ফিনল্যান্ড ভ্রমণ : সেদিন যা ঘটেছিল সাওনাতে

রহমান মৃধা | Dec 22, 2021 01:57 pm
ফিনল্যান্ড ভ্রমণ : সেদিন যা ঘটেছিল সাওনাতে

ফিনল্যান্ড ভ্রমণ : সেদিন যা ঘটেছিল সাওনাতে - ছবি : সংগ্রহ

 

পৃথিবীর যা কিছু নতুন সৃষ্টি এবং যা মানব কল্যাণকর তার সম্পর্কে আমরা কমবেশি জানি। আজ জানাব জানা অজানার মাঝে কিছু নতুন তথ্য যা হতে পারে জীবনে প্রথম শোনা কাহিনী। ফিনল্যান্ড স্ক্যান্ডিনেভিয়ার পাঁচটি দেশের (সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড) মধ্যে একটি দেশ, এবং এর চারপাশজুড়ে রয়েছে নরওয়ে, সুইডেন, এস্টোনিয়া এবং গালফ অফ ফিনল্যান্ড। ফিনল্যান্ডের লোক সংখ্যা ৫.৫ মিলিয়ন হবে। হাজারও লেকের সমন্বয়ে এই সুন্দর দেশ যার আয়তন বাংলাদেশের চেয়ে তিন গুণ বড়। ফিনল্যান্ডের অফিসিয়াল ভাষা দুটি, ফিনিশ ও সুইডিস। ফিনিস ভাষা সম্পূর্ণ ভিন্ন সুইডিস, ডেনিস বা নরওয়েজিয়ান ভাষার তুলনায়। এদের আর্কিটেক্ট ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর দক্ষতা সত্যি প্রশংসনীয় বিশেষ করে কনস্ট্রাকশন ডিজাইনের ক্ষেত্রে। ফিনল্যান্ড বরফের দেশ হওয়া সত্ত্বেও এদের সামারের সৌন্দর্য সুইডেনের মতো মনোরম এবং যা তিন থেকে চার মাস সময় মে, জুন, জুলাই, অগাস্ট পর্যন্ত। এরাও শীতের সময় নানা ধরণের এ্যাক্টিভিটিস করে থাকে সুইডেনে, নরওয়ে ও ডেনমার্কের মতো। ফিনল্যান্ডের এক বিশ্বয়কর আবিষ্কার তা হলো ‘ফিনিস সাওনা’ এবং যা সুইডেনে ‘বাসতু’ নামে পরিচিত।

ফিনল্যান্ডের বাথরুমের সাথে বা যৌথ গোসল খানাতে বা বাইরে এই সাওনা-ঘর তৈরি করা হয়ে থাকে। এ সাওনা-ঘর তৈরি করা হয় পুরো কাঠ দিয়ে, কোন জানালা ছাড়া। এর ভেতরে ইলেক্ট্রিক হিটার বা কাঠের জ্বালানি চুলা ব্যবহার করে এই সাওনা-ঘর খুব গরম করা হয়। এই সাওনা-ঘর ড্রাই আকারে কোনো পানি ছাড়া বা বাষ্প আকারে পানির সমন্বয়ে হয়ে থাকে, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গ্রামের বাড়িতে জ্বালানি কাঠ বা ইলেক্ট্রিক হিটার ব্যবহার করে সাওনা-ঘর গরম করা হয়। সাওনা-ঘর ফিনিসদের জন্য কাইন্ড অফ ফিনিস ঐতিহ্য এবং বিনোদনমূলক রিলাক্সেশন বলা যেতে পারে। সাওনা-ঘরের ভেতরের তাপমাত্রা ৫৫-৭৫ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড পর্যন্ত হতে পারে এবং বাতাসের আর্দ্রতা ৩০%। মাঝে মধ্যে আগুনে বা হিটারে পানির ছিটা দিলে গরমের সাথে বাতাসের আদ্রতা বেশি হয় এবং তখন বেশ গরম মনে হয়। সাওনার-ঘরে পুরুষ ও মহিলারা যৌথ বা আলাদাভাবে যেতে পারে, এ নির্ভর করে পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর। সুইডেনেও সাওনার ব্যবহার রয়েছে তবে সুইডিস ভাষাতে একে আমরা বাসতু বলে থাকি। আজ বলব আমার জীবনের ফিনিস সাওনার ওপর প্রথম অভিজ্ঞতার কথা। এসেছি হেলসিঙ্কিতে বেড়াতে (আমার ফিনিস বান্ধবী ছালা বার্ক যার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল স্পেনের গ্রানক্যানেরি আইল্যান্ডে) তার বাড়িতে। দুদিন হেলসিঙ্কি ঘোরার পর হেলসিঙ্কি থেকে গাড়িতে করে তার মা-বাবা এবং ছোট বোন মিলে রওনা দিলাম যয়েনসুর (Joensuu) উদ্দেশে। যয়েনসু ফিনল্যান্ডের আরেকটি শহর। হেলসিঙ্কি থেকে যয়েনসুর গাড়ির দূরত্ব ৬-৭ ঘন্টার জার্নি। যয়েনসু রাশান বর্ডারের খুবই কাছে।

