একজন সাকিব, মাশরাফীর খুঁজে বাংলার ফুটবল

আফফান উসামা | Jul 30, 2021 08:07 am
একজন সাকিব, মাশরাফীর খুঁজে বাংলার ফুটবল

একজন সাকিব, মাশরাফীর খুঁজে বাংলার ফুটবল - ছবি : সংগৃহীত

 

সে যেন এক রূপকথার গল্প। বর্তমানের দিকে তাকালে রূপকথাই তো বটে। কী একটা সময় ছিলো তখন, এখন ভাবলে মনে হবে নিছকই কল্পনা। দম বন্ধ করে, চোখের দু'পাট লাগিয়ে, মনটাকে অনুভবের গহীনে হারালে স্বপ্ন আর বাস্তবতার সংমিশ্রণে, সত্য-মিথের মিশেলে তৈরী হওয়া রূপকথাই মনে হবে তাকে। যে রূপকথার গল্পে আজও হৃদয়ে ঢেউ তুলে, শিহরণ খেলে যায় দেহে। যেই রূপকথা বুকে আফসোসের বেদনা দিলেও আজও ঠোঁটের কোণে ফোটায় কিঞ্চিৎ হাসির দোলা।

দেখিনি কোনো দিন, শুনেছি শুধু। শুনেছি, অতঃপর হয়েছি আনমনে তন্ময়। হবারই কথা, কারণ আমাদের প্রজন্ম বা পরবর্তী সময়ের কাছে তা তো শুধুই রূপকথা। একটা বলকে কেন্দ্র করে একটা দেশের ৫৭ হাজার বর্গমাইলের গোটা মানচিত্র ভাগ হয়ে যায় দুভাগে। কখনো তা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে, কখনো বা বার্সালোনা আর রিয়াল মাদ্রিদ হয়ে। কিন্তু তখন এদের কে ছাড়িয়ে যেত আরো একটা মহারণ; আবাহনী বনাম মোহামেডানে। লাল-সবুজের পতাকাটা যেন বদলে যেত সাদা-কালো আর আকাশি- নীলে।

আবাহনী-মোহামেডান উত্তুঙ্গ দ্বৈরথ কে না জানে। সেই সোনালি অতীত আজও বাবা-চাচাদের পুড়িয়ে বেড়ায়। গ্রামগঞ্জের মানুষ শুধু এই ঢাকা ডার্বি দেখার জন্য পাড়ি দিত শত কিলোমিটার। ভ্যান, বাসের ছাদ, ট্রাক্টরে ভরে আসা মানুষজনের মিলনমেলা হতো স্টেডিয়ামের গ্যালারি। অনলাইনে সেই সাদাকালো প্রিন্টের দর্শকভরা মাঠের ছবি নতুন প্রজন্ম দেখলে অবাক হওয়ারই কথা। ফুটবলের আমেজের শহর হয়েছিল ঢাকা। এ যেন স্বপ্নীল এক রূপকথার শহর!

আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ আজও হয়। কালের বিবর্তনে আমাদের বাপ-দাদারাও খেলা দেখতেন, আমরাও দেখি। সময়ের পার্থক্য শুধুই দুই যুগের, কিন্তু খেলায় পার্থক্য আসমান-জমিনে। তাদের সময় মাঠ কেঁপে উঠতো জনসমাগমে, ঠায় হতোনা স্টেডিয়াম চত্বরে। আর এখনকার সময়ে খেলার মাঠ যেন ধু ধু মরুভূমির মতো শূন্য, টাকা বিলিয়েও দর্শক মেলে না। কিছু দিন আগে তো ফ্রি জার্সিও দিয়েছিল কোনো এক দল। শুনেছি দর্শক টানতে নাকি বিরিয়ানিরও ব্যবস্থা হয়ে থাকে বিভিন্ন ক্লাবের পক্ষ থেকে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন আর জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। স্বাধীন বাংলা ফুটবল টিম দিয়ে প্রথম শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের ফুটবলের অগ্রযাত্রা।তাদের লক্ষ্য ছিল এই ভিন্নধর্মী চেষ্টা করে কিছুটা হলেও যদি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা যায়। ফলে, জাকারিয়া পিন্টুর নেতৃত্বে কাজী সালাহউদ্দিন, অমলেস সেনরা মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে। প্রথম ম্যাচ খেলেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া একাদশের বিপক্ষে। ২-২ সমতায় ম্যাচের সমাপ্তি ঘটে। এরপর ১৬টি প্রীতি ম্যাচ খেলে মুক্তিযোদ্ধা ফান্ডে ৫ লাখ টাকা জমা করে স্বাধীন বাংলা ফুটবল টিম। যা নিঃসন্দেহে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবিস্মরণীয় সহায়তা বলা চলে।

অতঃপর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের প্রথম বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল গঠিত হয়েছিলো ১৯৭২ সালে। ১৯৭৩ সালে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক প্রীতি মাচ খেলে বাংলাদেশ। সেই ম্যাচটাও ২-২ গোলে ড্র হয়। এরপর মালদ্বীপের বিপক্ষে ৮-০ গোলের এক বিশাল জয় পায় বাংলার দামালেরা। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেল এএফসি ও ফিফার অনুমোদন লাভ করে। মালদ্বীপের বিপক্ষে বিশাল জয়ের অনুপ্রেরণায় আর শক্তিতে উদ্দীপ্ত হয়ে ১৯৮০ সালে এফসির কোয়ালিফাই পর্বে সবচেয়ে বড় অর্জন গ্রুপ স্টেজে চ্যাম্পিয়ন হয়ে। সেখানে অন্য গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন ছিল ইরান, উত্তর কোরিয়া, চীন, সিরিয়ার মতো দলগুলো। আর তখন থেকেই বাংলার মানুষ স্বপ্ন দেখা শুরু করে দেয় এই ফুটবলকে ঘিরে। এই ফুটবল অনেক দূর যাবে।

