কুরআন অবমাননা : দাঙ্গা কার স্বার্থে?

তারেকুল ইসলাম | Oct 18, 2021 07:18 am
কুরআন অবমাননা : দাঙ্গা কার স্বার্থে?

কুরআন অবমাননা : দাঙ্গা কার স্বার্থে? - ছবি : সংগৃহীত

 

কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে কুরআন অবমাননার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন প্রতিবাদকারী নিহত হওয়ার সংবাদও এসেছে। কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু মন্দির ও পূজামণ্ডপেও হামলার ঘটনা ঘটেছে।

ইতোমধ্যে হাজীগঞ্জে ও নোয়াখালীতে হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরগুলো পরিদর্শন করেছেন মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাতকারে তিনি এসব হামলা ও ভাঙচুরের পেছনে ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর সম্পৃক্ততা আছে বলে মন্তব্য করেছেন (১৭ অক্টোবর ২০২১, প্রথম আলো)।

বাংলাদেশে এ ধরনের দৃশ্যত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর ফায়দা তোলে ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি। বিশেষত আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গসহ বাংলাদেশ সংলগ্ন ভারতীয় রাজ্যগুলোতে নির্বাচনের সময় বাংলাদেশের তথাকথিত হিন্দু নির্যাতনের গল্প পুঁজি করে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ভোট বাগানোর প্রয়াস চালায়। ফলে কেউ কেউ সঙ্গত কারণেই আগামী ত্রিপুরা নির্বাচনের সাথে কুমিল্লার কুরআন অবমাননার ঘটনার সম্পর্ক খুঁজছেন।

ত্রিপুরার বর্তমান রাজ্য সরকার বিজেপি নানা অপকর্ম ও অপশাসনের দরুন ব্যাপক সমালোচনায় জরাগ্রস্ত। এমনকি সম্প্রতি ত্রিপুরা রাজ্যের সুরমা আসনের বিজেপির বিধায়ক আশিস দাস দল ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আশিস অভিযোগ করে বলেছেন, ”The BJP is fostering 'political anarchy and chaos' in Tripura and the people are unhappy with the performance of the state government.” (05 Oct. 2021, NDTV)। সুতরাং, সামনের ত্রিপুরা নির্বাচনে কংগ্রেস ও তৃণমূলের সাথে বিজেপি ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে এমন সম্ভাবনা ক্রমশ ম্রিয়মান। তাই পরবর্তী নির্বাচনী প্রচারণার জন্য ক্ষমতালোভী বিজেপি তার চিরাচরিত মুসলিমবিরোধী প্রপাগান্ডাবাজির ওপর নির্ভর করতে পারে।

ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মুসলিম। আর মুসলিমবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক কার্ড খেলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ভোট বাগানোতে ওস্তাদ বিজেপি। সুতরাং, এমন ধারণা একেবারেই অমূলক নয় যে, বাংলাদেশের হিন্দু নির্যাতনের গল্প ত্রিপুরায় নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করতে এদেশে নতুন করে দাঙ্গা লাগানোর ষড়যন্ত্রে বহিরাগত উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদী ও হিন্দুত্ববাদীদের মদদ থাকতে পারে।

এছাড়া, বাংলাদেশের হিন্দুদের রক্ষায় ‘জরুরি হস্তক্ষেপ’ করতে মোদিকে আহ্বান জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী (১৪ অক্টো. ২০২১, বিবিসি বাংলা)। এই আহ্বান বাংলাদেশবিরোধী উসকানি এবং আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতি প্রকাশ্য হুমকি হলেও শুভেন্দু বাংলাদেশের কুমিল্লা ও হাজীগঞ্জের মন্দির ভাঙচুরের ঘটনাগুলোকে তার নির্বাচনী প্রচারণায় কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। কারণ শান্তিপুরের বিধানসভার উপনির্বাচন অতি সন্নিকটে। শুভেন্দু বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ঘটনার পর আরো তিন গুণ বেশি ভোটে এই আসনে জিতবে বিজেপি। ওপার বাংলায় বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজায় যা হয়েছে, তার উত্তর শান্তিপুরের মানুষ দেবে।’ (১৭ অক্টো. ২০২১, এইসময়)।

