ধোঁয়া ওঠা কফির পেয়ালায়

শাহীন চৌধুরী ডলি | Dec 30, 2021 02:13 pm
ধোঁয়া ওঠা কফির পেয়ালায়

ধোঁয়া ওঠা কফির পেয়ালায় - ছবি : সংগ্রহ

 

সন্ধে নামলে ঘন ঘন উত্তুরে হাওয়া জানান দিচ্ছে শীত আসছে। শীতে ধোঁয়া ওঠা কফির পেয়ালায় চুমুক, দারুণ জমে যায় তাই না? শহুরে জীবনে পানীয় হিসেবে কফি এখন বেশ জনপ্রিয়। শীতের উষ্ণতায় দিনের যেকোনো সময় এক কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি এনে দেয় ঝরঝরে অনুভূতি। কফি যেমন শরীর চাঙা করে তোলে তেমনই কর্মক্ষমতা বাড়ায়। মিটিং কিংবা অফুরন্ত আড্ডায় রাজধানীর কফিশপগুলো জমজমাট।

আজ যে কফি ছাড়া মানুষের চলেই না সেই কফির কথা কিন্তু নবম শতকের আগে জানা যায়নি। মজার কথা হলো, নবম শতকের আগে কফি গাছ থাকলেও সে গাছের পাকা ফলটি গরম পানিতে গুলিয়ে খাওয়ার কথা কেউ ভাবেনি। ইথিওপিয়া থেকে আরব বণিকেরা ৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ কফি বীজ নিয়ে যায় আরবে। সেখান থেকেই কফি বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। ১৪৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তুরস্কের রাজধানী কন্সটানটিনেপলে স্থাপিত হয় বিশ্বের প্রথম কফিশপ।
এখন বিশ্বের অনেক জায়গায় কফি সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়। আমেরিকানরা সোডা, জুস এবং চা পানের চেয়ে কফি বেশি পান করে। পশ্চিমাদের কাছে কফি কতটা জনপ্রিয় শুনুন তাহলে- যখন প্রথম একটি খবর ছড়িয়ে পড়ে যে যুবরাজ হ্যারি ও মেগান কানাডাতে স্থায়ীভাবে বসবাসের ইচ্ছে প্রকাশ করছেন, তখন কানাডার তুমুল জনপ্রিয় কফি জায়ান্ট ‘টিম হর্টনস’ অতিরিক্ত প্রলোভন হিসেবে ওই দম্পতিকে আজীবন বিনামূল্যে কফি সরবরাহ করতে চেয়েছে।
চা ও কফি নিয়ে কম বিপ্লব হয়নি। আবার এই দুটোর মধ্যে কোনটি বেশি জনপ্রিয়, সে তর্কের প্রদীপের রসদও ফুরিয়ে যায়নি। কফি হাউজের রোমান্টিকতা চায়ের ভাঁড়ের মতোই আপন। কফি হাউজের সাথে জড়িয়ে কত ইতিহাস। চা বনাম কফি বিতর্ক তর্কবাগিশ বাঙালির বড় আপন। পাড়ার চায়ের দোকানের সসপ্যানেও ধীরে ধীরে দিব্যি জায়গা করে নিচ্ছে কফি। জমজমাট গেরস্থালির এক কোণে গৃহকর্ত্রীর একান্ত সময়টুকুতে ভাগ বসাতে স্বাচ্ছন্দ্য হয়ে উঠেছে এক কালের প্রায় নিষিদ্ধ পানীয় কফি।

গত শতক পর্যন্তও বাঙালির অতিথি আপ্যায়নে বড় একটা অংশজুড়ে ছিল পানের বাটা। বাড়িতে অতিথি এলে বেড়িয়ে পড়ত পানের বাটা। বাড়িতে কেউ আসা মাত্র ‘চা না কফি’- এ প্রশ্ন স্বাভাবিক ছিল না, গত শতকের শুরুর দিকেও। বিলেতে জাতীয় পানীয় হয়ে ওঠা চা বা টি-কে এককালে যথেষ্ট লড়াই করতে হয়েছে বাঙালি সমাজে নিজের জায়গা করে নিতে।

