সাউথগেটের প্রায়শ্চিত্ত নাকি মানচিনির জয় ক্ষুধা?

আফফান উসামা | Jul 09, 2021 05:04 pm
সাউথগেটের প্রায়শ্চিত্ত নাকি মানচিনির জয় ক্ষুধা?

সাউথগেটের প্রায়শ্চিত্ত নাকি মানচিনির জয় ক্ষুধা? - ছবি : সংগৃহীত

 

ইউরোর ফাইনালে ইংল্যান্ড, ইতালি? নিঃসন্দেহে জমজমাট এক মহারণ অপেক্ষা করছে। কে কার থেকে কোন দিক দিয়ে পিছিয়ে, এমন প্রশ্ন করার উপায় নেই। প্রশ্ন করতে বলতে হয়, কে কার থেকে কোন দিকে কিভাবে এগিয়ে? একটা দিকে খানিকটা এগিয়ে হয়তো ইতালি, ওরা একবার হলেও হাতে নিয়েছে ইউরোর ট্রফি। যদিও তার বয়স ৫৭ বছর হয়ে গেছে! বিপরীতে ইংল্যান্ড তো ৫৫ বছর পর কোনো আসরে সেমিফাইনাল টপকে ফাইনালে এসেছে।

ফুটবল শুধুই কৌশলী পায়ের খেলা নয়, ফুটবল প্রখর মস্তিষ্কের খেলাও বটে। বুদ্ধির এই খেলার বাস্তবায়নটা ফুটবলাররা করলেও পরিকল্পনাটা সাজিয়ে দেন মাঠের বাহিরে থেকে একজন। যাকে আমরা কোচ বলি। ফুটবল প্রায় শুরু থেকে একটা সাম্যাবস্থায় চলে এসেছে যেখানে শুধু স্কিল আর টেকনিকের মিশ্রণই ম্যাচ জেতার জন্যে যথেষ্ট নয়, সাথে প্রচণ্ডভাবে প্রয়োজন ট্যাকটিক্স- মানে ভালো কোচ। এখন তো বোদ্ধারা প্রায় সবাই সদা সময়ই বলে থাকে, 'এক শ' ভাগ সুন্দর ফুটবলে ফুটবলারদের অবদান ষাট ভাগ, বাকি চল্লিশ ভাগ কোচের।'

ইউরোর ফাইনালে উঠা দুটি দলের পেছনেও আছে কোচের অসামান্য অবদান। দুজন কোচই বদলে দিয়েছেন দল দুটিকে। ইতালিকে এই ইউরোতে দেখে হয়তো অবাক হয়েছেন। অবাক হবারই কথা। এই ইতালি তো সেই ইতালি নেই। এই ইতালি এখন অনেক বেশি আক্রমণাত্মক। ওদের খেলা অনেক বেশি উপভোগ্য। এই বদলে যাওয়ার কারিগর কোচ রবার্তো মানচিনি। পরপর ইউরো আর বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন করতে ব্যর্থ হওয়া ইতালি দল ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছিল অন্ধকারের অতল গভীরে। সেই আজুরি দলেই মানচিনির হাত ধরে ঘটে নবজাগরণ। পরপর ৩৩ ম্যাচ জিতে তাঁরা ইউরোর ফাইনালে। ওরা যেন হারতেই ভুলে গেছে।

একই পথের পথিক ইংল্যান্ডের কোচ গ্যারেথ সাউথগেটও। পাঁচ দশকের বেশি যন্ত্রণাময় অপেক্ষা, প্রজন্মের পর প্রজন্মের বিষাদ, হতাশার অসংখ্য দিন-রাত্রি পেরিয়ে অবশেষে সেই বহুকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তের দেখা পেয়েছে ইংলিশ ফুটবল। সর্বশেষ ১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলেছিল ইংল্যান্ড। মাঝখানের ৫৫ বছর বড় কোনো টুর্নামেন্টের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে জায়গা করে নিতে পারেনি তারা। গত বিশ্বকাপেও অনেকটা অবাক করে সেমিফাইনালে চলে গেলেও, শেষ পর্যন্ত ট্রাইবেকারে স্বপ্ন ভেঙে ফিরতে হয় দেশে। তবে অবশেষে ইউরোতে দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর ফুরিয়েছে। যার কারিগর নিঃসন্দেহে প্রধান কোচ গ্যারেথ সাউথগেট।

গ্যারেথ সাউথগেট স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে আজ ইংল্যান্ডকে পৌঁছে দিলেও, একটা সময় তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের ভিলেন চরিত্র। ১৯৯৬ ইউরোর সেমিফাইনালে এবারের ফাইনালের মঞ্চ ওয়েম্বলিতেই মুখোমুখি হয় জার্মানি-ইংল্যান্ড। ৯০ মিনিটেও সমাধা না হওয়ায়, অতিরিক্ত ৩০ মিনিটেও থেকে যায় সমতা। ফলে ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণে যেতে হয় টাইব্রেকারে। দুই দলের পাঁচ দুগুণে দশ কিকের সবগুলোই পায় গোলের স্বীকৃতি। ফলে যেতে হয় সাডেন ডেথে। আর সেখানেই গোল করতে ব্যর্থ গ্যারেথ সাউথগেট। ‘জাতীয় ভিলেন’ হয়ে উঠতে আর কী চাই!

