ভুলে যাওয়া বিজ্ঞানী উলুঘ বেগ

জি. মুনীর | Jun 10, 2019 04:41 pm
উলুঘ বেগ

উলুঘ বেগ - ছবি : সংগ্রহ

 

কেউ বলেন তিমুর, কেউ বলেন তৈমুর। কেউ বলেন আমির তিমুর। এর বাইরেও নানা নামে আছে তার পরিচিতি। তৈমুর লং কিংবা তামের লেইন বা তিমুর দ্য লেইম নামেও অভিহিত এ তুর্কি-মঙ্গোলীয় বিজয়ী বীর। তৈমুর বিন তারঘাই বারলাস নামেও তিনি উল্লিখিত। তিনি পারস্য ও মধ্য-এশিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিমুরিড এম্পায়ার বা তৈমুরীয় সাম্রাজ্য। তিনি ছিলেন তিমুরীয় বা তৈমুরীয় রাজবংশের প্রথম শাসক। এটি ছিল একটি সুন্নি মুসলিম রাজবংশ। তিমুরীয় রাজবংশের সদস্যরা গভীরভাবে ছিলেন পারস্য সংস্কৃতির প্রভাবে প্রভাবিত। এরা ইতিহাসের দু’টি উল্লেখযোগ্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন : তিমুরীয় সাম্রাজ্য (১৫২৬-১৮৫৭) এবং মোগল সাম্রাজ্য (১৩৭০-১৫০৭)। তিমুরীয় সাম্রাজ্য ছিল মধ্য-এশিয়া ও পারস্যভিত্তিক। মোগল সাম্রাজ্য গড়ে তোলা হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশকে ভিত্তি করে। তৈমুরের জন্ম ১৩৩৬ সালের ৮ এপ্রিলে, উজবেকিস্তানের বারলাসে। বাবা মোহাম্মদ তারাগাই বেগ। তৈমুর মারা যান কাজাখস্তানের ভুতুড়ে শহর ওতরারে, ১৪০৫ সালে। তাকে সমাধিস্থ করা হয় উজবেকিস্তানের সমরখন্দের গুর-এ-আমিরে। তারই নাতি হচ্ছেন উলুঘ বেগ।

উলুঘ বেগ নামে বেশি পরিচিতি থাকলেও তার পুরো নাম মির্জা মুহাম্মদ তারাগাই বিন শাহরুখ। জন্ম ১৩৯৪ সালের ২২ মার্চ, পারস্যের সুলতানিয়েহতে। মৃত্যু সমরখন্দে, ১৪৪৯ সালের ২৭ অক্টোবর। তিনি এক দিকে ছিলেন একজন তৈমুরীয় সা¤্রাজ্যের শাসক, অন্য দিকে ছিলেন জ্যোতির্বিদ, গণিতবিদ। সাধারণত তিনি ‘উলুঘ বেগ’ নামে পরিচিত হলেও, এটি তার প্রকৃত নাম নয়। এটি ছিল তার একটি উপনাম। মোটামুটিভাবে যার অর্থ ‘গ্রেট রুলার’। আধুনিক তুর্কি ভাষায় ঁষঁ অর্থ মৎবধঃ,এবং নবু অর্থ পযরবভ। তার পার্সো-অ্যারাবিক টাইটেল ছিল আমির-এ কবীর।

তিনি বিখ্যাত ছিলেন তার জোতির্বিদ্যা-সম্পর্কিত গণিত বিষয়ে গবেষণার জন্য। ত্রিকোণমিতি ও গোলীয় ত্রিকোণমিতি ছিল তার গবেষণার অন্যতম ক্ষেত্র। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের নানা গবেষণার জন্য গড়ে তুলেছিলেন একটি সুবিখ্যাত মানমন্দির বা অবজারভেটরি। সমরখন্দে তিনি ১৪২৪-১৪২৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এটি গড়ে তোলেন। এটি ‘উলুঘ বেগ অবজারভেটরি’ নামে সুপরিচিত। এটি বিবেচিত ছিল বৃহত্তর মধ্য-এশিয়ার ইসলামী সবচেয়ে উন্নত মানমন্দিরগুলোর একটি হিসেবে। তিনি সমরখন্দ ও বুখারায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন উলুঘ বেগ মাদরাসা (১৪১৭-১৪২০)। এটি ছিল আমাদের প্রচলিত মাদরাসাগুলো থেকে পুরোপুরি ভিন্ন। তার মাদরাসা বিবেচিত বিশ্ববিদ্যালয় বা ইনস্টিটিউশন হিসেবে। এসব মাদরাসার মাধ্যমে তিনি নগর দু’টিকে মধ্য-এশিয়ার সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাকেন্দ্রে রূপান্তর করেন।

