যেভাবে টেক্কা দিলো চীন

গৌতম দাস | Jun 19, 2021 05:54 pm
চীনা প্রেসিডেন্ট

চীনা প্রেসিডেন্ট - ছবি সংগৃহীত

 

জো বাইডেন মার্কিন ক্ষমতার শপথ নেয়ার চার মাসের মাথায় চীনের বিরুদ্ধে জি-৭ জোট আর ন্যাটোকে দিয়ে আসলে যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন। এতে ক্ষুব্ধ চীন বলেছে, কয়েকটা ছোট দেশের জোট দুনিয়ার ভাগ্য নির্ধারণ করার দিন শেষ। তবে বাইডেনের ওসব কথাবার্তা অপ্রস্তুত থেকে বলা। কারণ ঠিক কোথায় কিভাবে তিনি পৌঁছাতে চান, তাতে আমেরিকার লাভ কী? অথবা বলা যায় সেটা সম্ভব কিনা, আমেরিকার সেই মুরোদ এখনো আছে কিনা, হোমওয়ার্ক যথেষ্ট করেছেন কিনা, এসব প্রশ্নের জবাব বাইডেনের সাথে আছে, তা তার পদক্ষেপের মধ্যে ছাপ বা প্রমাণ নেই।

ন্যাটোর হুমকি দিয়েছেন তিনি? অথচ তার কী মনে নেই, কেন ওবামা ইরানের সাথে আপস করেছিলেন? ইরানের জন্ম থেকে আরোপিত নানা অবরোধ ওবামা তুলে নিয়েছিলেন, ‘চ৫+১’ এর পারমাণবিক চুক্তি করেছিলেন- কেন? কারণ ইরাকে আইএস-এর তৎপরতা ও দখলদারি শুরু হলেও তাতে আমেরিকার খরচ বইবার মুরোদ ছিল না যে, আবার ইরাকে সৈন্য পাঠায়। আর এ কাজটাই ইরানি সেনাবাহিনী করে দেবে বলে তিনি আপস করেছিলেন। কাজেই...।

চীন-আমেরিকার বিরোধকে হালকা ভাষায় বললে এটা বাণিজ্য বিরোধ বা বড় জোর বাণিজ্যযুদ্ধ বলা শুরু হয়েছিল যা চলে আসছে কেবল ট্রাম্প আমল থেকে এ পর্যন্ত। কারণ ওবামা আমল পর্যন্ত এটা বিরোধ বা বাণিজ্যযুদ্ধ হিসেবেও দেখা দিতে দেয়া হয়নি। তবে ওবামা দুবারই প্রেসিডেন্ট হবার পরে চীন সফরে গিয়েছেন আর চীন তাকে একগাদা বাণিজ্য সুবিধা হাতে ধরিয়ে দিয়েছে আর তা দিয়েই সেটা আর কখনো বিরোধ বা কোনো বাণিজ্যযুদ্ধ হিসেবেও হাজির হয়নি। এমনকি ট্রাম্পের প্রথম বছরেও (২০১৭) তিনি এমনই ভাবে সফরে গিয়ে আরো বাণিজ্য সুবিধা নিয়ে এসেছিলেন যেটা পরের বছর (২০১৮) থেকে আর ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ টার্মটা ব্যবহার না করে পারেনি। তাহলে এটা কি ব্যক্তি ট্রাম্পের জাতিবাদী ভাব নিয়ে আগানোর সমস্যা, নাকি এটা অনিবার্য ছিল? জবাব হলো, এটা অবশ্যই অনিবার্য ছিল। তবে ট্রাম্পের জাতিবাদ এটাকে সহজ করবে মনে করতে গিয়ে ব্যাপারটাকে আরো জটিল করে তুলেছেন।
আসলে এটা যে অনিবার্য তা নিক্সন-কিসিঞ্জারও জানতেন। এটা হলো আমরা যখন রিফুজি হয়ে ভারতে আশ্রয় খুঁজছি সেই একাত্তরের জুলাইয়ে কিসিঞ্জার প্রথম গোপনে চীন সফরে গিয়েছিলেন। ফলে মাওয়ের চীন সফরে যাওয়া প্রথম কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলেন নিক্সন। তিনি ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে চীন সফরে যান। আর সেই থেকে সেকালের বিনিয়োগ-খরায় থাকা চীনে বিনিয়োগ নিয়ে হামলে পড়ার সুযোগ পেয়ে আমেরিকার বিনিয়োগপাড়া ওয়াল স্ট্রিট ছিল সবচেয়ে খুশি।

