কওমি মাদরাসায় রাজনীতি

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন | May 17, 2021 07:46 pm
কওমি মাদরাসা

কওমি মাদরাসা - ছবি : সংগৃহীত

 

রাজধানীর জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় গত ২৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া’-এর স্থায়ী কমিটির এক অধিবেশনে গৃহীত ছয়টি সিদ্ধান্তে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সোশ্যাল মিডিয়াতে এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত ও মন্তব্য উঠে আসে। আল হাইআতুল উলয়ার চেয়ারম্যান আল্লামা মাহমুদুল হাসান দা.বা.-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো হলো-

১. কওমি মাদরাসা সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণ করবে একমাত্র আল হাইআতুল উলয়া। আল হাইআতুল উলয়ার অধীন এক বা একাধিক বোর্ড কিংবা কোনো সংগঠন বা ব্যক্তি আল হাইআতুল উলয়ার সিদ্ধান্ত ব্যতীত পৃথকভাবে কওমি মাদরাসাবিষয়ক কোনো সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ বা উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারবে না।

২. কওমি মাদরাসার ছাত্র ও শিক্ষকরা প্রচলিত সর্বপ্রকার রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকবে মর্মে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
৩. আল হাইআতুল উলয়ার সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নের জন্য এবং কওমি মাদরাসা সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণ ও তত্ত্বাবধানের জন্য আল হাইআতুল উলয়ার অধীন পাঁচ বোর্ডের পাঁচজন, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া থেকে পাঁচজন এবং চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত পাঁচজনের সমন্বয়ে সর্বমোট ১৫ জনের একটি ‘বাস্তবায়ন সাব-কমিটি’ গঠিত হবে।

৪. উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কওমি মাদরাসার যেসব নিরীহ ছাত্র, শিক্ষক, আলেম-ওলামা, ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং মসজিদের ইমাম ও মুসল্লিদের গ্রেফতার করা হয়েছে, রমজানের এই রহমতের মাস বিবেচনায় সরকারের কাছে তাদের মুক্তির আহ্বান জানানো হয় এবং নিরীহ আলেম-ওলামা, মাদরাসার ছাত্র ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হয়রানি না করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়।

৫. পবিত্র রমজান কুরআন তিলাওয়াতের মাস। কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে বালা-মুসিবত ও মহামারী দূর হয়। তাই রমজানের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে হিফজ ও মক্তব বিভাগ খুলে দেয়ার জন্য এবং রমজানের পর কওমি মাদরাসার শিক্ষাকার্যক্রম চালু করার জন্য সরকারের কাছে বিশেষভাবে আবেদন করা হয়।

৬. আল হাইআতুল উলয়ার ওই সভার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করার জন্য তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক আল হাইআতুল উলয়ার উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে চেয়ারম্যানের একটি পত্র হস্তান্তর করেন।

এর একদিন আগে ২৪ এপ্রিল তেজগাঁও রেলওয়ে জামিয়া ইসলামিয়ায় ‘বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা সংরক্ষণ কমিটি’ আয়োজিত কওমি মাদরাসার অধ্যক্ষদের এক সম্মেলনে প্রায় অনুরূপ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়- মক্তব, হিফজখানা ও কওমি মাদরাসা খুলে দেয়া, বক্তৃতা করার সময় ওয়ায়েজদের জজবা ও আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা, কওমি মাদরাসার ছাত্রদের দলীয় রাজনীতি থেকে দূরে রাখা, শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, দেওবন্দ, মিসর, মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবের বিশ^বিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণেচ্ছুদের স্টুডেন্ট ভিসা প্রাপ্তির পথ তৈরি করা এবং মাদরাসা কিংবা মাদরাসার শিক্ষকদের ওপর অহেতুক কোনো হয়রানি যেন হতে না পারে এ উদ্দেশ্যে শীর্ষস্থানীয় আলেমদের একটি প্রতিনিধিদল গঠন করে সরকারের সাথে বসে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এখানে আরো একটি ঘোষণা দেয়া হয়- ‘মাদরাসাগুলোকে এই মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া জরুরি যে, কওমি মাদরাসাকে বোর্ড কর্র্র্তৃক প্রদত্ত নীতিমালা এবং ভর্তির সময় যেসব ওয়াদা করা হয় যেমন- তথাকথিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত না হওয়ার বিষয়ে যথাযথ বাস্তবায়ন করা এবং যেসব ছাত্র বা শিক্ষক এই নীতি ভঙ্গ করলে তাদের বিরুদ্ধে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ‘বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা সংরক্ষণ কমিটি’র একটি প্রতিনিধিদল বিষয়গুলো নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অবহিত করেন। ওই প্রতিনিধিদলে অন্যদের মধ্যে ছিলেন ড. মুশতাক আহমদ, মাওলানা ইয়াহিয়া মাহমুদ, মাওলানা মুজিবুর রহমান ও মুফতি মোহাম্মদ আলী। এই চারজন শীর্ষস্থানীয় আলেম গত বছর করোনার কারণে যখন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয় তখন সর্বোচ্চ মহলে যোগাযোগ করে কওমি মাদরাসায় পাঠদান ও পরীক্ষা গ্রহণের অনুমতির ব্যবস্থা করেন। এবারো তারা সফল হবেন এমনটা প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট সবার।

