ভারতকে ঘিরে ফেলেছে চীন!

মো: বজলুর রশীদ | Jun 17, 2021 09:15 pm
চীনা নৌবাহিনী

চীনা নৌবাহিনী - ছবি : সংগৃহীত

 

চীনকে নিয়ে পড়শিদের অনেক হিসাব-নিকাশ। স্বার্থের নীতিতে অন্য প্রতিবেশীরা সমর্থন করছে না। জাপান ইতোমধ্যে দশক পুরনো শান্তিবাদ নীতি পরিহার করে নিজের দেশকে অস্ত্রসজ্জিত করতে চলেছে। অস্ত্র রফতানি ও অত্যাধুনিক অস্ত্র বানানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে, একই সাথে আধুনিক যুদ্ধসরঞ্জাম সংগ্রহ করছে এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ বিমান ও মিসাইল ডিফেন্স ব্যাটারিও রয়েছে। ভারতীয় মহাসাগরে চীনের প্রভাব সম্পর্কে ভারত ওয়াকিবহাল। ভারত তার নৌশক্তি আরো বড় ও উন্নত করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। ভারতও নিজেদের প্রযুক্তিতে কেরিয়ার বানানো শুরু করেছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও ভারত সামরিক দিক উন্নত করার প্রয়াস চালাচ্ছে; ফ্রান্স ও চিলি থেকে যুদ্ধ সরঞ্জাম সংগ্রহ করছে।

ভয়াবহ আর্থিক সঙ্কটেও ভারত সরকার অত্যাধুনিক একঝাঁক সাবমেরিন নির্মাণ খাতে ৫০ হাজার কোটি রুপি বরাদ্দ করেছে। ভারতীয় নৌবাহিনী ২৪টি সাবমেরিন নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডারে যুক্ত করতে চলেছে। তার মধ্যে ছয়টি সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তির নিউক্লিয়ার অ্যাটাক সাবমেরিন। নতুন সাবমেরিন সিরিজের মধ্যে থাকবে ১২টি ল্যান্ড অ্যাটাক ক্রুজ মিসাইল এবং অ্যান্টি শিপ ক্রুজ মিসাইল। ডুবোজাহাজগুলো সমুদ্রের মধ্যেই টর্পেডো বহন এবং নিক্ষেপ করতে পারবে। ভারতের সামরিক ইতিহাসে এই সাবমেরিন প্রজেক্ট হতে চলেছে সবচেয়ে আধুনিক একটি প্রতিরক্ষা প্রকল্প। ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, দক্ষিণ কোরিয়া ও রাশিয়ার পাঁচটি সংস্থার সাথে যৌথ উদ্যোগে চুক্তি সম্পাদন করে পি-৭৫ আই ক্লাস ডুবোজাহাজগুলো নির্মিত হবে। প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছিলেন, সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হবে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পে। এটি তার এক উদাহরণ।

ভারত এখন আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে চীনের প্রতিপক্ষ। চীন ইতোমধ্যে নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে পয়েন্ট ধরে ভারতের চার দিকে বলয় তৈরি করেছে, ভারত মহাসাগরেও প্রভাব বিস্তার করছে। একইভাবে ভারতও পাকিস্তান বাদে অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্ক রেখে চীনকে কাউন্টার দেয়ার কাজ করছে। চীনের বিরোধিতা করার উপযুক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে বেছে নিয়েছে। কোনো এশিয়ান সুপার পাওয়ারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে একমাত্র ভরসা বলে মনে করা হয়। কমিউনিস্ট দেশ ভিয়েতনাম তার পুরনো শত্রু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সখ্যতার দুয়ার খুলে দিয়েছে, উত্তর ভিয়েতনামের কেম রেন নৌবন্দরে যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ ভেড়ার অনুমতি দিয়েছে, একই সাথে নিজের নৌশক্তিকে শক্তিশালী করার জন্য রাশিয়া, ভারত ও অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির সাথে চুক্তি করছে। অনুরূপভাবে অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্রের নেভি জাহাজকে নোঙর করানোর জন্য পোতাশ্রয়ের আয়তন বৃদ্ধি করেছে।