কিন্তু সেদিনও ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ সবাই জানতেন এই সুখ সাময়িক। কারণ এতে একদিন চীনই বড় হয়ে এই আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ জানাবে। কিন্তু সেসব ভুলে বিনিয়োগ গ্রাহক চীনের বিশাল বাজার তাৎক্ষণিকভাবে আমেরিকাকে বিশাল লাভালাভ রিলিফ দেবে, পাওয়া যাবে- এটাই ছিল মুখ্য বিবেচনা। ক্যাপিটালিজমের আদি এবং অনিবার্য স্ববিরোধ হলো, সে নিজেই ক্রমশ বাজার সঙ্কুচিত করবেই। তাতে আবার একসময় নতুন বাজার পাওয়ার সঙ্কটে পুরান মালিকেরা দিশেহারা হবেন আর নতুন উত্থিত মালিক তাকে চ্যালেঞ্জ করবেনই। তাই বলছি, সেই ১৯৭২ সাল থেকেই সবাই জানত এদিন আসবেই। এমনকি এখনকার ওয়াল স্ট্রিটের লিডার (গোল্ডম্যান স্যাক্সে) যারা তারা ইতোমধ্যেই আমেরিকান রাষ্ট্র ছেড়ে চীনা রাষ্ট্রের ভক্ত-পরামর্শক হয়ে গেছেন।

বাইডেন এবারের জি-৭ মানে ধনী সাত দেশের এক ক্লাবের বৈঠকে যোগ দিতে আয়োজনস্থল ব্রিটেনের কর্নওয়ালে গিয়েছিলেন। সত্যিকারভাবে জি-৭ হলো গ্লোবাল নেতা আমেরিকার একক সিদ্ধান্তগুলো ইউরোপের সাথে সমন্বয় করে নেয়ার এক সভা যাতে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকসহ গ্লোবাল প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক স্বরে পশ্চিমাদেশগুলো যেন কথা বলে বাকি রাষ্ট্রের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে পারে। জি-৭ এর জন্ম হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। তবে এভাবে জি-৭ নামে বসা একেবারেই ইনফরমাল। মানে হলো যেমন, বিশ্বব্যাংকের উপরে কোনো ফরমাল মাতব্বরি প্রতিষ্ঠান জি-৭ নয়।
এভাবে সত্তরের দশক থেকে জি-৭ এর শীর্ষ বৈঠক ব্যবস্থা চলে এলেও এবারই প্রথম চীনকে পশ্চিমা দেশ তাদের যেন এনিমি করে দেখেই কিছু কথা বলা হয়েছে; এমনকি গত ২০১৮ সালের সম্মেলনেও কারো নাম উল্লেখ করেনি।

জি-৭ ফ্যাক্টসশিট
এবারের জি-৭ বৈঠক উপলক্ষে হোয়াইট হাউজ থেকে এক ফ্যাক্টসশিট বুলেটিন বের হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘বাইডেন চীনের সাথে কৌশলগত প্রতিযোগিতা’ প্রসঙ্গে এখানে জি-৭ বৈঠকে নেতাদের সাথে আলোচনা করেছেন। অর্থাৎ চীনের নাম নিয়েই কথাটা তিনি বলেছেন। আবার দ্বিতীয়ত তিনি ঠিক শত্রু দেশ বলেননি; বলেছেন যার সাথে তার ‘কৌশলগত প্রতিযোগিতা’ আছে, এভাবে বলেছেন। অর্থাৎ এবার স্বীকার করে নিলেন চীনের সাথে আমেরিকার কৌশলগত প্রতিযোগিতার সম্পর্ক আছে। কিন্তু সে কথা এবারই প্রথম বলা হলো কেন?

