সংসার

ফাবিহা ফেরদৌস | Apr 23, 2021 03:37 pm
সংসার

সংসার - ছবি : অন্য দিগন্ত

 

শাড়িটা পছন্দ না হওয়ায় বিছানার এক কোণে ফেলে রেখে দিই। আদিব খেয়াল করল কি না জানি না। প্রতি বছর কোনো অনুষ্ঠান হলে ঘরের সব বউদের জন্য এক রকমের শাড়ি কেনা হয়। যেহেতু যৌথ পরিবার, চার বউয়ের জন্য একই ডিজাইনের শাড়ি, শুধু কালারটা আলাদা।

শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য কিছু বলতেও পারি না। বিয়ের দু’বছর পার হয়েছে। এখনো কোনও ঈদ বা অনুষ্ঠানে নিজের পছন্দের একটু আলাদা শাড়ি বা অন্যকিছু কিনতে পারি না। কিনলে সবার জন্য কিনবে এটা আমার শ্বশুর শাশুড়ির আদেশ। টুকটাক ছোটখাটো জিনিস কিনতাম শুধু নিজের জন্য আড়ালে।

বাবা মায়ের আদরের ছিলাম। কোনো কিছুর কমতি ছিল না। ইচ্ছামতো পছন্দ অনুযায়ী সব ছিল আমার। কিন্তু আদিবকে বিয়ে করার পর যৌথ পরিবারে এসে পড়ায় সব উল্টো হয়ে গেল। আমাদের পছন্দের বিয়ে এরকম হবে কখনো ভাবিনি।

বান্ধবীদের কাছে ওদের পরিবারের গল্প শুনলে মনে হয় আমি কোনো জেলখানায় কয়েদি হয়ে আছি।
খাবারের সময়ও সব পুরুষদের খাওয়া শেষে আমরা সব জা মিলে খেতে বসতাম। কোনো একটা তরকারি ভালো লাগলে দু’বার নিতে পারতাম না। আমার কোনো জা বাচ্চার কারণে খেতে না বসলে তার জন্য আলাদা অংশ রেখে বাকি সবাই ভাগ করে খেয়ে নিতাম একটুও বাড়তি থাকত না আর।

ঈদের দিন ঘরের সব বউরা গোসল করে সবাই একই রকম নতুন কাপড় পরে শ্বশুর-শাশুড়িকে সালাম করে একসাথে নাশতা করতাম। আমার শ্বশুর শাশুড়ি খাওয়া দাওয়ার পর আমাদের চারজনকে ডেকে একসাথে বসিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলতেন,

‘রাগ করো না তোমরা। তোমাদের এভাবে একসাথে দেখলে কেমন জানি শান্তি পাই। বুকটা ভরা ভরা লাগে। আমরা মারা গেলে না হয় তোমরা নিজেদের মতো করে থেকো।’
এই কথাগুলো কেমন জানি খারাপ লেগেছিল সেদিন।

তবে, বড় ভাবী যখন গাছের কাঁচা আম দিয়ে আচার করতেন তখন আমার খুব ভালো লাগত। কিন্তু আবার সেই, বাড়তি পেতাম না। খেয়ে আমার রুমে চলে আসতেই ড্রেসিং টেবিলের উপর দেখলাম বাটিতে আচার রাখা দেখেই খুব খুশি লাগল। পিছনে বড় ভাবী এসে বললেন, তুই না একটু বেশি পছন্দ করিস তাই লুকিয়ে রেখে দিয়েছি বাড়তি। এইটুকুতে অনেক আনন্দ লাগছিল।

