কোরবানির সৌন্দর্য

নাহিদ হাসান | Jul 21, 2021 02:27 pm
ছাগল

ছাগল - প্রতীকী ছবি

 

তখন সম্ভবত ক্লাস টু কিংবা থ্রিতে পড়ি। সম্ভবত এ কারণে বললাম, কারণ পুরোপুরি মনে নেই। তখন কোন ক্লাসে পড়ি সে কথা পুরোপুরি মনে না থাকলেও ওই সময়ের ঘটনা আমার পুরোপুরিই মনে আছে।

তখনো এমন ঈদুল আজহা'র সময় ছিল। সেবার বাবার হাতে টাকা-পয়সা কম থাকায় গরু দিয়ে কোরবানি দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। মা তার জমানো অল্প কিছু টাকা বাবার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ঘরে ছোট ছোট বাচ্চা আছে। এই নিন, এগুলোর সাথে মিলিয়ে অন্তত একটা ছাগল দিয়ে দেখেন কোরবানি দেয়া যায় কিনা?

বাবা কালো রঙের নাদুস নুদুস একটি ছাগল কিনে আনলেন। ছাগলটা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সাথে আপনভাবে মিশে গেল। মা ঘরের পাশের কাঁঠাল গাছ থেকে কতগুলো কাঁঠাল পাতা পেড়ে আরেকটা ছোট গাছের সাথে ঝুলিয়ে দিলেন। ছাগলটা লাফিয়ে লাফিয়ে কাঁঠাল পাতা খাচ্ছে। মনে হচ্ছে ও যেন আমাদের ঘরের অনেক দিনের পুরোনো কোনো সদস্য।

আমি সারা দিন ছাগলটা নিয়েই পড়ে ছিলাম। ওর মধ্যে অন্যরকম একটা মায়া ছিল। যার সবটুকু কেন্দ্রীভূত ছিল ওর চোখে। হিমশীতল এক মায়াভরা চোখ। নিস্পলক চাহনিতে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতো। আমি ওর গলাটা চুলকে দিতাম। ও গলাটা আরেকটু এগিয়ে দিত।
মনে হয়, আমরা যেন কত জনম জনম ধরেই পরিচিত।

তারপর, দশমীর ভাঙা চাঁদ নিয়ে এলো কোরবানির ক্ষণ গণনা। ঈদের দিন নামাজ পড়া শেষে ওই ছাগলকে কোরবানি দেয়া হবে। তার আগেই ওকে গোসল করিয়ে সুন্দর করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। নামাজ শেষে কোরবানির জন্য প্রস্তুত আমাদের অল্প সময়ে আপন বনে যাওয়া মায়াবি ছাগলটা।

কিন্তু আমার খুব মন খারাপ। ওর ওই হিমশীতল চোখ বার বার আমার মনের মাঝে ভেসে উঠছে। আমি ঘরের এক কোণে চুপ করে বসে রয়েছি। কোরবানি নিয়ে সবাই ব্যস্ত থাকলেও আমার ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছেন আমার মা।

মায়েরা বুঝি এমনই হয়। দুঃখ পেলে বলতে হয় না। বুক দিয়ে শুষে নেয়। আর সুখ দেখলে আড়াল থেকে হাসে।
তারপর মা এসে আমাকে বললেন-

তুমি যদি তোমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি করো, তবেই আল্লাহ খুশি হবেন। বস্তুত, আমরা আমাদের এই সসীম জীবনে আল্লাহকে খুশি করার জন্যই এই কাজ করি। কারণ, তিনি এসব রক্ত মাংস কিছুই দেখেন না। তিনি দেখে তাঁর প্রতি তোমার ভক্তি। তাক্বওয়া।
এটা আমার ধর্ম বিশ্বাস। আমি বলছি না এই বিশ্বাস আপনাকেও মানতেও হবে। কিংবা আমি কোনো ধর্ম প্রচারক নই যে আমি আমার বিশ্বাস আপনার কাছে প্রচার করছি।

বিষয়টা হলো-
কোরবানির ঈদ এলেই একদল পশুপ্রেমীর আবির্ভাব হয়। ইনিয়ে বিনিয়ে এরা বোঝাতে চায় মুসলমানেরা নিরীহ গরু-ছাগল হত্যা করে। এটা ঠিক না। ইনিয়ে বিনিয়ে মুসলমানদেরকে জ্ঞান দিয়ে ঐ সব লোক আবার নাস্তা সারে ফ্রায়েড চিকেন দিয়ে।

হায় সেলুকাস! কী অদ্ভুত তারা!
অনেকেই আবার আরো এক কাঠি সরেস। একটু ঝাঁঝ নিয়ে বলে মুসলমানেরা তো নিরীহ গরু-ছাগল হত্যা করে কোরবানি দেয়। পারলে বাঘ খেয়ে হজম করে দেখাক।

তাদের প্রতি আমারও প্রশ্ন-
ওহে জ্ঞানী! আপনারা যারা ভেজিটেরিয়ান, আপনারা লতা-পাতা-শাক না খেয়ে বটগাছ খেয়ে দেখান। বীরুৎ, গুল্ম বাদ দিয়ে একটু বৃক্ষ খান।

কথায় কথায় এসব পশুপ্রেমী বলে, মুসলমানেরা গরু-ছাগল হত্যা করে। সত্যিই কি তাই?

