মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় ব্ল্যাক হোল

জি. মুনীর | May 15, 2019 01:16 pm
মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় ব্ল্যাক হোল

মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় ব্ল্যাক হোল - ছবি : সংগ্রহ

 

ব্ল্যাক হোল। বাংলায় কৃষ্ণগহ্বর। এটি মহাবিশ্বের এক অপার রহস্য। বলা হয়, এ রহস্যে শেষ নেই। তবে এ রহস্য উদঘাটনে মানুষের আগ্রহেরও কমতি নেই। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এর নানা রহস্য উদঘাটনে। এরই মধ্যে আমরা ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে কিছুই জানতে পেরেছি। সম্প্রতি ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে জানার ব্যাপারে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ১০ এপ্রিল ২০১৯ জোতির্বিজ্ঞানীরা এই প্রথম কোনো ব্ল্যাক হোলের ছবি তুলে দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। ব্ল্যাক হোলের এই প্রথম ছবি সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকী ‘দ্য অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল জার্নাল লেটারসে’।

ফেরায়েল ওজেল হচ্ছেন অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট (জোতির্বিদ্যাবিষয়ক পদার্থবিদ) এবং ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ (ইএইচটি) গবেষণা দলের কলাবরেটর। প্রকাশিত ছবি সম্পর্কে এই নারী বিজ্ঞানী বলেন, ব্ল্যাক হোলটি এর চার পাশের আলো শোষণ করে নিচ্ছিল। এই আলো আসছিল উত্তপ্ত গ্যাস থেকে, যা এর চার পাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। আর তা ব্ল্যাক হোলের ভেতরে পড়ার পর তা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। অতএব যতক্ষণ তা ব্ল্যাক হোলের ভেতরে প্রবেশ না করে, ততক্ষণ আমাদের টেলিস্কোপ আলোর ছবি তুলতে সক্ষম হয়। কিন্তু এটি ব্ল্যাক হোলের ঠিক বাইরের দিকের ছবি। যখন আলো ইভেন্ট হরাইজনের ভেতরে পড়ে, ছবিতে সে অংশটি কালো। একটি ঘূর্ণিপাকের মতো ব্ল্যাক হোলের চার পাশের ঘুরপাক খাওয়া বস্তু প্রধানত সমতলিক। বৈজ্ঞানিকেরা এর নাম দিয়েছেন অ্যাক্রিশন ডিস্ক। এই অ্যাক্রিশন ডিস্ক ব্যাপক এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এ থেকে বের হয় ব্যাপক জ্বালানি শক্তি, যা কসমস বরাবর আলো ছড়ায়। কিন্তু আণবিক বিস্ফোরণের সময় ছবি তোলা মাশরুমের ছবি তোলার মতো। বিজ্ঞানীরা সবসময় প্রয়াস চালিয়ে আসছেন অ্যাক্রিশন ডিস্কের ভেতরের অবস্থা জানতে। তারা আসলে জানতে চান ব্ল্যাক হোলের ভেতরের বস্তুতে আসলে কী ঘটে।

১৯৯৩ সালে নেদারল্যান্ডসের রদবাউদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেইনো ফালকে প্রথম কৃষ্ণগহ্বরের ছবি তোলার প্রস্তাব করেন। তা সম্ভব হবে, এমনটি তখন কেউ বিশ্বাস করেননি। গত ১০ এপ্রিল একটি গবেষক বিজ্ঞানী দল ব্ল্যাক হোলের প্রথম ছবি তুলে সেটাকে সম্ভব করেন। এই আইকনিক ছবির মাধ্যমে বিশ্বের মানুষ প্রথম দেখতে পেল ব্ল্যাক হোলের সেই গ্যাস আর আবর্জনার এক জগতকে, যা এর ইভেন্ট হরাইজনের চার পাশে ঘুরপাক খাচ্ছে অনবরত। যে ঘূর্ণিপাকের আবর্তে পড়ে সবকিছুই অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। এই ছবি প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানীদের এক দশকব্যাপী গবেষণা উদ্যোগের ইতিবাচক সমাপ্তি ঘটল। গবেষকেরা ১০ দিন ধরে একটানা কাজ করেন এ ছবি তুলতে। গবেষকদের নজর ছিল মেসিয়ে ৮৭ (এম৮৭) নামের আমাদের কছাকাছি ছায়াপথ ও এর কেন্দ্রে থাকা সুপারমেসিভ ব্ল্যাক হোলের অবস্থানের ওপর। ব্ল্যাক হোলটি পৃথিবীর চেয়ে ৩০ লাখ গুণ বড়। এর ভর সূর্যের চেয়ে ৬৫০ কোটি গুণ বেশি। আকারের কারণেই এটির অবস্থান পৃথিবী থেকে পাঁচ কোটি ৩০ লাখ কিলোমিটার দূরে।

