নজরুলের গানে বাংলাদেশ

আমিনুল ইসলাম | Jun 30, 2019 05:06 pm
নজরুলের গানে বাংলাদেশ

নজরুলের গানে বাংলাদেশ -

 

বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান কাজী নজরুল ইসলাম। বিশ্বমানবতার পূজারি নজরুল স্বাদেশিকতায় সর্বভারতীয় হলেও তার নয়নজুড়ে ছিল সুজলা-সুফলা বাংলার নৈসর্গিক ছবি। সবুজ বাংলা মায়ের দুরন্ত সন্তান নজরুল। তার হৃদয়জুড়ে ছিল স্নেহময়ী বাংলার প্রকৃতির মায়া। বাংলার ইতিহাস তার মননকে করেছে সমৃদ্ধ। বাংলার নদনদী তাঁর মনকে করেছে গতিশীল। বাংলার পাহাড়-পর্বত তাঁকে দিয়েছে মাথা উঁচু রাখার শিক্ষা। বাংলার সমুদ্র তাঁর ভাবনাকে করেছে সুগভীর। বাংলার বাউল তার হৃদয়ে বাজিয়েছে একতারার সুর। বাংলার ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালী তাঁর মনকে ভাসিয়েছে শাশ্বত সুরের জোয়ারে। বাংলার নারী, কৃষক, জেলে, মাঝি, শ্রমিক, বেঁদে, সাঁওতাল, কৌম জনগোষ্ঠী তাকে করেছে আত্মার আত্মীয়। বাংলার সংগ্রামী বীর তার রক্তে জুগিয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা। বাংলার গ্রীষ্ম। তার মনকে করেছে কালবোশেখির ঝড়ের মতো সাহসী ও সৃজন-উন্মাদ।

বর্ষা তার মনের গহনে এনে দিয়েছে বিরহ-বিধুর প্রণয়কাতরতা। শরৎ বাজিয়েছে বাউলের একতারা। হেমন্ত দিয়েছে সোনালি ফসলের উৎসব-আনন্দ। শীত এনেছে ভাপা পিঠার উৎসব। বাংলার বসন্ত তার মনকে রাঙিয়েছে বারবার। প্রতিদানে নজরুল এদের সবার গৌরবগাথা রচেছেন গানে গানে। বাংলার প্রকৃতির বারোমাসি রূপ আর বাংলার মানুষের সারা বছরের সুখ-দুঃখের কথাচিত্র নজরুল ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর গানে অতুলনীয় পারঙ্গমতায়।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সমগ্র বাংলা। সাগর-নদী-পাহাড়-পর্বত-ঝরনা, অসংখ্য প্রজাতির বৃক্ষলতা, অসংখ্য রকমের পাখপাখালি, জীবজন্তু, ফুল-ফল-ফসল নিয়ে নৈসর্গিক লীলাভূমির দেশ বাংলা। নজরুলের কবিতা-গানে সেই সাগর-নদী, পাহাড়-ঝরনা, গাছপালা আর ফুল-ফসলের বর্ণনা এসেছে বারবার। তাঁর কবিতা পড়ে, গান শুনে মনে হয় বাংলার জীববৈচিত্র্যের বন্দনা এসব। মনে হয় তিনি বাংলার মাঠে-ঘাটে, বনে-জঙ্গলে, পাহাড়-পর্বতে ঘুরে বেড়িয়েছেন আর শব্দের ক্যামেরায় তুলে এনেছেন তাদের মনোহর ছবি। নজরুলের গানে ভিড় করা পাখিরা হচ্ছে : চড়ুই, নীলকণ্ঠ, হাঁড়িচাচা, মানিকজোড়, ঘুঘু, হলদে পাখি, চুমকুড়ি, ছাতারে, ময়না, কুক, টুনটুনি, শালিক, মুরগি, বাবুই, পানকৌড়ি, খঞ্জনা, বাজপাখি, হুতোম পেঁচা, বক, ভুতুমপেঁচা, জলপায়রা, টিয়া, সারস, মৌটুসি, গাঙচিল, চিল, কাক, ফিঙে, ডাহুক, বলাকা, চোখ গেল, চখাচখী, শকুন, শ্যামা, কপোত, হাঁস, বউ কথা কও, দোয়েল, চাতক, চকোর চকোরী, ময়ূর, কোকিল, পাপিয়া, বুলবুল, কোয়েলিয়া, বুনোহাঁস, শুকসারি, বনকপোত, মাছরাঙা, মরাল, মানিকজোড় প্রভৃতি। এসব পাখির বসবাস বাংলাদেশে। তাদের জন্য রয়েছে গাছপালা, ফুল ও ফল। নজরুলের গানে এত বেশি ফুলের নাম ব্যবহৃত হয়েছে যে তাঁর গানকে বাংলার ফুলবাগান বলা চলে। নজরুলের ফুলের নামগুলো হচ্ছে মহুয়া, পলাশ, বকুল, শিমুল, অশোক, চম্পা, মধুমালতী, বেলা, পথমঞ্জরী, কদম, সন্ধ্যামালতী, কমল, শাপলা, মল্লিকা, শালুক, পদ্ম, চামেলী, সূর্যমুখী, সন্ধ্যামণি, রজনীগন্ধা, কুমুদিনী, তারা, চাঁপা, গোলকচাঁপা, নার্গিস, টগর, যূথী, বেল, গোলাপ, পারুল, বৈঁচি, কলমীলতা, ভাঁটফুল, রক্তশালুক, হলুদচাঁপা কেয়া, নীলশালুক, জুঁই, নীলকমল, ডালিম, বনফুল, শিরীষ, বাবলাফুল, কেতকী, নাগকেশর, মৌরীফুল, কুন্দ, করবী, কনকগাঁদা, কুষ্ণচূড়া, কৃষ্ণকলি, অপরাজিতা, মাধবী, বনতুলসী, দোলনচাঁপা, মল্লিকা, হিজল, ঝিঙেফুল, রঙন, হাস্নাহেনা, সর্ষেফুল, কামিনী, নেবুফুল, সজিনাফুল, সোঁদালফুল, কাঁঠালচাপা, কচুরী, জবা।

