স্টার্টআপ থেকে চরবৃত্তি : যেভাবে উত্থার পেগাসাসের

অন্য এক দিগন্ত | Jul 24, 2021 08:04 am
স্টার্টআপ থেকে চরবৃত্তি : যেভাবে উত্থার পেগাসাসের

স্টার্টআপ থেকে চরবৃত্তি : যেভাবে উত্থার পেগাসাসের - ছবি : সংগৃহীত

 

বিশ্বের তাবড় প্রযুক্তি কোম্পানির হাজার হাজার কর্মী দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে সফ্টওয়্যার কোডের গলদ ধরার চেষ্টা করেন। এমনকি কোম্পানির সফ্টওয়্যার সুরক্ষার গাফিলতি ধরে দিতে পারলে পুরস্কারও দেয় অ্যাপল, গুগল, ফেসবুক, মাইক্রাসফটের মতো কোম্পানিগুলো। এই পরিস্থিতিতে বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে স্মার্টফোনের মাধ্যমে নজরদারির জন্য শুধুমাত্র টার্গেটকে এড়িয়ে চলার সাথে প্ল্যাটফর্মকেও এড়িয়ে চলতে হবে এই টেক কোম্পানিগুলোকে।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সমাজকর্মীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষদের স্মার্টফোনে নজরদারির জন্য আবারো শিরোনামে ইসরাইলের এনএসও গ্রুপের নাম। নাম জড়িয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে সংবেদনশীল স্পাইওয়্যার পেগাসাসের। এই স্পাইওয়্যার ফোনে প্রবেশ করলে একদিকে যেমন ব্যবহারকারী তা বুঝতে পারবেন না, একই ভাবে এই ফোনে এই স্পাইওয়্যারের উপস্থিতি টের পাবেন না সফ্টওয়্যার ডেভেলপাররাও। পাশাপাশিই আবার, কোনো লিঙ্কে ক্লিক না করলেও যেকোনো ফোনে এই স্পাইওয়্যার ইনজেক্ট করা সম্ভব হবে।

পেগাসাস : শুরু হলো যেভাবে?

ফরাসি নন প্রফিট ফরবিডেন স্টোরিজে ইসরাইলের এনএসও গ্রুপ সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। শ্যালেভ হুলিও ও ওমরি লাভি নামের দুই বন্ধু মিডিয়াঅ্যান্ড নামে একটি স্টার্ট-আপ শুরু করেন ২০০০ সালে। ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দায় এই সংস্থা প্রায় বন্ধ হতে চলেছিল। কিন্তু, ২০০৭ সালে আইফোন লঞ্চ হওয়ার পরে নতুন সম্ভাবনা খুঁজে পান শ্যালেভ হুলিও ও ওমরি লাভি। ওই সময় মানুষ ফোন ও টেক্সট মেসেজ ছাড়াও অন্যান্য কাজ করার জন্য ফোন কিনতে শুরু করেন।

ফরবিডেন স্টোরিজের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই সময় শ্যালেভ হুলিও ও ওমরি লাভি কমিউনিটেকের সূচনা করেন। এই অ্যাপ ব্যবহার করে দূর থেকেও যেকোনো স্মার্টফোন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। প্রথমে টেক সাপোর্টের জন্য এই সার্ভিস তৈরি হয়েছিল। কিন্তু, দিন দিন স্মার্টফোন ব্যবহার বাড়তে থাকার কারণে বিভিন্ন স্মার্টফোন মেসেজিং অ্যাপে এনক্রিপশন পদ্ধতি ব্যবহার শুরু হয়, যা নানা দেশের সরকারকে ফোন ট্যাপ করার কাজ কঠিন করে দেয়।

এত দিন পর্যন্ত টেলিকম নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কোনো কল অথবা মেসেজ আদান প্রদানের সময় ফোনে আড়ি পাতার কাজটি অত্যন্ত সন্তর্পণে সেরে ফেলত বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। কিন্তু, এনক্রিপশন পদ্ধতি চালু হওয়ার কারণে তা সম্ভব হচ্ছিল না। যেকোনো মেসেজ ডিক্রিপ্ট করার জন্য প্রয়োজন বিশেষ কি, যা শুধুমাত্র প্রেরক ও প্রাপকের ফোনেই থাকে।

'নিজেরা না জেনেই এই সমস্যার সমাধান করেন ওমরি লাভি ও শ্যালেভ হুলিও। এই সমাধানের ফলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যেকোনো ফোনে আড়ি পাততে পারবে। শুধু তাই নয়, এনক্রিপশনের বাধা টপকে যেকোনো মেসেজ পড়া যাবে। এর পরেই এই প্রযুক্তি ব্যবহারের আগ্রহ দেখাতে শুরু করে বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা। তখনই মোসাদের সাবেক সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ নিভ কারমিকে নিয়ে শুরু হয় এনএসও গ্রুপ। নিভ, শ্যালেভ ও ওমরির নাম থেকেই কোম্পানির নাম হয় এনএসও, দাবি করেছে ফরবিডেন স্টোরিজ।