তিনি ছিলেন পঞ্চদশ শতকের বিখ্যাত এক গণিতবিদ। তার মানসিক প্রত্যুৎপন্নতা ছিল নিজের সময়ের আর দশজন চিন্তাবিদের চেয়ে প্রখর। তার মানমন্দিরটি আজো রয়েছে উজবেকিস্তানের সমরখন্দে। জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিতচর্চার পাশাপাশি ১৪১১-১৪৪৯ পর্যন্ত সময়ে তিনি শাসন করেছেন উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরঘিজস্তান, দক্ষিণ কাজাখস্তান এবং আফিগানিস্তানের বেশির ভাগ অঞ্চল।

শুরুর দিকের জীবন : উলুঘ বেগ ছিলেন গ্রেট কনকোয়ারার তৈমুরের নাতি। বাবা শাহরুখ। তাদের সময়ে বর্তমান উজবেকিস্তানের নাম ছিল ট্র্র্যান্সওক্সিয়ানা। তারা সেই ট্র্যান্সওক্সিয়ানার তুর্কি বারলাস উপজাতির লোক। মা ছিলেন একজন অভিজাত মহিলা, নাম গোহারশাদ। তুর্কি উপজাতির অভিজাত ব্যক্তিত্ব গিয়াসিতদিন তারহানের (এরুধংরঃফরহ ঞধৎযধহ) কন্যা তিনি। তৈমুরের বহিরাক্রমণের সময়ে উলুঘ বেগের জন্ম পারস্যের সুলতানিয়েহতে। শৈশবে তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্য ও ভারত উপমহাদেশের নানা অঞ্চলে। তখন তার দাদা তৈমুরের সা¤্রাজ্য বিস্তৃত ছিল এসব অঞ্চল পর্যন্ত। তৈমুর মারা যাওয়ার পর তৈমুরীয় সা¤্রাজ্যের বেশির ভাগের অধিপতি হন উলুঘ বেগের বাবা শাহরুখ। তিনি বসবাস করতে শুরু করেন সমরখন্দে। সমরখন্দ ছিল তৈমুরের রাজধানী। আধুনিক আফগানিস্তানের হেরাতে শাহরুখ তার রাজধানী স্থানাস্তর করেন। এরপর ১৪০৯ সালে ১৬ বছর বয়সে উলুঘ বেগ হন সমরখন্দের গভর্নর। ১৪১১ সালে তিনি পুরো মেওয়ারন্নহর খানাতের সার্বভৌম শাসক হন। একটি কযধহধঃব বা কযধমধহধঃব হচ্ছে একটি রাজনৈতিক শাসনাঞ্চল, যা একজন কযধহ বা কযধমধহ-এর মাধ্যমে শাসিত হয়। তুর্কি ভাষায় কযধমধহ বা ছধমযধহ হচ্ছে একটি সাম্রাজ্যের ‘সম্রাট’ সমতুল্য উপাধি। ইংরেজিতে ভাষান্তর করা হয় কযধহ ড়ভ কযধহং, যার অন্য অর্থ করহম ড়ভ করহমং।

