দুর্লংঘ সময়

নুসরাত রীপা | Jun 27, 2021 04:10 pm
দুর্লংঘ সময়

দুর্লংঘ সময় - অন্য এক দিগন্ত

 

টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার ভরে দ্রুত গোসল সেরে নেয় মালিহা। আলমিরা খুলে একটা সাদা পাড় নীল খোল শাড়ি পরে। মুখে পাফ বোলাতে বোলাতে আড় চোখে একবার দেয়াল ঘড়িটা দেখে নেয়। সাতটা চল্লিশ। না, এখনো হাতে একটু সময় আছে। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার হাতড়ে একটা বহু পুরানা টিপের পাতা খুঁজে পায়। কালো টিপ নেই, অগত্যা একটা লাল টিপ কপালে পরতে পরতে জোর গলায় মেয়েকে ডাকে, তিন্নি ... তিন্নি ...।

তিন্নি ছুটে আসে। বল মা। বলতে বলতে মায়ের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে। মাকে ঠিক চেনা যাচ্ছে না। অল্প বয়সী দেখাচ্ছে। কেন, বোঝা যাচ্ছে না। বাবা হসপিটালে। তার শরীর খুব খারাপ। এবডোমেন ক্যান্সার। অ্যাডভান্সড স্টেজ। মা কী আজ বেশি সাজুগুজু করেছে? তাও নয়। তবু আজকের মতো মা’কে এমন কিশোরী টাইপ আগে কখনো দেখেনি তিন্নি। ও অবাক হয়ে বলে, তুমি হসপিটালে যাচ্ছো মা?

মেয়ের দৃষ্টির বিস্ময়টুকু মালিহার নজর এড়ায় না। অস্বস্তি লাগে একটু। তোর বাবা হসপিটালের খাবার খেতে পারে না। আমি তাই নাশতা আর লাঞ্চ নিয়ে যাচ্ছি। রাতে তোর ছোট ফুপি খাবার দেবে। মেয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। মালিহা সুযোগ দেয় না। বলে, টেবিলে খাবার রাখা আছে। নাশতা করে নিস। আর বাসা থেকে বেরোস না যেন। বুয়ার আজ কাজ করার দরকার নাই। ফোন অফ করে ঘুম দিবি না। আমি যেন কল করে পাই।
মা, আমিও বাবাকে দেখতে যাবো।

কাল নিয়ে যাবো। আজ ডাক্তাররা মেডিক্যাল বোর্ড বসাবে। তোর বাবার চিকিৎসার ব্যপারে। কী সিদ্ধান্ত হয় দেখি।
কথা বলতে বলতে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাতে টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে বেরোবার দরজার কাছে পৌঁছে যায় মালিহা।

আমার একা থাকতে ভালো লাগে না মা- তিন্নির কণ্ঠস্বর কাঁদো কাঁদো। বাবাকে ভীষণ মিস করছি। বাবা কি আর ভালো হবে না মা?
মেয়ের কথায় এক মুহূর্ত থমকায় মালিহা। বুকের ভেতর কোথায় একটু মোচড় দিয়ে ওঠে। একটা ঢোক গিলে গলায় জোর এনে বলে, বোকা মেয়ে, বাবার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো। হসপিটালে আমাকে অনেক দৌড়োদৌড়ি করতে হয়। তোকে ওখানে কার কাছে রেখে যাবো বল? দিনকাল যে বড্ড খারাপ সোনা। আনি বেরোচ্ছি দরজাটা ভালো করে আটকে দে।
মালিহা দ্রুত বেরিয়ে পড়ে।

তর্জনী দিয়ে চোখের কোণে জমা দুই ফোঁটা জল মুছে নিয়ে দরজাটা আটকে দেয় তিন্নি।

ব্যাংকার স্বামী সাফকাত আর সেভেনে পড়া একমাত্র কন্যা তিন্নিকে নিয়ে মালিহার নাটকের স্ক্রিপ্টের মতো সাজানো সংসার। হঠাৎ দিন কতক আগে মাঝরাতে সাফকাতের পেট ব্যথা আর বমি শুরু হয়। ভালো হয়ে যাবে ভেবে দুই দিন পেরিয়ে হসপিটালে আসা। তখন কে জানত এবডোমেন ক্যান্সারে ভুগছে সাফকাত! শরীর স্বাস্থ্য দেখে তো বোঝার উপায় নেই। অথচ অসুখটা অ্যাডভান্সড স্টেজে পৌঁছে গেছে।

ডাক্তাররা অপারেশনের বিকল্প কিছু দেখছেন না যদিও ব্যাপারটা খুব রিস্কি, অপারেশন চলার সময়ই হয়তো মারা যেতে পারে সাফকাত। কিন্তু এ মুহূর্তে সাফকাত যে পরিমাণ কষ্ট সহ্য করছে তা থেকে পরিত্রাণের চেষ্টা করা উচিত। জীবন মৃত্যু আল্লাহর হাতে।
সিএনজি ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে হসপিটালে ঢুকে পড়ে মালিহা।

