মৃত্যুযন্ত্রণা : কার কেমন

জামান শামস | Jun 08, 2021 03:11 pm
মৃত্যুযন্ত্রণা

মৃত্যুযন্ত্রণা - ছবি সংগৃহীত

 

‘সাকরাতুল মাওত’ বা মৃত্যুযন্ত্রণা বলে কিছু আছে কি? থাকলে তার কষ্ট কেমন!

সাকরাতুল মাওত সত্য এবং প্রত্যেকেই তা মৃত্যুর সময় অনুভব করবে। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে মরণ আক্রান্ত ব্যক্তির জ্ঞানহীন একটি অবস্থা হবে, সেটি কমবেশি রকমের কষ্টকর হবে এবং তার ছাপ মৃত ব্যক্তির চেহারায় ফুটে উঠবে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, মৃত্যুযন্ত্রণা নিশ্চিতই আসবে। এ থেকেই তোমরা অব্যাহতি চেয়ে আসছ। (সূরা কাফ : ১৯)

হজরত আয়েশা রা: বর্ণিত- এরপর মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হলো। এ সময় রাসূলুল্লাহ সা: স্ত্রী আয়েশার বুকে ও কাঁধে ঠেস দিয়ে বসা অবস্থায় ছিলেন। এমন সময় আয়েশা রা:-এর ভাই আব্দুর রহমান রা: সেখানে উপস্থিত হন। তার হাতে কাঁচা মিসওয়াক দেখে সেদিকে রাসূল সা:-এর দৃষ্টি গেল। আয়েশা রা: বলেন, আমি তাঁর আগ্রহ বুঝতে পেরে তাঁর অনুমতি নিয়ে মিসওয়াকটি চিবিয়ে নরম করে তাঁকে দিলাম। তখন তিনি সুন্দরভাবে মিসওয়াক করলেন ও পাশে রাখা পাত্রে হাত ডুবিয়ে (কুলিসহ) মুখ ধৌত করলেন। এ সময় তিনি বলতে থাকেন, ‘আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। নিশ্চয়ই মৃত্যুর রয়েছে কঠিন যন্ত্রণাসমূহ। (বুখারি ৪৪৪৯; মিশকাত ৫৯৫৯)

এমন সময় তিনি ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে হাত কিংবা আঙুল উঁচিয়ে বলতে থাকলেন, ‘(হে আল্লাহ!) নবীগণ, সিদ্দিকগণ, শহীদগণ এবং নেককার ব্যক্তিগণ যাদের তুমি পুরস্কৃত করেছ, আমাকে তাদের সাথী করে নাও। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা করো ও দয়া করো এবং আমাকে আমার সর্বোচ্চ বন্ধুর সাথে মিলিত করো। হে আল্লাহ! আমার সর্বোচ্চ বন্ধু!’ আয়েশা রা: বলেন, শেষের কথাটি তিনি তিন বার বলেন। অতঃপর তাঁর হাত এলিয়ে পড়ল, দৃষ্টি নিথর হয়ে গেল’। তিনি সর্বোচ্চ বন্ধুর সাথে মিলিত হলেন। (বুখারি ৪৫৮৬, ৫৬৭৪; মিশকাত ৫৯৫৯-৬০)

আয়েশা রা: বলেন, ‘আমার উপর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ এই যে, রাসূলুল্লাহ সা: আমার ঘরে, আমার পালার দিন এবং আমার বুক ও গলার মধ্যে হেলান দেওয়া অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। আর তাঁর মৃত্যুর পূর্বক্ষণে পার্থিব জীবনের শেষ দিন ও পরকালীন জীবনের প্রথম দিন আল্লাহ আমার মুখের লালার সাথে তাঁর মুখের লালা মিলিয়ে দিয়েছেন। আর আমার ঘরেই তাঁর দাফন হয়েছে’।

আয়েশা রা: থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, যখন মৃত্যু ঘনিয়ে এলো, তখন তাঁর মাথা ছিল আমার রানের ওপর, তিনি বেহুঁশ হয়ে গেলেন। তারপর হুঁশ ফিরে এলো। তখন তিনি ছাদের দিকে চক্ষু নিবদ্ধ করলেন। অতঃপর বললেন, ‘হে আল্লাহ! হে সর্বোচ্চ বন্ধু!’ আর এটাই ছিল তাঁর শেষ কথা। আয়েশা রা: বলেন, এর দ্বারা আমি বুঝলাম, এখন তিনি আর আমাদের পসন্দ করবেন না। বুঝলাম, যে কথা তিনি সুস্থ অবস্থায় বলতেন, সেটাই ঠিক হলো। তা এই যে, ‘কোনো নবী মৃত্যুবরণ করেন না, যতক্ষণ না জান্নাতে তাঁর ঠিকানা দেখানো হয়। অতঃপর তাঁকে এখতিয়ার দেওয়া হয় দুনিয়ায় বেঁচে থাকার অথবা মৃত্যুবরণ করে জান্নাতে যাওয়ার।’ আমি বুঝলাম যে, তিনি আখেরাতকেই পসন্দ করলেন। (বুখারি ৬৩৪৮; মুসলিম ২৪৪৪; মিশকাত ৫৯৬৪)

