জীবনানন্দের গল্পে বৈচিত্র্য-বিন্যাসের নান্দনিকতা

আশরাফ উদ্দীন আহমদ | Dec 25, 2021 02:36 pm
জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ - ছবি : সংগ্রহ

 

 প্রশ্ন করা বা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ানো মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি, এ থেকে কারোরই নিষ্কৃতি নেই। এখন কথা হচ্ছে কেমন প্রশ্ন করবে অথবা কী ধরণের প্রশ্নের উত্তর কী রকম হবে। বাংলা ছোটগল্প নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠছে সম্প্রতি, গল্পে বাস্তববোধের রূপায়ন কি সম্ভব, নাকি গল্প ছাড়া ছোটগল্প এগিয়ে যাবে এবং তা নতুন রীতির গল্প বলে আখ্যা পাবে। বাস্তব কথা মেনে চলা বড়ই কঠিন, হয়তো তা সম্ভব নাও হতে পারে, রূঢ় সত্য হলো, সময়ই সঠিক মূল্যায়ন করবে।

তাহলে, ছোটগল্পের সংজ্ঞা কী? কাকে ছোটগল্প বলব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘ছোট কথা ছোট ব্যথা, ছোট-ছোট...অবশেষে শেষ হয়েও হইলো না শেষ’, কেউ বা বলেন, রবীন্দ্রনাথ তো ছোটগল্পকে মাটি আর মানুষের কাছাকাছি নিয়ে এসে দফারফা করেছেন, আসলে ছোটগল্প মানে জগদীশ গুপ্ত, অমিয়ভূষণ মজুমদার, কমলকুমার মজুমদার, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ প্রমুখ কথাশিল্পীদের গল্পকেই বোঝায়। তাহলে তো পথ রুদ্ধ, কেন না এই চিন্তায় বসে থাকো, নতুন গল্প আর লিখো না! এই বয়ান খয়রাত করেন বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক অধ্যাপক-বুদ্ধিজীবী বা সমালোচকগণ। আমার এক বন্ধুবর প্রায়ই বলে, ‘রমাপদ চৌধুরী-বিমল কর বা সমরেশ বসুর গল্পই আসলে গল্প, আর সব ফালতু জঙ্গল’। লেখকেরা অধ্যাপক নামধারী বুদ্ধিজীবী-সমালোচকদের পেছনে হন্য হয়ে ছোটেন। সমালোচকরা সাহিত্যের ইতিহাসে জায়গা দিলেই তো লেখক, নয়তো জীবনটাই বরবাদ! অর্থাৎ পণ্ডিতদের শেখানো-দেখানো ছকে শেষ অবধি গল্প নির্মিত হচ্ছে।

সময়-স্থান-পাত্র ভেদে যুগের সাথে চিন্তা এবং প্রকৃতি-পরিবেশের সাথেই তো আমাদের পথ চলা, এই পথচলা নিরন্তর। এখানে কত নতুন ঘটনা, কত নতুন চিন্তা প্রতিনিয়ত উপস্থিত হচ্ছে, মানুষ কি সামনে যাব না, পুরনোর ভেতর দিয়ে নতুনকে চিনব না, সমস্ত নতুনই তো পুরনোকে অবলম্বন করে, কথাটা ভুলে গেলেও চলবে না। যুগ-যুগান্তর ধরে সমস্ত পুরনোর ভেতরেই তো নতুনের জন্ম দেখি, সেই নতুনই আগামীর চলার গন্তব্য।