গত এক দশক ধরে ইএইচটি এই উচ্চাকাক্সক্ষী প্রকল্প সম্প্রসারণ করে আসছে। ২০১৭ সালে ৫-১১ এপ্রিলে ইএইচটি পর্যবেক্ষণ করে এম৮৭। এতে ব্যবহার করা হয় আটটি স্থানে রাখা আটটি রেডিও টেলিস্কোপ। এই স্থানগুলো হচ্ছে : যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা, চিলি, যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই, মেক্সিকো, দক্ষিণ মেরু ও স্পেন। ২০টি দেশের ৫৯টি ইনস্টিটিউটের ২০০ সদস্য বছরের পর বছর ধরে গবেষণার পর এ পর্যবেক্ষণের অভিন্ন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি একীভূত করেন।

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর ফেভারিট বিষয় ব্ল্যাক হোলকে এর মাধ্যমে নামিয়ে আনা হলো বাস্তবতার জগতে। এটি সম্ভব হয়েছে ‘ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ’ (ইএইচটি) ব্যবহারের মাধ্যমে। তবে একক কোনো টেলিস্কোপের পক্ষে এ ছবি তোলা সম্ভব হয়নি। এ জন্য আটটি টেলিস্কোপ একসাথে ব্যবহার করা হয়। ইমেজ ডাটা সংগ্রহ করা হয় ২০১৭ সালে, কিন্তু বিজ্ঞানীরা দুই বছর কাটিয়েছেন এ ছবির টুকরো অংশগুলো একসাথে করতে। এর কারণ, ইএইচটি সাজানো হয়েছে আটটি স্বতন্ত্র মানমন্দিরে বা অবজারভেটরিতে। এসব অবজারভেটরিা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিশ্বের নানা জায়গায়। এগুলো একে অপরের সাথে সহযোগিতা গড়ে তুলে যৌথভাবে কাজ করে একটি বড় ধরনের ডিটেকটর হিসেবে। শেফ ডোয়েলেম্যান হচ্ছেন এই ইএইচটির ডিরেকটর।