একটু খেয়াল করলে দেখবেন, আমরা যেভাবে কোরবানি দেই, সেই প্রসেস অন্যদের থেকে আলাদা। এখানে কোরবানির আগে গরু-ছাগল কিনে এনে তাদেরকে নিজদের কাছে এক দুই দিন রাখা হয়। তাদেরকে খাবার খাওয়ানো, দেখাশোনার মাধ্যমে একটা বন্ধন গড়ে ওঠে। তারপর জবাই করার আগে তাদেরকে গোসল করিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়। সবশেষে ধারালো ছুরির সাহায্যে শ্বাসনালী কেটে দেয়া হয়। বৈজ্ঞানিকভাবেও এটা প্রমাণিত এই পদ্ধতিতে পশু কষ্ট কম পায়।

এসব পশুপ্রেমীর কাছে আমার আহবান। প্লিজ আপনারা মাছের হ্যাচারিদেরকে বোঝান, আপনারা মাছ বিক্রি করবেন না। সবাই বাড়িতে নিয়ে মাছ বটি দিয়ে জবাই করে খায়। উফ! কী কষ্ট।
আপনারা পোল্ট্রি শিল্পের মালিকদের বলুন, মুরগি বিক্রি বন্ধ করে দিতে, মুরগি জবাই করছে। উফ! কী কষ্ট।

এভাবেই আপনাদের ডায়নিং কাঁপানো আন্দোলনের ফসল হিসেবে একদিন এই দেশ ভরে উঠবে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি আর মাছে।

আর শরৎচন্দ্রের বিলাসী গল্পের মৃত্যঞ্জয়ের মতো সব মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। অথচ আপনারা বুঝতেই চান না যে এটা খাদ্য শৃঙ্খলের একটা অংশ।

হয়তো এদের জন্যই আবুল মনসুর আহমেদ লিখে গেছেন-
"গো দেওতা কা দেশ" যেখানে তিনি বলেছেন গরুর দুধে ভেসে গেছে সারা দেশ।
আরো একটা ব্যাপারে এরা মোটা দাগে চুপ করে যায়। সেটা হলো, কোরবানিতে যে সংখ্যক গরু-ছাগল বিক্রি হয়, হাটের ইজারা থেকে একটা রাজস্ব আদায় হয়। এটা অর্থনীতিতে অবদান রাখে। তাছাড়া কোরবানির চামড়া আমাদের চামড়া শিল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এগুলো তো আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতিকেই এগিয়ে নিচ্ছে।

তাছাড়া কোরবানি উপলক্ষে সমাজের দুস্থ মানুষদের বিশাল অংশের মাঝে আমরা গোশত দিয়ে থাকি। এই মানবিক দিকগুলো চোখে ঠুলিপরা ওই সব মানবতাবাদী লোকের চোখে পড়বে না।
এসব সিজনাল মানবতাবাদীর জন্য আমার কষ্ট হয়। সত্যিই কষ্ট হয়।

তবে আমাদের মুসলমানদেরও একটা অংশ কোরবানিকে একটা প্রেস্টিজিয়াস ইস্যু বানিয়ে ফেলেছে। কোরবানির মূল শিক্ষা থেকে তারাও সরে গেছে। ঘরে ঘরে ডিপ ফ্রিজ বোঝাই গোশত চাপা পড়ে থাকে। অথচ পাশের প্রতিবেশী ওই ডিপ ফ্রিজওয়ালা বাসা থেকে রান্না করা গোশতের ঘ্রাণ শুকেই দিন পার করে।
সিজনাল ওইসব পশুপ্রেম মানবতাবাদী আর এই এলিট শ্রেণির প্রেস্টিজিয়াজ মুসলমান উভয়ের জন্যই একরাশ সমবেদনা।

কোরবানি হোক ইসলামের মূল শিক্ষায়। কেননা আল্লাহ বলেছেন-
আল্লাহর কাছে কোরবানির রক্ত, গোশত কিছুই পৌঁছায় না।
বরং যা পৌঁছে তা হল তোমাদের তাক্বওয়া।
(সূরা হজ : ৩৭)
এই কোরবানি উপলক্ষে আল্লাহ আমাদের তাক্বওয়ার ভিত আরো মজবুত করুন।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us