মিসরে ৩ হাজার বছরের প্রাচীন নগরী আবিষ্কার

এরশাদ আলী | Dec 26, 2021 03:01 pm
মিসরে ৩ হাজার বছরের প্রাচীন নগরী আবিষ্কার

মিসরে ৩ হাজার বছরের প্রাচীন নগরী আবিষ্কার - ছবি : সংগ্রহ

 

দুনিয়ার প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে মিসর সব সময় গুরুত্বপূর্ণ। ট্যুরিস্টদের মিসরের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন সব সময় আকর্ষণ করে। সেখানকার ফেরাউনদের মমি এবং পিরামিডসহ মিসরীয় পুরাকীর্তির স্থানও বিশ্বের তাবৎ প্রত্নতাত্ত্বিকের কাছে সমান আকর্ষণীয়। বলা যায় প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনের এক লীলাভূমি মিসর। সেখানে নতুন নিদর্শন খুঁজে পাওয়ার জন্যে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ঘুরে বেড়ান। প্রাণান্ত পরিশ্রম করেন। তাদের সে প্রাণান্ত পরিশ্রম একসময় বিস্ময়কর আবিষ্কারে পর্যবসিত হয়। তাতে মানবজাতির সামনে উন্মুক্ত হয় তাদের সমৃদ্ধ অতীতের ইতিহাস। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে মিসরে সেরকম একটি আবিষ্কারের ঘোষণা করা হয়েছে।

চলতি বছরের মার্চে প্রখ্যাত মিসরীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জাহি হাওয়াস হারানো স্বর্ণনগরী (খড়ংঃ এড়ষফবহ ঈরঃু) আতেন (অঃবহ) উন্মোচন করার কথা ঘোষণা করেন। এ নগরী কয়েক শতাব্দীকাল যাবত মরুভূমির বালুর নিচে চাপা পড়ে ছিল। এ নগরীর অবস্থান লুক্সরের (খীঁড়ৎ) পাশেই। বিশ্বব্যাপী একনামে পরিচিত লুক্সরকে রাজাদের উপত্যকা (ঞযব াধষষবু ড়ভ করহমং) বলা হয়। তার অর্থ এটা নয় যে সেখানে রাজারা বসবাস করেন। তবে মৃত অনেক মৃত রাজার অবস্থানস্থল লুক্সর। সে এলাকায় মিসরের প্রাচীন সভ্যতার মূল্যবান অনেক নিদর্শন রয়েছে। আতেনকে বলা হচ্ছে সবচেয়ে পুরাতন এবং এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত শহর নগরের মধ্যে সর্ববৃহৎ নগরী। প্রতœতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা এ আবিষ্কারের প্রশংসা করে বলছেন, বালক রাজা তুতেনখামেনের (ঞঁঃধহশযধসবহ) সমাধি পাওয়ার পর এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। ড. জাহি হাওয়াস ও তার প্রতœতাত্ত্বিক টিমের সদস্যরা বলছেন, এ নগরী তিন হাজার বছরের পুরাতন। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির মিসরীয় শিল্প এবং প্রতœতত্ত্ব বিষয়ের অধ্যাপক বেটসি ব্রায়ান বলেছেন, এ নগরীর সন্ধান পাওয়া হচ্ছে তুতেনখামেনের সমাধি পাওয়ার পর দ্বিতীয় গুরুদ্বপূর্ণ প্রতœতাত্ত্বিক আবিষ্কার।

সেখানে প্রাপ্ত পুরাকীর্তিগুলোর ভিত্তিতে ধারণা করা হচ্ছে, রাজা তৃতীয় আমেনহাতেপের (অসবহযড়ঃবঢ় ওওও) রাজত্বকাল থেকে রাজা তুতেনখামেন (তার নামের এটা বর্তমান মিসরীয় উচ্চারণ। প্রকৃত নাম ঞঁঃধহশযসঁহ) পর্যন্ত এখানে বসবাস চলেছিল। ১৯২২ সালে রাজা তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কৃত হয়। সেখানে পাওয়া যায় স্বর্ণনির্মিত তৈজসপত্র ও নৌকাসমেত বহু মূল্যবান সম্পদরাজি। মৃত রাজার মমির সাথে এসব রেখে দেয়া হতো এ বিশ্বাসে যে, রাজা দৈনন্দিন জীবনে এগুলো ব্যবহার করবেন, নীল নদে নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়াবেন। যেমন এখনো কোন কোন দেশের লোক তাদের তৈরি ধর্মবিশ্বাসমতে মৃতদের সমাধিতে তাদের ব্যবহারের জিনিসপত্র রেখে দেয়। সমাধি উন্মোচিত হওয়ার পর থেকে এ রাজাকে নিয়ে অনেক গবেষণা ও লেখালেখি হয়েছে। তুতেনখামেন মিসরী সাম্রাজ্যের ইতিহাসের অষ্টাদশ রাজবংশের শেষ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তিনি ১২-১৩ বছর বয়সে সিংহাসনে আসীন হয়ে খ্রিষ্টপূর্ব ১৩২৩ সালে ১৯ বছর বয়সে মারা যান। এতদিন পর্যন্ত মিসরের রাজাদের বৃহৎ সমাধিক্ষেত্র বা দুনিয়াবি জীবনের পরবর্তী বাসস্থান পাওয়া গিয়েছিল। আর এবার রাজাদের নশ্বর জীবনের বসবাসের নগরী বা রাজধানী, যাই বলা হোক না কেন, সেটার সন্ধান পাওয়া গেল।