বর্তমানে সৃষ্ট পরিস্থিতি বিবেচনা করে আল হাইআতুল উলয়া ও বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা সংরক্ষণ কমিটির সিদ্ধান্ত মানুষ ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে। মাদরাসা খুলে দেয়া ও নিরীহ আলেমদের হয়রানি বন্ধ করা অগ্রাধিকার পাওয়ার বিষয়। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের কোনো মাদরাসায় ছাত্ররাজনীতির অনুমতি নেই। কোনো শিক্ষার্থী কোনো বিশেষ ছাত্রসংগঠনকে পছন্দ করতে পারে কিন্তু মাদরাসা অঙ্গনে শাখা গঠন ও সভা-সমাবেশ করার নজির নেই। এক সংগঠনকে অনুমতি দিলে অপরাপর সংগঠনগুলো সে সুযোগ চাইবে। অনেক সময় সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তাই কওমি মাদরাসার ভর্তিফরমের অঙ্গীকারনামায় স্পষ্টত উল্লেখ রয়েছে, মাদরাসা অভ্যন্তরে ছাত্ররাজনীতি বা কোনো সাংগঠনিক তৎপরতায় অংশ নেয়া যাবে না। তবে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের অগোচরে কেউ করে থাকলে সেটা ভিন্ন ব্যাপার। ধরা পড়লে নাম কাটা যাওয়ার নজির ভূরি ভূরি।

আল হাইআতুল উলয়া কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তের মধ্যে ২ নং সিদ্ধান্তটি ছিল ‘কওমি মাদরাসার ছাত্র ও শিক্ষকরা প্রচলিত সর্বপ্রকার রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকবেন’। এ ‘সর্বপ্রকার রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকা’ বলতে আসলে কী বোঝানো হচ্ছে এ নিয়ে কওমি ঘরানা ওলামা মাশায়েখদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়ে দেশের চার বুদ্ধিজীবী আলেমের সাথে কথা বলেছেন আওয়ার ইসলামের সাব-এডিটর নুরুদ্দীন তাসলিম।

এ বিষয়ে সমাজবিশ্লেষক মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী বলেন, ‘এটি খুবই সহজ বিষয়। মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা রাজনীতি শিখবেন, শেখাবেন, কিন্তু তারা প্রতিষ্ঠানে থাকাবস্থায় রাজনীতি করবেন না। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, মাদারাসাতে কিতাবুল বুয়ুসহ (ব্যবসা-বাণিজ্যের অধ্যায়) অনেক কিছু পড়ানো হয়, কিন্তু পড়াশোনার সময় ছাত্র-শিক্ষক কেউ প্র্যাকটিক্যালি ব্যবসায় নেমে পড়েন না, ঠিক তেমনি ছাত্ররা মাদরাসায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়বে, শিখবে, তবে প্রতিষ্ঠানকে তা প্রয়োগের ক্ষেত্র বানাবে না। ‘আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মাদরাসায় রাজনীতি করলে ধরপাকড়, হয়রানি এমনকি মসজিদ-মাদরাসা বন্ধ হওয়ার মতো আশঙ্কাও সৃষ্টি হয়। তাই মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক থাকাকালীন কেউ রাজনীতি করবে না।’ নদভী বলেন, ‘প্রত্যেকের ব্যক্তিস্বাধীনতা আছে, চাইলে তারা রাজনীতি করতে পারে, কিন্তু মাদরাসার পরিবেশে রাজনীতি করা কোনোভাবেই ঠিক হবে না। পড়াশোনা, তালিম তারবিয়তের পরিবেশই মাদরাসার জন্য উপযোগী।’