সেদিক থেকে বিচার করলে বলতেই হয়, ছোটগল্পের বিষয়বস্তু খুব একটা পালটায় না, পালটায় শুধু লেখকের দৃষ্টিকোণ বা ভঙ্গি-কাঠামো বা আঙ্গিক এবং স্বরভঙ্গি। ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করা যাক। একই বিষয় নিয়ে এক শতাব্দী ব্যবধানেও গল্প লেখা যেতে পারে, মানুষ সামাজিক জীব, সমাজের মধ্যে জীবনযাপন, সে সর্বপ্রথম জীবন-জগতের শিক্ষা নেয়, একজন লেখকও পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের ভেতরের তাবৎ অসামঞ্জস্য তাবৎ অনিয়ম এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে যাবতীয় ক্ষত-দুঃখ-কষ্ট-ক্ষোভ আনন্দ-ভালোবাসা নিয়ে আপন ভূবন বা বলয়, সে বলয় নিয়ে জীবন, সেখান থেকে শুরু-শেষ, অনেকে জীবনকে ভিন্নভাবে দেখে, কেউ বা সে বলয় থেকে খুব একটা বেরিয়ে আসতেও পারে না, মনে রাখা আবশ্যক যে, ছোটগল্প যুগযন্ত্রণার ফসল, বহু প্রচলিত বক্তব্য মেনে বলতেই হয়, এ শিল্পটি শুধু যুগযন্ত্রণারই নয়, সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রয়োজনও ছোটগল্পের জন্ম ত্বরান্বিত করেছে। শিল্পবিপ্লবের ফলে ধনতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশ, সামন্ততান্ত্রিক মন্থর জীবনযাত্রার অবসান উনিশ শতকের শেষপ্রান্তে ছোটগল্প রচনার পরিবেশ সৃষ্টি, ইউরোপ-আমেরিকান বুদ্ধিজীবীরা পারিবারিক গ্লানি বা ব্যক্তিগত সমস্যার দিকে তর্জনী উঁচু করলেন। পাশাপাশি ফ্রান্স ও রাশিয়ার সেই সমস্ত কথাসাহিত্যিকগণ সামাজিক সমস্যা ও অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে মুক্তি লাভের জন্য তীব্রভাবে ব্যাকুল হয়েছিলেন, এডগার অ্যালান পো, ফ্লবেয়ার, মোপাসাঁ, তুর্গেনিভ, গোর্কী, গোগোল, পুশকিন, চেখভের গল্পে কঠিন বাস্তবতা ও সামাজিক চিন্তার প্রকাশ ঘটে। দুর্গত মানুষের বেদনা-ক্লেশ, অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনের তীব্রকঠিন বিভীষিকাময় প্রতিচ্ছবি, কখনো বা জীবনের প্রতি অন্যরকম নিবিড় মমতা গল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে আসে, তাদের লেখনিশক্তির মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যে ছোটগল্প মর্যাদার আসন লাভ। যে যৌনতার মধ্যে টি এস এলিয়ট দেখেছেন দৈহিক বিকৃতি মানসিক অবমাননা ও আত্মিক অবক্ষয়, সেই যৌনতার মধ্যেই হুইটম্যান দেখেছেন মানসিক ও দৈহিক ঔৎকর্ষ ও আত্মিক মুক্তি। এর কারণ অবশ্যই সময় এবং দৃষ্টিভঙ্গি। সময়ের সাথে মানুষের চিন্তা ভাবনার, তার স্বর, মানসিকতা, ভাষাগত ব্যাপার পাল্টে যায়, হুইটম্যানের আমেরিকা তথা পাশ্চাত্য, টি এস এলিয়টের আমেরিকা তথা পাশ্চাত্যের সত্তর বছর আগের, অন্য দিকে এলিয়টের অভিজ্ঞতা হয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের, এলিয়ট ধরে রেখেছেন সেই সময়কার তছনছ হওয়া মানবিক মূল্যবোধ, পাশাপাশি হুইটম্যান গড়ে তুলেছেন সত্য ও সুন্দরকে। তাই হুইটম্যানের কাছে যৌনতা ও প্রেম মানসিক উৎকর্ষতা ও আত্মিক মুক্তি। আর এলিয়টের কাছে যৌনতা ও প্রেম মানে যান্ত্রিক জীবনের তাৎক্ষণিক উচ্চারণ। কবিতায় হুইটম্যান প্রেমকে অন্যতম শিল্পসৌন্দর্যের ধারক হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন, জীবনের প্রতি তার সমান কৌতূহল, দেহ ও আত্মার প্রতি যেমন আগ্রহ, জড়বাদ ও ভাববাদ উভয়বাদেই তার সমান আস্থা। তার কবিতায় রয়েছে অস্তিত্বের প্রশ্ন, কখনো তা দেহে সীমিত, আবার কখনো দেহকে ছাড়িয়ে তা গগনবিহারী। জীবনকে বিভিন্নভাবে দেখতেই তার চরম কৌতূহল। বোদলেয়ার বলেছেন, ‘নিছক সৌন্দর্য সৃষ্টির আকুতি থেকেই সাহিত্যের উন্মেষ, সৌন্দর্য সৃষ্টি ছাড়া সাহিত্যের আর কোনো উদ্দেশ্যে নেই’। শিল্প সাহিত্যের মাধ্যমে নান্দনিক উপলব্ধির দ্বারা মানুষ আপন আত্মার সত্য উপনীত হলে যে সামঞ্জস্যের সুষমা প্রতিষ্ঠিত হবে তার ব্যক্তিগত ও সমষ্টি জীবনে, হয়তো তাতেই প্রকৃত মঙ্গল, টলস্টয়ও বিশ্বাস করতেন, ‘শিল্প সাহিত্যের সার্থকতা এখানেই’।

