বায়ু দূষণ ও ইসলাম

নাসিম ইমরান | Sep 22, 2022 09:20 pm
বায়ু দূষণ ও ইসলাম

বায়ু দূষণ ও ইসলাম - ছবি : সংগ্রহ

 

বায়ু দূষণ : শিল্প, যানবাহন, নগরায়ন, বর্জ্য নিষ্কাশনে অনিয়ম বায়ু দূষণের (Air pollution) কয়েকটি প্রধান কারণ। এ ছাড়াও মরুঅঞ্চলে ধুলোঝড় এবং বনে বা ঘাসে আগুন লাগার ফলে নির্গত ধোঁয়া বাতাসে রাসায়নিক ও ধুলিকণাজনিত দূষণ ঘটিয়ে থাকে।

কয়েকটি প্রধান বায়ু দূষণকারী পদার্থ হলো

১. কার্বন মোনো-অক্সাইড (CO) : সাধারণত যানবাহনের থেকে এই গ্যাসের উৎপত্তি। পেট্রোল, ডিজেল সহ নানা ধরনের কার্বন-যুক্ত জ্বালানি আধপোড়া হলে এই রঙবিহীন গন্ধবিহীন গ্যাসটি তৈরি হয়। সিগারেট বা কাঠ পোড়ালেও এই গ্যাস বের হয়।

এ গ্যাস মানুষের শ্বাসক্রিয়ার জন্য চূড়ান্ত ক্ষতিকারক। এই গ্য‌াস আমাদের রক্তে অক্সিজেন গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এই গ্য‌াসের প্রতিক্রিয়ায় সব সময় ঝিমোনো ভাব আসে। বিভিন্ন ব্য‌াপারে সিদ্ধান্তহীনতারও শিকার হতে হয়। এই গ্যাস বায়ুমণ্ডলের গ্যাসীয় ভারসাম্য বিঘ্নিত করে।

২. কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO2) : কলকারখানা বা যানবাহনে কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ানোর ফলে নির্গত হয় এই গ্যাস। এটি মানুষের নানা কর্মকাণ্ডের ফলে নির্গত প্রধান গ্রিন হাউস গ্যাস। পরিবেশের নেসেসারি ইভিল এই গ্যাসীয় উপাদানের অতিরিক্ত উপস্থিতি ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

৩. সালফার ডাই-অক্সাইড (SO2) : মূলত তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা পোড়ানোর ফলে এই গ্য‌াস নির্গত হয়। অন্যান্য শিল্পজাত প্রক্রিয়ার ফলেও এই গ্যাস নির্গত হয় যেমন কাগজ উৎপাদন পদ্ধতিতে, ধাতু গলানোর ক্ষেত্রে ইত্যাদি। এই গ্যাস অ্য‌াসিড বৃষ্টি এবং ধোঁয়াশা সৃষ্টির একটি প্রধান কারণ। সালফার ডাইঅক্সাইডের প্রভাবে ফুসফুসের নানা ধরনের জটিল রোগ হয়।

৪. ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (CFC) : মূলত ফ্রিজ ও এসি থেকে এই গ্য‌াস নির্গত হয়। বাতাসে এই গ্যাস নির্গত হওয়ার পরে স্ট্র্যাটেস্ফিয়ারে চলে যায়, সেখানে অন্যান্য গ্যাসের সংস্পর্শে আসে। এর ফলে ওজোন স্তর পাতলা হয়ে যায়। সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মির বিকিরণ থেকে রক্ষা পাওয়ার স্বাভাবিক ক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৫. সাসপেনডেড পার্টিকুলার ম্য‌াটার (SPM) : ধোঁয়া, ধুলা, বাষ্প এবং একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে বাতাসে ভেসে থাকা কঠিন পদার্থের কণাকে এসপিএম বলে। এটি বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। ধোঁয়াশা একটা অন্যতম কারণ এসপিএম। এসপিএম বেশি থাকলে দূরের জিনিস দেখার ক্ষেত্রে খুব অসুবিধা হয়। এই ধরনের পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা ফুসফুসে প্রবেশ করে শরীরের এই অন্যতম প্রধান অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে। নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসের ক্ষেত্রে সমস্যারও সৃষ্টি করে।