মিসরের সাবেক পুরাকীর্তি বিষযক মন্ত্রী হাওয়াস তাদের এ প্রাপ্তি সম্পর্কে বলেন, অনেকগুলো বিদেশী টিম এ পুরাতন নগরের বহু খোঁজ করেছে। কিন্তু কেউ কখনো সেটার সন্ধান পায়নি। আমরা সেখানে পেয়েছি আংটিসহ অলঙ্কারাদি, রঙিন মাটির পাত্র, কাঠের হাতুড়ি এবং রাজা তৃতীয় আমেনহাতেপের সিলযুক্ত কাদার ইট। হাওয়াস তার টিম নিয়ে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেখানে খনন কাজ শুরু করেন। জায়গাটি মিসরের বর্তমান রাজধানী কায়রোর দক্ষিণ দিকে ৫০০ কিলোমিটার (৩০০ মাইল) দূরবর্তী লুক্সরের পাশে অবস্থিত রাজা তৃতীয় রামাসেস (জধসংবং ওওও) ও রাজা তৃতীয় আমেনহাতেপের সমাধি মন্দিরের মাঝখানে। মাত্র কয়েক সপ্তাহের খোঁড়াখুঁড়ির পরেই টিমের লোকদের সামনে বিস্ময়কর সব নমুনা উঠে আসতে থাকে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, চারদিকে বিস্তৃত ইটের দেয়ালের সারি নজরে আসতে থাকে। তারপর আরো ভালোভাবে খননকাজ করার পর একটা বিশাল শহর প্রায় অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। বাড়িঘরের দেয়ালগুলোর কোন ক্ষতি হয়নি। কক্ষগুলো দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য জিনিসপত্রে পূর্ণ। এগুলো ভালোভাবে সংরক্ষণ করারও উপযুক্ত রয়েছে। কয়েক সপ্তাহের খননে অনেকগুলো মহল্লা পুরো উন্মোচিত হয়। একটি বেকারি পাওয়া যায়। সেটার চুলা ও মালপত্র রাখার মাটির পাত্রসমূহ অমনি রয়েছে। প্রশাসনিক এবং আবাসিক এলাকার ভবনগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে।

প্রতœতাত্ত্বিক গবেষকরা বলেন, রাজা তৃতীয় আমেনহাতেপ উত্তরাধিকার সূত্রে যে সাম্রাজ্য পান সেটা বর্তমান ইরাকের ফোরাত নদী থেকে আফ্রিকা মহাদেশের সুদান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৫৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন বলে অনুমান করা হয়। তিনি চার দশক রাজত্ব করেন। তার সাম্রাজ্য বিত্তবৈভব এবং ঐশ্বর্যমণ্ডিত ছিল। সেখানকার বিশাল ও জমকালো সব স্তম্ভ তার সাক্ষ্য দেয়। এসব স্তম্ভের মধ্যে রয়েছে মেমননের বিরাটাকার মূর্তি (ঈড়ষড়ংংর ড়ভ গবসহড়হ) এবং লুক্সরের পাশের এলাকায় স্থাপিত দুইটি পাথরের মূর্তি, সম্ভবত তার একটি রাজা আমনহাতেপের নিজের ও অপরটি তার রাণীর।

আতেন খুঁজে পাওয়া টিমের ভাষ্য অনুযায়ী, নগরীর প্রতœতাত্ত্বিক স্তরগুলো কয়েক হাজার বছর ধরে জানার বাইরে ছিল। সেগুলো এখনো এমনভাবে রয়েছে যে মনে হচ্ছে শহরের বাসিন্দারা গতকালই সেখান থেকে চলে গেছে। তারা আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। অনেক কিছুই এখনো বিস্তারিতভাবে দেখা সম্ভব হয়নি। সেখানে অনেক সমাধি দেখা যাচ্ছে। সেগুলোর সিঁড়ি বাঁক নিয়ে পাহাড়ে উঠে গেছে মনে হচ্ছে। যেমন রাজাদের উপত্যকার পিরামিডগুলোতে দেখা যায়। এসব সমাধি থেকে অনেক সম্পদরাজিও পাওয়ার আশা করছেন তারা। কারণ সেগুলো ইতঃপূর্বে মানুষের অগোচরে ছিল এবং রেখে দেয়া সম্পদে কারো ছোঁয়া লাগেনি বলে মনে হচ্ছে। লুক্সরের পিরামিডগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতœতত্ত্ব বিভাগের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার আগে সেগুলো থেকে অনেক সম্পদ চুরি হয়ে গিয়েছিল। তখন লুক্সর ছিল চোর আর লুটেরাদের অভয়ারণ্য। শুধু তুতেনখামেনের সমাধি সবার অজান্তে থাকায় সেটার সম্পদ অক্ষতই পাওয়া গিয়েছিল।