বাংলাদেশে হিন্দু এবং মুসলমান– উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতি রাজনৈতিক স্বার্থের খেলায় পর্যবসিত হয়েছে। ডা. জাফরুল্লাহ তার উপরোল্লেখিত সাক্ষাতকারে এটাও বলেছেন, ‘ভারতের রাজনীতির সঙ্গে আমার দেশের রাজনীতি জড়িত হয়ে গেছে।’ দাঙ্গা লাগায় কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহল আর সেটার ভুক্তভোগী হয় সাধারণ হিন্দু-মুসলিম উভয়ই। কুরআন অবমাননার প্রতিবাদ করতে গিয়ে রাস্তায় গুলি খায় প্রতিবাদী ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা আর এ সুযোগে হিন্দুদের বাড়িঘর ও উপাসনালয়গুলো ক্ষমতাবান কায়েমি গোষ্ঠী দ্বারা অতর্কিত হামলার শিকার হয়। আর কুমিল্লায় আক্রান্ত মন্দিরগুলো পরিদর্শন করে স্থানীয়দের সাথে কথা বলার পর জাতীয় হিন্দু মহাজোটের সভাপতি গোবিন্দ প্রামাণিক এ হামলাগুলোর পেছনে স্থানীয় সরকারদলীয় এমপি’র অবহেলাকে দায়ী করেছেন (১৮ অক্টো. ২০২১, প্রথম আলো)। এছাড়া হামলা ঠেকাতে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্বহীনতা ও অসহযোগিতার জোরালো অভিযোগও উঠেছে (১৫ অক্টো. ২০২১ ডয়চে ভেলে)।

কুরআন অবমাননার কারণে স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে গভীর আঘাত লেগেছে; কিন্তু পাশাপাশি এটাও আমাদের বুঝা দরকার যে, দেশব্যাপী দাঙ্গাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। কারণ, পূজামণ্ডপে সকলের সামনে এভাবে মূর্তির পায়ের ওপর কুরআন রাখলে এর পরিণতি কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। যে বা যারা কুরআন অবমাননার কাজটা করেছে, তারা জেনেবুঝে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই তা করেছে। কোনো সাধারণ ধর্মপ্রাণ হিন্দু বা মুসলিমের এ ধরনের কাজ করার কথা নয়। এটি কোনো একটি সংঘবদ্ধ অপশক্তির পরিকল্পিত কাজ, যারা এটার রাজনৈতিক ফায়দা তুলবে, সন্দেহ নেই।

সুতরাং, এ ঘটনাকে নিছক সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা দিয়ে বুঝতে চাওয়া ঠিক হবে না। বরং এর নেপথ্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলতে হবে। কারণ নাসিরনগরে হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দির ভাঙচুরের মামলায় চার্জশিটভুক্ত তিন আসামিকে সম্প্রতি ইউপি চেয়ারম্যান পদে আ’লীগের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে (১৩ অক্টো. ২০২১, ডেইলি স্টার)। তাই, কখনো মুসলমানদের আবার কখনো হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে নৈরাজ্য তৈরির চেষ্টা নিছক সাম্প্রদায়িকতাপ্রসূত নয়, বরং কায়েমি স্বার্থ ও রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলক।

ঢাকা ট্রিবিউনের ১৪ অক্টোবরের এক রিপোর্টে জানা যায়, বান্দরবানের লামায় কুরআন অবমাননার প্রতিবাদ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন লামা উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক, পৌর মেয়র জহিরুল ইসলাম, উপজেলা ছাত্রলীগের সম্পাদক মো. শাহীন ও ওলামা লীগের নেতারা। সেই প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে লামা উপজেলার কেন্দ্রীয় হরি মন্দিরে দফায় দফায় হামলা চালানো হয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলে প্রতিবাদকারীদের সাথে সংঘর্ষ ঘটে। এতে পুলিশ সদস্যসহ অর্ধশত আহত হয়। সেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তত ৪০টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও ৮টি বসতঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় বলে জানা গেছে।

এখন বুঝতে কষ্ট হয় না, দাঙ্গাবাজ আসলে কারা। তবে ধর্মপ্রাণ ও নিরীহ প্রতিবাদকারী মুসলিমরা এসব সংঘবদ্ধ ভাঙচুর ও লুটপাটের সাথে জড়িত নয়।

সংবাদমাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দিরে মন্দিরে যেসব হামলা ও লুটপাটের খবর ইতোমধ্যে এসেছে, সেসব হামলায় অংশগ্রহণকারী শত শত তরুণ বয়সী মুসলমান যুবককে কারা এত দ্রুত সংগঠিত করেছে তা তদন্তের দাবি রাখে। এ বছরের মার্চে সুনামগঞ্জের শাল্লায় হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাটে কয়েক শ' লোক সংঘবদ্ধভাবে অংশ নিয়েছিল। প্রথমে ‘হেফাজতের সমর্থকদের’ দায়ী করে অপপ্রচার চালানো হলেও পরে পিবিআই-এর তদন্তের মাধ্যমে মূল হোতা গ্রেফতার হয়, যে কিনা সেখানকার ইউপি সদস্য এবং স্থানীয় ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি! (২০ মার্চ ২০২১, ঢাকা ট্রিবিউন)।

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আসলে এদেশের আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থীদের বেশিরভাগই শুধু ধর্মীয় অনুভূতিটার ব্যাপারেই সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে রাখেন। এর নেপথ্যে ইসলামবিদ্বেষী সেকুলার, ফ্যাসিস্ট ও হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর যে নোংরা রাজনৈতিক স্বার্থ বা এজেন্ডা থাকতে পারে, সেটা মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে তারা কোনো কৌশল নেন বলে প্রতীয়মান হয় না। তাছাড়া সংখ্যালঘু ইস্যুটা দেশে ও বিদেশে খুবই স্পর্শকাতর একটি বিষয়। তার ওপর এ দেশে আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থীদের চাপে রাখতে রাজনৈতিকভাবে সংখ্যালঘুদের ‘দাবার ঘুঁটি’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অথচ সংখ্যালঘু ইস্যুতে তাদেরকে কার্যকর কোনো কৌশলগত নীতি বা অবস্থান নিতে দেখা যায় না।

অন্যদিকে, হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় এমনভাবে অভিযোগ করতে থাকেন, যেন এ দেশের মুসলমানরা তাদের পর করে রেখেছে এবং নির্যাতন করছে। অথচ ব্যাপারটা এমন না। একটি ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের অনিবার্য ফলস্বরূপ সংখ্যালঘুরাও যে নির্যাতনের ঝুঁকিতে থাকে, সেই বিবেচনা তাদের মধ্যে লক্ষণীয় নয়। হিন্দু নেতৃবৃন্দের উচিত মুসলমানদের সহমর্মী ভাবা এবং ইসলামপন্থীদের সাথে লিয়াজোঁ রক্ষা করা। কিন্তু না, তারা যথারীতি একটি বিশেষ রাজনৈতিক মহলের ‘দাবার ঘুঁটি’ হিসেবেই বারবার ব্যবহৃত হতে থাকেন।

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা সমগ্র ভারতবর্ষে প্রধানত হিন্দু-মুসলিম বিভক্তি ও বিরোধ জারি রেখে প্রায় দু’শ' বছর তাদের উপনিবেশিক শোষণ ও শাসন ধরে রাখতে পেরেছিল। সেই একই ‘ভাগ করো শাসন করো’ নীতি অনুসারে পুরো বাংলাদেশকে আরো আগেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের মেরুকরণের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। এখন হিন্দু ও মুসলমানকে একে অপরের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়ার চূড়ান্ত আয়োজন চলছে।

জার্মানির বিখ্যাত কবি ও উপন্যাসিক জোহান ওফগ্যাংগ ভনের কালজয়ী উচ্চারণ : ”Divide and rule, the politician cries; unite and lead, is watchword of the wise.” অর্থাৎ, রাজনীতিবিদরা চায় জনগণকে বিভক্ত করতে এবং শাসন করতে; কিন্তু বুদ্ধিমানরা চেষ্টা করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং নেতৃত্ব দিতে।

সুতরাং, জাতি হিসেবে আমাদের এ মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সবচেয়ে জরুরি। আমরা বিপজ্জনক ক্রান্তিকাল পার করছি। আমাদের জাতীয় ঐক্যের মূলে ক্রমাগত কুঠারাঘাত করা হচ্ছে। আমাদের তৃণমূল সমাজে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহাবস্থান যথেষ্ট গৌরবের। আমাদের ধর্মীয় অনুভূতির সুযোগ নিয়ে এই গৌরব ধুলায় মিশিয়ে দিতে চায় স্বৈর-ফ্যাসিবাদ, হিন্দুত্ববাদ ও আধিপত্যবাদের মিলিত অপশক্তি। সুতরাং, আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য অক্ষুণ্ন রাখতে দেশের দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদ, নেতৃস্থানীয় আলেম-ওলামা ও সচেতন তরুণ সমাজের উচিত চলমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি শান্তকরণে যতদ্রুতসম্ভব ঐক্যবদ্ধভাবে তৎপর হওয়া।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
Email: tareqislampt@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us