জীবনানন্দের গল্পের মূল উপজীব্য মানুষ, মানুষের জীবনের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, সামাজিক-রাজনৈতিক বিচিত্র অবস্থার পরিবর্তনের ফলে মানুষের ওপর প্রতিফলিত প্রতিক্রিয়া প্রভৃতি সমস্ত কিছুই খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে তুলে ধরেছেন গল্পে। ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের পাশাপাশি নদী-আকাশ গাছগাছালি-পানি গরু-ছাগল অন্ধকার নৌকা ঝাউবন-প্রেম-ভালোবাসা-যৌনক্ষুধা-অত্যাচার-লালসা কাঁটাঝোপ সকাল-দুপুর গ্রাম-শহর শহরতলী-বসতি ভোরের সোনালি রোদ্দু তারপর এসেছে বেকারত্ব-দাম্পত্যকলহ-হীনতা প্রভৃতি কোনো কিছুই তার বিশ্লেষণের বাইরে যায়নি, সমস্ত উপাদান নিজের মতো ছকে সাজিয়ে পরিবেশন করেছেন পাঠকের দরবারে। মৃত্তিকা সংলগ্ন জনমানুষের যে জীবনালেখ্য, যে বৈচিত্র্যময় পরিবেশের অনুসন্ধান, তাকে কী বলব, অবশ্যই জীবনের গল্প, জীবন এখানে বৈচিত্র্যময়-অনুভূতিপ্রবল আর তিক্ত অভিজ্ঞতাসম্পূর্ণ।

গ্রামীণ জীবনের বিচিত্র রূপের সাথে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল তারাশঙ্করের, কঠিন ও অসুন্দর কর্কশ সংসারের চিত্র তিনি এঁকেছেন অনেক, গল্পের চরিত্রগুলো বিচিত্র পেশাজীবী-বৃত্তিধারী, গল্প ভাষাও ভিন্ন ধরনের। জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যে এমনই একজন, গল্পে তিনি চরিত্রের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়েছেন, গ্রামীণ জীবন-সমাজচিত্র তার নখদর্পণে, বেশ জমিয়ে বলতে পারেন, ভিন্ন-ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে যেতেও জুড়ি নেই, কোথাও-কোথাও বড় বেশি তাড়াহুড়োও দৃষ্টিগোচর হয়। গল্প জমতে না জমতে দেখা গেলো বনফুলের মতো শেষও হয়ে গেলো, তখনই পাঠক কেমন একটু হোঁচট খায় বৈ কি! তারপরও একাধিক বিচিত্র জীবিকা এসেছে গল্পে, তার গল্পের ভাষা ভিন্ন ধরনের, গল্পের উদ্দিষ্ট অভিপ্রায়ের কেন্দ্রীয় ভাববস্তুর উপযোগী আবহবদ্ধ- বিশ্লেষণী ভাষা প্রথম থেকে ব্যবহার করেন। তার কয়েকটি গল্প নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যাবে গল্পের শক্তিমত্তা কতখানি।