ব্ল্যাক হোল আসলে কী
মহাবিশ্বে মানুষের কাছে ব্ল্যাক হোল হচ্ছে সবচেয়ে বেশি কৌতূহলোদ্দীপক বস্তু। ব্ল্যাক হোল নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। কিছু প্রশ্নের উত্তর আমরা অবশ্য জানতে পেরেছি। তবে অজানা প্রশ্নের সংখ্যাই বেশি। এর মধ্যে আছে কিছু তাত্ত্বিক প্রশ্নও। এগুলোর সূত্র ধরে সৃষ্টি হয়েছে বিজ্ঞানের অনেক কল্পকাহিনী। তাই বলা যায়, সত্যিকার অর্থে ব্ল্যাক হোলের বেশির ভাগ দিক এখনো আমাদের কাছে অজানাই রয়ে গেছে।
আমাদের জানা মতেÑ ব্ল্যাক হোলগুলো মৃত তারার ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই নয়। কেউ বলেন, ব্যাক হোল হচ্ছে মৃত তারার লাশ। কারণ, তারার ধ্বংসের মধ্য দিয়েই ব্ল্যাক হোলের সৃষ্টি। তবে সব তারাই ব্ল্যাক হোলে রূপান্তিরিত হয় না। শুধু সেইসব তারাই ব্ল্যাক হোলে রূপ নেয়, যেগুলো সূর্যের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ গুণ বড়। বড় বড় তারা বিস্ফোরিত হয়ে নিজের মৃত্যু ঘটায়। একটি তারার ভেতরের জ্বালানি ফুরিয়ে গেলেই এমনটি ঘটে। এই প্রক্রিয়ার নাম সুপারনোভা বিস্ফোরণ। একটি তারার মৃত্যু হলেইএই বিস্ফোরণ ঘটে।
তারাগুলো দ্রুত ঘুরতে থাকে, এমনকি একটি তারার মৃত্যুর পরও তা ঘুরপাক খেতে থাকে। এর অর্থ -এগুলো ব্ল্যাক হোলের ভেতরে যাওয়ার পরও ঘুরতে থাকে। ব্ল্যাক হোলে এই ঘুরপাকের কাজ চলে আরো দ্রুততর গতিতে, এমনকি এর এটি বাষ্পীভূত হওয়ার সময়ে। শেষ পর্যন্ত তা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে প্ল্যাঙ্ক লেন্থে পরিণত হয়। প্ল্যাঙ্ক লেন্থ অর্জনের পরও এটি ঘুরতে থাকে। এই ঘূর্ণন ও গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্সবরাবর এর চার পাশের অর্থাৎ এর ইভেন্ট হরাইজনের সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। প্ল্যাঙ্ক লেন্থ ও ইভেন্ট হরাইজন প্রসঙ্গে একটু পড়ে আসছি। কোনো বস্তু যদি আলোর গতির চেয়ে বেশি গতি নিয়ে চলতে পারে, তবে সেই বস্তু ব্ল্যাক হোল থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবে। তবে আজ পর্যন্ত মানুষ এমন গতিসম্পন্ন কোনো বস্তুর কথা জানতে পারেনি। সোজা কথায় আলোর চেয়ে বেশি গতি নিয়ে কোনো কিছুই চলতে পারে না।

শিল্পীর আঁকাঈুমহঁং ঢ-১ নামের ব্ল্যাক হোলের চিত্র
ব্ল্যাক হোল হচ্ছে এমন একটি জায়গা, যেখানে এর গ্র্যাভিটি বা আকর্ষণ বল এতটা বেশি যে আলো পর্যন্ত এই গ্র্যাভিটির টানের বাইরে থাকতে পারে না। একটি তারার নিউক্লিয়ার ফিউশনের মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হয় ব্ল্যাক হোলের শক্তি ও আকর্ষণ বল। এ আকর্ষণ বল অকল্পনীয়ভাবে অতিমাত্রায় বেশি হওয়ায় ব্ল্যাক হোল কোনো বড় বস্তুকেও সঙ্কুচিত করে একটি ছোট্ট স্থানে নিয়ে যেতে পারে। যেহেতু কোনো আলো ব্ল্যাক হোল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না, সেজন্য মানুষ কোনো ব্ল্যাক হোল দেখতে পায় না। তাই ব্ল্যাক হোলগুলো অদৃশ্য। বিশেষ যন্ত্রসমৃদ্ধ টেলিস্কোপ ব্ল্যাক হোল খুঁজে পেতে আমাদের সাহায্য করতে পারে। এই বিশেষ যন্ত্র দেখতে পারে, কী করে ব্ল্যাক হোলের কাছের তারাগুলো অন্যান্য তারার চেয়ে আলাদাভাবে কাজ করে।