আগেই বলেছি, ১৯৭২ সাল থেকে চীন তো আমেরিকার কাছে খুবই আদরের দেশ ছিল। কারণ চীন ছিল সবচেয়ে বড় জনসংখ্যার বড় ঋণ খাতক দেশ। আর সেই সাথে আমেরিকার হাইটেক পণ্যের আমদানি দেশ। কিন্তু চীনই ২০১০ সালের পর থেকে হয়ে যায় সরাসরি আমেরিকার বাণিজ্যবিরোধের দেশ, প্রতিযোগী যেখান থেকে আজ গ্লোবাল অর্থনীতির নেতৃত্ব আগামীতে আমেরিকা থেকে কেড়ে নেয়ার দেশ। তাই এই প্রথম লজ্জার মাথা খেয়ে বাইডেন স্বীকার করেছেন যে, চীন আমেরিকার সাথে কৌশলগত প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্কে আছে। ফলে সরাসরি না হলেও নাম উল্লেখ করে স্বীকার করে নিলেন চীনের কাছে আমেরিকা নেতৃত্ব হারাতে যাচ্ছে, তাই ‘কৌশলগত প্রতিযোগী’।

এখন প্রশ্ন হলো আমেরিকা প্রতিযোগিতা করার যোগ্য কী? কতটা? জবাব হলো, না যোগ্য নয়। কারণ আমেরিকা চীনের কাছে হেরে যাবে। ঠিক যেমন এককালে ব্রিটেনও আমেরিকার কাছে হেরে গিয়েছিল। কারণ বিষয়গুলো অবজেকটিভ ফেনোমেনা বা ঘটনা। ক্যাপিটালিজমের কপালই এমন!
যেসব গরিব ব্রিটেনবাসীকে এককালে আমেরিকায় কলোনিদখলকারী ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা বিনা পয়সায় জাহাজ ভরে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল সেখানে জমি দেয়ার লোভ দেখিয়ে- পরে ১৭৭৬ সালে ওই গরিব ও চাষাবাদ করে খাওয়া লোকেরা কলোনি দখলকারী ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের সশস্ত্রভাবে উৎখাত করে নিজেদের আমেরিকাকে স্বাধীন ঘোষণা করেছিল। এরও পরে ১৮৮২ সালের পর থেকে আমেরিকা ক্যাপিটাল একুমুলেশনের বা উদ্বৃত্ত সঞ্চিত সম্পদের দিক থেকে ব্রিটেনকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এটা থেকে পরে ১৯৪৫ সালে মহাযুদ্ধ শেষে আমেরিকাই গ্লোবাল নেতা হয়ে যায়। ঠিক যেন একইভাবে এখনকার পূর্বাভাস হলো, ২০২৮ সালে চীন আমেরিকাকে ছাড়িয়ে দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ হয়ে যাচ্ছে।

ক্ষমতায় এসে এখন বাইডেন যে সিদ্ধান্ত নিলেন সেটা অবাস্তব স্বপ্ন-কল্পনার দিকে যাত্রা। সেটা হলো, আমেরিকা আবার দুনিয়াকে শাসন করেই যাবে। সেজন্যই গত নির্বাচনের সময় থেকে জিতার পরেও এখন তার স্লোগান হলো ‘আমেরিকা ইজ ব্যাক’। না এটা আমেরিকার (নেতাগিরিতে) ফেরত আসা নয়, বরং বাইডেন মানে ডেমোক্রেটরা ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন, মাত্র। আমেরিকা নয়। সোজাসাপ্টা বললে তিনি মিথ্যা আশ্বাসের স্লোগান দিচ্ছেন।

তাহলে তিনি সঠিক কী করতে পারতেন? বাইডেনের নেতৃত্বে আমেরিকা চীনকে নেতা মেনে নিতে প্রস্তুত হয়ে নিজের অবস্থান যতটা সম্ভব ভালো ও উঁচুতে ধরে রাখার চেষ্টা করে যেতেন। অর্থাৎ পরিস্থিতিকে অন্তত খামোখা যুদ্ধ-সঙ্ঘাতের দিকে ঠেলে দেয়া নয়। কারণ পরিস্থিতিকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার মানে হবে, স্বাভাবিক অবস্থায় যদি আমেরিকার দ্বিতীয় অবস্থানে থাকার সুযোগ থাকে তবে সেটাকেই নষ্ট বা নড়বড়ে করে ফেলা হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু কেন আমরা যুদ্ধের কথা তুলছি? বাইডেন কেবল চীনের সাথে স্ট্রাটেজিক প্রতিযোগিতার কথা বলেছেন, যুদ্ধের কথা তো বলেননি!

