কয়েকটি নীরব ঘাতক

ডা: মো: তৌহিদ হোসাইন | Oct 02, 2021 02:51 pm
নীরব ঘাতকদের চিনে রাখুন

নীরব ঘাতকদের চিনে রাখুন - ছবি সংগৃহীত

 

পৃথিবী এখন টিকা আর করোনা মহামারী জ্বরে আক্রান্ত। করোনাভাইরাস নিয়ে অস্থির। কিন্তু তার চেয়েও বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে যেসব নীরব ঘাতকের কারণে, তাদেরকে বোধহয় ভুলতে বসেছি। এই নিবন্ধে সেসব নীরব ঘাতকের ওপর আলোকপাত করব।

প্রকৃতপক্ষে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রোগ হয়নি এমন লোক তো কখনো জন্মেনি; এখনো নেই এবং ভবিষ্যতেও থাকবে না। ফলে রোগ জিনিসটি কী, কত প্রকার, নীরব ঘাতক রোগগুলোই বা কোনগুলো এ ব্যাপারে জানা দরকার।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুস্থতার সংজ্ঞা : ‘সুস্থতা বলতে কেবল রোগ বা দুর্বলতার অনুপস্থিতি বোঝায় না; বরং শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে সম্পূর্ণভাবে ভালোলাগা একটি অবস্থান বোঝায়।’ একজন লোক দেখতে যতই সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিক দেখাক না কেন; সে সুস্থ নয়, যদি সে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার পাশাপাশি মানসিক ও সামাজিকভাবে স্বাভাবিক না থাকে। সে জন্যই একজন পাগল দেখতে সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিক দেখালেও তাকে সুস্থ বলা যাবে না। আর রোগ হলো কোনো মানুষের স্বাভাবিক কাঠামোগত বা কার্যকরী অবস্থা থেকে ক্ষতিকারক বিচ্যুতি, যা সাধারণত কিছু লক্ষণ ও উপসর্গের সাথে যুক্ত। সাধারণত রোগের কিছু লক্ষণ ও উপসর্গ থাকে। সে লক্ষণ বা উপসর্গ বাহ্যিকভাবে পরিলক্ষিত না হলেও সে রোগী, যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণিত হয়।

রোগের উপসর্গ ও লক্ষণ কিন্তু এক জিনিস নয়; উপসর্গ হলো আপনি যে অসুবিধার কথা ডাক্তারকে বলেন। লক্ষণ হলো ডাক্তার সাহেব আপনার অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে যা দেখতে পান।

বিভিন্ন ধরনের রোগকে প্রধানত দু’ভাবে ভাগ করা যায়। অসংক্রামক ও সংক্রামক রোগ। অসংক্রামক রোগের জন্য কোনো রোগ জীবাণু দায়ী নয়, বরং দায়ী হলো আমাদের শরীরের এনাটমি বা কাঠামোগত অথবা শারীরের ফিজিওলজির ক্ষতিকারক বিচ্যুতি যার সাথে লাইফ স্টাইল, খাদ্যাভ্যাস, পরিবেশ ও অন্যান্য ফ্যাক্টর জড়িত থাকে। যেমন- কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজেজ, ক্যান্সার, ক্রনিক ফুসফুস ডিজিজ ও ডায়াবেটিস প্রভৃতি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৩ এপ্রিল ২০২১ সালের সর্বশেষ তথ্যমতে, প্রধান যে চারটি নন-কমিউনিকেবল রোগের কারণে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি লোক মারা যায়, সেগুলো হলো- কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজেস (হাইপারটেনশন, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন, স্ট্রোক), ক্যান্সার, ক্রনিক লাং ডিজিজ ও ডায়াবেটিস মেলিটাস।

প্রথমত, অভ্যাসগত রিস্ক ফ্যাক্টর যা মানুষ চাইলে সহজেই মডিফাই করতে পারে এবং যার মধ্যে আছে অতিরিক্ত ধূমপান, পুষ্টিহীন খাবার, মদ্যপান ও প্রয়োজনের চেয়ে কম ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি বা শরীরচর্চাহীনতা। দ্বিতীয়ত, মেটাবলিক রিস্ক ফ্যাক্টর যা মডিফাই করা মানুষের জন্য অসম্ভব নয়; তবে খানিকটা কষ্টকর যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে আরো চারটি রিস্ক ফ্যাক্টর যেমন- হাইপারটেনশন, অতিরিক্ত ওজন বা ওবেসিটি, হাইপারগ্লাইসেমিয়া ও হাইপারলিপিডেমিয়া।