‘গ্রাম ও শহরের গল্প’ শুধু অনুভূতির ওপর নির্ভর করেই গড়ে ওঠেনি, গল্পটি একটা ঘেরাটোপের মধ্যে আবদ্ধ, এখানে একটা শক্তমক্ত কাঠামো দাঁড় করানো হয়েছে, চরিত্র আছে তিনটি। ত্রিকোণ প্রেমের একটা সুখানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। প্রকাশ, যে একজন স্বচ্ছল চাকুরে, তার স্ত্রী শচী শুধুই গৃহকত্রী, গুছিয়ে সংসার করছে, সন্তান হয়নি বলে কষ্টও নেই তেমন। লক্ষেèৗ থেকে কলকাতায় এসেছে তারা। কলকাতার পরিবেশ তেমন ভালোও লাগে না প্রকাশের। এদের মাঝে জুটেছে পুরনো বন্ধু সোমেন, যে খবরের কাগজে কাজ করে। সোমেনকে একদিন রাস্তা থেকে তুলে আনে প্রকাশ। সেই থেকে অবাধ যাতায়াত শুরু হয় এ’ বাড়িতে সোমেনের। ক্রমে-ক্রমে আবার ভালোবাসা যেন দানা বেঁধে ওঠে, কেউই ভুল করছে না, তবুও ভুলের মধ্যে হারিয়ে যেতে থাকে শচী। একটা নেশা তাদের হাওয়ায় তুলে নিয়ে যায়, সময়ে-অসময়ে আসা-যাওয়ার ভেতর দিয়ে নতুন করে ভালোবাসা জাগ্রত হলে শচী ফিরে যেতে চায় অতীতে, তার কামনা-বাসনা ফুলে-ফেঁপে ওঠে। সোমেন বলে, মনে পড়ে একদিন বকমোহানার নদীর পাড়ে ভাঁট শ্যাওড়া জিউলি ময়নাকাটা আলোকলতার জঙ্গলে তোমাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম...শচীর মধ্যে গ্রাম্যজীবনের প্রতি যে আর্কষণ তা সোমেন আরো আগুন উষকে দেয়। এই নস্টালজিয়া শচীকে কোনোক্রমে আর স্বস্তি দেয় না, তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়; ভাবাবেগে বলে ওঠে, চলো না পাড়াগাঁয়ে, বকমোহানার নদীর ধারে! সোমেন বলল, সে পাড়াগাঁর জীবন তুমি কোনোদিন ফিরে পাবে না, সেই তেলাকুচো-ফণীমনসা বনধুঁধুল কোনো অন্ধকারে কোনো জ্যোৎস্নায় কত দূরে চলে গিয়েছে, আমরা তো আর সেখানে নেই, কি হবে সে সব দিয়ে? পেছনের স্মৃতিময় জীবনের গল্পগুলো একেএকে সামনে এলেও তার যে আর কোনো দিন পুনরাবৃত্তি হবে না, অর্থাৎ মানুষ ইচ্ছে করলেই আর পেছনে ফিরে যেতে পারে না, বর্তমানেই থাকতে হয়, অতীত সে তো মৃত একটা ধ্বংসস্তূপ, তাকে ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না, যেমন শচী ইচ্ছে করলেই প্রকাশকে ছাড়তে পারবে না এবং সোমেন ইচ্ছে করলেই শচীকে ফিরে পাবে না, সময় এবং স্মৃতি সর্বদা জ্বলন্ত শিখা হয়ে জ্বালায় বনভূমি-মনভূমি, হয়তো মানুষ দাবানল বলে কিন্তু বুকের ভেতর যে আগুন জ্বলে তাকে কী বলবে, অন্তর্জ্বালা, নাকি আত্মার কষ্ট! এ’গল্পে জীবনানন্দের আত্মাকে দেখতে পাওয়া যায়।