বায়ু দূষণের ফলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়, পরিবেশ এবং সম্পদও নষ্ট হয়। এর ফলে বায়ুমণ্ডলে ওজোন স্তর পাতলা হয়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে জলবায়ুর উপর এবং তা বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনেরও কারণ হয়। ইবনে কায়্যিম তাঁর 'তিব্বে নববী' গ্রন্থে বলেন, মহামারীর সক্রিয় কারণ ও হেতুগুলোর অন্যতম একটি হলো বায়ু দূষণ। ইবনে খালদুন মুকাদ্দিমায় বায়ু দূষণের সাথে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর সম্পর্ক উল্লেখ করেছেন।

বায়ু দূষণ ও ইসলাম : ইসলামে বায়ু দূষণ থেকে মুক্ত থাকার ব্যাপারে নির্দেশনা এসেছে। যার মাধ্যমে বায়ু দূষণের ক্ষতিকর বিষয় থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি। যেমন কষ্টদায়ক বস্তু সরানোর মাধ্যমে। রাস্তাঘাটে যদি কোনো কষ্টদায়ক বস্তু, বায়ু দূষণকারী পদার্থ থাকে, তাহলে তা সরানোর মাধ্যমে বায়ু দূষণরোধ করা যায়। হাদিসে বলা হয়েছে,
'ঈমানের তেহাত্তর বা তেষট্টিটি শাখা রয়েছে। ওসবের মধ্যে সর্বোত্তমটি হলো : লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা এবং সর্বনিম্নটি হলো রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা।'
(সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ৬০)

মু'আয ইবন জাবাল রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন,
'তোমরা অভিশাপ ডেকে আনে এরূপ তিনটি কাজ থেকে বিরত থাকো। চলাচলের রাস্তায়, রাস্তার মোড়ে অথবা ছায়াদার স্থানে মলমূত্র ত্যাগ করা থেকে।'
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং : ২৬)

আমাদের চলাচলের পথে মানুষের জন্য কষ্টদায়ক ও বিপদজনক অনেক বস্তু পড়ে থাকে। যেমন মরা জীবজন্তু, কাঁটা, ময়লা, কলার ছোলা, পিচ্ছিল পলিথিন, জলন্ত সিগারেটের কিয়দাংশ ইত্যাদি। ঈমানের দাবি হলো, এগুলো পথ থেকে অপসারণ করা। এ সব কষ্টদায়ক বস্তুর মধ্যে এমন উপাদান বা জীবাণু থাকতে পারে, যার দ্বারা বায়ু দূষিত হবে। রাসূলের এ হাদীসগুলো যদি বায়ু দূষণরোধের মূলনীতি হিসাবে ধরা যায় তাহলে বায়ুদূষণ রোধ করা সম্ভব।

কেউ মারা গেলে ইসলাম সাথে সাথে তাকে কবর দিতে বলে, যাতে পরিবেশের কোন ধরনের দূষণ না হয়। কুরআন থেকে জানা যায়, যে জিনিসটা পঁচে যায় তা মরে যাওয়ার পর মাটিতে পুঁতে ফেলতে হয়। যেমন কাবিল যখন হাবিলকে হত্যা করে তখন দুটি কাক সেখানে আসে আর তাদের একজন আরেকজনকে হত্যা করে এবং মৃত কাককে দাফন করে ফেলে তা দেখে কাবিল মাটি দিয়ে হাবিলকে ঢেকে ফেলে। এব্যাপারে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
'অতঃপর আল্লাহ এক কাক পাঠালেন, যে তার ভাইয়ের শবদেহ কিভাবে গোপন করা যায় তা দেখাবার জন্য মাটি খনন করতে লাগল।'
(সুরা মায়েদা, আয়াত : ৩১)