প্রতিটি ব্ল্যাক হোলের রয়েছে একটি ইভেন্ট হরাইজন। এর সম্পর্কে রয়েছে গভীর বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন। তবে সাধারণভাবে বলা যায়, ইভেন্ট হরাইজন হচ্ছে ব্ল্যাক হোলের বাউন্ডারি বা সীমানা, যেটিকে বলা যায় ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’। এ সীমানার বাইরে থাকলে সব কিছুই ব্ল্যাক হোল থেকে নিরাপদ। কিন্তু কোনো কিছু ইভেন্ট হরাইজন নামের এই সীমানার ভেতরে কোনো ক্রমে ঢুকে পড়লে আর রক্ষা নেই। সোজা ঢুকে পড়তে হবে ব্ল্যাক হোলের পেটে। তাকে ব্ল্যাক হোলের ভেতর চিরদিনের জন্য হারিয়ে যেতে হবে। সেখান থেকে ফিরে আসার কোনো সুযোগ নেই। একজন মানুষ যদি ঘটনাক্রমে এই ইভেন্ট হরাইজন অতিক্রম করে, তবে তার পরিণতি একই হবে। আমরা বলতে পারি, আসলে ইভেন্ট হরাইজন থেকেই ব্ল্যাক হোলের শুরু।
একটি ব্ল্যাক হোলে বস্তুর ঘনত্ব হচ্ছে মানুষের জানা সব বস্তুর ঘনত্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এই ঘনত্ব যে কত বেশি তা অনুমান করতে একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ধরা যাক, আপনি কোনো উপায়ে পৃথিবীর সব বস্তুকে সঙ্কুচিত করে এমন একটি বলের ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন, যার ব্যাস ৯ মিলিমিটার। ভাবুন তো, তখন এই বলের ভেতরের বস্তুর ঘনত্ব কত বেশি হতে পারে। ব্ল্যাক হোলের ভেতরের বস্তু ঘনত্ব অনেকটা এমন।
একটি ব্ল্যাক হোল অব্যাহতভাবে বেড়ে চলতে পারে। কারণ, ইভেন্ট হরাইজনের ভেতর যেসব গ্যাস, তরল ও কঠিন পদার্থ শুষে নেয়া হয়, তা ব্ল্যাক হোলকে ক্রমেই বড় আকার দিতে থাকে। অনেক বড় আকারের ব্ল্যাক হোলই পরিচিত সুপারমেসিভ ব্ল্যাক হোল নামে। আবার একটি ব্ল্যাক হোল ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে একটি ইলেকট্রনের (সাব-অ্যাটোমিক পার্টিকল) আকারও ধারণ করতে পারে। এ অবস্থায় যে আকারে পৌঁছে তাকে প্ল্যাঙ্ক লেন্থ বলা হয়। এই দৈর্ঘ্যকে বলা হয় কোয়ান্টাম সাইজ লিমিট। তাত্ত্বিকভাবে এর চেয়ে ছোট কোনো আকার হতে পারে না। আসলে প্ল্যাঙ্ক লেন্থ মাপার কোনো উপায়ও নেই। প্ল্যাঙ্ক লেন্থের পরিমাণ হচ্ছে ১.৬১৬১৯৯২৬ী১০-৩৫ মিটার।

একটি ব্ল্যাক হোল ছোট কিংবা বড় হতে পারে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, একটি ছোট আকারের ব্ল্যাক হোল ঠিক একটি অণু বা অ্যাটমের আকারের মতো ছোট হতে পারে, তবে এর সধংং বা ভর হতে পারে একটি বড় পাহাড়ের ভরের সমান। বিজ্ঞানের ভাষায়, ভর একটি বস্তুতে থাকা পদার্থ বা উপাদানের পরিমাণ। ওজন বা ওয়েট শব্দটির সাথে এর পার্থক্য আছে। ওজন হচ্ছে একটি বস্তু কতটুকু ভারী তার পরিমাণ।
আরেক ধরনের ব্ল্যাক হোলের নাম ংঃবষষধৎ সধংং ব্ল্যাক হোল। এর ভর ২০টি সূর্যের ভরের চেয়েও বেশি হতে পারে। এগুলোর সংখ্যা অনেক। পৃথিবীর গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের মধ্যেই রয়েছে অনেক স্টেলার ব্ল্যাক হোল। পৃথিবীর গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের নাম মিল্কি ওয়ে, যা বাংলায় আমাদের কাছে ছায়াপথ নামে পরিচিত।
অন্য দিকে বড় বড় ব্ল্যাক হোলকে বলা হয় সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল। এ ধরনের একটি ব্ল্যাক হোলের ভর ১০ লাখ সূর্যের সম্মিলিত ভরের চেয়েও বেশি। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন, প্রতিটি বড় ছায়াপথের কেন্দ্রে থাকে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল। মিল্কি ওয়ে তথা পৃথিবীর ছায়াপথের কেন্দ্রে থাকা সুপারমেসিভ ব্ল্যাক হোলকে বলা হয় ঝধমরঃঃধৎরঁং অ। এর ভর ৪০ লাখ। শিল্পীর আঁকা মিলকিওয়ে নামে পৃথিবীর ছায়াপথ সূর্যের ভরের সমান। এটি এমন বড় আকারের একটি বলের ভেতর রাখা যাবে, যার মধ্যে রাখা সম্ভব কয়েক লাখ পৃথিবী।