বেশ কয়দিন পর আমার দুই ভাসুরের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে ঝামেলা হলো। বড় ভাই চাইলেন উনি আলাদা হবেন। আমার শ্বশুর শাশুড়ি আলাদা করে দিতে রাজি কিন্তু এই ঘরেই আলাদা খাবে, থাকতে হবে এখানেই।
ব্যবসায়িক সমস্যা মিটমাট হলো না উনাদের। আলাদা হলেন ঠিক, তবে ঘরও আলাদা করলেন। কিন্তু একই বাড়িতে আলাদা ঘর বানিয়ে রইলেন।
আমার শ্বশুর-শাশুড়ির ইচ্ছা বা কথা হলো, মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত যেন উনার ছেলেমেয়েদের একসাথে দেখে যেতে পারেন। আমার একটা শহরের কলেজে চাকরি হয় কিন্তু অনেক বুঝিয়েও তাদের রাজি করাতে পারলাম না। উনাদের এক কথা, এখানে থেকে যা করার কর। দূরে গিয়ে থাকা হবে না। গ্রাম থেকে শহর অনেকটা দূরে। যাতায়াতে কষ্ট। এখানে থেকে হবে না। তাই শেষ পর্যন্ত করা হয়নি চাকরিটা।

অনেকটা রাগ অভিমান হচ্ছিল। আদিব আগে বলেছিল তখন বুঝিনি এতটা হবে। আবেগে এসবে খুব একটা নজর দেওয়া হয়নি। সেও তার বাবা মায়ের কথার অমান্য করেনি।

বারবার নিজের ইচ্ছেগুলোকে এভাবে ভেঙ্গে যেতে দেখে মনের অজান্তেই যেন একটা বিতৃষ্ণা চলে আসছিল। এতবড় পরিবারে অভ্যস্ত ছিলাম না আমি।
এসব নিয়ে আদিবের সাথে কথা কাটাকাটি হয় প্রায়ই। তবুও আদিব সবকিছু বুকে আগলে রাখে।
মন খারাপ হলেই আমি রান্নাঘরের পিছনে গিয়ে বসে থাকতাম একা একা। এক সন্ধ্যায় মন খারাপ করে এভাবে বসে থাকায় আমার শাশুড়ি একটু বকা দেন। কারণ সবে মাত্র আমি কনসিভ করেছিলাম। এমন সময়ে হুটহাট নাকি বের হওয়া ঠিক না।

কোনো কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে এলাম। আমার জায়েরা অনেক সময় অনেক কিছু বলতেন আমি অতটা পাত্তা দিতাম না।
একটু ভালো থাকার তাগিদে কয়েকদিনের জন্য বাবার বাড়ি গেলাম। মাও অসুস্থ, বাবা একা।
একটু দেখাশোনার জন্য যাচ্ছি। বাড়িতে শুধু আমি আর বাবা মা। ভাইটা বাইরে থেকে পড়াশোনা করে। গোসল করে ছাদে গেছি কাপড় মেলতে। নামতে গিয়ে হঠাৎ পা পিছলে পরে যাই।
নিজেকে যখন হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করি তখন শরীরটা কেমন অবশ অবশ লাগছিল। আমি হাসপাতালে, তাহলে বাসায়, মা? আদিব আসতেই জিজ্ঞেস করলাম। ও বলল চিন্তা করো না।

হাসপাতালে পালাক্রমে আদিবের পাশপাশি আমার জায়েরা এসে থাকছেন আমার জন্য। একটুর জন্য বড় কোনো ক্ষতি হয়নি বেবির। কিন্তু কম হলে এক সপ্তাহ থাকতে হবে এখানে।
আমি মা-বাবার জন্য চিন্তা করছিলাম; তারা কি করছেন? আমার জা মানে মেজো ভাবী বললেন, এখানে থেকে এসব চিন্তা করতে হবে না।

ভাবী নিয়ম করে চুল বেঁধে দিতেন। শাড়ি পরিয়ে দিয়ে, খাবার দিয়ে, ঠিকমত ওষুধ খাইয়ে, নিয়ম মত করে গল্প করতেন তিনজনই। যখন যিনি আসতেন। কারোরই যেন ক্লান্তি নামক শব্দটা জানা ছিল না। মনে হচ্ছিল, বহুদিন পর বড় বোন নামক শব্দটাকে অনুভব করছি। খারাপ সময়ে মানুষ চেনা যায়।

