চীনের কাছে হেরে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র!

গৌতম দাস | Jun 19, 2021 05:41 pm
জো বাইডেন

জো বাইডেন - ছবি সংগৃহীত

 

চীন-আমেরিকার বিরোধকে হালকা ভাষায় বললে এটা বাণিজ্য বিরোধ বা বড় জোর বাণিজ্যযুদ্ধ বলা শুরু হয়েছিল যা চলে আসছে কেবল ট্রাম্প আমল থেকে এ পর্যন্ত। কারণ ওবামা আমল পর্যন্ত এটা বিরোধ বা বাণিজ্যযুদ্ধ হিসেবেও দেখা দিতে দেয়া হয়নি। তবে ওবামা দুবারই প্রেসিডেন্ট হবার পরে চীন সফরে গিয়েছেন আর চীন তাকে একগাদা বাণিজ্য সুবিধা হাতে ধরিয়ে দিয়েছে আর তা দিয়েই সেটা আর কখনো বিরোধ বা কোনো বাণিজ্যযুদ্ধ হিসেবেও হাজির হয়নি। এমনকি ট্রাম্পের প্রথম বছরেও (২০১৭) তিনি এমনই ভাবে সফরে গিয়ে আরো বাণিজ্য সুবিধা নিয়ে এসেছিলেন যেটা পরের বছর (২০১৮) থেকে আর ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ টার্মটা ব্যবহার না করে পারেনি। তাহলে এটা কি ব্যক্তি ট্রাম্পের জাতিবাদী ভাব নিয়ে আগানোর সমস্যা, নাকি এটা অনিবার্য ছিল? জবাব হলো, এটা অবশ্যই অনিবার্য ছিল। তবে ট্রাম্পের জাতিবাদ এটাকে সহজ করবে মনে করতে গিয়ে ব্যাপারটাকে আরো জটিল করে তুলেছেন।

আসলে এটা যে অনিবার্য তা নিক্সন-কিসিঞ্জারও জানতেন। এটা হলো আমরা যখন রিফুজি হয়ে ভারতে আশ্রয় খুঁজছি সেই একাত্তরের জুলাইয়ে কিসিঞ্জার প্রথম গোপনে চীন সফরে গিয়েছিলেন। ফলে মাওয়ের চীন সফরে যাওয়া প্রথম কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলেন নিক্সন। তিনি ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে চীন সফরে যান। আর সেই থেকে সেকালের বিনিয়োগ-খরায় থাকা চীনে বিনিয়োগ নিয়ে হামলে পড়ার সুযোগ পেয়ে আমেরিকার বিনিয়োগপাড়া ওয়াল স্ট্রিট ছিল সবচেয়ে খুশি।

কিন্তু সেদিনও ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ সবাই জানতেন এই সুখ সাময়িক। কারণ এতে একদিন চীনই বড় হয়ে এই আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ জানাবে। কিন্তু সেসব ভুলে বিনিয়োগ গ্রাহক চীনের বিশাল বাজার তাৎক্ষণিকভাবে আমেরিকাকে বিশাল লাভালাভ রিলিফ দেবে, পাওয়া যাবে- এটাই ছিল মুখ্য বিবেচনা। ক্যাপিটালিজমের আদি এবং অনিবার্য স্ববিরোধ হলো, সে নিজেই ক্রমশ বাজার সঙ্কুচিত করবেই। তাতে আবার একসময় নতুন বাজার পাওয়ার সঙ্কটে পুরান মালিকেরা দিশেহারা হবেন আর নতুন উত্থিত মালিক তাকে চ্যালেঞ্জ করবেনই। তাই বলছি, সেই ১৯৭২ সাল থেকেই সবাই জানত এদিন আসবেই। এমনকি এখনকার ওয়াল স্ট্রিটের লিডার (গোল্ডম্যান স্যাক্সে) যারা তারা ইতোমধ্যেই আমেরিকান রাষ্ট্র ছেড়ে চীনা রাষ্ট্রের ভক্ত-পরামর্শক হয়ে গেছেন।

বাইডেন এবারের জি-৭ মানে ধনী সাত দেশের এক ক্লাবের বৈঠকে যোগ দিতে আয়োজনস্থল ব্রিটেনের কর্নওয়ালে গিয়েছিলেন। সত্যিকারভাবে জি-৭ হলো গ্লোবাল নেতা আমেরিকার একক সিদ্ধান্তগুলো ইউরোপের সাথে সমন্বয় করে নেয়ার এক সভা যাতে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকসহ গ্লোবাল প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক স্বরে পশ্চিমাদেশগুলো যেন কথা বলে বাকি রাষ্ট্রের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে পারে। জি-৭ এর জন্ম হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। তবে এভাবে জি-৭ নামে বসা একেবারেই ইনফরমাল। মানে হলো যেমন, বিশ্বব্যাংকের উপরে কোনো ফরমাল মাতব্বরি প্রতিষ্ঠান জি-৭ নয়।
এভাবে সত্তরের দশক থেকে জি-৭ এর শীর্ষ বৈঠক ব্যবস্থা চলে এলেও এবারই প্রথম চীনকে পশ্চিমা দেশ তাদের যেন এনিমি করে দেখেই কিছু কথা বলা হয়েছে; এমনকি গত ২০১৮ সালের সম্মেলনেও কারো নাম উল্লেখ করেনি।