সাফকাতের কেবিন ছয় তলায়। পাঁচ তলায় প্রফেসরদের চেম্বার। পাঁচ তলায় নেমে সিঁড়ি দিয়ে উঠলে সাফকাতের কেবিনটা আগে পাওয়া যায়। লিফটে গেলে ঘুরে যেতে হয়। মালিহা পাঁচ তলায় নেমে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে একবার ডাক্তার কাইজার মোশাররফের চেম্বারের দিকে তাকায়। উনিই সাফকাতের চিকিৎসা করছেন।
চেম্বার খোলা। সামনে চেয়ারের সারিতে অপেক্ষমাণ রোগী ও স্বজনেরা বসে। মালিহা সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সিঁড়িতে পা রাখে।

সাফকাত ঘুমোচ্ছে। একজন সিস্টার স্যালাইন পুশ করছিল। মালিহা টেবিলে টিফিন ক্যারিয়ার রেখে সিস্টারের কাছে এগিয়ে গেল, কী অবস্থা সিস্টার? ও ঘুম থেকে জাগেনি? আমি খাবার নিয়ে এসেছিলাম। আমাদের একজন রাতে ছিলেন উনি কোথায়?

রাতে সাফকাতের ভাই ছিল। সিস্টার জানাল, উনি কিছু আগে চলে গেছেন। আর ব্যথাটা আরো বেড়ে যাওয়ায় মরফিন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে সাফকাতকে। আজ থেকে কোনো শক্ত খাবার আর দেওয়া যাবে না। লিকুইড ফুড চলবে অপারেশনের আগ পর্যন্ত।
সিস্টার কাজ শেষ করে চলে গেল। মালিহা সাফকাতের কপালে হাত বুলিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে চুলে বিলি কাটে। সাফকাত শুধু একবার অস্পষ্ট শব্দ করে, ও হ। ও হ।

মালিহার চোখে জল চলে আসে। সরে এসে টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে সোফায় বসে তাকিয়ে থাকে সাফকাতের দিকে। কী অদ্ভুত একজন মানুষ। অফিসেও নাকি মাঝে মাঝে তীব্র পেট ব্যথা হতো। অথচ কোনো দিন বাসায় বলেনি কিছু। মালিহা এখন বুঝতে পারছে কখনো কখনো সাফকাত অফিস থেকে ফিরে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ত, রাতে খেত না, ক্ষিদে নেই বলে। মালিহা তো তিন্নির গানের ক্লাস, নাচের ক্লাস, ছবি আঁকার ক্লাস, ক্লাসের পড়ার টিউশনে ছুটে বেড়াত সারা বিকেল সন্ধ্যা থেকে রাত সাড়ে ৯টা অবধি। বিয়ের অনেক বছর পর তিন্নির জন্ম। মেয়ের জন্য তাই সব রকম কষ্ট করতে রাজি মালিহা। সাফকাতের বিষয়টা তাই নজরে আসেনি তেমন। ইস, একটু খেয়াল করলে, একটু আগে চিকিৎসকের কাছে এলে হয়তো এতটা খারাপ হতো না অবস্থা।

দরজায় নক করে ডাক্তার কাইজার ঢুকলেন। সাথে তিনজন জুনিয়র ডাক্তার, ডিউটি ডাক্তার, নার্স।

একগাদা নতুন টেস্ট করা হয়েছে রাতে। ডাক্তার সব দেখলেন। নিজেদের মধ্যে কথা বললেন, তারপর মালিহাকে বললেন, আগামী পরশু আমরা উনার অপারেশন টা করে ফেলতে চাই। বেশ কয় ব্যাগ ব্লাড লাগতে পারে। ডোনার জোগাড় করুন।
প্রফেসর কাইজারের কথা যেন কানেই গেল না মালিহার। ওর চোখের সামনে পাশের বাসার পড়–য়া ছেলেটার ছবি ভেসে উঠল। প্রফেসর কাইজার, ডাক নাম মিসু। পাশাপাশি বাসা বলে যোগাযোগ বেশি ছিল। মিসু মেডিক্যালে, মালিহা উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষে-ঠিক ওই বয়সে যা হয়! প্রেম হয়ে গেল দুজনের। মোবাইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা তারপর আবার চিঠি লেখা। মেধাবী ছাত্র মিসুর তাতে সমস্যা না হলেও মালিহা এইচএসসিতে ঠিকই ফেল করে ফেলল। মালিহার ফেলের রহস্য উদঘাটিত হতে বেশি সময় লাগল না।

ভাই নাই। তিন বোন পিঠেপিঠি - বাবা কোনো রিস্ক নিলেন না। মালিহার বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। তার কথা, মালিহাকে দেখে বাকি দুই বোনও সাহস পেয়ে যাবে।