জীবন তার কাছ থেকে যা কেড়ে নিয়েছিল সিকি শতাব্দী আগে, তাই এবার সুদে-আসলে ফিরিয়ে দেবার উপলক্ষ এনে দিয়েছে গ্যারেথ সাউথগেটকে। ইংল্যান্ডের কোচ হিসেবে রাউন্ড অব সিক্সটিনে জার্মানিকে হারানোয় হয়তো সেই জ্বালায় খানিকটা প্রলেপ হয়েছে। আর ওয়েম্বলিতে ডেনমার্কের বিপক্ষে সেমিফাইনাল দ্বৈরথ জয়ে হয়তো আরো অনেকটা হৃদয় জুড়েছে। তবে সাউথগেটের প্রায়শ্চিত্ত পুরো পূর্ণতা পাবে ফাইনাল জয়ে, শিরোপা হাতে পেয়ে। একটি টশিরোপা জিতবে বলে ইংলিশদের ৫৫ বছরের অপেক্ষার অবসান কি করতে পারবেন সাউথগেট?

কিন্তু তাকে কি এত সহজে ছেড়ে দেবেন মানচিনি? তিনি তো হারতে পছন্দ করেন না। আর তাকে হারাতে না পারলে তো সাউথগেটের প্রায়শ্চিত্ত পূর্ণতা পাবে না। অন্যদিকে সাউথগেটের কাছে হেরে গেলে মানচিনির যে প্রিয় জয়টা পাওয়া হবে না। কিন্তু মানচিনির তো জয় চাই। ড্র করার জন্য ফুটবল বা রক্ষণাত্মক ফুটবল তার খুব একটা পছন্দের নয়। তার চাওয়া হলো শুধুই জয়, সেই জন্যই তো রক্ষণশীল ইতিহাসদীপ্ত ইতালিকে বদলে দিয়ে আক্রমণাত্মক ফুটবলে পারদর্শী করে তুলেছেন। সুবাদেই কি আর তাকে ইতিলিয়ানরা দ্য রেনেসাঁ ম্যান বলে সম্বোধন করে?

টানা ৩৩ জয়ে ভূমিকা রেখেছে মানচিনির সেই আক্রমণাত্মক ফর্মুলা। দায়িত্ব নেবার পর শুরুর দুই ম্যাচ হারলেও পিছিয়ে পড়েননি বা নিজেকে গুটিয়ে আনেননি। কারণ আক্রমণাত্মক ফুটবলেই তিনি ইতালির সমস্যার সমাধান দেখেছিলেন। নামকরা স্ট্রাইকার দলে না থাকলেও দারুণ পরিকল্পনা সাঁজিয়ে আক্রমণাত্মক ফুটবলে ইতালিকে পরিবর্তন করে দিয়েছেন। তাই তো প্রায়শ্চিত্ত পূরণটা সহজ হবে না সাউগেটের। কারণ তার প্রতিপক্ষ হারতে চান না।

মানচিনির এই হারতে না চাওয়া নিয়ে একটা ঘটনা আছে, তিনি কতটা আক্রমণাত্মক আর জয় প্রিয় তাই উঠে আসবে এই ঘটনা থেকে। মানচিনির বয়স যখন মাত্র ৯ বছর, তখন তিনি তার কাজিনের সাথে প্রতিযোগিতায় মেতেছিলেন টেবিল টেনিসে। কিন্তু ওই খেলায় মানচিনি হেরে যান কোনো এক কারণে। হারের অপবাদ মানতে না পেরে মানচিনি তার টেবিল টেনিস ব্যাটটাই ছুঁড়ে মারেন কাজিনের কপাল লক্ষ্য করে। বোঝাই যায়, ছোট থেকেই আক্রমণাত্মক মানসিকতা মিশে আছে তার সাথে। তিনি সর্বদাই এগ্রেসিভ, তিনি হারতে চান না, বা ড্র করে আনন্দ ভাগাভাগি করার ইচ্ছেও তার হয় না। তিনি জিততে চান সদা, সর্বদা।

বলাই চলে, দুই দলের দুই বদলে যাওয়ার কারিগরের সম্মুখে তাই অগ্নিপরীক্ষা। একজন হারতে চান না কোনোভাবেই, অপরজন প্রায়শ্চিত্ত পূরণ করতে চান শিরোপা জিতেই। একজনকে তো ব্যর্থ হতেই হবে, কে সেইজন, তা জানার অপেক্ষা ফুরোবে ১২ তারিখ ফাইনালে রেফারির শেষ বাঁশিতে। ইটস কামিং হোম, নাকি ইটস কামিং রোম; সেই প্রশ্নেরও উত্তর মিলবে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us