আতেন আবিষ্কার মিসরের পর্যটন শিল্পের জন্যেও নতুন আশার সঞ্চার করছে। ২০১১ সালে শক্তি প্রয়োগ করে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলন নস্যাৎ করতে নির্বিচার হত্যাকান্ড চালানোর পর থেকে সেখানে পর্যটকদের আগমন আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ায় দেশের আয়ের অন্যতম উৎস পর্যটনশিল্প ধুঁকছে। দেশটি কিভাবে পর্যটকদের আগমন আগের মতো বাড়ানো যেতে পারে তার ফিকিরে আছে। তাদের অতীত ঐতিহ্যের নিদর্শগুলো জনসমক্ষে আরো বেশি করে তুলে পর্যটক আকর্ষণের চেষ্টা হচ্ছে। এপ্রিল মাসে ১৮ ফেরাউনের এবং চার রানীর মমি মিসরীয় জাদুঘর থেকে বের করে কায়রো ঘুরিয়ে নতুন স্থাপিত মিসরীয় সভ্যতার জাতীয় জাদুঘরে নেয়া হয়। রাজা-রানীদের মরদেহের এ শোভাযাত্রার নাম দেয়া হয় ফারাওদের স্বর্ণালি শোভাযাত্রা (চযধৎধড়যং’ এড়ষফবহ চধৎধফব)। এ প্যারেডে ২২ মমির মধ্যে রাজা আমেনহাতেপ ও তার রানী তিয়ে (ঞরুব) শামিল ছিল। আতেন নগরীর আবিষ্কার মিসরীয় পর্যটন শিল্পে একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে।

অধ্যাপক বেটসি ব্রায়ান আশা প্রকাশ করে বলেছেন, এ নগরী আবিষ্কারের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা প্রাচীন মিসরের মানুষের জীবনধারা সম্পর্কে জানার সুযোগ পাবো, যখন সে সাম্রাজ্য ছিল সবচেয়ে সম্পদশালী। দুনিয়ার ধর্মনিরপেক্ষ ও বস্তুবাদী মানুষরা এ ধরনের কথাই বলবেন, এর বাইরে কিছু আশা করা যায় না। কিন্তু এ বিশ্ব চরাচরের স্রষ্টা আল্লাহতায়ালা মানব বসতির এসব ধ্বংসাবশেষ অনাগত মানুষের শিক্ষাগ্রহণের জন্যে রেখে দেন বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি কুরআন মজিদে খুব শক্তিমান ও সমৃদ্ধশালী আদ, সামুদ জাতিসহ অনেক জাতির উদাহরণ তুলে ধরেছেন। সুরা বনি ইসরাইলে ফেরাউন রাজাদের কাহিনী বর্ণিত আছে। বনি ইসরাইল জাতির উপর আল্লাহ বিরোধী ক্ষমতাগর্বী ফেরাউনদের জুলুমের ইতিহাস এবং নবী মুসার (আ:) সাহায্যে বনি ইসরাইলিদের মুক্তি ও তৎকালীন ফেরাউনের নীলনদে ডুবে মরার ঘটনাও আমরা কুরআন থেকে জানতে পারি। এখন ফেরাউনদের রাজধানী নগরী আতেন আবিষ্কারের পর সে সময়ের মানুষের সমৃদ্ধ জীবন সম্পর্কে শুধু জানার চেষ্টা করলে হবে না। এটাও জানার চেষ্টা করতে হবে, নগরী পরিত্যক্ত হওয়ার কারণ কি ছিল? সবকিছুই অক্ষত রয়েছে। ঘরের ব্যবহার্য তৈজসপত্রও রয়েছে। সেসব দেখে বোঝা যায় তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব ছিল না। সে অবস্থায় ঘরবাড়ি ছেড়ে তাদের চলে যেতে হলো কেন? বাইরের কোনো আক্রমণ, না কোন ভয়ানক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিশ্বাসীদের মতে খোদায়ি গজবে এমনটি হয়েছে? গবেষণা করে এসব জানা এবং সকল মানুষকে জানানো খুই দরকারি। তাহলে পরবর্তী মানুষ তাদের দুনিয়ার চলার পথে কোনো উপায় অবলম্বন করা উচিত সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা নিতে পারবেন।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us