বিজ্ঞান সাধনা
কিশোর শাসক উলুঘ বেগ সিদ্ধান্ত নেন সমরখন্দকে পরিণত করতে হবে তার সা¤্রাজ্যের অন্যতম বুদ্ধিজীবী ও বিদ্বজ্জনদের কেন্দ্র হিসেবে। সেই সাথে এটি হবে অন্যতম এক শিক্ষানগরী। সেজন্য ১৪১১-১৪২০ সাল পর্যন্ত সময়ে বর্তমান উজবেকিস্তানের সমরখন্দের রেজিস্তান স্কোয়ারে প্রতিষ্ঠা করেন একটি মাদরাসা। তিনি অসংখ্য মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতবিদকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন সমরখন্দে। তাদের সুযোগ করে দেন এসব বিষয়ে জ্ঞানসাধনার। সমরখন্দে তার প্রতিষ্ঠিত সেই মাদরাসা ভবন আজো রয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানে উলুঘ বেগের সবচেয়ে খ্যাতিমান ছাত্র ছিলেন আলী কোশেজি। তার মৃত্যু হয় ১৪২০ সালে।

অনেকেরই হয়তো জানা নেই, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও কবিতার জগতে তার সুখ্যাতি ছিল। তিনি সমসাময়িক সমস্যাবলি নিয়ে অন্য কবিদের সাথে বিতর্ক করতে ভালোবাসতেন। তিনি কবিত্বের ধাঁচে তথা পয়েটিক স্টাইলে বিতর্ক করতে পছন্দ করতেন। স্থানীয় কবিদের মাঝে তার এ বিতর্কের স্টাইল ইধযৎরনধুঃ নামে পরিচিত ছিল। গধংযশড়াংশরু নামে রুশ ভাষায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি বই রয়েছে। এ বইয়ে উল্লেখ আছে : উলুঘ বেগ আবিষ্কার করেন রসুন ও অ্যালকোহলের মিশ্রণ। এ মিশ্রণ ডায়রিয়া, মাথাব্যথা, পেটব্যথা ও আন্ত্রিক রোগের চিকিৎসায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নববিবাহিত দম্পতির জন্য তার পরামর্শ ছিল : তাদের এমন খাবার খেতে হবে, যাতে বাদাম, কমলা রঙের শুকনো গোলাপি ফল খুবানি, শুকনো আঙুর ইত্যাদি উপাদান থাকে। তার দাবি, এ ধরনের খাবার পৌরুষ তেজোদীপ্ত রাখতে সহায়তা করে। এ ধরনের পথ্যের কথা ইবনে সিনার বইয়েও উল্লেখ রয়েছে।

জ্যোতির্বিজ্ঞান
তার আগ্রহ ও মনোযোগের বিশেষ ক্ষেত্র ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান। সে আগ্রহ থেকেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন এক বড়মাপের মানমন্দির বা অবজারভেটরি। সেটিকে আমরা উলুঘ বেগ অবজারভেটরি হিসেবে জানি। এটি এঁৎশযধহর তরল নামেও পরিচিত। এটি ছিল ডেনিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও লেখক টাইকো ব্রাহের অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজারভেটরি, পরবর্তী সময়ে টাইকোব্রাহে প্রতিষ্ঠিত ডেনিশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজারভেটরি ও কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি এবং সেই সাথে ইস্তাম্বুলের তাকি আল-দীনের অবজারভেটরির সমমানের। তবে এগুলোর চেয়ে বেশি সুখ্যাতি ছিল উলুঘ বেগের অবজারভেটরির। কাজ করতে গিয়ে টেলিস্কোপের অভাবে পর্যবেক্ষণের যথার্থতা বাড়াতে তিনি তার সেক্সট্যান্টের দৈর্ঘ্য বাড়িয়েছিলেন। তার কথিত ফখরি সেক্সট্যান্টের ব্যাসার্ধ ছিল ৩৬ মিটার। ফুটের হিসাবে ১১৮ ফুট। অপটিক্যাল সেপারেবিলিটি ১৮০ সেকেন্ডস অব আর্ক। সেক্সট্যান্ট দুই ধরনের : মুরাল ইনস্ট্রুমেন্ট এবং ফ্রেম-বেইজড ইনস্ট্রুমেন্ট।

