যেভাবে কাজ করে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ

মাসুদ আলম | Jun 13, 2021 01:12 pm
যেভাবে কাজ করে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ

যেভাবে কাজ করে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ - ছবি সংগৃহীত

 

এক ফ্রেঞ্চ সাংবাদিকের সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম ২০১৯ সালে। আবুধাবি থেকে প্রকাশিত টাইম আউট (Time Out) ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল সাক্ষাতকারটি। সাংবাদিক লোকটির নাম মনে নেই, তাই ধরে নেই, তার নাম ডেভিড।

ডেভিড বলেছিলেন, আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় আমার এক সহপাঠী বন্ধু ছিলেন হানান। তিনি এসেছিলেন দখলদার ইসরাইল থেকে।

দীর্ঘ প্রায় দুই দশক পরে ফ্রান্সের রেন্নেস শহরে হঠাৎ তার সাথে আমার দেখা। তিনি আমাকে না চেনার ভান করে কেটে পরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি তাকে আগলে ধরি। তিনি ছিলেন আমার অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ভালো বন্ধু। এখানে তাকে এক সামান্য সবজি বিক্রেতা হিসেবে দেখি, যেটা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। কারণ তিনি ছিলেন গণযোগাযোগ (mass communication) বিষয়ে পড়ুয়া তুখোড় ছাত্র।

আমি তার সাথে কথা বলে জানতে পারি, তিনি শহরের বাইরে সপরিবারে বসবাস করেন, লিজ নেয়া কৃষি জমিতে নিজেই সবজি ফলান এবং শহরে তার নিজের দোকানে বিক্রি করেন। শহরের অনেক নামি-দামি ব্যক্তির বাড়িতে অর্গানিক (বিষমুক্ত) সবজি সরবরাহ করে থাকেন। আমি রেন্নেস শহরে গেলে তার সবজি খামারে যেতাম, তার সাথে গল্প করতাম। তিনি চমৎকারভাবে ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলতেন, একেবারে স্থানীয় ফ্রেঞ্চদের আঞ্চলিক ভাষা, ফলে মনেই হতো না যে তিনি বিদেশী!

একবার রেন্নেসে বেড়াতে গিয়ে দেখলাম, তার সবজির দোকান হাত বদল হয়েছে, তার কৃষি খামারে গেলাম, সেখানে জানানো হলো যে তিনি বছর দুয়েক হলো সপরিবারে নিরুদ্দেশ হয়েছে তার কোনো খবর নেই!

তার সাথে পাঁচ বছর পর আবার যোগাযোগ হলো, তাকে খুঁজে পেলাম ফেসবুকের মাধ্যমে, টেলিফোনেও কথা হয়। তিনি এখন তেল আবিব শহরে বসবাস করে, অবসরপ্রাপ্ত মোসাদ কর্মকর্তা!

কথাটা শুনে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো, বললাম তুমি কি তাহলে ফ্রান্সে মোসাদের কোনো মিশনে ছিলে?
ডেভিড : হ্যাঁ, একজন কলম্বিয়ান ড্রাগ মাফিয়া যিনি ইতালিয়ান নাগরিকত্ব নিয়ে ফ্রান্সে বসবাস করত, তাকে ডাউন করতে (মেরে ফেলতে) আমার মিশন ছিল ফ্রান্সে।

ডেভিড : তুমি তো ভালো ফ্রেঞ্চ বলতে পারো!
: হ্যাঁ, আমি ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরে ১০ বছর কাটিয়েছি। পাঁচ বছর রেন্নেসে। যখন নিশ্চিত হলাম, ড্রাগ মাফিয়া মোরালেস লোকটি রেন্নেস শহরে নিজস্ব এপার্টমেন্ট কিনে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। আমি অনেক চেষ্টায় তার বাসায় অর্গানিক সবজি ও ফল সরবরাহ করার কাজ নেই। এই কাজটি পেতে আমার অনেক অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। সে এখানে বসেই কলম্বিয়ায় শীর্ষস্থানীয় কোকেন ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করত...! আমার উপর এ কাজটির (তাকে শেষ করার) দায়িত্ব পরে। সে খুব ঘন ঘন আবাসন পরিবর্তন করত, দুই মাস- তিন মাস পরপর এলাকা এমনকি শহর পরিবর্তন করত। আমরা একসময় নিশ্চিত হলাম, সে এই শহরে নিজস্ব এপার্টমেন্ট কিনেছে এবং মাঝে মাঝে এখানে পরিবারের সাথে রাত্রিযাপন করে থাকে।

এটা ছিল মূলত কলম্বিয়ান প্রজেক্ট। তবে ইসরাইলের স্বার্থ জড়িত ছিল। ১০ বছরের সমস্ত খরচ মোসাদ বহন করেছে। আমাদের কাছে প্রমাণ ছিল যে সে মধ্যপ্রাচ্যের ড্রাগ মাফিয়াদের সাথে ঘনিষ্ঠতা রাখে এবং তার বাহিনীই মধ্যপ্রাচ্যের দায়িত্বে আছে। সে ইসরাইল ভ্রমণ করেছিল কয়েকবার।