হ্যাঁ, এটুকু আপাত-সত্য হলেও বাইডেন আরেক কিছু বড় আকাম করেছেন। যেমন একই নিশ্বাসে তিনি প্রায় নাই হয়ে ন্যাটোর (সেক্রেটারির) সাথে মিটিং করেছেন; জি-৭ এর সভা শেষের এক দিন পরে। আর সেখান থেকেই যুদ্ধের উসকানিমূলক কথা বা হুমকি দিয়েছেন। এমনিতেই এটা ছিল বাইডেনের ‘এক ঢিলে অনেক পাখি মারা’র সফর। কারণ তিনি ব্রাসেলসে গিয়ে ইইউ-আমেরিকার শীর্ষবৈঠকও করে নিয়েছেন আগের দিন। এদিকে, জি-৭, ন্যাটো বা ইইউ-এর সাথে বৈঠক মানে হলো, মূল টপ সাত-দশ নেতার সাথে তিন ফোরামেই বসা মিটিং। একই লোক অথচ ফোরামগুলো ভিন্ন।

ফলে জি-৭ এর বৈঠকে সবকিছুতে আলোচনার ইস্যু হলো চীন। আবার বাইডেন ন্যাটোতে এলে ন্যাটোর দেয়া বিবৃতি লিখছে যে, ‘চীনের উচ্চাকাক্সক্ষা ও চাপানো আচরণ তাদের অ্যালায়েন্সের নিরাপত্তাকে সিস্টেমেটিক চ্যালেঞ্জ করছে বিশেষত তাদের আন্তর্জাতিক নিয়ম আইনের প্রতি অনুগত থাকার বিরুদ্ধে।’ এ ছাড়া ন্যাটোর আরো অভিযোগ হলো, চীন-রাশিয়া মিলে কেবল পারমাণবিক অস্ত্রের ঢিবি বানাচ্ছে। অর্থাৎ সার কথায় বাইডেন চীনের সাথে আমেরিকার বিরোধকে মিলিটারিলি লড়ার দিকে ঠেলে দিতে চান এই পরিষ্কার ইঙ্গিত এখানে আছে। আর ন্যাটো এই প্রথম যে অজুহাতে ইন্দো-প্যাসিফিক বা কোয়াড জোট গড়া হয়েছিল তা এখন বাইডেনের উপস্থিতির সভা থেকে ন্যাটোরও অজুহাত হয়ে গেল।

ঘটনা হলো, আপনি যদি কারো বাসার প্রধান প্রবেশমুখ কোন অজুহাতে বাধা খাড়া করতে যান তবে ভুয়া আইনি বা বেআইনি যে যুক্তিতেই হোক ওই বাড়িওয়ালা আপনাকে উৎখাত করবেই। চীনের কেবল উত্তর-পূর্ব দিকটাই সমুদ্রের দিকে খোলা। বাকি সাড়ে তিন দিকে এটা ল্যান্ডলকড। এখন আমেরিকার সিনেটের পেশ করা লিখিত পরিকল্পনায় মালাক্কা প্রণালী বন্ধ করে দেবার পরিকল্পনা পেশ করা হয়েছিল। আর চীনে সমুদ্রপথের প্রবেশমুখের চার দিকে প্রায় ১০টা দেশের সাথে সামুদ্রিক সীমানা আছে। আর বলাই বাহুল্য তা আন-ডিমার্কেটেড। জাতিসঙ্ঘের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান আছে যারা এসব বিরোধ মীমাংসার সালিশ করে দেয়। তবে এটা আমাদের রাষ্ট্রের আদালত বা জুডিশিয়ারি ব্যবস্থা নয়। এটা আসলে আরবিট্রেশন অর্থাৎ যেটাকে আমরা গ্রামের সালিশি বা আপসে মীমাংসা বৈঠক বলি, এটা তাই। যেমন এখানে দুই পক্ষেরই বিচারক নিয়োগ দেয়ার সুযোগও থাকে। এই আনক্লসের সালিশ আদালতে কেবলমাত্র চীন-ফিলিপাইনের সমুদ্র সীমানাবিরোধের কেসটাই উঠেছিল। তাতে এই জাপানি বিচারকের ব্যাপারে, তাকে বদল করে অন্য বিচারক দেবার আবেদন করেছিল চীন, যা মানা হয়নি। তাই ক্ষুব্ধ চীন সেই থেকে বিচার কার্যক্রম থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। আর এতে ব্যাপারটা আর আপস সালিশি না হয়ে (অর্থাৎ বিচারক বদলে না দিয়ে) রাষ্ট্রের আদালতের ভূমিকাই যেন হয়েছিল। আর সেই রায় দেয়া হয়েছিল ফিলিপাইনের পক্ষে। স্বভাবতই চীন সেই রায় মানেনি। আর সেই থেকে ইন্দো-প্যাসিফিক বা কোয়াড জোটের প্রপাগান্ডা শুরু হয় যে, আন্তর্জাতিক আইন না-মানা দেশ হলো চীন। অথচ শুরু থেকেই এটা ছিল গায়ে পড়ে চীনের প্রবেশপথে বাধা তৈরির জন্য আমেরিকার কৌশল যে কথা ওই সিনেট রিপোর্টে লেখা আছে।

