আমার বাবা

ফাবিহা ফেরদৌস | Feb 21, 2022 01:36 pm
আমার বাবা

আমার বাবা - ছবি : সংগ্রহ

 

আমার বাবা আমার বাসায় হঠাৎ করেই হাজির। আমি বেশ বিব্রত বোধ করলাম। বাসা ভর্তি মেহমান।
এর ভিতরেই বাবা একটা পুরোনো, ময়লা পাঞ্জাবি পরে এসেছে। পাঞ্জাবির এক জায়গায় আবার সেলাই করা । সম্ভবত মা যত্ন করে সেলাই করে দিয়েছে।

বাবা এই দিয়ে সম্ভবত তিনবার আমার বাড়িতে এসেছে। আমি বাবাকে স্টোর রুমে নিয়ে বসালাম। তারপর বেশ চাপা রাগের স্বরে বললাম,
– যখন তখন আসার মানে কী? আমি কোনো সাহায্য সহযোগিতা করতে পারব না। এ মাসেই আমার একটা বিদেশ টুর আছে। বেশ কয়েক লাখ টাকা ওখানে খরচ হবে।

বাবা বেশ অবাক হয়ে বলল,
– তোমার কাছে তো কোনো দিন সাহায্য চাইনি বাবা।

তা অবশ্য ঠিক । কিন্তু যখন তখন বাড়িতে এলে যে আমার প্রেস্টিজ নষ্ট হয়, তা যে কেন এই অশিক্ষিত লোকগুলো বুঝে না। না পারি সইতে, না পারি কইতে। তাই বেশ ঝাঝের সাথেই বললাম,
– সাহায্য না লাগলে, খামোখা আসছো কেন?

– তোমার মা আজ সকালে মারা গেছে। আছরবাদ দাফন হবে। মরার আগে তোমাকে খুব দেখার ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু তুমি ব্যস্ত মানুষ। অসুস্থ মাকে দেখতে যাওয়ার সময় ছিল না তোমার। এখানে এনে যে দেখিয়ে নিয়ে যাব, তাতে আবার তোমার সম্মান নষ্ট হয়। তাই মরার আগে তোমাকে আর দেখতে পারল না। যদি তার জানাজায় যেতে, তাহলে তার আত্মা একটু শান্তি পেত।

বাবা কি আমাকে ইচ্ছা করে কটু কথা শোনাচ্ছে? বয়স হইলে মানুষ তো মারা যাবেই। এতে এত আপসেট হওয়ার কী আছে? আজ বাসায় এত মেহমান, যাবো কী করে? সোমার জন্মদিন উপলক্ষে সোমার আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু বান্ধবীরা এসেছে। কিন্তু গ্রামে না গেলে, গ্রামের মানুষজনও কথা শোনাবে। গ্রামের মানুষ জন তো গীবত ছাড়া আর কিছুই পারে না। তাই বাবাকে নিয়ে রওনা দিলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে।

আমাদের বাড়ি শহরতলীতে, গ্রামই বলা যায়। আমার নিজস্ব গাড়িতেই গিয়েছিলাম। যখন পৌঁছালাম, তখন লাশ অলরেডি জানাজার জন্য মসজিদে নেয়া হয়েছে। আমাকে দেখে, সবাই সরে দাঁড়াল। মাতবর চাচা বলল,
– রায়হান বাবা, শেষ বারের মত মায়ের মুখখান দেখবা নাকি?

আমি বললাম,
– থাক, দরকার নেই। জানাজা শুরু করুণ।

মাকে কবর দিয়ে এসে ঘরে এসে বসলাম। কেমন যেন একটু মন খারাপ মন খারাপ লাগছে। হয়তো, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা কান্নাকাটি করছে, সেজন্য। কান্নাকাটি একটা ছোঁয়াচে রোগ। একজনের থেকে আর একজনের ভেতর সংক্রামিত হয়। গ্রামের কেউ কেউ সুর করে কাঁদছে – 'ওরে রায়হান, তুই শেষ পর্যন্ত আইলি, কিন্তু তোর মা তোরে একটু দেখতি পারলো না।'
বাবা ঘরে ঢুকে সবাইকে অনুরোধ করল, পাশের ঘরে যাওয়ার জন্য।

