চীনা কমিউনিস্ট পার্টি কিভাবে এত শক্তিশালী হলো
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলন - ছবি : সংগৃহীত
চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তথা সিপিসির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সিপিসি নিজের সুবিধা আদায়ের জন্য আত্মম্ভরি হয়নি বরং মানবসম্পদ উন্নয়ন ও শান্তির কাজও করেছে। প্রঙ্গত, উইঘুরদের ব্যাপারে বিভিন্ন অভিযোগ এলেও হুইদের উন্নয়নের কথা কেউ বলে না। চীনে দু’টি বড় মুসলিম গোষ্ঠী রয়েছে। একটি হলো জিনজিয়াংয়ের উইঘুর এবং অপরটি হুই। চীনা জনসংখ্যার বিশাল সাগরে তারা ¯্রফে কয়েক ফোঁটা পানির মতো। এক কোটি করে লোকসংখ্যা উভয় গোষ্ঠীর, আকারে তাইওয়ানের সমান। কিন্তু উইঘুরদের যখন পুলিশি চাপ সইতে হয় তখন হুইরা সমৃদ্ধ হচ্ছে, বিষয়টি ভেবে দেখার মতো।
সিপিসির আন্তর্জাতিক বিভাগের বড় কাজ কোনো আক্রমণ বা যুদ্ধ প্রতিহত করা, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা, আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক গভীরতর করা, দেশে ও বন্ধু দেশে আধুনিক অবকাঠামো নির্মাণ করা। ১৯৭০ সালে চীন রিফর্ম শুরু করে এবং চীনকে আন্তর্জাতিক অবস্থানে নিয়ে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করে। বলা যায়, মার্কসবাদে চীনা চরিত্র ঢুকতে থাকে। দেং জিয়াও পিংয়ের মতবাদগুলো কাজ করতে শুরু করে ও এসব মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে নীতিমালা তৈরি শুরু হয়। উল্লেখ্য, মাও দে জুংয়ের সময়ের মতো লাল বই ছাপিয়ে তা বিলি বণ্টন করা হয়নি বরং পার্টি সভাগুলোকে কার্যকরী রূপ দেয়া হয় এবং কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করা হয়। শুধু বিদেশী কমিউনিস্টদের সাথে সংযোগ রক্ষা করা, শুধু কমিউনিস্ট শ্রমিক ও বামপন্থীদের সাথে বৈঠক-বন্ধনের নীতি সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য হয়। অন্য ঘরনার ও মতবাদের দল ও রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আলাপ-আলোচনার দ্বার উন্ম্ক্তু করায় পারস্পরিক সম্পর্ক আরো উচ্চতায় অবস্থান করছে। সিপিসির সদস্যদের সবাইকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একই কাতারে রাখার চেষ্টা করা হয়।
দেশ পরিচালনায় যোগ্যতা সৃষ্টির পাশাপাশি অভিজ্ঞান অর্জনের সুবিধা দেয়া হয়। ‘গ্লোবাল ভিশন’ কেমন তার স্বচ্ছ ধারণা দেন সিপিসির পণ্ডিত নেতারা। সিপিসির রয়েছে নিজস্ব প্রশিক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্র। গ্লোবাল ভিশন সম্পর্কে সঠিক ধারণা নিতে পার্টি-পার্টি বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয় যেখানে সামাজিক উন্নয়ন, সোসিয়ালিস্ট ভাবধারার পরিচর্যা ও কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালনার কৌশলাদি শেখানো হয় ও সমসাময়িক অন্যান্য দেশের পার্টি পলিসিগুলো নিজেদের নীতিমালার সাথে তুলনামূলক মূল্যায়ন করা হয়; এই স্তর থেকে নিজেদের ভাবধারার আরো উন্নয়নের শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহ করে সিপিসি। বর্তমান বিশ্ব রাজনীতি ছাড়াও, চারটি বিষয়- অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও টেকনোলজিও চর্চিত হয়। এতসব বিষয়ের চর্চায় সদস্যরা সমৃদ্ধ হয় যা সরকার পরিচালনায় নীতি নির্ধারণে, কৌশল প্রণয়নে কাজে লাগে। বিদেশী রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য সিপিসি স্টাডি ট্যুর করে, যদিও এটি সনাতন পদ্ধতি। প্রাদেশিক ও মিউনিসিপাল পার্টি নেতারা বিদেশ সফরের সময় গ্রামপর্যায়ের নেতাদের সাথে নিয়ে যান। দুদেশের সহযোগিতামূলক প্রকল্প কিভাবে বাস্তবায়িত হয় তা হাতে-কলমে শেখা বা দেখার সুযোগ এসব সফরে থাকে। চীনা সরকারি প্রকল্পগুলোতেও বিদেশীদের সমানভাবে সফরের ও স্টাডির সুযোগ থাকে। পদ্ধতির সঠিক বাস্তবায়নের ফলে এসব প্রকল্প সন্তোষজনক পর্যায়ে রয়েছে।
বিশ্বে উন্মুক্ত হওয়ার পর চীন অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে একটি স্থিতিশীল সমাজ গঠন করতে পেরেছে। এখন চীনের এই স্থিতিশীলতা আগের চেয়ে অনেক মজবুত। সিপিসির অভিজ্ঞতা অনেক শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত। অনেক বেশি বিদেশী রাজনৈতিক দল দ্রুত উন্নয়নের কৌশল জানার জন্য এখন চীনমুখী হয়েছে। পশ্চিমা উন্নত দেশের কিছু থিঙ্ক ট্যাঙ্কের সাথে চীনের সংযোগ রয়েছে যারা বিশ্বশান্তি ও উন্নয়নের জন্য ‘কমন গ্রাউন্ডস’ নিয়ে কাজ করতে চায়। বিশ্বায়ন মতবাদেও এদের চিন্তাভাবনাকে চীন নিজের করে কাজে লাগাতে চায়। ফলে বিশ্বব্যাপী চীনের সাপোর্ট বেড়ে যেতে শুরু করেছে।
এ বছর চীনের নাগরিকরা বার্ষিক পরিকল্পনায় মন্তব্য করার সুবিধা পাচ্ছেন। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে জনগণ সরকারি ওয়েবসাইটে এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারছে। মন্তব্য, প্রস্তাবনা ও সমালোচনা করতে পারছে যা কমিউনিস্ট পার্টিতে এক ধরনের নিষিদ্ধ বস্তু। চীন গত কয়েক বছর ধরে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আসছে। সর্ব ক্ষেত্রে দেশ পরিচালনায় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে চাচ্ছে। দেশের পলিসি তৈরিতে জনগণের কণ্ঠস্বরকে কতটুকু সংযুক্ত করা গেল সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। এই পদ্ধতি জনগণের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও প্রস্তাবনাকে সহজে ও দ্রুত বুঝতে সহায়তা করেছে। সরকারও নানা বিষয়ে স্টেকহোল্ডারদের সাথে সহজে সংলাপ করতে পারছে, এভাবে পরিকল্পনা প্রণয়নে ‘টু ওয়ে কমিউনিকেশন’ প্রতিষ্ঠা সিপিসির আরেক মাইলফলক সাফল্য বলে মনে করছেন বৈশ্বিক উন্নয়নবিদরা। অনেকে বলছেন, এতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াই প্রখরভাবে কাজ করছে।