অনুভবে অনুভূতি

রহমান মৃধা | Nov 21, 2021 03:41 pm
অনুভবে অনুভূতি

অনুভবে অনুভূতি - ছবি সংগৃহীত

 

আমরা পৃথিবীর, মহাশূন্যের তথা সৌরজগতের খোঁজ নিতে ব্যস্ত, আমরা ব্যস্ত পাড়া-প্রতিবেশি থেকে শুরু করে পাশের বাড়ির ভাবির খবর নিতে, অথচ নিজের ভিতরে এবং বাইরে কী হচ্ছে বা না হচ্ছে এবং কেন হচ্ছে সেটা জানা বা বোঝার প্রয়োজনীয়তা আমরা অনুভব করি না। আর সেটা জানার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেও আমাদের সময় নেই, আমাদের ধৈর্য নেই তা নিয়ে ভাবার। তবে আমরা সকলেই যে কাজটা করি সেটা হলো শুধুমাত্র বিপদ বা মহাবিপদে মরণাপন্ন হয়ে একজনের সান্নিধ্য কামনা করি, সাহায্য চাই তাঁর কাছে যিনি পরম করুণাময় এবং অত্যন্ত দয়ালু আল্লাহ পাক রাব্বুল আলআমিন।

আমার দেহের মধ্যে যে 'রূহ বা আত্মা' রয়েছে এর সম্পর্কে আমি আমার অনুভূতির কথা বর্ণনা করবো। কারণ এটাই আমার জীবন, যে জীবন নিজস্ব গতিতে চলছে এবং হঠাৎ কোনো একসময় থেমে যাবে। এটা জানার পরও আমি আমার পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন নিয়ে অনেক অনেক লম্বা একটি জীবন কাটাতে চাই। আমরা স্বেচ্ছায় কেউ সব কিছু ছেড়ে চলে যেতে রাজি নই। তারপরও যেতে হচ্ছে, যেতে হবে। যখন কেউ এই জগৎ ছেড়ে চলে যায়, সবার ধারণা এটাই তার জীবনের সমাপ্তি, সবকিছু শেষ কারণ তার মৃত্যু ঘটেছে, সে চলে গেছে। চলে কোথায় গেছে তা জানি ধর্মীয় গ্রন্থ যেমন কুরআনে জীবনের নতুন সংজ্ঞা দেওয়া রয়েছে। মৃত্যুর কথা সেখানে উল্লেখ আছে, কুল্লু নাফসিন যা-ইকাতুল মাউত। অর্থাৎ প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে [সূরা আম্বিয়া, ২১:৩৫] এবং সেখানে মৃত্যুকেই সবকিছুর শেষ বলা হয়নি, কারণ আরো উল্লেখ আছে তোমাদেরকে স্থানান্তর করা হবে এক ভিন্ন নতুন জগতে।

তাহলে কুরআনের বক্তব্যে বোঝা যায়, মৃত্যুই আমাদের চূড়ান্ত পরিণতি নয়, আমরা মৃত্যুবরণ করব এবং পরবর্তী জীবনের দিকে ধাবিত হবো; থেমে থাকব না। এক জীবন থেকে অন্য জীবনে স্থানান্তরিত হবো, তবে তা যে মৃত্যু দিয়েই সর্বপ্রথম শুরু, বিষয়টা এমন নয়। রূহ হিসেবে আমরা দীর্ঘসময় অবস্থান করেছি, আল্লাহই জানেন কত সময়! রূহদের সেই মহাসমাবেশে কেউ কারো আত্মীয় ছিল না। এমনকি নারী/পুরুষ বা কোনো কিছুই ছিল না, ছিল শুধুই রূহ বা আত্মা। আদম [আ.] ও হাওয়াকে সৃষ্টির পূর্বে কোনো একসময় আল্লাহতায়ালা সকল রূহকে একত্রে একটি প্রশ্ন করেছিলেন, যা কুরআনে বর্ণিত রয়েছে : আর যখন তোমার পালনকর্তা বনি আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করলেন তাদের সন্তানদেরকে এবং নিজের উপর তাদেরকে প্রতিজ্ঞা করালেন, আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই ? তারা বললো, অবশ্যই, আমরা অঙ্গীকার করছি। আবার না কেয়ামতের দিন বলতে শুরু কর যে, এ বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। [সূরা আ’রাফ, ৭:১৭২]