হাইপারটেনশন : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বে ১২৮ কোটি হাইপারটেনশনের রোগী আছে যারা ৩০-৭৯ বয়সী এবং যাদের দু-তৃতীয়াংশ নিম্ন ও মধ্যআয়ের দেশের মানুষ। পুরুষদের মধ্যে প্রতি চারজনে একজন এবং মহিলাদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনে একজন হাইপারটেনশনের রোগী। এর মধ্যে ৭০ কোটি হাইপারটেনশনের রোগীর কোনো চিকিৎসাই হয় না। তার মধ্যে ৪৬ শতাংশ লোক জানেই না যে, তাদের হাইপারটেনশন নামক কোনো রোগ আছে। কেবল ৪২ শতাংশ রোগী চিকিৎসা নেয়। তার মধ্যে প্রতি পাঁচজনের একজন হাইপারটেনশন কন্ট্রোলে রাখে। পৃথিবীব্যাপী অকালে মানুষ মৃত্যুর বড় কারণ এটি। হাইপারটেনশনের কারণেই হার্ট ডিজিজ, ব্রেইন ও কিডনি রোগীর ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। একনাগাড়ে ১০ বছর হাইপারটেনশন আনকন্ট্রোল থাকলে কিডনি ড্যামেজ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যেতে পারে। হাইপারটেনশনের বিশ্ব টার্গেট হলো ২০১০-৩০ সালের মধ্যে এর প্রকোপ ৩৩ শতাংশে নামিয়ে আনা। আশ্চর্য হতে হয় এ কথা জেনে যে, বর্তমানে আফ্রিকা অঞ্চলে হাইপারটেনশনের রোগী হলো ২৭ শতাংশ আর আমেরিকায় ১৮ শতাংশ। ১৯৭৫ সালে বিশ্বব্যাপী হাইপারটেনশনের রোগী ছিল ৫৯ কোটি ৪০ লাখ, ২০১৫ সালে ১১৩ কোটি আর বর্তমানে ১২৮ কোটি।

হাইপারটেনশনের রিস্ক ফ্যাক্টর : অতিরিক্ত লবণ, সেচুরেটেড ও ট্রান্সফ্যাট, কম পরিমাণে ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়া, শারীরিক কাজকর্ম কমিয়ে দেয়া, তামাক-মদজাতীয় খাবারে অভ্যস্ত হওয়া ও অতিরিক্ত ওজন।

স্থূলতা : অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতা হলো শরীরে অস্বাভাবিক বা অতিরিক্ত চর্বি জমা, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন মতে, ১৯৭৫ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী স্থূলতা প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতার প্রবণতা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। ১৯৭৫ সালে মাত্র ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৬ সালে তা ১৮ শতাংশে আশঙ্কাজনক উন্নীত হয়েছে।
১৯৭৫ সালে ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মাত্র ১ শতাংশ শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের স্থূলতা ছিল; ২০১৬ সালে ১২ কোটি ২৪ লাখে উন্নীত হয় (৬ শতাংশ মেয়ে ও ৮ শতাংশ ছেলে)। ২০১৬ সালে ১৯০ কোটিরও বেশি প্রাপ্তবয়স্ক ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী অতিরিক্ত ওজনের ছিল। এর মধ্যে ৬৫ কোটিরও বেশি লোক স্থূলকায় ছিল। ২০১৬ সালে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী প্রাপ্তবয়স্কদের ৩৯ শতাংশ ছিল অতিরিক্ত ওজনের এবং ১৩ শতাংশ ছিল স্থূলকায়। পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষে এবং না খেয়ে যত লোক মারা যায় তার চেয়ে অনেক বেশি লোক মারা যায় অতিরিক্ত খেয়ে অতিরিক্ত ওজন বাড়িয়ে ও স্থূলকায় হয়ে যাওয়ার কারণে। (সাব সাহারান আফ্রিকা ও এশিয়ার কিছু অঞ্চল বাদে)। ২০২০ সালে পাঁচ বছরের নিচে বিশ্বে তিন কোটি ৯০ লাখ অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলকায় শিশু ছিল। ২০১৬ সালে ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৩৪ কোটিরও বেশি শিশু ও কিশোর-কিশোরীর ওজন বেশি বা স্থূলকায় ছিল। স্থূলতা এমন একটি অসুখ যা সতর্ক থাকলেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।

