সেই প্রাগে

ওহিদুল ইসলাম | Mar 15, 2023 02:59 pm
সেই প্রাগে

সেই প্রাগে - ছবি : সংগ্রহ

 

চেক উচ্চারণে শব্দটি Praha (প্রাহা), ইংরেজিতে Prague (প্রাগ), চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী। চেক ভাষা যতটা শুনেছি বেশ কাব্যিক ও শ্রুতিমধুর মনে হয়েছিল। জার্মান ভাষায় কোনো শহরের কেন্দ্রীয় রেল স্টেশনকে বলা হয় Hauptbahnhof, চেক ভাষায় এটা আরো কাব্যিক। প্রাগ কেন্দ্রীয় রেল স্টেশনকে চেক ভাষায় বলা হয়- Praha Hlavni Nadrazi.

আমরা যখন প্রাগ পৌঁছাই তখন রাত ৯টা। ন্যুরেমবার্গ, জার্মানি হতে ট্রেনে গিয়েছিলাম আমরা। প্রায় পাঁচ ঘণ্টার জার্নি। মাঝখানে শেভ স্টেশনে ট্রান্সফার ছিল। ট্রান্সফার হচ্ছে বিমানের কানেক্টিং ফ্লাইটের মতো। গন্তব্যে পৌঁছতে হলে মাঝখানের ট্রানজিট স্টেশনে নেমে ট্রেন পরিবর্তন করে নির্ধারিত ট্রেনে উঠতে হয়। ইউরোপের সর্বত্র ট্রেন ব্যবস্থা একই। সুন্দর চমৎকার! বুলেট ট্রেন চলে প্রায় ৩০০ কিমি স্পিডে। ভাড়াও অনেক বেশি, বিমানের চেয়েও বেশি ভাড়া পড়ে অনেক সময়। বিমানের মতো এখানে ট্রেনের ভাড়াও বেশ উঠানামা করে। মাঝে দুই একবার ট্রান্সফার নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েছিলাম। পরে জানলাম ট্রেন নাম্বার না মিললেও গন্তব্য ও সময় মিল থাকলে ট্রেনে উঠে যেতে হবে। অনেক সময় নির্দিষ্ট ট্রেন বাতিল হয় কারিগরি ত্রুটি বা বিবিধ কারণে।

স্টেশন হতে ট্রামের টিকেট কাটলাম দুজনের। আমরা দুজনই গিয়েছিলাম প্রাগ। আমার সাথে ছিলেন আমার এক সহকর্মী, যিনি নির্বাহী প্রকৌশলী। ভাড়া ৬০ ক্রোনার। এখানে নগদ লেনদেন আবার ইউরো তে হয় না। ক্রেডিট কার্ডে পে করলাম। স্টেশন হতে বের হতেই শীতে বেশ কাবু, ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সাথে হিমহিমে বাতাস। অবশ্য জার্মানিতে মাইনাস ৩ ডিগ্রি হজম করার অভিজ্ঞতা ছিল বলে মনে সাহস ছিল। স্টেশনের বাইরে সুন্দর একটি পার্ক। পার্ক পেরিয়ে দেখি ট্রাম আসছে। উঠে পড়লাম বিসমিল্লাহ বলে। ড্রাইভারকে হোটেলের ম্যাপ দেখালাম। সে কয়েক মিনিট পর নামিয়ে দিলো। সেখান থেকে গুগল ম্যাপ দেখে পাঁচ/সাত মিনিটের মধ্যে হোটেল খুঁজে বের করে ফেলি।
ইউরোপে রিসিপশনিস্টবিহীন কিছু হোটেল থাকে যেগুলোতে আপনি বুকিং (অগ্রিম পেমেন্টসহ) দিলে কী কোড পাঠিয়ে দিবে মেইলে। হোটেলের গেটে গিয়ে সেই কী কোড চাপলে চাবির বাক্স খুলে যাবে এবং নির্দিষ্ট চাবি দিয়ে আপনার জন্য নির্দিষ্ট কক্ষ খুলে আপনি আপনার প্রাপ্য আবাসন সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। আমাদের হোটেলটিও এমনই ছিল। সব কিছু বেশ সুন্দর ছিল। তবে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে এমন স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার হোটেল নিয়ে বেশ বিপদে পড়েছিলাম, সেই গল্প অন্যদিন বলা যাবে।