‘মেয়ে মানুষ’ জীবনানন্দের গুরুত্বপূর্ণ গল্প, মনস্তাত্ত্বিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে মানুষ কখনো নিজেকে হারিয়ে ফেলে, তখন সে নিজেই সৌন্দর্যের একটি রূপ নির্মাণ করে। এখানে তারই প্রকাশ ঘটেছে। জীবনানন্দ প্রত্যক্ষ করেছেন, একজন পুরুষের জীবনে হৃদয়বতী নারীর প্রেম কতটা আবশ্যক। প্রতিটি পুরুষই নারীর ভালোবাসা পেতে ইচ্ছুক, জীবনানন্দ সচেতন কথাশিল্পী বলেই হেমেন-চপলা, দ্বিজেন-লীলার ভেতরের দ্বন্দ্ব চাক্ষুষ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে সমাজের বা সংসারের এই টানাপড়েন মানুষের জীবনকে অতিষ্ট করে এবং তারপরও মানুষ নিজের প্রয়োজনে নিজেকে গড়ে তোলে।

‘মা হবার কোনো সাধ’ গল্পে জীবনের লেনদেনের হিসাব বেশ সাবলীলভাবে ধরা দিয়েছে। জীবন সত্যি বিচিত্র। গল্পের প্রধান চরিত্র প্রমথ। বছর দুই আগে বিয়ে করেছে, মেয়েটির নাম শেফালী, জীবনের কোনো মানেই সে বোঝে না। শেফালী অন্তঃসত্ত্বা, গ্রাম থেকে স্বামীকে সে চিঠি লেখে পাতার পর পাতা, কাকুতি ভরা প্রেমে সিক্ত চিঠি, কত গল্প তাতে রঙে রঙিন হয়ে থাকে। শেফালীর গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে প্রমথ বেশ কয়েক মাস গ্রামেই ছিল, অথচ শেফালী যখন ক্রমে অসুস্থ হয়ে পড়ে সেসময় প্রমথ কলকাতায় পালিয়ে যায়, চাকরি খোঁজে। শেফালী নিয়মিত চিঠি লেখে, কয়েকটি টাকা যেন পাঠায়, কারণ গর্ভের শিশুটিকে নিয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছে। প্রমথকে পালিয়ে থাকতে হয়। নিয়মিত চিঠি আসে এবং সে পড়ে। চিঠির ভাষা রঙের মতো বদলে যায়, ভালোবাসা যেন আরো প্রগাঢ় হয়ে ধরা পড়ে, প্রমথ তবুও নিশ্চুপ, তার যেন কিছুই করার নেই। দারিদ্র্য এভাবেই মানুষকে কর্তব্যজ্ঞান থেকে, জীবন থেকে দূরে ঠেলে দেয়। সর্বশেষে বারো টাকা পাঠাতে বলে শেফালী, সন্তান হওয়ার জন্য ওই টাকা অতি প্রয়োজন। কিন্তু কলকাতার মেসের খরচা থেকে বারো টাকা পাঠানো কঠিন। জীবনের প্রতি ঘৃণা ধরে যায় প্রমথের। তারপর এক পূর্ণিমার দিন টেলিগ্রাম এলো, শেফালীর মেয়ে হয়েছে, কিন্তু শেফালী চলে গেছে। এ হলো দারিদ্র্যের মাঝে আশাহীন জীবনের গল্প। মানুষ বুঝি এভাবেই হেরে যায়, হারতে-হারতে জীবন হয় ধোঁয়ার ধূসর পাণ্ডুলিপি।

সম্বোধনহীন চিঠির আকারে লেখা গল্প ‘সঙ্গ, নিঃসঙ্গ’, চিঠি এবং ডায়েরির মতো ভঙ্গি, কখনো মনে হবে কতগুলো চিঠি পরপর সাজানো, ‘মা হবার কোনো সাধ’ গল্পের মতই একই আঙ্গিকে নির্মিত, ঘটনাপ্রবাহে অনেক কবিত্ব আছে, আছে বিরহকাতর উপমা। তবে গল্পের বা চিঠির বিষয় ভিন্ন। পত্রলেখক একজন হতভাগ্য পুরুষ, যার জীবনে কোনো সখই পূরণ হয় না। দীর্ঘশ্বাসের একটা কু-লী হয়ে সঞ্চিত হয়, স্ত্রী অনুপমা পিতাগৃহে গেছে তিন বছর। স্বামীর কোনো খোঁজ-খবর নেয় না। জীবনানন্দের অন্যান্য গল্পের মতোই ‘সঙ্গ, নিঃসঙ্গ’ গল্পেও ফুটে উঠেছে হতাশা-বিচ্ছেদ মৃত্যু-কষ্ট দুঃখ-দৈন্য।

