সূর্য না ডোবার দেশেও রোজা রাখা হয়

রহমান মৃধা | Apr 04, 2022 06:20 pm
সূর্য না ডোবার দেশেও রোজা রাখা হয়

সূর্য না ডোবার দেশেও রোজা রাখা হয় - ছবি : সংগ্রহ

 

উত্তর ও দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের অনেকটা অংশজুড়েই গ্রীষ্মকালের একটা নির্দিষ্ট সময় আক্ষরিক অর্থেই সূর্য ডুবতে দেখা যায় না। তেমনি শীতকালেরও একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে সূর্য উঠতে দেখা যায় না। গ্রীষ্মকালের এ সময়টাকে ‘মেরু দিন’ এবং শীতকালের এই সময়টাকে ‘মেরু রাত্রি’ বলা হয়ে থাকে। স্ক্যান্ডেনেভিয়া অঞ্চলের দেশ সুইডেনের কিরুনা শহরটি আর্কটিক সার্কেল বা উত্তর মেরু বলয়ের আরো ১৪৫ কিলোমিটার ভেতরে। এখানে গ্রীষ্মকালেও পর্বত চূড়াগুলো সাদা বরফে ঢাকা থাকে। পুরো গ্রীষ্মকালেই রাতের আকাশ থাকে অনেকটাই আলোকিত, পুরো শীতকালে দিনের আলোর দেখা মেলা ভার। তবে এবার এপ্রিল মাসে রোজা শুরু হয়েছে বিধায় সুইডেনের কৃষিখেতে কাজ করেছি আজ সকালে। এক ঘণ্টা কাজ শেষে সবাই বললো কফি টাইম ফিকা করবো। আমি বললাম, তোমরা যাও আমি কাজ করতে থাকি। সবাই একসঙ্গে বলল, না তুমিও এসো। আমি বললাম, আমি রোজা, গতকাল থেকে রমজান শুরু হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সবাই বলল, সরি রহমান ভুলে গেছি যে রমজান শুরু হয়েছে।

একথা শেষে তারা বলল, তাহলে আমরা কুইক ফিকা সেরে আসছি। সুইডিশ ফিকা বলতে আমাদের দেশে আমরা বলি নাস্তা-পানি। আমি বললাম, তাড়া নেই তোমরা যখন খুশি এসো।

গ্রুপের মধ্যে একজন নাম জুং, বলল, রহমান আমি রোজা থাকতে চাই। আমি বললাম সেকি? জুং বলল, আমি খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাসী, তবে রোজা থাকার খুব শখ। আমি বললাম, তাহলে কাল থেকে শুরু করো। জুং ফিকায় না গিয়ে আমার সঙ্গে কাজ করতে লাগল। জুংয়ের বয়স ৩০ বছর, এক ছেলের বাবা, ছেলের বয়স ৪ বছর। জুং বলল, রহমান কী বলব ছেলেকে, সে যখন জিজ্ঞেস করে, বাবা মানুষ মানুষকে কেন গুলি করে মারছে? করোনার সময় সবাই সবাইকে সাহায্য করেছে অথচ এখন খুন করছে? পলেটিক্স আর ধর্ম নিয়ে কথা উঠলে যা হয়, অনেক কথা আলোচনা হলো আজ।