এই চেক প্রজাতন্ত্র, এই প্রাগ/প্রাহা এক সময় ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। উসমানিয়া আক্রমণও হয়েছিল চেকোস্লাভিয়ার মোরাভিয়ায়। তবে হাঙ্গেরিতে সফলতা পেলেও উসমানিয়ারা এখানে সুবিধা করতে পারেনি নানাবিধ কারণে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধকল সামলে অস্ট্রো হাঙ্গেরি হতে আলাদা হয়ে এটি প্রথমে চেকোস্লাভাকিয়া ও পরে চেক প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য ভেঙ্গে চেকোস্লাভাকিয়া পৃথক হওয়ার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে হয় হিটলারি বুদ্ধির শিকার। হিটলারি বুদ্ধির সেই গল্পটাই আজ প্রথমে বলি।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর চেক ও স্লাভ দুই পৃথক জাতিগোষ্ঠী নিয়ে গঠিত হয় চেকোস্লাভাকিয়া যেখানে পরাজিত জার্মানি হতে দখল করা কিছু ভূমিও ছিল। ১৯৩৮ সাল, তখন এডলফ হিটলারের ভয়ে কম্পমান ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়াসহ বৃহৎ শক্তিগুলো। ঘরে একজন অবুঝ বা মেজাজি হলে সবাই যখন তাকে একটু ছাড় দেয় বা দিতে বাধ্য হয় তেমনি হিটলারের মেজাজ মর্জিকে সমঝে চলতো ফ্রান্স, বৃটেন ও রাশিয়া। তাই হিটলার যখন গোঁ ধরলেন যে জার্মানির দখল করা ভূমি জার্মানিকে ফেরত দিতে হবে তখন ঐতিহাসিক মিউনিখ চুক্তির মাধ্যমে সাদেতেনল্যান্ড নামক ভূখণ্ডটি জার্মানিকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। চেকোস্লাভিয়ার ভূমি জার্মানিকে ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়ে চেকোস্লাভিয়াকে জানানোর প্রয়োজনও মনে করেনি কেউ।

চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলিন, ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী দালাদিয়ে, ইতালির একনায়ক মুসোলিন ও জার্মানির তখনকার মা বাপ এডলফ হিটলার উপস্থিত থাকলেও ছিল না খোদ চেকোস্লাভাকিয়ার পক্ষ থেকে কেউ। হিটলারকে চটানোর ঝুঁকি নিতে চায়নি কেউ।

কিন্তু হিটলার থেমে থাকলে তো! হিটলার ভাবলেন, 'চেক দখল করা এক ঘণ্টার মামলা, এই অহেতুক চুক্তির দরকার কী!' তবে সরাসরি দখল করার আগে হিটলারি বুদ্ধিই প্রয়োগ করলেন। ছয় মাসের মাথায় চেক প্রেসিডেন্ট মিস্টার হাঁচাকে জার্মানিতে নিমন্ত্রণ করলেন এডলফ হিটলার। এয়ারপোর্টে প্রেসিডেন্টকে দেয়া হলো রাজকীয় সংবর্ধনা যা বিশ্ব মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার হলো। মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করা হলো দামি রাজকীয় খাবার সহযোগে। তারপরই আসল খেলা শুরু।