এদিকে শিক্ষাবিদ ও গবেষক আলেম, দারুর রাশাদ মাদরাসার শিক্ষাসচিব মাওলানা লিয়াকত আলী বলেন, ‘শিক্ষার উন্নয়ন ও মান বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকা একান্ত জরুরি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার কারণে শুধু কওমি মাদরাসা নয়, সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার ক্ষতি হয়। অনেক সময় দলীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকতে গিয়ে পড়াশোনায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। তার মতে, এ সিদ্ধান্ত সঠিক এবং মাদরাসা রক্ষার স্বার্থে কার্যকর পন্থা। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অধিকার থেকে চাইলে যে কেউ রাজনীতি করতে পারেন, তবে অবশ্যই তা প্রতিষ্ঠানের বাইরে গিয়ে একান্ত রাজনৈতিক পরিবেশে হওয়া কাম্য।’

লেখক ও দারুল উলুম রামপুরার মুহাদ্দিস মাওলানা যাইনুল আবেদীন বলেন, ‘রাজনীতির স্বার্থেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে রাজনীতিকে আলাদা করা প্রয়োজন। বর্তমানে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যেভাবে রাজনীতি চলছে, এই ধারায় চলতে থাকলে আমাদের ঘরানার রাজনীতি কখনো প্রতিষ্ঠা পাবে বলে মনে হয় না। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক দলগুলো যদি আলাদা অফিস, নিজস্ব শৃঙ্খলা, নিজস্ব ঠিকানার মধ্যে পরিচালিত হয় তবেই আমাদের আকাক্সিক্ষত রাজনীতি প্রতিষ্ঠা পেতে পারে বলে আমি মনে করি।’

ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড দাওয়াহ বাংলাদেশের পরিচালক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ বলেন, কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা প্রচলিত সর্বপ্রকার রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকবে- এই সিদ্ধান্তের সঠিক ব্যাখ্যা দায়িত্বশীলরাই দিতে পারবেন। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে- বর্তমানে পরিস্থিতির যে প্রতিকূলতা তাতে যারা রাজনীতির সাথে জড়িত এবং মাঠপর্যায়ে সক্রিয়, রাজনৈতিক সংগঠন হোক অথবা আধা রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক বা অন্য কোনো দল, তারা কেউ বর্তমানে এ সঙ্কট থেকে উত্তরণে ভূমিকা রাখতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতে অন্য বেশ কিছু শর্তের সাথে হাইআতুল উলয়ার যেই শর্তটি যুক্ত করেছে, আপাতদৃষ্টিতে একে কিছুটা ভিন্নরকম মনে হলেও পরিস্থিতির প্রতিকূলতা দূর করে মাদরাসাগুলো খুলে দেয়া, পরিবেশের মধ্যে এক ধরনের আনুকূল্য ফিরিয়ে আনা, গ্রেফতারি, সরকারি রুষ্টতা, হয়রানি বন্ধ, সাহরি ও ইফতারে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতের খাতিরে এই ছোট্ট একটি বিষয়কে এত বড় করে দেখার সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না।’ আরেকটি বিষয় হলো, ওই বৈঠকে হেফাজতের বড় বড় নেতা যেমন- মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী, মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী, মাওলানা মাহফুজুল হকসহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন। যেহেতু তাদের উপস্থিতিতেই শর্তটি রাখা হয়েছে, তাই বোঝা যায় তারা সব দিক বিবেচনা করেই সিদ্ধান্তটি মেনে নিয়েছেন।

এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান। তিনি বলেন, ‘হাইআতুল উলয়ায় নির্ভর করার মতো মুরুব্বিরা রয়েছেন। তারা দ্বীন-দেশ এবং কওমি মাদরাসার স্বার্থ সব দিক চিন্তা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন, এ ব্যাপারে আমরা আশাবাদী ছিলাম। আমাদের বিশ্বাস, তারা হয়তো সর্বোচ্চ ইখলাসের সাথে সেই চেষ্টাই করেছেন। কিন্তু অতীব দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, হাইআর গতকালের দু’টি সিদ্ধান্তে আমরা চরমভাবে হতাশ হয়েছি। এদেশ থেকে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের নামে ইসলামী সংগঠনগুলো নিষিদ্ধের যে আওয়াজ বেশ কিছু দিন ধরে উচ্চারিত হচ্ছে, সে কাজটিই সহজ করে দেবে হাইআ। এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে আরো যেসব সঙ্কট সৃষ্টি হবে তা হলো- এ দেশের প্রায় সবগুলো ইসলামী সংগঠন অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে। স্বাধীনতা পরবর্তী বিশেষ করে বিগত চার দশকে যেসব ইসলামী সংগঠন বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে যতটুকুই বিকাশ লাভ করেছে, সেই ধারা থেমে যাবে। সবচেয়ে বড় যে সঙ্কট দেখা দেবে- যা রাষ্ট্র, সরকার এবং মাদরাসা সবার জন্যই উদ্বেগের তা হলো, কওমি মাদরাসাগুলোকে ‘ভয়ঙ্কর উগ্রবাদীরা’ গ্রাস করে নিতে পারে।