শুরুও হয়েছিল অগ্রযাত্রা। দারুণ সব ফলাফলও আসছিল। '৯০-এর দশকটা ফুটবলের রঙে সোনালি হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আফসোস! এর পরই বাংলার ফুটবল তার জায়গা থেকে পিছু হটতে শুরু করে। এগোতে তো পারেইনি, পা ফসকে পেছনেই ছুটে চলেছে অনবরত। এদিকে উপমহাদেশে ক্রিকেটের বিপ্লব ঘটে, বাংলাতেও যার যথেষ্ট ভালো প্রভাব পড়ে। তাছাড়া যেই সালাউদ্দীনদের পায়ে ফুটবল রেখে গোটা দেশ স্বপ্ন দেখেছিল, আজ সেই সালাউদ্দীনের হাতে ফুটবল দেখে সবাই আফসোসের করুণ সুর তুলে আহ! শব্দতে।

আমাদের গর্ব করার মতো কিছুই কি নেই? স্যাটেলাইট আছে, আছে সাবমেরিন, সমৃদ্ধ জিডিপি। আছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। আছে এগিয়ে যাবার প্রেরণা, উন্নত দেশ গড়ার ইচ্ছা। আছে ক্রিকেটের সাফল্য। আরো অনেক স্বপ্ন, অর্জন, সাফল্য আছে। কিন্তু তবুও যখন বিশ্বকাপের বিশ্ব মঞ্চে ৩২ দলের লড়াই দেখি, মুখ ফসকে আহ! শব্দটা বেড়িয়ে তখন মনের অজান্তেই। এতো কিছু আছে, কিন্তু বিশ্বমঞ্চে নিজের দেশটাই নেই! এই শুন্যতা ভুলতেই তো ঘরে ঘরে লাগানো হয় অন্য দেশের পতাকা!

বার বার আশার সঞ্চার করেও নীতি নির্ধারকদের খপ্পরে ফুরিয়ে যাচ্ছে তা। দিনের পর দিন প্রিয় ফুটবলের ব্যর্থতার দায়ভার ফুটবলের নীতিনির্ধারক বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন- বাফুফের। এক যুগের বেশি সময় ধরে ফেডারেশনে রাজত্ব করলেও ফুটবল ও ফুটবলারদের জন্য কিছুই করতে পারেননি ফেডারেশনটি। দুর্নীতি, ক্যাসিনো, সিন্ডিকেটে পদদলিত হয়ে বরং ফুটবলের উন্নয়ন হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের ফুটবল কতটা দুর্নীতিতে আবদ্ধ, তা বুঝতে কিশোরী ফুটবলারদের লোকাল বাসে বাড়ি পাঠানো হয়, কোমলমতি কিশোরী ফুটবলাররা পথে লাঞ্ছনার শিকার হবার ঘটনাই যথেষ্ট। তাছাড়া, অনূর্ধ্ব- ১৬ সাফ চ্যাম্পিয়ন অধিনায়কের অভাবের টানাপোড়েনে রাজমিস্ত্রির কাজ করার গল্প শুনে, বা পেশাদার লিগ চলাকালীন জাতীয় স্টেডিয়ামে ক্যামেরায় ধরা পড়ে মিষ্টি কুমড়ার চাষাবাদ বাকিটার মূল্যায়ন করে।

আশা ছিল পরিবর্তনের। কিন্তু হায়, কিভাবে কী হয়ে বাফুফে নির্বাচন থেকেই সরে দাঁড়ালেন তরফাদার রুহুল আমিন। এর মাঝে দুই সহ-সভাপতি সালাউদ্দীনের বিপক্ষে লড়বেন বলেও হয়ে গেলেন নিশ্চুপ। অপরদিকে একজন একাকী আপ্রাণ চেষ্টা করেও পেলেন মাত্র ১ ভোট! নির্বাচনের পর শোনা গেল ভোট বেচা-কেনার গল্প। অবাক হইনি, এই আর তেমন কী, সমাজটাই যে আমাদের দোষনীয়। ঘুনে ধরে গেছে আমাদের মানসিকতায়। যেন সবার উপরে টাকা সত্য, তার উপরে কিছু নাই।

দেশের মানুষ তবুও আশা রাখে, ঘুণে ধরা চলমান মরীচিকাময় ফুটবল থেকে উত্তরণ ঘটবে কারো হাত ধরে। কিন্তু কে হবেন সেই সঠিক মানুষ? আসবেন কী সত্যিই? একজন ত্রাতা হয়ে, ফিনিক্স পাখির মতো উড়ে আসুক বাংলার ফুটবলে বিপ্লব ঘটাতে। এমন কি কেউ নেই, যিনি ঝিমিয়ে পড়া আমাদের ফুটবলকে জাগিয়ে তুলবে। এমন কেউ কি নেই যে দেবদূত হয়ে ভালোবাসার খেলাকে যত্ন করে দায়িত্ব নিয়ে পৌঁছে দেবে বিশ্বদরবারে? এমন একজন কবে আসবে, যার হাত ধরে বিশ্বকাপের ওই বিশ্বমঞ্চে 'আমার সোনার বাংলা' উচ্চারিত হবে? ক্রিকেটের মতো ফুটবলেও বের হয়ে আসুক একজন সাকিব, তামিম, মাশরাফী! যার হাত ধরে লেখা হবে লাল-সবুজের কালিতে রূপকথার নতুন অধ্যায়।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us