অতঃপর আমি তাঁর মাথা বালিশে রাখি এবং অন্যান্য মহিলাদের সাথে কাঁদতে কাঁদতে উঠে আসি’ (ইবনু হিশাম ২/৬৫৫)। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন (আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। (বাকারাহ ২/১৫৬)

‘রাফিক’ কুরআনের শব্দ।
আর যে কেউ আল্লাহর হুকুম এবং তাঁর রসূলের হুকুম মান্য করবে, তাহলে যাঁদের প্রতি আল্লাহ নেয়ামত দান করেছেন, সে তাঁদের সঙ্গী হবে। তাঁরা হলেন নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ। আর তাদের সান্নিধ্যই হলো উত্তম। (সূরা নিসা : ৬৯)
প্রশ্ন হচ্ছে এনেক ভালো ভালো দোয়া জানা থেকেও রাসূল সা: এটি কেনো বেছে নিলেন?
আমরা জানি নবীগণ একই রাস্তার অনুসারী। ইউসুফ আ:-এর দোয়ার ধরনও এমন ছিল। তার দোয়াটি কুরআন উদ্ধৃত করে দিয়েছে, হে পালনকর্তা! আপনি আমাকে রাষ্ট্রক্ষমতাও দান করেছেন এবং আমাকে বিভিন্ন তাৎপর্যসহ ব্যাখ্যা করার বিদ্যা শিখিয়ে দিয়েছেন। হে নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডলের স্রষ্টা, আপনিই আমার কার্যনির্বাহী ইহকাল ও পরকালে। আমাকে ইসলামের উপর মৃত্যু দান করুন এবং আমাকে সালিহগণের সাথে মিলিত করুন। (সূরা ইউসুফ : ১০১)

হাফিজ ইবনে হাজার রহ: বলেন, নেককার বদকার নির্বিশেষে মৃত্যুযন্ত্রণা অবশ্যম্ভাবী। নেককারের জন্য শেষ সময়ে ক্ষমা প্রার্থনা সুযোগ হতে পারে, বদকারো হতে পারে, ক্ষমা চাইলে সময়ে তাকেও আল্লাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন।

অতঃপর যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছা তিনি শাস্তি দেবেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে শক্তিমান। (সূরা বাকারা: ২৮৪)
খলিফা ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ বলেন, আমি চাই না মৃত্যুযন্ত্রণা আমার জন্য লাঘব হোক। কেননা সেটাই আমার জন্য শেষ সুযোগ। ক্ষমা নসিব হলে গুনাহমুক্ত ব্যক্তির স্পর্শ পেয়ে ফেরেশতারা খুশি হবেন, কবর পর্যন্ত সঙ্গ দেবেন।

সব ইমাম এ বিষয়ে একমত যে একমাত্র শহীদগণের মৃত্যু কষ্টবিহীন হবে। মনে হবে তার শরীরে একটা পিঁপড়া কামড় বসিয়েছে মাত্র। বাকিদের ব্যাপারে মৃত্যুযন্ত্রণা হবেই সেটা অল্প বা বিস্তর।
ইবনে হাযম আন্দালুসী তার ‘মৃত্যু যন্ত্রণাময়’ শীর্ষক এক নিবন্ধে বলেন, কোনো মৃত্যুপথযাত্রীকে দেখে বুঝার উপায় নেই যে সেটা আসলেই কষ্টকর। কারণ এর কোনো আলামত দৃশ্যমান হয় না। তিনি বলেন, সাকরাতুল মাওত শারীরিক নয়, আত্মিক। কুরআনে ‘তুমি যদি দেখতে’ এমন আয়াতে এ কথার সমর্থন মিলে। যদি তুমি দেখতে যখন জালেমরা মৃত্যুযন্ত্রণায় থাকে এবং ফেরেশতারা স্বীয় হস্ত প্রসারিত করে বলে, বের কর স্বীয় আত্মা! অদ্য তোমাদেরকে অবমাননাকর শাস্তি প্রদান করা হবে। কারণ, তোমরা আল্লাহর ব্যাপারে অসত্য বলতে এবং তাঁর আয়াত সমূহ থেকে অহঙ্কার করতে। (সূরা আনআম : ৯৩)
পক্ষান্তরে ঈমান আনার পর যারা দ্বীনের পথে অবিচল থাকে তাদেরকে মৃত্যুর ফেরেশতা এ সময় অভয় দেয় এবং জান্নাতের সুসংবাদ শোনায়- নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, অতঃপর তাতেই অবিচল থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় এবং বলে, তোমরা ভয় করো না, চিন্তা করো না এবং তোমাদের প্রতিশ্রুত জান্নাতের সুসংবাদ শোনো। (সূরা ফুসসিলাত : ৩০)

হে আল্লাহ ! আমাদের মৃত্যুকে সহজ ও প্রশান্তময় করে দিন, মৃত্যুকালীন আজাব থেকে রক্ষা করুন, ঈমান ও ইসলামের উপর মৃত্যু দিন এবং মৃত্যুকালে ক্ষমা নসিব করুন। আমিন।

লেখক : সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি:


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us