তিউনিসিয়ার অভ্যুত্থান : একটি সরল সমীকরণ

আবু সাঈদ | Aug 02, 2021 03:21 pm
প্রেসিডেন্ট সাইয়িদ

প্রেসিডেন্ট সাইয়িদ - ছবি : সংগৃহীত

 

আরব বসন্তের ১০ বছর পেরিয়ে গেছে। অভাব মুক্তির সোনার হরিণ এখনো অধরাই রয়ে গেছে। বিন আলীর তলানিতে ঠেকানো অর্থনীতি এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর‌ই মধ্যে আইএসের হামলায় পর্যটন-নির্ভর দেশটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিরাপত্তার অভাব পর্যটন শিল্পের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। দেশটির ১৫/২৫ শতাংশ মানুষ এই পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত। তাদের কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। হ্রাস পায় পর্যটন খাতের ৬০/৭০ ভাগ আয়। দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়ে। সরকার এখনো সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এর‌ই মধ্যে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে করোনা মহামারী। এ যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। সরকার দেশ পরিচালনায় হিমশিম খেতে থাকে। আন্তর্জাতিক তহবিল সংস্থা আইএমএফ থেকে তিন তিনবার ঋণ গ্ৰহণ করে। তবুও যেন প্রয়োজন ফুরায় না। ফলে চতুর্থ প্যাকেজের আলোচনা শুরু হয়। ওদিকে আইএমএফের চাহিদা অনুসারে দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। বৃদ্ধি করা হয় করের হার। কমানো হয় সরকারি চাকরির‌ও সংখ্যাও। ফলে বিন আলীর নিষ্পেষণে ক্ষুব্ধ জনতা আবারো ক্ষেপে ওঠে। শুরু হয় বিক্ষোভ। রাজধানী তুনিস পেরিয়ে অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে পড়ে।

সেমি প্রেসিডেন্সিয়াল তিউনিশিয়ার সংবিধানে প্রেসিডেন্টের রয়েছে বিশেষ কর্তৃত্ব। প্রেসিডেন্ট যদি মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভা যথাযথভাবে দেশ পরিচালনা করতে পারছেন না, তবে প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারকে তিনি বরখাস্ত করতে পারবেন। স্থগিত করে দিতে পারবেন নির্বাচিত পার্লামেন্ট। সংবিধানের এই ৮০ ধারা অনুসারে দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট কায়েস সাঈদ প্রধানমন্ত্রী হিশাম মাশিশিকে বরখাস্ত করেন। স্থগিত করেন নির্বাচিত পার্লামেন্ট। গ্ৰহণ করেন নির্বাহী ক্ষমতা। প্রেসিডেন্টের এহেন পদক্ষেপকে তার সমর্থকরা স্বাগত জানায়। অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বলিষ্ঠ ভূমিকা বলেও উল্লেখ করে। তবে অপরাপর দলগুলোর পক্ষ থেকে একে সাংবিধানিক অভ্যুত্থান আখ্যা দেয়া হয়। ক্ষমতাসীন দল আন নাহদা এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ করার লক্ষ্যে সবাইকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানায়।

প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এই বিক্ষোভ পরিস্থিতির জন্য অর্থনৈতিক সঙ্কটকে দায়ী করা হলেও সাংবিধানিক অভ্যুত্থানের দাবিকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। নানা কারণে তা প্রবলভাবে প্রমাণিত হয়। গত মে মাসে প্রেসিডেন্টের চিফ অফ স্টাফ নাদিয়া আকাশার দফতর থেকে একটি গোপন নথি প্রকাশ পেয়ে যায়। সেখানে দেশের বিপুল সমস্যার সমাধানে সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়।

তাছাড়া প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপের বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনার পথ উন্মুক্ত রাখতে এমপিদের জন্য ছিল আলাদা আইনি সুবিধা। প্রেসিডেন্ট ওই সুবিধাও বাতিল করে দিয়েছেন। বিরোধীদের কঠোরভাবে দমনের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ব্যাপকভাবে গ্ৰেফতারের অনুমতি প্রদান করেছেন। সরকারি ভবন সেনা নিরাপত্তার অধীনে দিয়ে দেন। দেশব্যাপী ২৭ অগাষ্ট পর্যন্ত কারফিউ জারি করেন। এই সময় সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত চলাচল করা যাবে না। অন্য সময় অপ্রয়োজনে বাইরে বের হওয়া যাবে না। সরকারি সড়ক ও চত্ত্বরে তিনের বেশি মানুষ একত্রিত হতে পারবে না। প্রেসিডেন্টের আরো নানা কার্যক্রমে সাংবিধানিক অভ্যুত্থানের হাতছানি পাওয়া যায়।