স্পাই টেক ও জিরো ক্লিক

এর পর থেকে বিশ্বব্যাপী গোয়েন্দাদের জন্য নজরদারির সরঞ্জাম পেগাসাস তৈরির কাজ শুরু করে এনএসও। সরকারি সংস্থাগুলো সন্ত্রাসবাদ দমন ও মাদক পাচারের মতো বেআইনি কাজ রুখতে এই স্পাইওয়্যার ব্যবহার করবে বলে দাবি করে এনএসও। কিন্তু, একাধিক মিডিয়া রিপোর্টে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, এই স্পাইওয়্যারের প্রথম ক্রেতা মাদক পাচারকারীদের ধরা ছাড়াও অন্য কাজে পেগ্যাসাস ব্যবহার শুরু করে। ফরবিডেন স্টোরিজে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ২০১৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৫ হাজার নম্বরে নজরদারি জানিয়েছিল মেক্সিকো সরকার। ওই তালিকায় নাম ছিল মেক্সিকোর বর্তমান প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাডোরের। এছাড়াও, একাধিক সাংবাদিক, সরকার বিরোধী মানুষ, তাদের বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের নামও ছিল।

ফরবিডেন স্টোরিজের পক্ষ থেকে আরো বলা হচ্ছে, 'মেক্সিকো সরকার পেগাসাসকে এতটাই পছন্দ করেছিল যে শেষ পর্যন্ত গোয়েন্দা বিভাগের নজরদারির টুলে পরিণত হয় এই স্পাইওয়্যার। এছাড়াও, দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস, সেনা অফিসারদের এই স্পাইওয়্যার ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল মেক্সিকো। এর পরই মেক্সিকোকে আরো আকর্ষণীয় অফার দিতে শুরু করেন এনএসও গ্রুপ। প্রত্যেকবার প্রযুক্তি আগের থেকে উন্নত হতে শুরু করে।'

ঠিক তার পরই স্পাই-প্রযুক্তিতে শীর্ষস্থান দখল করতে শুরু করে ইসরাইলের কোম্পানিটি। এর আগে এই কাজে দক্ষ ছিল ইউরোপের ফিনফিশার হ্যাকিং টিম। এই সময় পর্যন্ত টার্গেটের ফোনে ইমেল অথবা এসএমএসের মাধ্যমে লিঙ্ক পাঠিয়ে ফোনে পেগাসাস ইনস্টল করার কাজ চলত। লিঙ্কে ক্লিক করলেই ফোনে ইনস্টল হয়ে যেত এই স্পাইওয়্যার, যা ঘুণাক্ষরেও টের পেতেন না ফোন ব্যবহারকারী। পরবর্তীতে শুরু হয় 'জিরো-ক্লিক' ইনফেকশন। এর মাধ্যমে আইমেসেজ ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো এনক্রিপটেড মেসেজেও নজরদারি করা সম্ভব হয়।

বিস্তৃতি

২০১৪ সালে এনএসও গ্রুপ কিনে নেয় মার্কিন প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট ফার্ম ফ্রান্সিসকো পার্টনার্স। ১২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে এই কোম্পানি বিক্রি হয়ে যায়। এর পরে স্মার্টফোনে ব্যবহার হওয়া বিভিন্ন অ্যাপের সুরক্ষার গাফিলতি খোঁজার কাজ শুরু হয়। ফলে, আরো বেশি গ্রাহকের কাছে পৌঁছতে শুরু করে এই কোম্পানি। ২০১৮ সালে কানাডার সিটিজেন ল্যাবের তরফে জানানো হয়েছিল, ৩৩ থেকে ৩৬টি পেগাসাস অপারেটরের সন্ধান মিলেছে। মোট ৪৫ দেশে ব্যবহার হয়েছে এই স্পাইওয়্যার।

সেই বছরই অর্থাৎ ২০১৮ সালে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি খুব মামলায় পেগাসাসের নাম সামনে আসে। সেই সময় প্রথম জানানো হয় যে সমাজকর্মী, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও বিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাদের উপরে পেগাসাস ব্যবহার করে নজরদারি করছে বিভিন্ন দেশের সরকার। এক বছর পরে ১৭টি মিডিয়া কোম্পানির সাথে হাত মিলিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে ফরবিডেন স্টোরিজ। সেখানে জানানো হয়, বিশ্বব্যাপী ৫০ হাজার সাংবাদিক, বিরোধী নেতা, সমাজকর্মী, এমনকি সরকারি কর্মীদের উপরেও পেগাসাসের মাধ্যমে নজরদারি করে হয়েছে।

কী বলছে এনএসও

দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে এই বিষয়ে এনএসও গ্রুপের প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে। এনএসও গ্রুপ ওই রিপোর্টে বলছে, 'এই তদন্ত প্রথম থেকেই যুক্তিহীন।' রিপোর্টে প্রকাশিত তালিকার সত্যতা অস্বীকার করে কোম্পানির মুখপাত্র আরো বলেন, 'এই রিপোর্ট কিছু সাদা কাগজ খুলে দেখার সমান। যেমন খুশি ৫০ হাজার নম্বর বাছাই করে, তা থেকে শিরোনাম তৈরি করা হয়েছে।'

ওয়াশিংটন পোস্টের সম্পাদক নিজে বলেছিলেন, 'তালিকার উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট করে নির্ধারণ করা যায়নি।'

যদিও কোম্পানির মুখপাত্র জানিয়েছেন, এই প্রযুক্তি অপব্যবহার করার 'সব ধরনের দাবি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।' কোনো ধরনের অপব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি গ্রাহকের সিস্টেম বন্ধ করে দেয়ার হুমকিও দিয়েছে এনএসও। 'এনএসও গ্রুপ সব ধরনের দাবির তদন্ত করবে। তদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া হবে', বলছে এনএসও।

সূত্র : এই সময়


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us