইতিহাস এবং এক ধরনের নতুন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে দীর্ঘস্থায়িত্ব দেয়ার যে উদ্যোগকে মহিমান্বিত রূপ দেয়ার জন্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা যথাসাধ্য চেষ্টা করলেও জনগণের ওপর যে নিপীড়ণ চালানো হয়েছে বার বার তার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ জনগণ বিদ্রোহ করেছে এবং বিদ্রোহের ধারাবাহিকতায় ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ঘটে মহাবিদ্রোহ, যা ইতিহাসে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু সে বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করা হয়ে। তাতেও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা শেষ হয়ে যায়নি। তারা নিরন্তর সংগ্রাম করেছে এবং সে সংগ্রামের সফল বাস্তবায়ন ঘটেছে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us