এদিকে ওই মালাক্কা প্রণালী হয়ে চীনের একমাত্র উত্তর-পূর্ব সমুদ্র প্রবেশপথেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে চীনের সব জ্বালানি আসে। তাই এই পথ ও এর বিকল্প পোর্টও চীন খুঁজবে, সেটাই স্বাভাবিক। সে কারণে পাকিস্তান, বাংলাদেশ (প্রস্তাবিত), মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কায় গভীর সমুদ্রবন্দর বানানো চীনের নিজের স্বার্থেই জরুরি। অথচ এই বন্দরগুলো বানাতে গেলে এবার ভারতকে দিয়ে আমেরিকা কান্নার রোল উঠাবে যে, আমাকে চীন চার দিকে ‘মুক্তামালা’র মতো ঘিরে ফেলল! মানে চোর উলটা পুলিশ ডাকে! এমনকি থাইল্যান্ডের ভূখণ্ড কেটে সুয়েজ খালের মতো আরেকটা মালাক্কা বাইপাস তৈরির আলাপ চলছে চীনের থাইল্যান্ডের সাথে।
আমেরিকা ভূখণ্ড এশিয়াতে নয়। তাহলে, ইন্দো-প্যাসিফিক বা কোয়াডে আমেরিকার এই নেতাগিরি কেন? আমেরিকা বলবে আমার বন্ধুরা এখানে আছে তাদের রক্ষা করতে। এই অজুহাতও না হয় মেনে নেয়া যাক।

প্রেসিডেন্ট ওবামা হলেন সেই লোক যিনি এশিয়া পিভোট পলিসি চালু করতে গিয়েছিলেন ২০১১ সালে এবং শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হন। কিন্তু কী ছিল সেটা?

উপরে যেটা বলেছিলাম চীনের প্রবেশপথের দুদিকেসহ চার দিকে প্রায় ১০টা দেশ আছে (যাদের বেশির ভাগই আবার আসিয়ান জোটের সদস্য) এবং যাদের সাথে চীনের সমুদ্রসীমা মীমাংসিত নয়। আমেরিকার সব প্রশাসনের খুবই মন-কামনা যে, সমুদ্রসীমা নিয়ে এরা সবাই চীনের সাথে সামরিক বিরোধে জড়াক। আর তাতে আমেরিকা তাদের সবাইকে নিজের কোলে বা কোনো জোটে তুলে নিয়ে এবার তাদের পক্ষ হয়ে চীনের সাথে বিরোধে আমেরিকা সামরিক নেতা হিসেবে হাজির হোক। এটাই ছিল আমেরিকার কথিত স্বপ্ন বা আমেরিকার পিভোট বা ভরকেন্দ্র-ভূমিকা; চীনের বিরুদ্ধে এক আলগা মাতবর আমেরিকা।