‘কুষ্ঠের স্ত্রী’ গল্পের প্রধান চরিত্র সুশোভন, যার মুখপোড়া দাগ দেখে লোকে কুষ্ঠের দাগ বলে এবং বিয়েও হতে চায় না, অনেক ভালো-সুন্দরী পাত্রী হাতছাড়া হয়, কন্যাপক্ষকে যতই বোঝানো যায় কিন্তু তারা গঙ্গাযাত্রীর কাছে মেয়ে বিসর্জন দেবে না। অবশেষে বাপ-মা নেই, এমন একটা এতিম মেয়ে অতসীকে পাওয়া গেলো, যে বুড়ো মামার ঘাড়ে আছে। যথারীতি বিয়ে হলেও অতসী প্রথমে চন্দনের ফোঁটা মনে করে কিছু না বুঝলেও পরে শিউরে ওঠে, ভয়ে দূরে সরে যায়। সে একসময় বলে যেহেতু তুমি আমার মামাকে ঠকিয়েছো, আমাকে ঠকিয়েছো, তোমার বিষয়-সম্পত্তি আমাকে সব লিখে দেবে, নয়তো মামার সাথে চিরকালের মতো চলে যাবো। পরবর্তী সময়ে সুশোভন দেখে, অতসীর দাঁতের দু’ পাটি ক্ষয় ধরেছে, মুখের ভেতরটা পায়খানার গহবরের মতো গভীর বিকৃত ছোট-বড় এবড়ো-থেবড়ো খাদ। স্নানের পর মনে হলো যতটা সুন্দরী ভেবেছিল প্রকৃতপক্ষে তা সম্পূর্ণ ভুল, হয়তো চোখের ভুল, মানুষ কি এভাবেই নেশায় পড়ে ভালোমন্দ বিচার না করে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। গল্পটি নবদাম্পত্যের কাহিনী যেখানে নবজীবনের স্বাদের আগেই ভাঙার সুর, একটা অমীমাংসিত কুহুকের হাতছানি।

‘অশ্বত্থের ডালে’ গল্পেও আর্থিক দৈন্যতা ঘুরেফিরে ফুটে উঠেছে। প্রধান চরিত্র নির্মল। ওর বাবা-মা আছে, বোনও আছে, একটি মেয়ে এবং বৌও আছে। কিন্তু তারপরও নির্মল সেখানে নেই, দারিদ্র্যের কশাঘাতে প্রতিনিয়ত জর্জরিত, জীবনে সখ-সাধ বলতে বই পড়া, অথচ তাও জোটে না। নতুন-নতুন বই কেনার সাধ্য নেই। তাই পুরনো পত্রিকা পড়ে নিজেকে ভুলে থাকতে হয়। নির্ঘুম রাত কাটে, পেঁচা-বাঁদুড়ের ডাক শোনে, জ্যোৎস্নার ভেতর খড়ের মাঠের খেঁকশিয়ালের দৌড় দেখে, জীবনটাকে ছোট নদী ভাবে, আবার নিজেকে গুটিয়ে নেয়। এক রাতে মজুমদারের উঠোনের দিকে যায়, সেখানে বংশলোচন নামের একজন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। সে কি ভুত নাকি মজুমদারের আত্মা! কিন্তু সে জীবনের অনেক গল্প করে, হয়তো ভৌতিক কিংবা রহস্যজনক কিছু। তবে গল্পে যে মানুষের কথা এসেছে, সে তো জীবনের কাছ থেকে পুরোদস্তুর উপেক্ষিত।