চা বেশি জনপ্রিয় না কফি, কার পাল্লা বেশি ভারী? এ প্রসঙ্গে আব্রাহাম লিংকনের অসাধারণ উক্তিটি মনে পড়ে গেলো। এক পেয়ালা গরম পানি দেখে না কি একবার লিংকন বলেছিলেন,‘এর আগে যদি আমাকে চা দিয়ে থাকেন, তাহলে এবার কফি দিন। আর আগেরটা যদি কফি হয়ে থাকে, তবে চা দিন।’ অনেক বাঙালির মনের অবস্থাও এমনই। চা-কফি নিয়ে বাঙালির পিটপিটানি অনেকটা কেটেছে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেও। শান্তি নিকেতনের নানা গল্পে ওঠে আসে, কয়েকটা চা-পাতা অল্প পানিতে জ্বাল দিয়ে ফুটিয়ে নিয়ে কাপে ঢেলে নিতেন রবীন্দ্রনাথ। বাকি কাপটি ভরতেন দুধ-চিনিতে। অভ্যাস ছিল কফিরও, বানানো হতো একই কায়দায়।

এক কাপ কফি না পেলে দিন ভালো যায় না- এমন অনেকেই বলে থাকেন। আর তা যদি সকাল সকাল পাওয়া যায়, তবে হয় একেবারে অন্যরকম অনুভূতি। সেই কফি খাওয়া মাত্র কেমন যেন মনে আনন্দ ফিরে আসে। কেন এমন হয়? এ কিন্তু কেবল সরল ভালো লাগা থেকে নয়। ২০১৫ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র বলছে, কফি অবসাদের আশঙ্কা কমিয়ে দিতে সক্ষম। সাত দফায় সে বছর হয়েছিল সমীক্ষা। ২০১৮ সালের একটি গবেষণা বলছে, মন খারাপ থাকলে সাথে সাথে তা ভালো করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে কফি।

কফি কেবল উষ্ণ মিষ্ট তরল পানীয় নয়। কি পশ্চিমে কি প্রাচ্যে- এর পরিবেশনা শিল্পসম্মতও বটে। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও কফির অবাধ বিচরণ। শহরের কমবয়সীদের এখন ক্যাফেগুলোতে নিত্য আনাগোনা। শুধুমাত্র আড্ডা দিতেই নয়, তার চেয়েও বেশি কাজের জন্য। অতিমারিতে সেই অভ্যাস আরো বেড়েছে। বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে কাজ করতে আর কতদিন ভালো লাগে? তাই লকডাউনের কড়াকড়ি শিথিল হতেই অনেকে ছুটছেন বিভিন্ন ক্যাফেতে। গত পাঁচ-সাত বছরে ঢাকার ক্যাফের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। ক্যাফেগুলো নানা রঙ, নানা কায়দায় গজিয়ে ওঠেছে। কোনো কোনোটি আন্তর্জাতিক মানের তকমা এঁটে।

নামীদামি ক্যাফেতে ঢুকে একটি ‘চেক ইন’ দেয়া মানেই বন্ধুমহলে তার কদর বেড়ে যাওয়া। আবার কোনো ক্যাফে নেহাতই ছোটখাটো। অন্তর্মুখী তরুণ-তরুণীদের জন্য সেটাই শ্রেষ্ঠ কর্মক্ষেত্র। এখন শহরে অনেক ক্যাফের পরিবেশে আছে চোখ- ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্য, আছে শান্ত পরিবেশের ভদ্রতা। কফি শপের মেনুতেও রয়েছে দেশ-বিদেশের নানারকম খাবার। সেখানে একদিকে যেমন চলে কাজের মিটিং, তেমনই অন্য দিকে চলে জমিয়ে আড্ডা। এক কাপ চায়ে যেমন তোমাকে চাই তেমনই অনেকের আবার এককাপ কফিতে তোমাকে চাই। কত ঘরানার কফির খবর রাখে আজকের প্রজন্ম।

আজকের লেখায় রইলো ভিন্ন স্বাদের জনপ্রিয় কিছু কফির সন্ধান :