জি-৭ ফ্যাক্টসশিট
এবারের জি-৭ বৈঠক উপলক্ষে হোয়াইট হাউজ থেকে এক ফ্যাক্টসশিট বুলেটিন বের হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘বাইডেন চীনের সাথে কৌশলগত প্রতিযোগিতা’ প্রসঙ্গে এখানে জি-৭ বৈঠকে নেতাদের সাথে আলোচনা করেছেন। অর্থাৎ চীনের নাম নিয়েই কথাটা তিনি বলেছেন। আবার দ্বিতীয়ত তিনি ঠিক শত্রু দেশ বলেননি; বলেছেন যার সাথে তার ‘কৌশলগত প্রতিযোগিতা’ আছে, এভাবে বলেছেন। অর্থাৎ এবার স্বীকার করে নিলেন চীনের সাথে আমেরিকার কৌশলগত প্রতিযোগিতার সম্পর্ক আছে। কিন্তু সে কথা এবারই প্রথম বলা হলো কেন?

আগেই বলেছি, ১৯৭২ সাল থেকে চীন তো আমেরিকার কাছে খুবই আদরের দেশ ছিল। কারণ চীন ছিল সবচেয়ে বড় জনসংখ্যার বড় ঋণ খাতক দেশ। আর সেই সাথে আমেরিকার হাইটেক পণ্যের আমদানি দেশ। কিন্তু চীনই ২০১০ সালের পর থেকে হয়ে যায় সরাসরি আমেরিকার বাণিজ্যবিরোধের দেশ, প্রতিযোগী যেখান থেকে আজ গ্লোবাল অর্থনীতির নেতৃত্ব আগামীতে আমেরিকা থেকে কেড়ে নেয়ার দেশ। তাই এই প্রথম লজ্জার মাথা খেয়ে বাইডেন স্বীকার করেছেন যে, চীন আমেরিকার সাথে কৌশলগত প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্কে আছে। ফলে সরাসরি না হলেও নাম উল্লেখ করে স্বীকার করে নিলেন চীনের কাছে আমেরিকা নেতৃত্ব হারাতে যাচ্ছে, তাই ‘কৌশলগত প্রতিযোগী’।

এখন প্রশ্ন হলো আমেরিকা প্রতিযোগিতা করার যোগ্য কী? কতটা? জবাব হলো, না যোগ্য নয়। কারণ আমেরিকা চীনের কাছে হেরে যাবে। ঠিক যেমন এককালে ব্রিটেনও আমেরিকার কাছে হেরে গিয়েছিল। কারণ বিষয়গুলো অবজেকটিভ ফেনোমেনা বা ঘটনা। ক্যাপিটালিজমের কপালই এমন!
যেসব গরিব ব্রিটেনবাসীকে এককালে আমেরিকায় কলোনিদখলকারী ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা বিনা পয়সায় জাহাজ ভরে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল সেখানে জমি দেয়ার লোভ দেখিয়ে- পরে ১৭৭৬ সালে ওই গরিব ও চাষাবাদ করে খাওয়া লোকেরা কলোনি দখলকারী ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের সশস্ত্রভাবে উৎখাত করে নিজেদের আমেরিকাকে স্বাধীন ঘোষণা করেছিল। এরও পরে ১৮৮২ সালের পর থেকে আমেরিকা ক্যাপিটাল একুমুলেশনের বা উদ্বৃত্ত সঞ্চিত সম্পদের দিক থেকে ব্রিটেনকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এটা থেকে পরে ১৯৪৫ সালে মহাযুদ্ধ শেষে আমেরিকাই গ্লোবাল নেতা হয়ে যায়। ঠিক যেন একইভাবে এখনকার পূর্বাভাস হলো, ২০২৮ সালে চীন আমেরিকাকে ছাড়িয়ে দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ হয়ে যাচ্ছে।

ক্ষমতায় এসে এখন বাইডেন যে সিদ্ধান্ত নিলেন সেটা অবাস্তব স্বপ্ন-কল্পনার দিকে যাত্রা। সেটা হলো, আমেরিকা আবার দুনিয়াকে শাসন করেই যাবে। সেজন্যই গত নির্বাচনের সময় থেকে জিতার পরেও এখন তার স্লোগান হলো ‘আমেরিকা ইজ ব্যাক’। না এটা আমেরিকার (নেতাগিরিতে) ফেরত আসা নয়, বরং বাইডেন মানে ডেমোক্রেটরা ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন, মাত্র। আমেরিকা নয়। সোজাসাপ্টা বললে তিনি মিথ্যা আশ্বাসের স্লোগান দিচ্ছেন।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us