সবাই চলে গেলে, বাবা একটা নতুন টেবিল ফ্যান বের করে আমার সামনে চালু করে দিলো। অনেকক্ষণ পরে একটু আরাম লাগল। আসলেই গরমে খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। দেখি বাবাও ঘেমে গেছে। ফ্যানটা মুভ করে দিলাম। কিন্তু বাবা আবার আমার দিকে ফিক্সড করে দিলো। বলল,

– এ ফ্যানের বাতাস তো আমার গায়ে লাগাতে পারব না বাবা। তোমার মা যখন খুব অসুস্থ ছিল, গরমে খুব কষ্ট পেত। কিন্তু এই ফ্যানটা চালু করতে দিতো না। বলতো, 'থাক, নষ্ট হয়ে যাবে । খোকা আসলেই ফ্যানটা চালাবো।'

বাবা একটু থেমে আবার বলতে লাগল,
– গতবার তুমি যখন আইছিলে, তখন গরম বলে বাড়িতে দু ঘন্টাও বসতে পারোনি। তাই তোমার মা তোমার জন্য এই ফ্যানটা কিনাইছে। যাতে বাড়ি এলে, তোমার কষ্ট না হয়।
আমার মার জন্য হঠাৎ করেই খারাপ লাগতে শুরু করল। বাবা মায়ের পুরোনো বাক্সটা খুলল। একটা পোটলা বের করে নিয়ে এলো। আর একটা খেলনা গাড়ির প্যাকেট।

আমার হাতে দিয়ে বলল,
– তোমার বাসায় তোমার মা জীবনে একবার গিয়েছিল। তুমি বলেছিলে, তোমার ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ, অনেক টাকা লাগবে। সেই থেকে তোমার মা আমার সাথে সারাক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান করে। আমাদের দক্ষিণ মাঠের তিন বিঘা জমি বিক্রি করে দেয়ার জন্য। উত্তর মাঠের জমিটা তো তোমার পড়াশুনার জন্য বিক্রি করেছিলাম। শেষ সম্বল ছিল দক্ষিণ মাঠের জমিটা। তাই আমি রাজি হতাম না। কিন্তু তোমার মায়ের শরীর দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। তাই তার শেষ ইচ্ছা পূরণ করার জন্য গত মাসে বিক্রি করে দিলাম জমিটা। পনেরো লাখ টাকা পেয়েছি জমিটা বিক্রি করে।
তার ভেতর তিন হাজার টাকা দিয়ে ফ্যানটা কিনেছি। আর এক হাজার টাকা দিয়ে এই খেলনা গাড়িটা কিনেছি। বাকি টাকা এই পুটলিতে আছে। তুমি যখন ছোট ছিলে, তখন মাতবরের ছেলের এমন একটা গাড়ি ছিল। তুমি সারাক্ষণ তোমার মার সাথে ঘ্যান ঘ্যান করতে, এরকম একটা গাড়ির জন্য। তোমার মা খুব কষ্ট পেত। সামর্থ্য ছিল না বলে, কিনে দিতে পারি নাই। যখনই তোমার মা তোমার জন্য খুব মন খারাপ করত, তখনই বলত, ছেলেডারে একটা খেলনা গাড়িও কিনে দিতে পারি নাই। গাড়িটা যেদিন কিনে আনি, সেদিন যদি তোমার মায়ের খুশিটা দেখতে বাবা! খুব ইচ্ছা ছিল তার, এই টাকা কয়টা আর এই খেলনা গাড়িটা নিজ হাতে তোমারে দেবে। তোমারে অনেকবার খবরও পাঠাইছি, কিন্তু তোমার ব্যস্ততার জন্য তুমি আসতে পারো নাই । যাই হোক, তার আত্মা নিশ্চয়ই দেখতেছে।

মনে পড়ল, মা একবারই আমার বাড়িতে গেছে। মনে করেছিলাম, সাহায্য চাইতে পারে। তাই আগে থেকেই, ব্যবসায় লসের গল্প শুনিয়েছিলাম মাকে।

পৃথিবীটা কেমন যেন অর্থহীন লাগছে আমার কাছে । মাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে আমার। কবর খুঁড়ে মাকে তো আর দেখতে পারব না। আমি বাচ্চা ছেলেদের মতো বাবাকে ধরে কাঁদছি। বাবা পরম স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর বলছেন, 'কাঁদে না বাবা। মা তো সবার চিরকাল বাঁচে না।'


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us