এসপ্রেসো : এটি একেবারেই বেসিক বা মৌলিক কড়া কালো কফি। এসপ্রেসোকে শর্ট ব্ল্যাকও বলা হয়। এই কফিকে বিশুদ্ধ বলে মনে করা হয়। বিশ্বের প্রায় সবধরনের কফি এটা থেকেই তৈরি হয়। এটা বিশ্বের পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে। এই কফির স্বাদ সামান্য তেতো হয়ে থাকে।
ডাবল এসপ্রেসো : একে ইতালিয়ান ভাষায় ডপিও বলা হয়, যার অর্থ দ্বিগুণ। শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এই কফিতে এক্সপ্রেসোর তুলনায় দ্বিগুণ কফি থাকে। সিংগেল শটে এক আউন্স এসপ্রেসো এবং ৬৪ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে কিন্তু ডাবল এসপ্রেসোতে দুই আউন্স এসপ্রেসো এবং ১২৮ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে।

ব্ল্যাক আইভরি কফি : এর প্রতিকাপ কফির দাম জানলে চোখ কপালে উঠবে। যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫ গ্রাম পরিমাণ কফির দাম ৮৫ ডলার। বাংলাদেশে প্রতিকাপ কফি মাত্র- সাত হাজার দুইশো টাকা। এর নাম আইভরি ব্ল্যাক কফি। এটি যে সে কফি নয়, হাতির মল থেকে বেরনো কফির বীজ দিয়ে তৈরি কফির দাম তো অনেক বেশি চুকাতে হবেই। আইভরি কফিটির গন্ধ ফুলের এবং চকোলেটের মিশ্রণের মতো আর স্বাদও চকোলেটের মতো। আইভরি কফিতে কোনো তিক্ততা থাকে না। বিশ্বের মাত্র ২২টি হোটেলে এই কফি পাবেন যার সব ক’টিই থাইল্যান্ডে।
লং ব্ল্যাক : এসপ্রেসোর ডাবল শট কফি গরম পানিতে ঢাললেই তৈরি হয়ে গেলো লং ব্ল্যাক। অ্যামেরিকানোর মতো এখানে কফিতে পানি দেয়া হয় না বরং উল্টোটা করা হয়।

অ্যামেরিকানো: অ্যামেরিকানো হলো একদম সাদাসিধে, ফেনাবিহীন এবং হালকা কফি। এই কফিটি সাধারণত ব্ল্যাক কফি নামে পরিচিত। এই ধরনের কফিগুলো এসপ্রেসো কফির মধ্যে আধ কাপ গরম পানি, একটু দুধ এবং পরিমাণমতো চিনি মিশিয়ে তৈরি করা হয়। কফিশপগুলোতে এই কফি তৈরি করতে ১০ গ্রাম এসপ্রেসো হলে ২০ গ্রাম পানি মেশায়।

মাকিয়াটো কফি : ইতালিয়ান ভাষায় মাকিয়াত্তোর অর্থ হলো দাগ লেগে গেছে এমন। নাম থেকেই বোঝা যায় এটা কি। অল্প একটু ফোমের মার্ক, আর কিছু না। খাঁটি কালো কুলীন এসপ্রেসোর শটে সাদা দুধ যোগ করে অল্প একটু ফোমের মার্ক। যদিও অনেকে ফোমের পাশাপাশি ২:১ রেশিওতে দুধ ব্যবহার করে। মানে ২০ গ্রাম এসপ্রেসো হলে ১০ গ্রাম দুধ।