গত দশকে ভারত মহাসাগর লক্ষ রেখে চীন পাকিস্তানের বন্দর গোয়াধরকে সামরিক ও বাণিজ্যে কৌশলগত উত্তরণে সমৃদ্ধ করেছে। নির্মাণ করেছে বিভিন্ন প্রকল্প, যা এখনো চলমান। যার বেশির ভাগ বাইরের বিশ্ব জানে না। গোয়াধর হরমুজ প্রণালীর কাছেই বলতে হয়। প্রয়োজনে গোয়াধর থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর আসা-যাওয়া সহজ। চট্টগ্রাম বন্দরকে আরো আধুনিক উন্নত বন্দর করার জন্য ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উদগ্রীব। এর মধ্যে চীন শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরকে আধুনিকীকায়ন করেছে। বড় জাহাজ অবস্থানের বার্থ বানানো হয়েছে। চীনের বাণিজ্য ও সামরিক কাজকর্ম সহজে সম্পন্ন করা যাবে এই বন্দরের মাধ্যমে। পাকিস্তানও উপকৃত হবে। এখান থেকে শ্রীলঙ্কা গোয়াধর বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। শ্রীলঙ্কায় ইমরান খানের সফরে এ চুক্তিও হয়েছে। নয়া দিগন্তে প্রকাশিত আমার লেখা ‘শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তান : কূটনীতি থেকে বন্ধুত্ব’ নিবন্ধে বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে গোয়াধর-হাম্বানটোটা-চাবাহার-হরমুজ প্রণালীতে চীনের একচ্ছত্র অবাধ চলাচল। পারস্য উপসাগর, ওমান সাগর ও ভারত মহাসাগরের একাংশ সম্পূর্ণ চীনের কব্জায়। দক্ষিণ চীন সাগরেও একই অবস্থা। এশিয়া প্যাসিফিক ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রির প্রসিদ্ধ ভাষ্যকার জন গ্রাভেট বলেছেন, ‘দক্ষিণ চীনসাগরে চীন সামরিক শক্তিতে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছে যে, অন্য শক্তির উত্তরণকে সমস্যায় ফেলেছে।’ শক্তির উন্মেষকে চীনারা বলেন প্যাক্স সিনিকা-শান্তি, মহাশান্তি।

বিবিসি ও অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব সিডনির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চীনের সামরিক শক্তিকে সুপার পাওয়ার না বলে অনেক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করছে এমন বলাই সঙ্গত। বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কৌশল ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নজিরবিহীন সঙ্কটে রয়েছে। শতাব্দী ধরে ওভারসিজ মিশনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে যে দাপট দেখিয়েছে এখন সেখানে চীন পদচারণা শুরু করেছে। চীন এশিয়া ও নিজেদের আশপাশে শক্তি বৃদ্ধি করতে চায় এবং এশিয়াতে চীন ইতোমধ্যে একটা সুপার পাওয়ার হয়ে উঠেছে বিধায় তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে। বিবিসি জানিয়েছে, চীন যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতা এবং যুদ্ধের লড়াই নিয়ে গবেষণা করেছে এবং তারা একটা কার্যকর কৌশল তৈরি করেছে। এশিয়া প্যাসিফিকে কোনো যুদ্ধ শুরু হলে চীন ‘ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইন’ ও ‘সেকেন্ড আইল্যান্ড চেইন’ কৌশলী ব্যূহ রচনা করবে, যাতে যুক্তরাষ্ট্র সমুদ্রে ব্যাটল চার্জ করতে না পারে। ‘ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইন’ হলো দক্ষিণ চীনসাগর বরাবর একগুচ্ছ দ্বীপ। এই দ্বীপের সারি শুরু হয়েছে জাপানের তলা থেকে যা তাইওয়ান পার হয়ে ফিলিপাইনের পশ্চিম দিক অতিক্রম করেছে! ‘সেকেন্ড আইল্যান্ড চেইন’ সাগরের আরো দূরবর্তী অংশের দ্বীপপুঞ্জের একটি সারি যার মধ্যে গুয়াম দ্বীপও রয়েছে। এই গুয়াম দ্বীপে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। চীন তাদের অস্ত্র ব্যবহার করে এই গুয়ামকেও ঠেকাতে চায়। গুয়ামে পরমাণু হামলা করে সব পানিতে মিশিয়ে দিতে উত্তর কোরিয়ার কিম উন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে হুমকি দিয়েছিলেন। এমনকি হামলার সময়সীমাও নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। চীনের এসব কৌশল সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রও ওয়াকিবহাল।

বেইজিং রাশিয়াকে নিয়ে বিশ্বব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক আইনানুসারে রক্ষা করার জন্য দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করেছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্জেই ল্যাভরবের সাথে আলাপ করে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই মিডিয়ায় এ কথা বলেন। ‘আন্তর্জাতিক বিষয়ে আমরা অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতে চাই।’ ওয়াং ই আরো বলেন, ‘জাতিসঙ্ঘের প্রদর্শিত নীতিমালা অনুসারে আন্তর্জাতিক সিস্টেম সঠিক রাখতে আমরা কাজ করব যেখানে সর্বজনীন মূল্যবোধ মেনে শান্তি, উন্নয়ন, সুবিচার, গণতন্ত্র, সমতা ও স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করা হবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার

 

 

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us