একদিন ব্যবসায়ীদের কালচারাল পার্টির একটি অনুষ্ঠানে তার (ড্রাগ মাফিয়ার) স্ত্রী এবং সন্তানদের দাওয়াত দেই। যেহেতু তারা ছিল আমার সবজি ও ফলের পাকা গ্রাহক, অনেক অনুরোধের পর তারা রাজি হয়। পার্টিতে তার স্ত্রী সন্তানদের বিভিন্ন রাইডে চড়িয়ে এবং ডিনারে যথেষ্ট সন্মানের সাথে আপ্যায়ন করা হয়। ওই রাতেই মাফিয়া সম্রাট মোরালেসকে তার এপার্টমেন্টে বিষাক্ত ছুরি মেরে হত্যা করা হয়, তার বাসায় সবকিছু তছনছ করে তার বিভিন্ন নথিপত্র নিয়ে নেই। ফ্রেঞ্চ পুলিশ সেটাকে 'চুরির জন্য হত্যা' মামলা বলে নথিভুক্ত করেছিল। (সংক্ষেপিত)

ম্যাগাজিনটি আল আইনের লুলু সুপারমার্কেট থেকে ফ্রি নিয়েছিলাম, ঘটনাটি বা বিষয়টি আজকে মনে করার কারণ হলো- ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর ইরানের একজন শীর্ষস্থানীয় পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসিন ফখরজাদেহ্ আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। তিনি ছিলেন ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক প্রকল্পের প্রধান বিজ্ঞানী। তার হত্যার পর ইরান কয়েক দিন চুপ ছিল। তারপর কিছু দিন পর বলেছিল যে এটা দখলদার ইসরাইলের কাজ এবং এর পিছনে স্থানীয় 'বেঈমানরা' সম্পৃক্ত আছে।

কিছুদিন পর ইরানি প্রশাসন একজন ইরানিকে গ্রেফতার করে এবং মোসাদকে সহযোগিতার প্রমাণ পাওয়ায় তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।
ফখরজাদেহ্কে হত্যার খবর শুনে আমি একটি ফেসবুক পোস্ট করেছিলাম, আমার কাছে মনে হয়েছিল যে এই হত্যাকাণ্ডটি মোসাদই ঘটিয়েছে। এর কারণ হলো- ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পে গোয়েন্দাগিরি করার ক্ষমতা, মানসিকতা ও প্রয়োজনীয়তা আছে কেবল দুটি দেশের- একটি আমেরিকা এবং অন্যটি দখলদার ইসরাইল।

ইরানের সেই শঙ্কা/ধারণা (আমার ধারণাও বটে) আজকে বাস্তব প্রমাণিত হলো।

কিভাবে?

সেটা হলো, গতকালের দ্যা গার্ডিয়ান এবং বিবিসি'র অনলাইন সংবাদপত্রে দেখলাম মোসাদের একজন অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ইয়োচ্ছি কোহেন যিনি পাঁচ বছর এই গোয়েন্দা সংস্থাটির প্রধান ছিলেন, তিনি সম্প্রতি চ্যানেল ১২ টেলিভিশনের সাংবাদিক ইলানা ডায়ানের সাথে এক সাক্ষাৎকারে খোলামেলা ভাবে ইরানে হামলার দায় স্বীকার করেছেন।

তিনি বলেন, ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প কেন্দ্রের আর্কাইভ থেকে হাজার হাজার গোপন নথিপত্র তারা চুরি করে ইসরাইলে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। অবশ্য এ কাজে একজন ইসরাইলিও অংশ নেয়নি, ২০ জন ইরানি এজেন্ট তাদেরকে এই চুরির কাজে সহায়তা করেছে। আর এই চুরির কার্যক্রম তারা ইসরাইলে মোসাদের সদর দফতরে বসে 'লাইভ' দেখেছে।

চুরি করা এসব দলিলের মূলকপি ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সংবাদ সন্মেলনে প্রদর্শন করেন।

মোহসিন ফখরজাদেহ্কে রিমোট কন্ট্রোলড বোমা মেরে হত্যার দায়ও তিনি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, এ কাজটির পরিকল্পনা করতে আমাদের ঠিক দুই বছর সময় লেগেছে!

সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে কোহেন বলেন, মোসাদের চাকরি জীবনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘুরতে আমি কয়েক শ' পাসপোর্ট ব্যবহার করেছি।

তাহলে এবার ভাবুন, মোসাদের কার্যক্রম কেমন? আর কেমনই বা তাদের খরচ মেধা, কৌশল আর ধৈর্য!

২০২১ সালে মোসাদ- এর বাজেট কত জানেন?
মাত্র তিন বিলিয়ন ডলার! মানে ৩০০ কোটি ডলার বা প্রায় ২৬০০০ কোটি টাকা মাত্র!


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us