অর্থনৈতিক সঙ্কটের জেরে বিক্ষোভ শুরু হলেও প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইয়িদের ইঙ্গিতে তা হয় বলে শোনা যায়। করোনা সঙ্কট সব দেশের অর্থনীতিতেই প্রভাব ফেলে। আইএসের হামলা দেশটির অর্থনীতিকে আরো বেকায়দায় ফেলে। দেশের জনগণ তা বুঝে। তবুও কায়েস সাইয়িদ তার হীন স্বার্থ চরিতার্থের উদ্দেশ্যে এই বিক্ষোভের ইন্ধন জোগায় বলে অভিযোগ উঠে। রোববার গভীর রাতে বিবৃতির মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাহী ক্ষমতা নিজের কর্তৃত্বে নিয়ে নিলে মিছিলকারীদের একাংশ এ নিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে। এতে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। তিউনিসিয়াভিত্তিক সাংবাদিক রাবেব আলৌই আল জাজিরাকে বলেন, 'সাইয়িদের পদক্ষেপে বিস্মিত হ‌ওয়ার মতো কিছু নেই। কারণ, তিনি তো আগে থেকেই সংসদ ভেঙে দেয়ার ও প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করার হুমকি দিয়ে আসছিলেন।'

দেশটির বিদায়ী প্রেসিডেন্ট মনসেফ মারজুকি বর্তমান প্রেসিডেন্টের এই পদক্ষেপের কঠোর নিন্দা জানান। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে একটি ফেইসবুক ভিডিওতে বলেন, 'আমরা আজ রাতে (রোববার রাতে) বড় এক ধাপ পেছনে চলে গেছি। ফিরে এসেছি আগের স্বৈরাচার শাসনে।' অতপর তিনি প্রেসিডেন্টকে রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা নিরসনের আহ্বান জানান।

দেশটির মার্কস ও লেলিনবাদি ওয়ার্কাস পার্টিও প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপকে অভ্যুত্থান বলে প্রত্যাখ্যান করে। তারা বলে, ‌'প্রেসিডেন্ট কর্তৃক সংসদ স্থগিত করা ও মন্ত্রিসভা বাতিল করে নির্বাহী ক্ষমতা কুক্ষিগত করায় তিউনিসিয়া আবার স্বৈরশাসনের কবলে পড়তে যাচ্ছে।'

তিউনিসিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম দল কালব তিউনিস‌ও প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপের নিন্দা জানায়। তারা বলে, 'প্রেসিডেন্ট এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন।'

অভ্যুত্থানে কায়েস সাইয়িদ সামনে থাকলেও বিশ্লেষকরা নেপথ্য নায়ক হিসেবে অন্য ব্লককেই ভাবছেন। আরব বসন্তের সূতিকাগার এই তিউনিসিয়া মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের চেতনার বাতিঘর। দেশটি স্বৈরাচার ও একনায়কতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনে মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের আশাবাদ জাগিয়ে তোলে। এজন্য সৌদি-আমিরাত ব্লক তিউনিসিয়ার গণতন্ত্রকে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে। ওদিকে তুর্কি-কাতার ব্লককেও ভালোভাবে দেখে না সৌদি-আমিরাত ব্লক। তিউনিসিয়ার ক্ষমতাসীন দলের তুরস্কের সাথে আদর্শিক মিল রয়েছে। তাই ক্ষমতাসীন দল আন নাহদাকেও পছন্দ করে না তারা। অভিযোগ উঠেছে, সৌদি-আমিরাত জোটের ইন্ধনেই কায়েস সাইয়িদ এই পথে অগ্ৰসর হয়। অভ্যুত্থানের পর দিন কায়েস সাইয়িদ সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করলে তিনি কায়েস সাইয়িদের পদক্ষেপের আকুন্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেন। আমিরাত এই বিষয়ে মুখ না খুললেও তাদের সংবাদ মাধ্যমে দেশটির দৃষ্টিভঙ্গি উঠে আসে।

আমিরাত ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম টোয়েন্টিফোর মিডিয়ার হেডলাইন করা হয়, 'তিউনিসিয়া রক্ষায় প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইয়িদের সাহসী পদক্ষেপ'। ফলে এই অভ্যুত্থানের কলকাঠি মধ্যপ্রাচ্যের এই ব্লকের হাতে মর্মে অনেক পর্যবেক্ষক নিশ্চয়তা প্রকাশ করেছেন। কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরার তিউনিসিয়া কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে কর্মীদের বের করে দেয়া, আল জাজিরার কার্যালয় বন্ধ করে দেয়া ও কার্যালয় প্রধানকে আটক করা তাদের দাবিকে আরো জোরালো করে তুলেছে। ওদিকে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট মারজুকির বয়নেও তাদের সমর্থন মিলছে। অভ্যুত্থান পর দিন সোমবার আল জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট মারজুকি বলেন, 'এই অভ্যুত্থানের পেছনে আমিরাতের হাত থাকার ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই।'

নানা দেশের পক্ষ থেকে তিউনিসীয় জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্বকারী সংসদ স্থগিত হওয়ার ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। অতিসত্বর সাংবিধানিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য আহ্বান করা হয়। সামনে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে কিনা, আগামীর দিনগুলোই বলে দেবে। তবে রাজনৈতিক সকল দলের সমন্বয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলে উন্নতির আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়। আরব বসন্তের সফল ফসল তো সম্মিলিত প্রচেষ্টাই ঘরে ওঠেছিল। তিউনিসিয়ার ক্ষমতায় কোনো ধরনের পরিবর্তন এলে লিবিয়ার দীর্ঘ দিনের শান্তিপ্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক সমঝোতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করেছেন।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us