‘জামরুলতলা’ গল্পেও সেই আর্থিক সঙ্কট প্রকট হয়ে ধরা দিয়েছে, গ্রাম্য-জীবনের রোমান্স হিসেবে জামরুলতলাকে দেখেছেন লেখক, হারানি নামের যে মেয়েটিকে কথক একটু-একটু ভালোবেসেছিল। জামরুলতলায় রোজ দুপুরবেলায় আসত কিশোরী মেয়েটি, কথক টেবিলের ওপর কলম রেখে চুপচাপ দেখত, সে দেখার মধ্যে একটা নির্মল আনন্দ বা আর্কষণ ছিল। সে ভাবে, হারানি কলিকাতায় বিএ পড়বে, চাকরি একটা করবে হয়তো। কিন্তু বাবার বয়সী অবনীর সাথে বিয়ে হয় হারানির। এই ঘটনা কথকের মর্মপীড়ার কারণ হয়, চাকরিহীন-রোজগারহীন কথক তাই শুধু নির্বাক দর্শক। তার ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই সমাজের কাছে।

জীবনানন্দের গল্প ভিন্নধর্মী। মেজাজ-স্বর এবং জীবনতৃষ্ণায় লালিত। গল্পে অভিনতুন আঙ্গিক, কাহিনী উপস্থাপনের স্বতন্ত্রভঙ্গি, গ্রামীণ পটভূমি, বিষয় ও ভাষা শৈলীর স্বাতন্ত্র্য, স্বতঃস্ফূর্ততার বর্ণনাবিন্যাস, প্রয়োজনীয় ডিটেলস বা প্রতিবেশ বর্ণনায় জীবনানন্দ সার্থক।

‘রক্তমাংসহীন’ মনস্তাত্ত্বিক গল্প। নিঃসন্তান এক নারীর কষ্ট ফুটে উঠেছে গল্পে।
‘শাড়ি’ গল্পে এক দারিদ্র্যনিমজ্জিত দম্পতি এখানে মুখ্য হয়ে উঠেছে, দারিদ্র্যতা যে একটা অভিসাপ তার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। স্বামী রণজিৎ অনেক কষ্ট এবং যন্ত্রণা সহৃ করতে পারলেও স্ত্রী ঊষা বুঝেও বুঝতে চায় না, কিংবা কখনো-সখনো ভুলেই যায় যে তারা কতটা বাস্তবতার মুখোমুখি, জীবনানন্দ হয়তো এভাবেই জীবনকে দেখেছেন, নানান রঙে নানান ভাবনায়, শাড়ি গল্পটিকে প্রতীকধর্মী বললেই হয়তো বেশ ইঙ্গিতবাহী হয়। গল্পের পটভূমি নিম্ন মধ্যবিত্ত একটা পরিবারকে কেন্দ্র করে, আবহ বেশ রহস্যময়তা সৃষ্টি করেছে, অনুভূতি সর্বদা কাজ করে, একটা দেয়াল ঘিরে আছে, সে দেয়াল ভাঙতে হবে। সে দেয়াল ভাঙনের ফলেই প্রত্যাশিত সেই সমাজ আসবে।
মূলত গ্রামীণ জনপদের ভাঙন-সামাজিক শোষণ, কখনো প্রতিবাদ বা বাঁচার সংগ্রাম, এসব বিষায়াদি জীবনানন্দের গল্পজগৎ। জীবনানন্দ দাশ তার কাব্যে ইউরোপীয় শিল্প মতবাদ আত্মস্থ করে লোকজ মিথ-রূপকথা-পুরাণ ও ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে যুগগত ভাবকে বাণীরূপ দেন অবলীলায়। তার গল্পও বাঙালি পাঠকের মন ভরিয়েছে। এখানেই তার সাফল্য মানতেই হয়, তারপরও জীবনানন্দ সস্তা খ্যাতির পেছনে ছুটে যাননি। চিরটাকাল থেকেছেন নিজের মধ্যেই। জীবনানন্দের মধ্যে আরেক জীবন-আনন্দ।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us