ক্যাপাচিনো : যারা কফির খুব সমঝদার নয় তারাও যে কফিটির নামের সাথে পরিচিত, তা হলো ক্যাপাচিনো। প্রতিটি কফিশপে ক্যাপাচিনো কফি পাওয়া যায়। এটি এসপ্রেসো কফির মধ্যে আলাদাভাবে দুধ ও চকোলেট সিরাপ মিশিয়ে তৈরি করা হয়। কফির ওপরে বেশি পরিমাণ ফেনার স্তরযুক্ত ক্যাপাচিনো কফি স্বাদে এসপ্রেসো কফি থেকে খুব ভিন্ন।
ফ্ল্যাট হোয়াইট : দুধ বা ক্রিম মেশানো কফিগুলোর মধ্যে ফ্ল্যাট হোয়াইটের অবস্থান একটু উঁচুতে। এটির স্বতন্ত্র ফ্যাক্টর হচ্ছে, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ফোম যা বুদবুদ দিয়ে স্টিমড মিল্ক। এটি ল্যাটে কফির চেয়ে শক্তিশালী,তবে ক্যাপুচিনোর চেয়ে বেশি মজার। ফ্ল্যাট হোয়াইটের উৎপত্তি অস্ট্রেলিয়ায়। এটি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের জনপ্রিয় পানীয়। গত কয়েক বছর ধরে, ফ্ল্যাট হোয়াইট দ্রুত অন্যান্য দেশেও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। খুব আকর্ষণীয়ভাবে এই কফি সাধারণত সিরামিকে পরিবেশন করা হয়।

ল্যাটে কফি : দুধের অনুপাত এসপ্রেসো শটের দ্বিগুণ বা তিনগুণ হওয়ায় এতে তেমন তিতকুটে বা কড়া ভাব থাকে না। এই কফির মধ্যে দুধের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণে সাদাটে ভাব চলে আসে,পাশাপাশি চিনির পরিমাণও বেশি রাখতে হয়। এটির সাথে কুকিজ খেলে স্বাদ বেড়ে যায়।
মোকা : ইয়েমেনের উৎকৃষ্ট অ্যারাবিকা কফি বিনকে মোকা বলা হলেও প্রচলিত অর্থে মোকা কফি বলতে চকলেট মেশানো কফিকেই বোঝানো হয়। এই কফিগুলো ক্যাপাচিনো কফিতে কোকো পাউডার মিশিয়ে তৈরি করা হয়। মোকা কফি সাজানোর জন্য হুইপড ক্রিম ব্যবহার করা হয়।

আইরিশ কফি : যারা কফি খেতে ভালোবাসেন তাদের কাছে আইরিশ কফি খুব প্রিয়। সামান্য পরিমাণ জিন, এসপ্রেসোর গুঁড়া এবং চিনি দিয়ে আইরিশ কফি তৈরি করা হয়।

অ্যরাবিকা কফি : এই কফিগুলোর টেস্ট ভালো। রোবাস্তার সাথে তুলনা করলে অ্যারাবিকা কফিতে ক্যাফেইনের পরিমাণ কম। অ্যারাবিকা কফির দামও বেশি। কারণ এগুলোর উৎপাদন খরচ বেশি।
রোবাস্তা : রোবাস্তা কফিগুলো একটু বেশি তিতা এবং ক্যাফেইনের পরিমাণও বেশি। রোবাস্তা কফির দাম তুলনামূলকভাবে কম।

ভারতীয় ফিল্টার কফি : দক্ষিণ ভারতের কিছু এলাকায় এই কফি পাওয়া যায়। এটা কফির শুকনো পাতা পেস্ট করে তৈরি করা হয়। পাশাপাশি দুধ এবং চিনি যোগ করে অন্যান্য কফিগুলোর মতো তৈরি করতে হয়।
ইন্সট্যান্ট কফি : বাজারে নেসক্যাফে, ম্যাককফিসহ অনেক ব্রান্ডের ইন্সট্যান্ট কফি পাওয়া যায়। এগুলোও সাধারণত এসপ্রেসো যেভাবে ব্রিউ করে, সেভাবেই করা হয়। এরপর ব্রিউ করার পর পানিগুলো শুকিয়ে গুঁড়া করে প্যাকেটজাত করে। ফ্রেশ ব্রিউ কফির স্বাদের তুলনায় এগুলো যদিও অত টেস্টি না।

গ্রিন কফি : ওজন কমাতে গ্রিন কফির বেশ সুনাম রয়েছে। মূলত যাদের ওজন একটু বেশি তাদের জন্যই গ্রিন কফি। বাজারে গ্রিন কফি কিনতে পাওয়া যায়। বাসায় বসে নিজেই বানিয়ে ফেলা যায়। অনেকে গ্রিন কফির স্বাদ বাড়ানোর জন্য এর সাথে মধু বা সামান্য চিনি মিশিয়ে পান করেন।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us