অতএব কুরআন এই নির্দেশনা দিচ্ছে যে কেউ মারা গেলে তাকে মাটির নিচে কবরস্থ করতে হয়। ইসলাম শুধুমাত্র মৃত লাশকে দাফন করতে বলে না বরং ইসলাম অন্যান্য পচা-দুর্গন্ধ বস্তুকে মাটিতে পুঁতে দেয়ার ব্যাপারে বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান করেছে।

বায়ু দূষণ রোধে জাবির রা. থেকে বর্ণিত হাদীসটি এখানে প্রণিধানযোগ্য। রাসূল সা. বলেন,
'যে ব্যক্তি কাঁচা পেঁয়াজ খাবে, সে যেন আমাদের থেকে অথবা আমাদের মসজিদ থেকে দূরে থাকে এবং ঘরে বসে থাকে।'
(সহীহ বুখারি, হাদিস নং : ৫৪৫২)

ইসলাম শুধুই বস্তুজগতের ক্ষতিকে দূষণের মাপকাঠি মনে করে না বরং আত্মিক ক্ষতিকেও দূষণের মাপকাঠি মনে করে। তাই তো সুঘ্রাণ হওয়া সত্তেও ইসলাম নারীর সুগন্ধি ব্যবহার করে বহির্গমণকে পরিবেশ দূষণ হিসেবে দেখেছে। হাদীসে এ জাতীয় দূষণের ভয়াবহতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। আবূ মূসা আল-আশ'আরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন,
'যেকোনো মহিলা সুগন্ধি বা পারফিউম ব্যবহার করে, অতঃপর মানুষের সামনে দিয়ে অতিক্রম করে, যাতে তারা তার সুবাস পায় সে একজন ব্যভিচারিণী।'
(জামে তিরমিজি, হাদিস নং : ২৭৮৬)

সত্যিই উন্মুক্ত স্থানে বা রাস্তাঘাটে নারীর সুগন্ধি ব্যবহার এমন এক দূষণ, যা খাটি মুত্তাকিদের ঈমানের স্বচ্ছতাকে কর্দমাক্ত করে এবং পরিবেশ বিপর্যয় করে। যদিও সুগন্ধির প্রতি দুর্বলতা, সুগন্ধি ছড়ানো এবং অন্যকে তা উপহার প্রদান পরিবেশ উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। বরং ইসলাম এর প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে। যেমন আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করিম সা. বলেন,
'যার সামনে সুগন্ধি উপস্থাপন করা হয় সে যেন তা প্রত্যাখ্যান না করে। কারণ তা বহনে হালকা এবং বাতাসকে সুবাসিত করে।'
(সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ৫৮৩৫)

নবী করিম সা. যখন সিংগা দিতেন অথবা লোম পরিষ্কার করতেন, নখ কাটতেন তখন তিনি তা বাকীউল গারকাদ কবরস্থানে পাঠাতেন, তারপর তা পুঁতে ফেলা হতো।
(আখলাকুন নবী, ৩৫৯)

আমরা অনেক সময় হাঁচি, কাশি দেয়ার সময় মুখ ঢেকে রাখি না। এতে নির্গত ময়লা ও জীবাণু দ্বারা অন্যরা আক্রান্ত হতে পারে। এ ব্যাপারে মহানবী সা.-এর বিশেষ আচরণ বর্ণিত হয়েছে। আবূ হুরায়রা রা. বলেন, মহানবী সা. যখন হাঁচি দিতেন তখন এক টুকরা কাপড় বা নিজ হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলতেন এবং নিম্ন আওয়াজ করতেন।
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং : ৪৯৪৫)

লেখক : গবেষণা বিভাগ, সেন্টার ফর ইসলামিক থট এ্যান্ড স্টাডিজ
nasimuzzamanimran@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us