যাদেরকে হাইআ, বেফাক, পীর, বুজুর্গ, ওস্তাদ কারো পক্ষেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। বর্তমানে যে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, তা কিন্তু রাজনৈতিক কারণে নয়, বরং গঠনমূলক রাজনীতির অভাবে। অতীতেও কোনো নিয়মতান্ত্রিক ইসলামী রাজনৈতিক দলের কারণে দেশের কোনো কওমি মাদরাসায় কোনো সঙ্কট সৃষ্টি হয়নি। এবারো হাটহাজারী ও বি-বাড়িয়ায় যেসব মাদরাসার ছাত্র জীবন দিয়েছেন, তারা একজনও কোনো ইসলামী রাজনৈতিক দলের কর্মী নন। মূলত রাজনীতিতে মেধাবী আলেমদের অনাগ্রহের কারণেই দুর্নীতিবাজরা আজ সমাজের সর্বত্র নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমরা দীর্ঘমেয়াদে দুর্নীতিবাজদের হাতে দেশ ছেড়ে দিয়ে, এর পরিবর্তনের যথাযথ চেষ্টা কৌশল না করে, ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া পরিচয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারি না।

অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কওমি মাদরাসায় ছাত্ররাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা আগে থেকে বহাল আছে। কওমি মাদরাসার শিক্ষকদের মধ্যে বৃহত্তর অংশ সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে অবস্থান করে জ্ঞান সাধনায় ব্যাপৃত থাকাকে পছন্দ করেন। তবে ব্যতিক্রমও আছে। অনেকে মাদরাসায় পাঠদানের পাশাপাশি দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল। বাংলাদেশে মুফতি ফজলুল হক আমিনী ঢাকার লালবাগ মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদিস হয়েও সক্রিয় রাজনীতি করেন এবং জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস যশোরের মনিরামপুর মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদিস হয়েও সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী ছিলেন। কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদিয়ার ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা আতাউর রহমান খান বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভীর খলিফা ও হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিম আল্লামা আবদুল ওয়াহাব সাহেব এবং পটিয়া মাদরাসার মুহতামিম হাজী মাওলানা ইউনুছ সাহেব নিখিল পাকিস্তান জমিয়তে ওলামা ও নেজামে ইসলাম পার্টির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

পটিয়া মাদরাসার শায়খুল হাদিস খতিবে আজম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন কক্সবাজারের মহেশখালী-কুতুবদিয়া নির্বাচনী এলাকা থেকে। বঙ্গবন্ধুর সাথে একই প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলির মেম্বার ছিলেন এবং সংসদে জনস্বার্থে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। আমৃত্যু তিনি নেজামে ইসলাম পার্টির নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভীর বিশিষ্ট খলিফা ও কিশোরগঞ্জ জামিয়া ইমদাদিয়ার প্রিন্সিপাল মাওলানা আতাহার আলী পাকিস্তান মারকাজি জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি ও পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির মেম্বার (এমএনএ) ছিলেন। কামরাঙ্গীরচর মাদরাসার প্রিন্সিপাল থাকাকালীন হজরত হাফেজ্জী হুজুর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মাদরাসার সাথে যুক্ত ময়মনসিংহের মাওলানা ফয়জুর রহমান নেজামে ইসলাম পার্টি থেকে পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির মেম্বার (এমএনএ) ছিলেন। সিলেটের একঝাঁক তারকা আলিম মাদরাসার সাথে যুক্ত থেকে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও খিলাফত মজলিশের প্লাটফর্মে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। মাওলানা বৈয়ামপুরী, শায়খে কৌড়িয়া, শায়খে গহরপুরী, শায়খে হবিগঞ্জী, শায়খে বিশ্বনাথী, মুফতি হাবিবুর রহমান অন্যতম। এখনো বিয়ানীবাজার আংগোরা মুহাম্মদপুর মাদরাসার মুহতামিম ও শায়খুল হাদিস মাওলানা জিয়াউদ্দিন সাহেব জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে কর্মরত।