মালিহা অনেক কান্নাকাটি করেছিল। মিসু বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। তার বাবা মা ছেলের পাস করা পর্যন্ত সময় চেয়েছিল। কিন্তু কলেজের অঙ্কের অধ্যাপক বাবা কারো কথা শোনেননি। মালিহার বিয়ে হয়ে গেল সাফকাতের সাথে। যেদিন বিয়ে হলো সেদিন মিসুর সাথে মালিহার দেখা করার কথা ছিল শাড়ি আর টিপ পরে। টিপ মিসুর ভীষণ প্রিয়। আর শাড়িটা সে স্কলারশিপের টাকায় কিনে দিয়েছিল মালিহাকে। মালিহাকে মাথা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিল, এ শাড়ি পরেই মালিহা দেখা করতে আসবে! যদিও সে দেখা আর করা হয়নি।
গত উনিশ বছর শাড়িটা তুলে রেখেছিল মালিহা। মিসুর সাথে দেখা হবে ভাবেনি কখনো। ফেলে দিতে পারেনি হৃদয় ছিঁড়ে।

কিছুই ভোলেনি মালিহা। সুখের স্রোতে ভাসতে ভাসতে মিসুকে মনে পড়েছে কত একাকী বিকেলে কিংবা গ্রীষ্মের অলস মধ্যাহ্নে আবার ভুলেও গেছে স্বামী সন্তানের ভালোবাসায়। সাফকাতের ভীষণ রকম খেয়াল ও যত্নের আবর্তে।

সাফকাতকে এই হসপিটালে চিকিৎসা করাতে এসে মিসু মানে প্রফেসর কাইজারকে দেখে ভীষণই অবাক হয়েছিল। কথা সরছিল না মুখে। ভাবী ভয় পাচ্ছে ভেবে সাফকাতের ভাইই সব ম্যানেজ করছিল। রোগী পরীক্ষায় ব্যস্ত কাইজারকে দেখে বোঝা যায়নি কখনো সে চিনত মালিহাকে।... কথা বলার ভঙ্গি, হাত নাড়াবার ঢং কিছুই বদলায়নি। আপন মনে ভাবছিল মালিহা।
সদলবলে ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন।
মালিহা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, অপারেশন, ডোনার, ব্লাড ... বাসায় জানানোর কথা মনেই রইল না! অনেক বছর আগের দিনগুলো চলে আসতে লাগল চোখের সামনে। মনে প্রশ্ন জাগলো, সত্যিই কি মিসু চিনতে পারেনি মালিহাকে?
আসতে পারি ...
কণ্ঠস্বরের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল মালিহা। প্রফেসর কাইজার দরজার সামনে, একা।
মালিহা বলল, আসুন।

ওদেরকে চলে যেতে বললাম। আমার পেশেন্ট ভিজিট শেষ। তোমাকে এতদিন পর দেখে কথা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না।
মালিহা চুপ করে আছে।
প্রফেসর কাইজার এগিয়ে এসে সোফায় বসে বললেন, সাফকাত সাহেবের অসুখটা অনেক ডিপে চলে গেছে। খেয়াল করোনি?

ও এত চাপা স্বভাবের। জ্বর, মাথাব্যথা হলেও বলেনি, কখনো, কোনো দিন।
ওহ। এক মুহূর্ত চুপ থেকে ফের কাইজার সোফা দেখিয়ে বললেন, বসো না। কটা বাচ্চা তোমার?
মালিহা বসল। একটা মেয়ে।
বাহ। কোন ক্লাসে পড়ে?

সেভেনে। কনসিভ করতে অনেক লেট হয়েছিল আমার। আপনি ঢাকায় ফিরেছেন কবে?
সাত আট বছর হলো। ওই দেশে আর ভালো লাগছিল না। আমাকে আপনি করে বলছ কেন? আমি তো কোনোদোষ করিনি।
দোষ! শব্দটা কানে ধাক্কা দিলো। একটু চুপ থেকে মালিহা বলল, তোমার ওয়াইফও ডাক্তার নিশ্চয়ই।
না।
কী করেন?
আমি তো বিয়ে করিনি মালিহা। তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তোমার পরিবার আমাকে সময় দিল না ...
তাই বলে বিয়ে করবে না?
যাকে ভালোবাসতে পারব না। তাকে বউ করে এনে কী হবে? তার চেয়ে এই তো ভালো আছি।
প্রফেসর কাইজার উঠে দাঁড়ায়। শাড়িটার কথা মনে আছে তোমার! সে জন্য ধন্যবাদ। বাই দ্য ওয়ে, তোমার হাজব্যান্ডের দিকে খেয়াল রেখো। আমি যাচ্ছি। পরশু অপারেশন হবে। সেভাবে প্রিপারেশন। নিও।
প্রফেসর কাইজার বেরিয়ে গেলেন। মালিহার বুক চিঁড়ে একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। পানি খাবো ... সাফকাত মৃদু স্বরে বলল। মালিহা অ্যালার্ম বাটনে কল দেয়। সিস্টারকে জিজ্ঞেস করতে হবে, সাফকাতকে পানি দেওয়া যাবে কী না!

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us