ওই জগতে আমরা শুধুমাত্র আল্লাহকেই চিনতাম, আর কিছু না। আমাদের আশেপাশে আরো আত্মাকে দেখতে পেতাম, কিন্তু ফেরেস্তাদের মতো শুধু আল্লাহর যিকর করাই তখন একমাত্র আমাদের কাজ ছিল। তিনি তখনই আমাদের কাছ থেকে রব হিসেবে স্বীকারোক্তি রেখে দিয়েছেন যেন কিয়ামতের দিন আমরা বলতে না পারি যে, আমরা আল্লাহর পরিচয় জানতাম না, পূর্বপুরুষরা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে। আল্লাহ অতঃপর আদম [আ.] ও হাওয়াকে পৃথিবীতে পাঠালেন। যখন তাদের প্রথম জোড়া সন্তান হয় (তাদের দুটি করে সন্তান জন্ম নিতো) তখন সেই অসংখ্য রূহের মধ্য থেকে দুটি রূহকে নিয়ে হাওয়ার ভ্রূণে স্থাপিত করা এভাবে রূহের জগতের পরিবর্তন শুরু। রুহের দ্বিতীয় জীবন মায়ের গর্ভ এবং এসময় আল্লাহ মা এবং সন্তানের একটি মধুর সম্পর্ক তৈরি করে দেন। পৃথিবীতে জন্মের আগে আরো দুটি জীবন আমাদের রূহ পার করে এসেছে। মৃত্যুর পরও রুহকে একাধিক জীবনে ভ্রমণ করতে হবে। আমাদের রূহ মোট ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন জীবন-যাপন করবে, এর জন্যে মোট পাঁচবার স্থানান্তর ঘটবে। দুনিয়ায় থাকার সময়টি রূহের জীবনগুলোর মোট দৈর্ঘ্যের তুলনায় খুবই সামান্য অংশ। এই সময়টুকু অনেকের ক্ষেত্রে এক মুহূর্ত আবার অনেকের ক্ষেত্রে অনেক বছর। সত্যিকারার্থে আমরা সুবিশাল এক অনন্ত জীবনের বিভিন্ন ধাপ পার হচ্ছি মাত্র। আল্লাহ আমাদের রূহ সৃষ্টি করেছেন। রূহ সৃষ্টির পর মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করে রূহ ঢুকিয়ে দিয়েছেন আমাদের দেহে। একমাত্র দেহের মৃত্যু দুনিয়ায় ছাড়া বাকি জীবনে পূর্বে/ভবিষ্যতে রূহের কোনো মৃত্যু হয়নি।

তাহলে প্রথম জীবনে আমরা সবাই রূহ ছিলাম। আগত-অনাগত সকল রূহ তিনি সংরক্ষিত রেখেছেন। আল্লাহ প্রথম আদম আ.-কে সৃষ্টি করেছেন একজন ব্যক্তি হিসেবে এবং তার মেরুদণ্ডে স্থাপন করে দিয়েছেন আগত-অনাগত সকলের বীজ। সকল মানব অর্থাৎ পৃথিবী ধ্বংসের পূর্ব পর্যন্ত যারা আসবেন, আদম আ.-এর মেরুদণ্ডে স্থাপিত বীজগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্মতে প্রবাহিত হয়ে মানবজাতির বংশধারা বজায় রেখে চলবে।
দুনিয়ার জীবনে আল্লাহ আমাদেরকে দিয়েছেন বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু, স্ত্রী-পুত্র, সামাজিক অবস্থান, বুদ্ধিমত্তা, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, চিন্তা করার জন্যে মন, স্বাধীনতা, চলার ক্ষমতা, সৌন্দর্য, দক্ষতা আরো কত কী! আমরা যতদিন বাঁচি তত বেশি জিনিসের স্বত্বাধিকারী হই; দুনিয়ার মায়া ততই বেড়ে যায়। দুনিয়া ছেড়ে যেতে ইচ্ছেই হয় না।

এই দুনিয়ার মোহে যেন আমরা আমাদের সত্যিকারের গন্তব্য ভুলে না যাই তাই আল্লাহ আমাদেরকে ৫ ওয়াক্ত সালাত দিনের বিভিন্ন সময়ে দিয়েছেন, যেন রূহ নির্দিষ্ট বিরতির পর পর আল্লাহর সাথে সংযুক্ত থাকতে পারে। প্রথম জগৎ ছিল আলামুল আরওয়াহ বা রূহের জগৎ, দ্বিতীয় জগৎ মাতৃগর্ভ। এখন আমরা দুনিয়াতে বসবাস করছি তৃতীয় জীবনে। চতুর্থ জীবন হবে বারযাখ বা কবর। মৃত্যুর পর থেকে শিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার আগ পর্যন্ত এই জীবনের ব্যপ্তি। কাউকে কবর দেয়া হোক বা নাই হোক, আত্মাকে বারযাখের জীবন-যাপন করতে হবে। পঞ্চম জীবন হবে বিচার দিবস। ষষ্ঠ ও চূড়ান্ত জীবন হচ্ছে জান্নাত বা জাহান্নাম। কী সর্বনাশ! যে জিনিসগুলো ছাড়া এক মুহূর্ত বাঁচার উপায় নেই তা নিয়ে কখনো ভাবি না। না চাইতেই, না ভাবতেই পেয়ে যাচ্ছি। অথচ যা না হলেও চলে তার জন্য জীবন, যৌবন, মান, সম্মান সবকিছু দিয়েও মনের শান্তি যোগাড় করতে ব্যর্থ হচ্ছি কারণে অকারণে। এ ভাবে আমার অনুভবে যে অনুভূতি ঘুমের ঘোর স্বপ্নে এসেছিল, হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। হঠাৎ মনের জার্নি আমাকে নিয়ে গেল সাত আসমানে। আমি বিছানায় ঘুমিয়ে আছি অথচ কিভাবে সাত আসমানে গেলাম এবং দিব্যি ফিরে এলাম? কে সেই মহাশক্তিধর যিনি সবসকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন এবং তার সাথে আমার আত্মার কী সম্পর্ক রয়েছে!

তাহলে দুনিয়ার জীবনে সর্বপ্রকার সাফল্যই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিৎ নয়। আমাদের যাবতীয় অর্জনের কিছুই সাথে যাবে না। তবে দুনিয়া উপভোগ করা মোটেই দোষের কিছু নয়, দুনিয়ার মোহ যেন আমাদেরকে আচ্ছদিত করে না ফেলে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যে মুহূর্তে সময় শেষ হয়ে যাবে, দেহ থেকে রূহ পৃথক হয়ে যাবে, দুনিয়ার বাহাদুরির সব শেষ হয়ে যাবে!

লেখক : সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us