যয়েনসুতে ছালার নানিবাড়ি এবং তার বড় খালাও সেখানে থাকেন। সন্ধ্যায় পৌঁছে গেলাম যয়েনসুতে। বিশাল বাড়ি, লেকের ধারে, সব দেখে মনে হোল প্যারাডাইসে এসেছি। চারিদিকে বরফ আর বরফ। সবাই জানে আমরা আসব। আজ আয়োজন করেছে বাইরে সাওনার একটিভিটিসের ওপর প্রতিযোগিতা এবং শুধু ছেলেদের জন্য। কাঠের তৈরি এই মডার্ন সাওনা-ঘরে জ্বলছে কাঠের আগুন এবং ওপরে বিরাট এক পানির ট্যাংক যেখানে পানি টগবগ করে ফুটছে। ছোট্ট এই সাওনা-ঘরের ভেতরে তৈরি হয়েছে প্রচুর বাষ্প যা দেখতে মেঘের মতো এক পরিবেশ, কাউকে দেখার কোনো উপায় নেই, কারণ বাইরের তাপমাত্রা -৩০ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড, দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই তাপমাত্রা +৭৫ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড। কী এক অদ্ভুত বিপরীত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি! ৮টি ছেলে-মেয়ে তার ভেতরে অলরেডি ঢুকে আছে ওই সাওনা-ঘরের ভিতরে। জীবনে প্রথম ফিনল্যান্ডে আদম সেজে ঢুকে গেলাম আমরাও ভেতরে। সবাইকে জাস্ট হাই বলতেই বেশ একটু নতুন পরিবেশ সৃষ্টি হলো। তাদের ধারণা ছিল, ছালা বার্কের বয়ফ্রেন্ড নিশ্চয় সুইডিস হবে এবং সাওনাতে অভ্যস্ত। আমাকে দেখে কিছুটা হতাশ হয়েছে তারা, কারণ প্রতিযোগিতা ভালো হবে না। তাদের ধারণা, বাংলাদেশের ছেলে, পাঁচ মিনিটও এ গরমে টিকবে না! আমি ভিতরে ঢুকে বেশ চুপচাপ। হাতে সবার কোল্ড ড্রিংক, এবার দেখি পানি বেশ মারছে আগুনের ওপর তাতে করে তাপমাত্রা আরো বেশি ধারণ করছে। ছোটো ছোটো পাতা ভরা গাছের ডাল (দেখতে কিছুটা বাংলাদেশের দেবদার গাছের পাতার মতো হবে) সাওনা-ঘরের মধ্যে, তা দিয়ে একে অপরকে বেশ করে বাড়ি মারছে মাঝে মধ্যে, সাথে আমাকেও। মনে হলো শরীরের তাপমাত্রার ভারসাম্যতা ঠিক রাখতে এমনটি ব্যবস্হা। কিছুক্ষণ পর এবার আমিও পানি মারা শুরু করলাম।

এক র্যায় সবাই না টিকতে পেরে বের হয়ে চলে গেল সাওনা থেকে রিল্যাক্স রুমে। ওরা ইচ্ছে করে বেশি পানি মেরেছে আমাকে জব্দ করার জন্য এবং মনে মনে ভাবছে আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না এই সাওনা-ঘরে। পরে জানতে পারি বিষয়টি। ওদের ধারণা নেই যে বাংলাদেশে চৈত্র মাসে গরমের সময় আমরা কিভাবে ম্যানেজ করি! সবাই পরাজিত প্রথম পর্বে। এবার প্লান করেছে সাওনা-ঘর থেকে বাইরে পুরো আদম সেজে দৌড়ে তুষারের ভেতর হেঁটে গিয়ে লেকের মধ্যে বেশ ছোট্ট করে একটু গর্ত করা রয়েছে সেখানে গিয়ে ডুব মেরে আবার ফিরতে হবে সাওনা-ঘরে। ১৫ মিনিট সময়ের মধ্যে যে বেশিবার পারবে সেই হবে উইনার।

পায়ে উলের মোটা মোজা পরা থাকতে হবে নইলে পা গরম এবং ঠান্ডার সমন্বয়ে জমে ফেটে যেতে পারে। বিষয়টি বেশ ভয় এবং চিন্তার মধ্যে পড়ে গেল। ভাবলাম ওরা যখন পারছে আমি কেন পারব না? লেগে গেলাম তাদের সাথে! বিশ্বাস আমারই হয়নি জানতে পেরে যে আমি তাদের সবার থেকে একবার বেশি ডুব দিয়ে সবাইকে হারাতে পেরেছিলাম সেদিন। সেদিনের সাওনার একটিভিটিসে জেতার কারণে ফিনল্যাল্ডে জিরো থেকে হিরো হয়ে ওই দিনেই সবার ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম। জীবনের এ এক নতুন অভিজ্ঞতা, তা সম্ভব হয়েছিল ফিনিশ বান্ধবীর সাথে বন্ধুত্বের কারণে। তবে এই ফাঁকে বলে নেই, আমি সুইডেনে এসে এর আগেই সুইডিশ বাসতু ব্যবহার করেছিলাম। এ কারণে ফিনল্যান্ডের সেদিনের প্রতিযোগিতায় জেতাটি কিছুটা সুবিধার হয়েছিল। আমি নিশ্চিত বাংলাদেশের যারা ফিনল্যান্ডে আছে তাদের এ এক্সপেরিয়েন্স না থাকলেও তারা জানে এর সম্বন্ধে যা শুধু অনুভব করার মতো। আজ থেকে ৩৬ বছর আগের কথা! ফিনল্যান্ডের সাওনা, সাথে তুষারের ভিতর হেঁটে লেকের মধ্যে ডুব দিয়ে আবার সাওনা-ঘরে ফিরে আসা! কিভাবে ভুলি এমনটি অভিজ্ঞতা? জানি আমাদের সমাজে এটা বেমানান তবে পৃথিবীতে এমন অনেক বিষয় রয়েছে যা কারো জন্য মানান কারো জন্য বেমানান, আর এই মানান এবং বেমানানের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে মানুষ জাতি। অন্তর যদি হয় সুন্দর তাহলে সব কিছুই এডজাস্ট করা সম্ভব।

লেখক : সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন, rahman.mridha@gmail.com

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us