ভারত ও পাকিস্তানের দিকে তাকালে কওমি মাদরাসার সাথে যুক্ত বহু আলেম-ওলামাকে রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় থাকতে দেখা যায়। ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের শায়খুল হাদিস আল্লামা হোছাইন আহমদ মাদানি রহ. জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের প্লাটফর্ম থেকে সর্বভারতীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। গান্ধী-জিন্নাহ নেহরু-প্যাটেল-আজাদের সাথে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। কওমি মাদরাসার মুহতামিম জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সভাপতি মাওলানা মুফতি মাহমুদ আহমদ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের নির্বাচিত চিফ মিনিস্টার ছিলেন। তার দলের মাওলানা আবদুল্লাহ দরখাস্তি ও মাওলানা গোলাম গাউস হাজারভী ছিলেন পার্লামেন্ট মেম্বার। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন নিজ নিজ এলাকার কওমি মাদরাসার মুহতামিম। করাচি দারুল উলুমের প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম ও বিখ্যাত তাফসির ‘মাআরিফুল কুরআন’-এর রচয়িতা আল্লামা মুহাম্মদ শফিও মারকাজি জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টির সাথে যুক্ত থেকে ’৫৬ সালের সংবিধান রচনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হন। এখনো ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের মুহাদ্দিস মাওলানা সাইয়েদ আরশাদ মাদানি জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের সভাপতি হিসেবে পুরো ভারতে রাজনীতিতে সক্রিয়।

কোনো দলের সাথে যুক্ত থেকে রাজনীতি করা এটা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। আলিয়া মাদরাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যদি রাজনীতি করতে পারেন তাহলে কওমি মাদরাসার শিক্ষকরা এ অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবেন কেন? এ প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট মহলের। রাজনীতির অর্থ তো সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ বা ভাঙচুর নয়। নিয়মতান্ত্রিক পথে রাজনীতি দোষ বা অপরাধ হতে পারে না। কওমি অঙ্গনে যদি ইতিবাচক রাজনীতির চর্চা রুদ্ধ হয়ে যায় তা হলে জাতীয় পর্যায়ের লিডারশিপ কওমি মাদরাসা থেকে তৈরি হবে না। প্রচলিত রাজনীতিতে এটা দূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।

হাইআতুল উলয়ার অধিবেশনে গৃহীত ৪ নম্বর সিদ্ধান্তটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কওমি মাদরাসার যেসব নিরীহ ছাত্র, শিক্ষক, আলেম-ওলামা, ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং মসজিদের ইমাম ও মুসল্লিদের গ্রেফতার করা হয়েছে, রমজানের এই রহমতের মাস বিবেচনায় সরকারের কাছে তাদের মুক্তির আহ্বান জানানো হয় এবং নিরীহ আলেম-ওলামা, মাদরাসার ছাত্র ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হয়রানি না করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়। কেউ যদি কোনো অপরাধ করে থাকে বা সহিংসতায় যুক্ত হয়ে জনগণ বা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ক্ষতি সাধন করে ভিডিও ফুটেজ দেখে তদন্তের মাধ্যমে তার বিচার হতে হবে। এতে কারো দ্বিমত থাকতে পারে না। কিন্তু হেফাজতের কমিটির সাথে থাকলেই তাকে হয়রানি করতে হবে এটা সুষ্ঠু রাজনীতি, নৈতিকতা ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।

অনুরূপভাবে হাইআতুল উলয়ার অধিবেশনে গৃহীত ১ নম্বর সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত গুরুত্বের দাবি রাখে। ‘কওমি মাদরাসা সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণ করবে একমাত্র আল হাইআতুল উলয়া। আল হাইআতুল উলয়ার অধীন এক বা একাধিক বোর্ড কিংবা কোনো সংগঠন বা ব্যক্তি আল হাইআতুল উলয়ার সিদ্ধান্ত ব্যতীত পৃথকভাবে কওমি মাদরাসাবিষয়ক কোনো সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ বা উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারবে না।’ কওমি মাদরাসায় শিক্ষক নিয়োগ, বিয়োগ, পদোন্নতি, শূরা গঠন, মুহতামিম নিয়োগ, শিক্ষক ও মুহতামিমদের বয়সসীমা, অডিট নিরীক্ষণ, শিক্ষার্থীদের পেটানো ও শিশু নিপীড়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রভৃতি বিষয়ে বিধিবদ্ধ নীতিমালা প্রণয়ন আশু প্রয়োজন। এগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় যদি আল হাইআতুল উলয়া কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে তাহলে তা হবে যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। কওমি সংশ্লিষ্ট ওলামা মাশায়েখ ও ধর্মপ্রাণ মানুষ এটাই চায়।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক

drkhalid09@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us