সেক্সট্যান্ট ছিল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবজারভেশনের একটি যন্ত্র। যাতে অঙ্কিত রয়েছে একটি বৃত্তের এক-ষষ্ঠাংশ। এটি প্রাথমিকভাবে ব্যবহার হয় তারার অবস্থান পরিমাপে। এগুলোর ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে। তবে এক সময় এসে এ যন্ত্রের জায়গা দখল করেছে ট্র্যানজিট টেলিস্কোপ, অ্যাসট্রোনমি টেকনিকস ও হিপারকাসের মতো স্যাটেলাইট। হিপারকাস ছিল ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি উৎক্ষেপিত বিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট উপগ্রহ। এটি একান্তভাবেই চালু করা হয়েছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আরো যথার্থ সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য। ১৯৮৯ সালে চালু করা এ উপগ্রহ কার্যকর ছিল ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত।
উলুঘ বেগ ১৪৩৭ সালে সঙ্কলন করেন ৯৯৪টি তারার তরল-র-ঝঁষঃধহর নামে একটি স্টার ক্যাটালগ। সাধারণত এটিকে বিবেচনা করা হয় টলেমি ও টাইকোব্রাহের মধ্যবর্তী সময়ের ‘গ্রেটেস্ট স্টার ক্যাটালগ’ হিসেবে। এটি পারস্যের জোতির্বিজ্ঞানী আবদ আল-রহমান আল-সুফির ‘বুক অব ফিক্সড স্টারস’ বইটির মতোই একটি কর্মসাধনার ফসল।

উলুঘ বেগ তার পূর্ববর্তী অ্যারাবিয়ান ক্যাটালগগুলোর নানা ভুলত্রুটি সংশোধন করেন। এগুলোর বেশির ভাগই ছিল টলেমির কাজের হালনাগাদ করা। তিনি পুনর্নির্ধারণ করেন ৯৯২টি স্থায়ী তারার অবস্থান। তিনি আবদ আল-রহমান আল-সুফির ক্যাটালগ ‘বুক অব ফিক্সড স্টারসে’- উল্লিখিত তারার সাথে আরো ২৭টি তারার বর্ণনা যোগ করেন। এগুলো ছিল সমরখন্দ থেকে পর্যবেক্ষণের জন্য অনেক দক্ষিণে। উলুঘ বেগের এ ক্যাটালগ ছিল মধ্যযুগের সবচেয়ে মৌলিক ক্যাটালগ। ১৬৬৫ সালে এটি প্রথম অক্সফোর্ডে সম্পাদনা করেন ইংরেজ প্রাচ্যবিদ থমাস হাইড। তার সম্পাদিত ক্যাটালগটির নাম : ঞধনঁষধব ষড়হমরঃঁফরহরং বঃ ষধঃরঃঁফরহরং ংঃবষষধৎঁস ভরীধৎঁস বী ড়নংবৎাধঃরড়হব টষঁমনবরমযর। জি শার্প ১৭৬৭ সালে এটি ফের প্রকাশ করেন। অতি সম্প্রতি এর যেসব সংস্করণ প্রকাশ করা হয়, তার মধ্যে আছে ১৮৪৩ সালে ফ্রান্সিস বেইলি প্রকাশিত সংস্করণ। এটি প্রকাশিত হয় ‘মেময়ার্স অব দ্য রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি’র ত্রয়োদশ খণ্ডে। এটি ১৯১৭ সালে এডওয়ার্ড বেল নবেল প্রকাশ করেন টষঁময ইবম'ং ঈধঃধষড়মঁব ড়ভ ঝঃধৎং, জবারংবফ ভৎড়স ধষষ চবৎংরধহ গধহঁংপৎরঢ়ঃং ঊীরংঃরহম রহ এৎবধঃ ইৎরঃধরহ, রিঃয ধ ঠড়পধনঁষধৎু ড়ভ চবৎংরধহ ধহফ অৎধনরপ ডড়ৎফং।