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, একদম ছোট ছোট ব্ল্যাক হোল গঠিত হয়েছিল তখন, যখন সৃষ্টি হয়েছিল এই মহাবিশ্ব। স্টেলার ব্ল্যাক হোলগুলো তৈরি হয়েছিল তখন, যখন প্রতিটি বড় তারার মৃত্যু ঘটে। যখন তা ঘটে, তখন সৃষ্টি হয় একটি সুপারনোভা। সুপারনোভা হচ্ছে একটি বিস্ফোরিত তারা। তারা বিস্ফোরিত অংশ মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ছায়াপথ সৃষ্টির সাথে সাথেই সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলগুলোর সৃষ্টি।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক- ব্ল্যাক হোল যদি সত্যিই ব্ল্যাকই হয়ে থাকে, তবে বিজ্ঞানীরা কী করে এগুলোর উপস্থিতি জানতে পারলেন? ব্ল্যাক হোলের গ্রাভিটি বা নিজের দিকে শক্তিশালী আকর্ষণের কারণে এটি আলোও টেনে নিয়ে যায় এর মধ্যভাগে। সেজন্যই ব্ল্যাক হোলগুলো দেখা যায় না। কিন্তু বিজ্ঞানীরা দেখতে পারেন, কিভাবে ব্ল্যাক হোলের চার পাশের তারা ও গ্যাসের ওপর ব্ল্যাক হোলের প্রভাব কাজ করে। বিজ্ঞানীরা তারাকে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন- এগুলো এর চার পাশে উড়ে চলেছে, না একটি ব্ল্যাক হোলকে প্রদক্ষিণ করছে। যখন একটি তারা ও একটি ব্ল্যাক হোল কাছাকাছি আসে, তখন হাই-এনার্জি লাইট সৃষ্টি হয়। এ ধরনের আলো মানুষের পক্ষে খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীরা মহাকাশে উপগ্রহ ও টেলিস্কোপ ব্যবহার করেন এই হাই-এনার্জি লাইট দেখতে। সেভাবেই তারা সম্ভব করে তুলেছেন ব্ল্যাক হোলের উপস্থিতি জানাকে।
ব্ল্যাক হোল কি আমাদের পৃথিবীকে ধ্বংস করে দিতে পারে? তারা, চাঁদ ও পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহ খেয়ে সাবাড় করতে ব্ল্যাক হোলগুলো মহাকাশে ঘুরে বেড়ায় না।

পৃথিবী কখনোই ব্ল্যাক হোলের ভেতরে পড়বে না। কারণ, সৌরজগতে প্রবেশের সুযোগ ব্ল্যাক হোলের নেই। এমনকি সূর্যের সমান ভরের একটি ব্ল্যাক হোল যদি সূর্যের স্থান দখল করত, তখনো পৃথিবী ব্ল্যাক হোলের ভেতরে পড়ত না। তখন ওই ব্ল্যাক হোলের গ্রাভিটি বা আকর্ষণ বল হতো সূর্যের সমান। ফলে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহগুলো ওই ব্ল্যাক হোলের চার পাশে নিজ নিজ কক্ষপথে ঠিক সেভাবেই প্রদক্ষিণ করত, ঠিক যেভাবে প্রদক্ষিণ করছে সূর্যের চার পাশে। আর সূর্য কখনোই পরিণত হবে না একটি ব্ল্যাক হোলে।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা কৃত্রিম উপগ্রহ ও টেলিস্কোপ ব্যবহার করছে ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে জানার কাজে। এসব কৃত্রিম উপগ্রহ ও টেলিস্কোপ মহাকাশে পরিভ্রমণ করে চলেছে। মহাকাশযানগুলো বিজ্ঞানীদের সহায়তা করছে মহাবিশ্ব সম্পর্কিত নানা প্রশ্নের উত্তর জানার কাজে।

মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্ল্যাক হোল
একটি ব্ল্যাক হোলের আকার ও ভর সরাসরি আনুপাতিক। এর আকার যত বড় হবে, ভরও তত বেশি হবে। তবে ব্ল্যাক হোলের আকার আসলে সরাসরি মাপা সম্ভব নয়। তবে তা মাপার বিকল্প উপায় আছে। এটি পরিচিত ঝপযধিৎুংপযরষফ জধফরঁং নামে। এটি হচ্ছে ব্ল্যাক হোলের ইভেন্ট হরাইজনের ব্যাসার্ধ। ব্ল্যাক হোলের এ ব্যাসার্ধ যত বেশি বড় হবে, ব্ল্যাক হোলের আকারও তত বেশি হবে। আর ব্ল্যাক হোল যত বেশি বড় হবে এর ভেতরের বস্তুও ঘনত্ব তত বেশি বড় হবে। এর অর্থ একটি বড় ব্ল্যাক হোলের পয়েন্ট অব সিঙ্গুলারিটির ভর অপেক্ষাকৃত ছোট ব্ল্যাক হোলের সিঙ্গুলারিটির ভরের চেয়ে বেশি হবে। অন্য কথায় যে ব্ল্যাক হোলের ঝপযধিৎুংপযরষফ জধফরঁং যত বেশি, সেটি তত বেশি বড় ব্ল্যাক হোল।

জোতির্বিদেরা মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় ও উজ্জ্বল ব্ল্যাক হোল আবিষ্কার করেছেন। বলা হচ্ছে, এটি একটি প্রাচীন দানব। এর ভর, অর্থাৎ, এর ভেতরে থাকা বস্তুর পরিমাণ একটি সূর্যের তুলনায় ১২০০ কোটি গুণ বেশি। এর সৃষ্টি হয় তখন, যখন মহাবিশ্বের বয়স ১০০ কোটি বছরের মতো। গবেষকেরা বলেন, এটি সত্যিই রহস্যজনকÑ কী করে তুলনামূলকভাবে এত কম সময়ে এত বিরাট একটি ব্ল্যাক হোল সৃষ্টি হতে পারল। সবগুলো বড় গ্যালাক্সিতে না হলেও প্রায় সব বড় গ্যালাক্সির কেন্দ্রেই একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল থাকে। মহাবিশ্বে সবচেয়ে কাছের সবচেয়ে বড় ব্ল্যাক হোলের ভর একটি সূর্যের চেয়ে ১০০০ কোটি গুণ বেশি। সে তুলনায় পৃথিবীর ছায়াপথ তথা মিল্কিওয়ের কেন্দ্রের ব্ল্যাক হোলের ভর সূর্যের চেয়ে ৪০ লাখ থেকে ৫০ লাখ গুণ বড়। এমনকি আলোও একটি ব্ল্যাক হোলের আকর্ষণ থেকে বাঁচতে পারে না, সেজন্যই এদের নাম ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর। তবে কিছু উজ্জ্বল ব্ল্যাক হোলও আছে। এর কারণ, এগুলো চার পাশটায় রয়েছে কতগুলো ধপপৎবঃরড়হ ফরংশ। এসব ডিস্ক তৈরি গ্যাস ও ধুলোবালি দিয়ে, যেগুলো উত্তপ্ত হয়ে আলো সৃষ্টি করে, তা ব্ল্যাক হোলের মতোই ঘুরপাক খায়। জ্যোতির্বিদদের সন্দেহ, মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় বস্তু কোয়াসারে রয়েছে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল, যা বিপুল পরিমাণে বিশেষ ধরনের আলো নিঃসরণ করে, যখন এগুলো তারাগুলোকে টুকরো টুকরো ও ছিন্নভিন্ন করে ধ্বংস করে দেয়।

একটি বড় ‘যদি’
কিছু বৈজ্ঞানিক সমীকরণ নির্দেশ করে- প্রতিটি ব্ল্যাক হোল ধারণ করে এক-একটি ইউনিভার্স বা মহাবিশ্ব। তবে, তা এখনো প্রমাণিত হয়নি। যদি তা সত্যি হয়, তবে ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে আমাদের সব জানা বদলে যাবে। তা যদি সত্যি হয়, তবে এই মুহূর্তে আমরা অবস্থান করছি একটি ব্ল্যাক হোলের ভেতরে। এমনটি না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us