হাইপারলিপিডেমিয়া : রক্তে প্রবাহমান লিপিডে কোনো অ্যাবনরমালিটি বা হাইপারলিপিডেমিয়া আছে কি না, তা দেখার জন্য আমরা সাধারণত লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন বা এলডিএল, হাই-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন বা এইচডিএল, কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড বা টিজিএল- এ চারটির রক্তের লেভেল দেখি। কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড এসব হলো লিপিড, যা পানিতে দ্রবণীয় নয়। অথচ এদের প্রয়োজন সারা শরীরের বিভিন্ন অংশে পৌঁছানোর।

নীরব ঘাতক বহু প্রাণনাশক নন-কমিউনিকেবল রোগ থেকে সাবধান : প্রকাশ্য শত্রু দমন করা যত সহজ, গোপন শত্রু চেনাও তত কঠিন। দুঃখজনক হলেও সত্য, বেশির ভাগ এনসিডির রোগই নীরব ঘাতক। এনসিডির রোগগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে উপসর্গ তৈরি করে না বা করলেও খুব কম, ফলে রোগ শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। এরাই সাইলেন্ট কিলার রোগ। তবে আজকে যার হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হলো বলে আমরা মনে করি, তা আজকের নয়; বরং এ অবস্থায় পৌঁছাতে কমপক্ষে ২০-৩০ বছর লাগে; কারণ তরুণকাল থেকেই প্রতিটি নীরব ঘাতক রোগের বীজ রোপিত হয়।

নীরব ঘাতক ডায়াবেটিস : আমেরিকান ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ১৯৯৭, ২০০৫ ও ২০০৭ সালে ডায়াবেটিস আছে কিন্তু শনাক্ত হয়নি এমন পরিমাণ যথাক্রমে ৫০, ৩০ ও ২৪ শতাংশ। পৃথিবীর ২.৬ শতাংশ লোক ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির কারণে অন্ধ হয়। ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি, স্ট্রোক ও ক্রনিক কিডনি ডিজিজ প্রভৃতি রোগ ডায়াবেটিসেরই জটিলতার কারণে। ফলে প্রতি বছর ৩২ লাখ লোক ডায়াবেটিসে মারা যায় অকালে।

কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজেস : হাইপারটেনশনের পর পর্যায়ক্রমে আথারোস্কেলেরোসিস এরপর করনারি আর্টারি ডিজিজ বা ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ এবং যার কারণে হয় হার্ট অ্যাটাক। হার্টের নিজস্ব রোগ কার্ডিওমায়োপ্যাথি নামে আছে আরেক নীরব ঘাতক। মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বা হার্ট অ্যাটাকের ২৫ শতাংশের ক্ষেত্রেই সাইলেন্ট হার্ট অ্যাটাক হয়, বিশেষ করে যদি বয়স্ক ও ডায়াবেটিক রোগী আগে থেকেই হয়।

আরেক নীরব ঘাতকের নাম হলো ক্রনিক কিডনি ডিজিজ, যা একটি প্রগ্রেসিভ ডিজিজ। একবার শুরু হলে আর পেছন ফিরে তাকানোর সময় নেই। কিডনি ড্যামেজ হতে হতে একপর্যায়ে ডায়ালাইসিস ছাড়া উপায় নেই। সমস্যা হলো- অনেক ক্ষেত্রেই ক্রনিক কিডনি ডিজিজের শুরুতে এমনকি ডায়ালাইসিস করার মতো জটিল পর্যায়ে চলে এলেও কোনো উপসর্গেরই দেখা নেই।

হেপাটাইটিস বি এবং সি : যদিও এগুলো একধরনের ভাইরাস। কিন্তু এগুলোর ভ‚মিকাও নীরব ঘাতকের মতোই। বর্তমানে পৃথিবীতে ৫৩ কোটি আক্রান্ত লোক আছে। প্রতি বছর ৩০ লাখ থেকে ৪০ লাখ লোক হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাসে নতুনভাবে আক্রান্ত হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, হেপাটাইটিস বি-এর টিকা আবিষ্কার হলেও এখন পর্যন্ত হেপাটাইটিস সি-এর কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দেখা মেলেনি।

নীরব ঘাতক ডিপ ভেইন থ্রমবসিস : হঠাৎ পায়ের ডিপ ভেইনের ভেতর ব্লাড ক্লট দেখা দিলে এটি হার্টে গিয়ে তারপর ফুসফুসে বড় ভেসেলকে বøক করে দেয়। এটি পালমোনারি এম্বোলিজম। এ অবস্থায় আক্রান্ত হতভাগা মানুষের স্পট ডেথ ছাড়া উপায় নেই।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি। শেরেবাংলা নগর, ঢাকা।
towhid.drhossain@gmail.com

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us