আগে থেকে সুন্দরভাবে লিখিত একটি চুক্তিপত্র দেয়া হলো প্রেসিডেন্ট হাঁচার কাছে স্বাক্ষরের জন্য যে চুক্তিপত্রের কপি, তার মূল কথা হচ্ছে চেকোস্লাভাকিয়া দেশটি জনস্বার্থ, ভবিষ্যত সমৃদ্ধি ও মর্যাদা বিবেচনায় সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় বিলীন হয়ে জার্মানির সাথে সংযুক্ত হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট হাঁচা ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলেন। হিটলারের সামরিক উপদেষ্টা এসে জানিয়ে গেলেন, 'প্রিয় ফুরারে, আপনি আদেশ করলে এক ঘণ্টার মধ্যে প্রাগ দখলে নিবে বিমান বাহিনী।' আর প্রেসিডেন্ট হাঁচাকে উদ্দেশ করে বললেন, 'আর ওই গর্দভকে মারতে একটির বেশি বুলেট খরচ করা হবে না।'

প্রেসিডেন্ট হাঁচা এবার সংজ্ঞাহীন হয়ে গেলেন। ডাক্তার এসে ইনজেকশন পুশ করে আবার জাগিয়ে দিয়ে গেল। বেচারা প্রেসিডেন্ট হাঁচা, আগে নিজের প্রাণ বাঁচা। বাধ্য হয়ে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করলেন। হিটলারের স্মার্ট তথ্য উপদেষ্টাদের কল্যাণে পরদিন বিশ্বমিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হলো- চেকোস্লাভাকিয়া স্বেচ্ছায় বিলীন হয়ে জার্মানির সাথে একীভূত হয়েছে। ব্রিটেন ও ফ্রান্স ঘটনা বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু চুপ থাকা ছাড়া তখন উপায় ছিল না, হিটলারকে ঘাঁটানোর সাহস হয়নি কারোই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে যখন সোভিয়েত ও মার্কিন সেনারা জার্মানিতে প্রবেশ করে তখন প্রাগ বিদ্রোহের মাধ্যমে চেকোস্লাভাকিয়া আবার স্বাধীনতা ফিরে পায়। ১৯৯৩ সালে দেশটি শান্তিপূর্ণভাবে পৃথক দুটি জাতি গোষ্ঠী নিয়ে চেক প্রজাতন্ত্র এবং স্লোভাকিয়া নামক দুটি দেশে বিভক্ত হয়ে যায়।

চেক প্রজাতন্ত্র হতে আমরা পরের দিনই ফিরে আসি জার্মানিতে। প্রাগ শহরটি বেশ সুন্দর। প্রচুর শীত থাকলেও আমরা প্রাগ শহরটি দেখতে বের হই ট্রামে চড়ে। মানুষজনও দেখি। এরা দেখতে জার্মানদের তুলনায় সুন্দর মনে হলো। উন্নত গ্রীবাদেশ, গড়পড়তা উচ্চতাও জার্মানদের চেয়ে বেশি। আরেকটি বিষয় উপলব্ধি করলাম, এখানে দ্রব্যমূল্য ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেকটাই কম। চার্লস ব্রিজ দেখে ফিরতি ট্রেন ধরার জন্য স্টেশনে আসি। ফিরতি যাত্রায়ও ট্রান্সফার আছে শনডর্ফ স্টেশনে।

ট্রেন হতে দেখি চেকের আরেক রূপ। ফেরার সময় যেহেতু দিনের আলো ছিল সব দেখেছিও প্রাণভরে। ছোট ছোট পাহাড়ের কোলে সুন্দর সুন্দর একতলা বা ডুপ্লেক্স বাড়ি। কোথাও বড় ফার্ম হাউজ, শীত শেষে আসন্ন বসন্তের কৃষি ফলনের প্রস্তুতি চলছে। মাঝে মাঝে দেখা যায় পাহাড়ের পাদদেশে স্বচ্ছ প্রবাহমান ঝর্ণা, কোথাও কোথাও লেকের মতো জলাশয়। একটু পর পর চোখে পড়ে বায়ু চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র। আবার ছোট পাহাড়ের সারি। ক্লান্তিহীন চোখে দেখেই যাই, দেখেই যাই।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us