আলগা বললাম কেন? বললাম এজন্য যে, বাস্তবে অমন ১০ দেশের কেউ আমেরিকার প্ররোচনায় পা দেয়নি। তাদের অবস্থান বুদ্ধিমানের। সেটা হলো, তারা মনে করে, চীনের সাথে সমুদ্রসীমা অমীমাংসিত বলে বিতর্ক আছে সত্য। কিন্তু সেজন্য আমেরিকার সামরিক জোটে যাওয়া বিপজ্জনক। তারা মনে করে, চীন বিরোধিতার স্বার্থে আমেরিকার কোলে উঠে বসার মানে হয় না। আর সমুদ্রবিরোধে চীনের সাথে আপসে না গেলে তো তাদের দাবি লোপাট হবে না।

আবার ওই ১০ দেশের সবার বাণিজ্য স্বার্থের দিক থেকে চীন তাদের কাম্য। কারণ চীন অবকাঠামো-ঋণ দেয়ার উত্থিত দেশ। এ ছাড়া চীনে রফতানির বাজার পাওয়াও সম্ভব। কাজেই এই স্বার্থকে মেরে ফেলাও তো বোকামি। এ কারণে ওইসব দেশের (এমনকি চীনের বিরুদ্ধে জেতা ফিলিপাইনও) কেউ আমেরিকার কোলে ওঠেনি। উল্টা, চীনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি সাম্প্রতিককালের ইন্দোনেশিয়া যার সাথে চীনের ঠিক সমুদ্রসীমা বিতর্ক নেই তবে জেলেদের মাছ ধরার রাইট নিয়ে বিরোধ আছে, সেও এই টিকা পাবার কালে চীনা টিকার টেস্টে অংশগ্রহণ ও টিকা কেনার সম্পর্কে জড়িয়েছে। আর প্রকাশ্যে বলছে, দুটা আলাদা ইস্যু, আমরা আমাদের মাছ ধরার রাইট ছাড়িনি।

এক কথায় বললে এটা ওবামার পিভোট শুধু পাত্তা না পাওয়া নয়, এশিয়াতেই আমেরিকার পা ফেলার জায়গাও কেউ দিতে, যুদ্ধে জড়াতে কেউ রাজি না হওয়া।
এখন ওবামার আমেরিকার এতবড় ব্যর্থতার পরও বাইডেন একই ফর্মুলা নিয়ে আবার এসেছেন কেন? যারা কেউ পিভোটে যোগ দেয়নি তারা কেন আবার ইন্দো-প্যাসিফিক না কোভিডে যোগ দেবে বলে বাইডেনের আশাবাদ? তাহলে কিসের ভরসায় তিনি জি-৭ বা ন্যাটোকে দিয়ে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দিতে ও ঢোল বাজাতে এলেন?

চীনের সাথে আমেরিকার গ্লোবাল নেতৃত্ব নেয়া বা দেয়া নিয়ে বিরোধ আছে, যেটাকে ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ বলা হচ্ছে। কিন্তু সেটাকে ফয়সালার জন্য বাইডেন যুদ্ধের দিকে এটাকে ঠেলে দেবেন আর এশিয়ার দেশগুলো আমেরিকার পক্ষে যুদ্ধে যেতে পোলারাইজড্ হতে যাবে কেন? ইতোমধ্যেই এটা পরীক্ষিত যে তারা কেউ যাবে না এবং পিভোট প্রকল্প আজ মৃত!

তাহলে এবার ইউরোপ অনেক সাড়া দিচ্ছে মনে হচ্ছে; সেটা কেন? খুব সম্ভবত এটা এক ‘সাদা’-বাদী শঙ্কা ও তা থেকে একাত্মবোধ। বাইডেন এই ভয়টাই ইউরোপে বিক্রি করেছেন। কথাটাকে প্রতীকীভাবে অনেক সময় বলা হয়, এশিয়া বা চীন গ্লোবাল নেতৃত্বে শক্ত হয়ে বসে যাওয়ার মানে কী? মানে হলো, আমরা দেখব, গুলিস্তানের কামানের পাশ দিয়ে সাদা পশ্চিমা তরুণেরা ক্লান্ত হলে ফাইল হাতে হেঁটে বেড়াচ্ছে, চাকরি খুঁজছে। ঠিক যেমন এখন আমেরিকার কুইন্সে বা পশ্চিমের কোনো শহরের বাঙালি পাড়ায় আমরা ভিড় করি- কখনো চাকরি কখনো স্কলারশিপের লোভে! এই ভয়টাই বাইডেন ইউরোপে বিক্রি করে তাদের তিনি নিজের পেছনে জড়ো করেছেন যে, দেখি না চীনের নেতা হয়ে যাওয়াকে ১০ বছর ঠেকিয়ে রাখতে পারি কিনা!

বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড
বাইডেন জি-৭ বৈঠকে শুধু চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উসকানি তুলেছেন তাই নয়, সাথে আরেক চালচুলাহীন কর্মসূচি চালুর ঘোষণা করেছেন। সেটা বিনা তুলনায় বললে কেউ কিছু বুঝবে না। বলতে হবে এটা চীনের বেল্ট-রোডের বিকল্প এক বাইডেন জোটের কর্মসূচি। এর নাম দেয়া হয়েছে- ‘বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড (ই৩ড )’। প্রথম তিনটা শব্দ ইংরাজি বি দিয়ে বলে ই৩ আর পরে ওয়ার্ল্ডের ড। এ কারণে সংক্ষিপ্ত ই৩ড। এক কথায় বললে বেল্ট-রোড জাতীয় বিনিয়োগ অবকাঠামো গড়ার খাতের ঋণ, তবে যার পরিমাণ বিশাল। ই৩ড এর কি সেই মুরোদ আছে? আমেরিকার এই দিন শেষের বেলায়? এখানে আমেরিকান বিনিয়োগ বলতে বিশ্বব্যাংক বা এডিবির মাধ্যমে তাদের জন্মকালে যা চাঁদা দিয়েছিল। একালে ইউএসএইডের মতো সরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিতরণের অর্থ কমে আসা দেখলেই তো বুঝা যায় কিভাবে আমেরিকান সক্ষমতা কমে এসেছে, কী হাল হয়েছে! এর ওপর বাইডেন আশাবাদ রেখেছেন ব্যবসায়ীদের তারা মটিভেট করে এখানে আনবেন! এসব কল্পকাহিনী তুলে রেখে বাইডেনের পরামর্শকদের উচিত বিশ্বব্যাংকের জন্য ফান্ড তুলতে ওর জন্মের সময় কী কষ্ট করতে হয়েছিল তা স্মরণ করা।

আর চীন কিভাবে করেছে? চীন একালে বিপুল সারপ্লাস একুমুলেশনের দেশ। সেই সরকারি ফান্ডটাই পরে কোথায় লাগানো যায় সেই বুদ্ধি করতেই প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মাথায় কেউ বুদ্ধি দিয়েছিল বলে ২০১৩ সাল থেকে বেল্ট-রোডের জন্ম। এখন ই৩ড হলো অনিশ্চিত আর ফকিরি চাঁদা তোলা এক ফান্ডমাত্র- সে কি করে চীনা সরকারি বিপুল সারপ্লাসের সাথে প্রতিযোগিতা করবে? আমেরিকার হাতে বিপুল সারপ্লাস সম্পদ সঞ্চিত হচ্ছে, সেই আমেরিকা কবেই মরে গেছে। সেই বুড়া বাঘকে এখন নয়া চাবুক দিয়ে চাবকালেই কি সে বাঘ তরুণ হয়ে চীনের সমতুল্য বা প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারবে? না সম্ভব? এগুলো কি স্বপ্ন কল্পনার গল্প দিয়ে পূরণ হওয়ার মতো কাজ?

আবার মনে করিয়ে দেই। বেল্ট-রোডের বেলায় প্রপাগান্ডা চালানো হয়েছিল এটা নাকি ঋণগ্রস্ত করে দিয়ে সে দেশের সম্পদের মালিকানা চীনের নিয়ে নেয়ার ব্যবসা। তাহলে এখন বাইডেন ই৩ড করতে চাচ্ছেন কেন? একই ঋণব্যবসা করতে? এর জবাব কী দিবেন বাইডেন?
ওদিকে আফ্রিকায় চীনা এমন বিনিয়োগ নিয়ে যারা প্রপাগান্ডা চালিয়েছিল তাদের আজকাল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ এক নয়া সার্ভে রিপোর্টে আফ্রিকায় চীনা সাকসেস নিয়ে গবেষণা রিপোর্ট বের হয়েছে।
শেষ কথা হলো, বিনিয়োগ আর গল্প আসলে এক কথা নয়। ‘ট্যাকার মুরোদ’ থাকা লাগে চাচা!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us