আলোচনার শেষে আমার ভাবনায় যে চিন্তা ঢুকেছে তার অংশ বিশেষ শেয়ার করছি। পাশ্চাত্যের চার্চগুলো জনশূন্য অথচ pub বা bar-এ মানুষে ভরা। এরা চার্চে যাওয়া ছেড়েই দিয়েছে বলতে হয়। চার্চের পরিবর্তে ন্যাচারে বা সাগরের পাড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় পার করে, নির্জন জঙ্গলে সময় কাটায়। যা দেখা বা শোনা যায় না তার ওপর সময় দিতে বা কথা বলতে এরা চায় না। চার্চে বসে বসে ভাবার চেয়ে ন্যাচারে সময় কাটানো ভালো, ৮০ ভাগেরও বেশির ভাগ মানুষের সাথে কথা বললে এমনটি উত্তর মিলবে। আমি তর্কে জড়িত না হয়ে বরং যেটা আমার বিবেকে মনে হয় সেটাই বলি। আমি মনে করি স্রষ্টা আদেশ করেছেন রোজা থাকার, নামাজ পড়ার সেগুলো করলেই হলো। আমরা স্রষ্টার নির্দেশনা থেকে যত দূরে সরে যেতে চেষ্টা করছি ততই মহামারি, মানুষে মানুষে ঘৃণা, গণহত্যা, ধর্ষণ, দুর্নীতি এসবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছি। যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে বিশ্বের নানা ধরণের যুদ্ধে এর দশ ভাগের এক ভাগ যদি মানুষের সেবায় ব্যয় হতো তবে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটত বিশ্বে। আমরা আল্লাহর সান্নিধ্য পেতাম আরো বেশি।
এখন পাশ্চাত্যে না হয় এরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে না বুঝলাম কিন্তু আমাদের জগতে তো সবাই ধর্মকে গুরুত্ব দেয়। তাহলে সেখানে কেন কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না? তাহলে কি আমরা লোক দেখানো ধর্মে মগ্ন? আমরা নিজেদেরকে ঠকাচ্ছি না তো? যাই হোক না কেন আর যাই করি না কেন, এতটুকু বলতে চাই তা হলো ধর্মকে মন থেকে বিশ্বাস করার মধ্যে মজাটাই আলাদা।

সুইডেনের রমজান মাস বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই পালিত হয়। শুধু সময়ের পার্থক্যটাই লক্ষণীয়। আজ সূর্য উঠেছে সকাল ০৬:০৯ এবং অস্ত যাবে ১৯:৩৪। আমাদের এখানে রোজা শুরু হয়েছে ২ এপ্রিল। খুব কম লোকই আছে এখানে যারা ভোর রাতে রান্নাবান্না করে। সবাই রাতের ডিনার করেই ঘুমিয়ে যায় এবং সূর্য অস্ত গেলে রোজা ভাঙ্গে। প্রতিদিন তারাবির নামাজ পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সব দেশের মুসলমানরা একত্রে তারাবির নামাজ পড়ে। এবার বসন্তের শুরুতে রোজা শুরু হওয়ায় দিন প্রতিদিনই বড় হতে থাকবে। গোলাকার, বিস্ময়কর পৃথিবী, সবকিছু চলছে তার গতিতে, কোনো কিছুরই অভাব নেই অভাব শুধু আমাদের মানবতা এবং মনুষ্যত্বের। পাশ্চাত্যে এরা কিন্তু রোজা থাকে এদের মতো করে যাকে আমরা ‘উপোস থাকা’ বলি। এরা পানি পান করে এবং অন্যান্য খাবার থেকে বিরত থাকে।
রমজান মাসের রোজা সুইডেনের সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে আরব দেশের প্রায় দ্বিগুণ সময় যা নিশ্চয় একটু কঠিন সময়। সুইডেনে এবারের রোজা বসন্তে হবার কারণে কিছু সময় দিন শেষে রাত হবে। তা না হলে যদি রোজা শীত অথবা গ্রীষ্মে হতো তবে সূর্য না উঠার সমস্যার পরিবর্তে তখন সূর্য না ডোবার সমস্যায় পড়তে হতো। গ্রীষ্মকালে দীর্ঘ সময় ধরে রোজা রাখার পরিবর্তে শীতে তখন মাত্র কয়েক ঘণ্টা রোজা রাখতে হতো। শীতকালের কিছু দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও পড়তে হয় মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। কেননা বছরের কিছু সময়ে মাত্র দুই-তিন ঘণ্টা সময় আকাশে সূর্য দেখা যায়। আল্লাহপাক সব জেনে শুনেই কুরআনে বর্ণনা করেছেন, “আর তোমরা আহার করো ও পান করো যতক্ষণ তোমাদের জন্যে (রাত্রির) কালো রেখা থেকে ফজরের সাদা রেখা স্পষ্ট হয়ে যায়। এরপর রাত পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করো।” (সূরা বাকারাহ-১৮৭)।

সবাইকে মাহে রমজানের শুভেচ্ছা।

লেখক : সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।rahman.mridha@gmail.com

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us