কোন কোন দেশ হতে পারে সুপার পাওয়ার?

জান্নাত খাতুন | Jun 10, 2021 09:00 pm
কোন কোন দেশ হতে পারে সুপার পাওয়ার?

কোন কোন দেশ হতে পারে সুপার পাওয়ার? - ছবি : সংগৃহীত

 

সুপার পাওয়ার তথা বিশ্বের বৃহৎ ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। এ ধারণাটা হাজার বছর আগের। কালে কালে সুপার পাওয়ার সাম্রাজ্য বা রাষ্ট্র বদলেছে। কোনো কোনো রাষ্ট্র সুপার হিসেবে টিকে ছিলো ১০০ বছর। কোনো কোনো সাম্রাজ্য বা রাষ্ট্র টিকেছিল ২০০ থেকে ৩০০ বছর। একমাত্র রোমান সাম্রাজ্য টিকে ছিল হাজারের বেশি সময় নিয়ে সুপার পাওয়ার হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে নয়া দুই সুপার পাওয়ার আবির্ভূত হয়। একটি হলো যুক্তরাষ্ট্র অন্যটি হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৯২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়লে একমাত্র পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৯২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এই ৩০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র বা আমেরিকা সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসেবে টিকে রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা এখন পড়তির দিকে। যুক্তরাষ্ট্র আর পৃথিবীর একমাত্র বৃহৎ শক্তি হিসেবে থাকবে না। চীনের উত্থান হচ্ছে দ্রুত। যুক্তরাষ্ট্রের জায়গা চীন নেবে কি না তা ভবিষ্যৎেই দেখা যাবে। বর্তমান সময়ে একটি দেশ কীভাবে সুপার পাওয়ার হয়ে উঠে? সুপার পাওয়ার হয়ে উঠার জন্য একটি দেশের কী কী প্রয়োজন হয়? কোন কোন দেশের সুপার পাওয়ার হয়ে উঠার সম্ভাবনা আছে? চলুন এ সম্পর্কে জানা যাক।

কোনো দেশের সুপার পাওয়ার হয়ে উঠার জন্য তিনটি জিনিস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এক, বৃহৎ জনসংখ্যা, দুই, যোগ্য নেতৃত্ব এবং তিন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অসাধারণ উন্নতি। এই তিনটি জিনিসের জোরেই একটি দেশ হয়ে উঠতে পারে সুপার পাওয়ার। আরো কয়েকটি জিনিসও প্রয়োজন আছে৷ সেগুলোর মধ্যে তিনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো হলো এক, বৃহৎ আয়তন; দুই, নিজস্ব সমুদ্রসীমা থাকা; তিন, দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা।

এবার আসা যাক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি জিনিসের দিকে। এক, বৃহৎ জনসংখ্যা। একটি দেশের বৃহৎ জনসংখ্যা একটি দেশের সুপার পাওয়ার হয়ে উঠার প্রধান অস্ত্র। বৃহৎ জনসংখ্যা মানে বৃহৎ কর্মক্ষম জনশক্তি। তা সে দক্ষ হোক আর না হোক। দক্ষ হলেও আরো ভালো এক জনশক্তি। বৃহৎ জনসংখ্যা মানে দেশের অভ্যন্তরে বিশাল বাজার। যা বিদেশী বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সহায়ক হবে। শক্তিশালী হবে অর্থনীতি। শক্তিশালী অর্থনীতি একটি দেশের সুপার পাওয়ার হওয়ার প্রধান শর্ত। ১৯৯২ সালে ভেঙ্গে পড়ার আগে সুপার পাওয়ার সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি ছিলো। এছাড়া বৃহৎ জনসংখ্যা মানে বৃহৎ সেনাবাহিনী। বর্তমান সময়ে সেনাবাহিনীর সৈন্যসংখ্যা দিয়ে সেনাবাহিনীর শক্তি বোঝায় না। তবুও বর্তমানে সময়ে একটি সেনাবাহিনীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৈন্য থাকা আব্যশক মনে করা হয়। এছাড়া যে দেশের সেনাবাহিনী যত বড় ওই দেশ তত দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতাও রাখে।