১৪৩৭ সালে উলুঘ বেগ নির্ধারণ করেন সাইডরিয়েল ইয়ারের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৩৬৫. ২৫৭০৩৩৭৫ দিন = ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা ১০ মিনিট ৮ সেকেন্ড (এখানে ভুল ছিল + ৫৮ সেকেন্ডের)। এ পরিমাপে বেশ কয়েক বছর তিনি ব্যবহার করেছেন ৫০ মিনিট হাই মহড়সড়হ। এ মান ১৫২৫ সালে কপারনিকাস উন্নীত করেন ২৮ সেকেন্ডে। এর ফলে তা কপারনিকাসের অনুমিত পরিমাপ থেকেও যথার্থ সঠিক হয়। তার হিসাবে ত্রুটি ছিল + ৩০ সেকেন্ড। একটি মহড়সড়হ হচ্ছে সান ডায়েলের একটি অংশ, যাতে ছায়াপাত করা হয়। উলুঘ বেগ ডিগ্রির সেক্সাজেসিমেল ব্যবস্থায় পৃথিবীর ধীরধষ ঃরষঃ নির্ধারণ করেছিলেন ২৩ ডিগ্রি ৩০ মিনিট ১৭ সেকেন্ড, যা দশমিক ব্যবস্থায় রূপান্তর করলে দাঁড়ায় ২৩. ৫০৪৭ ডিগ্রি।

গণিত
গণিতে তার অবদান শ্রদ্ধার সাথে আজো স্মরণ করা হয়। তিনি সঠিকভাবে ত্রিকোণমিতির ংরহব এবং ঃধহমবহঃ-এর মান লিখে প্রকাশ করেন। তিনি এ মান আট দশমিক স্থান পর্যন্ত নির্ণয় করেন।

ইন্তেকাল
উলুঘ বেগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন বিজ্ঞান বিষয়েও। সে তুলনায় ততটা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেননি শাসন কাজে। তিনি যখন তার বাবা শাহরুখ মির্জার ইন্তেকালের খবর শোনেন, তখন তিনি চলে গেলেন বলখে। তিনি শুনলেন তার ভাই বেসনকরের ছেলে আলা উদ-দৌলা মির্জা বিন বেসনকর হেরাতে তিমুরীয় সা¤্রাজ্যের অধিপতি হওয়ার দাবি করেছেন। এর ফলে উলুঘ বেগ সৈন্যবাহিনী নিয়ে হেরাত অভিমুখে রওনা হন। তিনি আলা উদ-দৌলার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন মুরঘাব নামে এক স্থানে। এ যুদ্ধে জয়ী হয়ে তিনি রওনা হন হেরাত অভিমুখে। শাহরুখ মির্জার ইন্তেকালের পর তার উত্তরাধিকার পুনরুদ্ধার যুদ্ধে উলুঘ বেগকে সহায়তা করেন তার তৃতীয় সন্তান বলখের গভর্নর আবদাল লতিফ মির্জা। তারা ১৪৪৮ সালে হেরাত দখলে সক্ষম হন। কিন্তু আলা উদ-দিনের ভাই মির্জা আবুল কাশিম বাবুর বিন বেসনকর তার ভাইকে সহায়তা করেন উলুঘ বেগকে পরাজিত করতে। উলুঘ বেগ ফিরে যান বলখে। সেখানে তিনি দেখতে পান বলখের গভর্নর তার তৃতীয় সন্তান আবদাল লতিফ মির্জা তার প্রতি আর অনুগত নন। তিনি উলুঘ বেগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। ফলে আরেকটি গৃহযুদ্ধ সূচিত হয়। উলুঘ বেগ অভিযান পরিচালনা করেন খোরাসান দখল করতে। ১৪৪৯ সালে নিজের সন্তানের কাছে পরাজিত হন সমরখন্দের কাছে দামেস্কে। এ পরাজয়ের পর উলুঘ বেগ আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন।

আবদাল লতিফ মির্জা তাকে অনুমতি দেন হজ পালনের জন্য মক্কায় চলে যেতে। কিন্তু মক্কা যাওয়ার পথে তার সন্তানের আদেশে তাকে হত্যা করা হয়। এর ফলে আবদাল লতিফ মির্জা অভিহিত হতে থাকেন ‘পাদারকুশ’ নামে। পার্সি ভাষায় এর অর্থ ‘নিজের বাবার হন্তক’। এর অল্প কিছুদিন পর আবদুল লতিফ মির্জা খুন করেন তার ভাই আবদাল আজিজকে। একটি সময়ে উলুঘ বেগের সুনাম পুনর্বাসন করেন তার ভাইপো আবদুল্লাহ মির্জা (১৪৫০-১৪৫১)। তিনি তার লাশের অবশিষ্টাংশ সমরখন্দে তৈমুরের সমাধিতে স্থানান্তর করেন।