পাঁচ দিনের মাথায় বাবা এলেন। বাবাও অসুস্থ, ঠিকমত হাটতে পারছেন না। সবকিছু জানতে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম। বাবা যা বললেন তাতে আমি অনেকটা অবাক হয়ে যাই। মা-বাবা দু’জনই আমার শ্বশুরবাড়িতে আছেন। প্রথম দুদিন আমার ননদ ছিল আমার বাবার বাড়িতে মায়ের দেখাশোনার জন্য। কিন্তু বাবাও অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। আমার শ্বশুর শাশুড়ির সাথে অনেক ভালো সময় কাটছে উনাদের। বাবা হাসিমুখে সব বলে যাচ্ছেন।

আর আমার কেন জানি কি মনে করে চোখের কোণটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল বারবার।
এর একটু পরেই আমার শ্বশুর আসেন একটি খাম হাতে। খামটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, এটা আরো এক বছর পর কাজে লাগবে এখন রেখে দিও কেমন!

আমি জানতে চাইলে বললেন, মফস্বল এলাকায় একটা কলেজ খুলছে সেখানে আমাকে শিক্ষক পদের ব্যবস্থা করেছেন আমার শ্বশুর। তবে সেটা এখন না, বেবি হয়ে যাওয়ার পর জয়েনিং।
আমার কথাগুলো শুনে এত খুশি লাগছিল বলতে পারব না। পরিবার শব্দটার মানে বুঝতে পারছিলাম আজ। তাও এত বড় পরিবারে কোথায় সুখ থাকে জানা ছিল না আমার।

আজ জানলাম। মানুষের কঠিন সময়ে যে পাশে থাকে তখন চেনা যায়। আমি যে জীবনের আশা করতাম হয়ত সেখানে এই সুখটা আমি পেতাম না। সবাই মিলে এই সুখ সব জায়গায় পাওয়া যায় না। এটাই হয়তো যৌথ পরিবারের ভালোবাসা।
হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে বাড়ি ফিরলাম। গাড়িতে জায়গা না থাকায় আদিব পরে আসছিল। হাসপাতালের প্রয়োজনীয় কাজ সেরে।

বাড়িতে সবাই একসাথে সবার হাসিমুখ। এরই মাঝে খবর এলো আদিব নেই। রোড এক্সিডেন্টে গাড়ি একদম নদীতে তলিয়ে যায়। সবার হাসি মুখটা নিমষে পানসে হয়ে যায়। আমি দুচোখে আঁধার দেখছিলাম। সবকিছুর মাঝে এমন কেন হলো!
মানতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছে আমার পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেছে। কোথাও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। যেন নিজের মাঝে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছি এতটা কষ্ট হচ্ছে। আদিব ছাড়া যে আমার জগৎ শূন্য একেবারে!
তবুও ওই যে বাবা মা, তাদের মুখে তাকিয়ে সবটা ভুলে থাকার চেষ্টা করি। দুই দুইটা বাবা আর মা আমার। আর আমার আগত সন্তান!

রাতের আঁধারে হয়তো আদিবের জন্য কান্না করি কিন্তু সূর্যের আলোয় ওই মানুষগুলোর হাসিমুখ দেখে নিজের ভালো থাকাটা খুঁজে বেড়াই। সন্তান হারা বাবা মায়ের ভালোবাসার জায়গাটা পূরণ করার চেষ্টা করি।
আর আমি আছি আমার স্মৃতি নিয়ে আর এই আমার এত বড় পরিবার নিয়ে।

ভালোবাসাটা সত্যি অদ্ভুত একদিকে যেমন সুখ দেয় অন্যদিকে ঠিক কাঁদায়।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us