এবার আসা যাক দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের ব্যাপারে। যোগ্য নেতৃত্ব দেশের বৃহৎ জনসংখ্যাকে দক্ষ করে তুলতে পারে এবং দেশের অর্থনীতিকেও শক্তিশালী করতে তুলতে পারে। যোগ্য নেতৃত্বই দেশের অভ্যন্তরীণ কাঠামোকে শক্তিশালী করে তোলে আর যোগ্য নেতৃত্বই দেশকে সম্ভাব্য বিপদ থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করে থাকে। যা একটি দেশের সুপার পাওয়ার হয়ে উঠার পূর্ব শর্ত।

এবার আসা যাক তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের দিকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অসাধারণ উন্নতি বা দখল। বিশ্বের অতীত শক্তিশালী সাম্রাজ্য ও বর্তমান সুপার পাওয়ারের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে যত বেশী উন্নত ওই দেশের জনসংখ্যা তত বেশি দক্ষ এবং ওই দেশের অর্থনীতি তত শক্তিশালী। এছাড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিই যোগ্য নেতৃত্ব ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলে। যা একটি দেশের সুপার পাওয়ার হয়ে উঠার পূর্ব শর্ত। উদাহরণ স্বরূপ আমরা বলতে পারি বর্তমান সুপার পাওয়ার আমেরিকার কথা। যার এখন পর্যন্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে কোনো সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীও নেই। এছাড়া অতীত সুপার পাওয়ার ব্রিটেনের কথাও বলা যায়। অতীতে ব্রিটিশরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য তৈরি করে ছিল।

এবার আসা যাক সুপার পাওয়ার হয়ে উঠার জন্য বাকি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের দিকে। এর মধ্যে প্রথম হলো, বৃহৎ আয়তন। বৃহৎ আয়তন একটি দেশের সুপার পাওয়ার হয়ে উঠার ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশের বৃহৎ আয়তন থাকলে দেশটি সামরিক শক্তি বৃদ্ধি, গোপন গবেষণা, বিশাল জনসংখ্যা দক্ষকরণ এবং অর্থনীতি শক্তিশালী করতে পারে। একটি দেশের আয়তন বৃহৎ হলে দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ বেশি হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও গবেষণা স্থাপনার পর্যাপ্ত উপকরণ পাওয়া সম্ভব। একটি দেশের আয়তন যতবড় এর প্রতিবেশী দেশের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। আর সেই দেশের প্রভাবও সেই প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে। এছাড়া অনেক গোপন প্রজেক্ট চালানোও বৃহৎ আয়তনের দেশগুলোর জন্য সহজ। এবার আসা যাক নিজস্ব সমুদ্রসীমার ব্যাপারে। বিখ্যাত গ্রিক সেনানায়ক থেমিসটোক্লিস বলছিলেন, 'যে শক্তিগুলো সমুদ্রকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। তারাই পৃথিবীর সম্পদ ও পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে।' গ্রিক সেনানায়ক থেমিসটোক্লিস আড়াই হাজার বছরেরও বেশী=ি সময় আগে এই কথাটি বলেছিলেন।

আর আজ আধুনিক সময়েও গ্রিক সেনানায়কের এই উক্তি সত্য প্রমাণিত হচ্ছে। আমরা জানি যে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী নৌবাহিনী রয়েছে আমেরিকা বা যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী আজ পৃথিবীর যেসব দেশের সমু্দ্রসীমা ওই প্রত্যেকটি দেশের সমুদ্রসীমার কাছে অবস্থান করছে। এমন কোনো দেশের সমুদ্রসীমা নেই যার কাছাকাছি যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহর অবস্থান করছে না। উদীয়মান পরাশক্তি চীনের সমুদ্রসীমার কাছেও যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহর অবস্থান করছে। পৃথিবীর বাণিজ্যের বেশির ভাগ আজ যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে। যা ২৪ শতাংশ। একটি দেশের পরাশক্তি হওয়ার জন্য সমুদ্রসীমা ও শক্তিশালী নৌবাহিনী পূর্বশর্ত। যে দেশের সমুদ্রসীমা নেই তার সুপার পাওয়ার হয়ে উঠার কোনো সম্ভাবনা নেই। উদাহরণ স্বরূপ আমরা বলতে পারি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থলবেষ্টিত দেশ কাজাখস্তানের কথা।

সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা না থাকলে দেশের ব্যবসা বাণিজ্যসহ সকল কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এছাড়া কোনো দেশে স্থিতিশীলতা না থাকলে ওই দেশের অস্থিতিশীলতার সুযোগ নেয় অন্যান্য দেশ। ফলে ওই দেশ কখনো সুপার পাওয়ার হয়ে উঠতে পারে না। তাই সুপার পাওয়ার হয়ে উঠার পূর্বশর্ত হলো অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা। সর্বোপরি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ও শক্তিশালী সফট পাওয়ার। সফট পাওয়ার হলো কোনো দেশের পণ্য, নাটক, সিনেমা, গান বাজনা বা আদর্শ। যা সারা পৃথিবীর মানুষ গ্রহণ করে থাকে। এখন পর্যন্ত আমেরিকা এ ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। উদীয়মান সুপার পাওয়ার চীনের আদর্শ পৃথিবীর মানুষের গ্রহণযোগ্য নয়। আর তাছাড়া চীনের কাছে মিডিয়ার প্রপাগান্ডা শক্তিও নেই।

এছাড়া চীনা ভাষার চীনের বাইরে তেমন প্রচলন নেই। যেখানে ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা। বর্তমান সময়ে একটি দেশ সুপার পাওয়ার হয়ে উঠতে গেলে উপরোক্ত শর্ত পূরণ করেই সুপার হয়ে উঠতে হবে। এই শতাব্দীতে আমেরিকার জায়গা অন্য কেউ নিতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে আগামী শতাব্দীতে এর পরিবর্তন হতে পারে।
তখন আরো কয়েকটি দেশের নাম উঠে আসবে সম্ভাব্য সুপার পাওয়ারের তালিকায়। ওইসব দেশগুলো হলো - ১. রাশিয়া, ২. ভারত, ৩. ব্রাজিল, ৪. ইরান ৫. তুরস্ক।

ইরান ও তুরস্কে মুসলিম বিশ্বে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে বেশ অগ্রসর। অন্যদিকে তুরস্কের কাছে রয়েছে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে দক্ষ সেনাবাহিনী। এছাড়া ইতিমধ্যে তুরস্ক কৃষ্ণসাগরে বেশ কয়েকটি গ্যাস ও তেলের বিশাল মজুদ আবিষ্কার করেছে। যার মধ্যে একটি এ বছরের অক্টোবরে চালু হতে পারে। যা তুরস্কের অর্থনীতিকে অনেক বেশি শক্তিশালী করবে। তবে সুপার পাওয়ার হতে গেলে তুরস্ক ও ইরানকে বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। তাহলে আগামী শতাব্দীতে হয়তো তুরস্ক ও ইরান বেশ বড় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে। মুসলিম বিশ্বের একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দক্ষ হলেও পাকিস্তানে যোগ্য নেতৃত্ব, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও শক্তিশালী অর্থনীতির অভাব রয়েছে। এটি পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে উঠার পথে প্রধান বাধা৷ বাংলাদেশের বৃহৎ জনসংখ্যা ও সকল উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। তবে দুটি জিনিস ছাড়া। এক, যোগ্য নেতৃত্ব, দুই বিশাল ভূখণ্ড। এই দুটির অভাব পূরণ করতে পারলে বাংলাদেশও হয়ে উঠতে পারে সুপার পাওয়ার।

চীনের পর সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা রয়েছে ভারতের। তবে প্রযুক্তিগত অদক্ষতা, যোগ্য নেতৃত্বের অভাব, দুর্বল অর্থনীতি ও অশিক্ষিত জনগণ এ পথে প্রধান বাধা।

তথ্যসূত্র

Superpower-Wikipedia [English]
Potential superpowers - Wikipedia
How America became the most powerful country on Earth, in 11 maps Vox - 20 May, 2015.
How to become a superpower in three easy steps by Charles Firth - Griffith Review.
superpower | Definition, Examples, & Facts | Britannica
1898: The Birth of a Superpower - Short History - Department History - Office Of The Historian - Department Of State - United States Of America.
Why the United States Is the Only Superpower- Tufts Now.
China: the Emerging Superpower by/par Major H.A. Hynes - fas.org

লেখক : সাবেক শিক্ষার্থী, আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়, তুরস্ক


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us