উলুঘ বেগ অবজারভেটরি
১৪২৮ সালে সমরখন্দে প্রতিষ্ঠিত হয় উলুঘ বেগ অবজারভেটরি। সেটি ছিল সমকালে সেরা এক অবজারভেটরি বা মানমন্দির। উলুঘ বেগ ও তার বাবা-মা সমরখন্দ, বুখারা ও হেরাতকে পরিণত করেছিলেন অন্যতম শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। তার পরাজয়ের পর ১৪৪৯ সালে বিজয়ীরা এ মানমন্দিরটি গুঁড়িয়ে দেয়। অবশ্য ১৯০৮ সালে এটি পুনরুদঘাটন করা হয়। বিদ্বজ্জনেরা এ মানমন্দিরকে বিবেচনা করতেন ইসলামী দুনিয়ার অন্যতম একটি মানমন্দির হিসেবে। বেশ কয়েকজন মুসলিম জ্যোতির্বিদ এ মানমন্দিরে জোতির্বিদ্যা চর্চা করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন আল-কাশি, আলি-কুশি এবং উলুঘ বেগ নিজে।

উলুঘ বেগ ১৯২০ সালে সমরখন্দে প্রতিষ্ঠা করেন উলুঘ বেগ মাদরাসা। এই মাদরাসা বা বিশ্ববিদ্যালয়টিই হয়ে উঠেছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম একটি কেন্দ্র। শুধু আমন্ত্রিত জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাই এ মাদরাসায় জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্র্চা করতেন। তাদের অনুমতি দিতেন উলুঘ বেগ নিজে। সেখানে কাজ করতেন শীর্ষস্থানীয় ৬০-৭০ জ্যোতির্বিদ। এ মাদরাসায় জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় সহায়তা করতে ১৪২৪ সালে তিনি মানমন্দির গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। এর নির্মাণকাজ পাঁচ বছর ধরে চলে শেষ হয় ১৪৪৯ সালে। উলুঘ বেগ তার সহকারী স্কলার আলী-কুশিকে এ অবজারভেটরি পরিচালনার দায়িত্ব দেন। তখন এরনাম ছিল সমরখন্দ অবজারভেটরি। উলুঘ বেগ খুন হওয়ার আগে পর্যন্ত আলী-কুশি-এর দায়িত্বে ছিলেন। এখানে কর্মরত অন্যান্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাজাগতিক বস্তুর চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন তুর্কি জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদ কাজিযাদা রুমি (প্রকৃত নাম : সালাহ আল-দিন মুসা পাশা) এবং পারস্যের জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদ জামশিদ আল-কাশানি। কাজিযাদা রুমি সাইন ১ ডিগ্রির মান ১০-১২ পর্যন্ত সঠিকভাবে নির্ণয় করেছিলেন। আল-কাশানির কর্মসাধনাই ইউরোপে পৌঁছেনি। তার বেশির ভাগ গবেষণার ফল কোনো-না-কোনোভাবেই প্রকাশ করা হয়নি। উলুঘ বেগ, আল-কাশি ও আরো কয়েকজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর সাথে একযোগে কাজ করে কাজিযাদা তৈরি করেন তরল-র-ঝঁষঃধহর। এটি হচ্ছে এর ২০০ বছর এগর মারাঘেহ অবজারভেটরির তরল-র ওষশযধহর ক্যাটালগের পরবর্তী সময়ের প্রথম ব্যাপকধর্মী স্টেলার বা নাক্ষত্রিক ক্যাটালগ। জিজ-ই সুলতানি ক্যাটালগে উল্লেখ ছিল ৯৯২টি তারার অবস্থানের কথা।
কিন্তু মানমন্দিরটি ১৪৪৯ সালের অতিশয় ধর্মীয় গোঁড়া ব্যক্তিরা গুঁড়িয়ে দেন। ১৯০৮ সালে এটি সমরখন্দে পুনরুদ্ধার করেন উজবেক-রুশ প্রত্নতাত্ত্বিক ভি এল ভিয়াতকিন। তিনি আবিষ্কার করেন একটি এনডাউমেন্ট ডকুমেন্ট (বৃত্তিদান দলিল), সেখানে উল্লেখ রয়েছে এ মানমন্দিরের প্রকৃত অবস্থানের কথা।

প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ পরিচালনার সময় ভিয়াতকিন এ অবজারভেটরিতে ব্যবহৃত একটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র দেখতে পান। সেখানে পান একটি বড় আর্ক, যা ব্যবহার হতো মধ্যদিন নির্ণয়ের জন্য। পাওয়া যায় পাহাড়ে মেরিডিয়ান বা উত্তর ও দক্ষিণ মেরু সংযোজক কল্পিত মধ্যরেখা বরাবর খনন করা একটি পরিখা। এটি প্রশস্ত ২ মিটার। এতেই স্থাপন করা হয়েছিল উল্লিখিত আর্ক যন্ত্রটি। আজ সেখানে রয়েছে একটি সার্কুলার বেইস, যা মূল পরিকাঠামোর আউটলাইন প্রদর্শন করছে। দরজার পথটি চলে গেছে ফখরি সেক্সেরন্টর অভূগর্ভস্থ সেকশনে। এখন এটির ওপর রয়েছে একটি ছাদ। সেক্সস্ট্যান্টটি ছিল ১১ মিটার লম্বা এবং এক সময় তিনতলা কাঠামোর ওপর পর্যন্ত চলে গেছে। যদিও এটিকে ভূমিকম্প থেকে বাঁচাতে রাখা হতো ভূগর্ভে। লম্বালম্বি বরাবর ক্রমাঙ্কিত এইকোয়াড্রেন্টটি ছিল তৎকালে বিশ্বে ৪০.৪ মিটার ব্যাসার্ধের সবচেয়ে বড় ৯০ ডিগ্রি কোয়াড্রেন্ট। মধ্যযুগের তুরস্কের একজন বিশ্বস্ত জ্যোতির্বিদের মতে, মেরিডিয়ান আর্কটি ছিল প্রায় ৫০ মিটার। বলা হয় এটি ছিল ইস্তাম্বুলে হেগিয়া মসজিদের গম্বুজের সমান। এটি ব্যবহার হতো চাঁদ, সূর্য, তারা ও অন্যান্য নাক্ষত্রিক বস্তু পর্যবেক্ষণের কাজে। আর্মিলারি ও অ্যাস্ট্রোল্যাবের মতো অন্যান্য আরো উন্নতমানের যন্ত্রের সাহায্যে সমরখন্দের জোতির্বিদেরা সেখানে কাজ করতেন। তারা প্রতিদিন সূর্যের মেরিডিওনাল উচ্চতা, জেনিথ থেকে দূরত্ব ও ডিক্লাইনেশন অনুসারে সঠিকভাবে দুপুর নির্ণয় করতে পারতেন।

১৪৩৭ সালের মধ্যে এ অবজারভেটরি ব্যবহার করে পাণ্ডিত্যপূর্ণ সমীক্ষা চালিয়ে হালনাগাদ করা হয় জিজ ইল-খানি ছকগুলো। এ ছকগুলো তৈরি করা হয়েছিল ১২৬০, ১২৭০-এর দশকের মারাগে অবজারভেটরিতে গবেষণা পরিচালনার মাধ্যম। এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল মূল্যবান সাইন ও ট্যানজেন্ট ছক। আরো ছিল জিজ-ইর-সুলতানি ছক, যাতে দেখানো হয়েছে গ্রহরাজির উন্নততর প্যারামিটার এবং ১০১৮টি তারার স্থানাঙ্ক। এর ভিত্তি ছিল এ মানমন্দিরের কিছু মৌলিক গবেষণা। এগুলো টলেমির ও আল-সুফির ছকের হালনাগাদ সংস্করণ ছিল না। আসলে উলুঘ বেগ এবং তার বিদ্বজ্জনেরা অতি যথার্থতার সাথে নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন স্থির তারাগুলোর অবস্থানের লঙ্গিচ্যুড ও লেটিচ্যুড।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us