বাংলাদেশ একসময় ছিল সমৃদ্ধির উঠোন। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষকের গোয়ালভরা গরু, গোলাভরা ধান এবং পুকুরভরা মাছ ছিল। তার সাথে ছিল গলাভরা গান। বেনিয়া-ইংরেজ শাসন-শোষণে সর্বস্বান্ত হয়ে যায় বাংলার কৃষককুল। ইংরেজ এবং তাদের এদেশীয় দোসর জমিদারেরা কৃষকদের ওপর শোষণ-নিপীড়নের স্টিমরোলার চালায়। নজরুলের গানে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ অতীত এবং ইংরেজ জমিদারদের শোষণ-নিপীড়নের ছবি রয়েছে :
ওঠ রে চাষী জগদ্বাসী ধর কষে লাঙল
আমরা মরতে আছি ভাল করেই মরব এবার চল॥
মোদের উঠোন ভরা শস্য ছিল হাস্য ভরা দেশ
ঐ বৈশ্য দেশের দস্যু এসে লাঞ্ছনার নেই শেষ,
ও ভাই আমরা ছিলাম পরম সুখী ছিলাম দেশের প্রাণ
তখন গলায় গলায় গান ছিল ভাই গোলায় গোলায় ধান।

বাংলাদেশ মানেই গ্রামবাংলা। প্রকৃতির লীলাভূমি এই গ্রামবাংলার সৌন্দর্যের শেষ নেই। গাছপালা-পাহাড়-নদী-ঝরনা-সাগর-ফুল-ফলে ভরা ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশে ছয়টি ঋতু বছরে ছয় রকম রূপ-রস দিয়ে যায়। ঋতুর পরিবর্তনে পাল্টে যায় গ্রামবাংলার সৌন্দর্যের রঙ। গ্রীষ্মে শুষ্ক থাকে প্রকৃতি। খালে-বিলে পানি থাকে না। প্রকৃতি ধারণ করে জীর্ণশীর্ণ ধূসর চেহারা। বৃষ্টির জন্য আকাশের দিকে চেয়ে থাকে বৃক্ষ ও প্রাণিকুল। বৃষ্টির পথ চেয়ে বসে থাকে খেতের কৃষক। আবার সুমিষ্ট পাকা ফলের গন্ধে ম ম করে মাঠ-ঘাট-উঠোন। বর্ষা আসে তার জলের ভাণ্ডার উজাড় করে দিতে। ঝরঝর ঝরে বৃষ্টির ধারা। জলে ভরে যায় খালবিল। নদীতে নেমে আসে বন্যা। গাছপালা তরুলতা ধারণ করে সবুজ বর্ণ। আউশের ক্ষেতে জল করে থৈ থৈ। বন্যপ্রাণীর দেহে-প্রাণে ফিরে আসে স্বস্তি। শরৎ এলে বৃষ্টি কমে যায়। কমতে থাকে নদীর পানি। জাগতে থাকে চর। কাশবন ছেয়ে যায় সাদা সাদা কাশফুলে। আকাশে ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘ। ফোটে শিউলি-শাপলা-শালুক ফুল। শারদীয় পুঁজোর ঢোলে মুখরিত হয়ে ওঠে শহর-গ্রাম। হেমন্তে পাকা ধানে ভরে ওঠে মাঠ। ঘাসে ঘাসে পড়ে শিশির। জমে ওঠে নবান্ন উৎসব। শীত এলে সাদা কুয়াশার চাদরে জড়িয়ে যায় প্রকৃতির শরীর। গাছের পাতা ধারণ করে হলুদ বর্ণ। বহে উত্তরের ঠাণ্ডা হাওয়া। বাজারে ওঠে নতুন শাকসবজি। গৃহস্থ বাড়িতে পড়ে পিঠা বানানোর ধুম।
শীতের পর আসে ঋতুরাজ বসন্ত। বনে বনে পড়ে যায় সাড়া। শাখায় শাখায় গজায় নবকিশলয়। ডালে ডালে নতুন পাতা। বোঁটায় বোঁটায় নতুন ফুল। গাছে গাছে পাখি ডাকে। আবির রঙে রেঙে যায় প্রকৃতি। তার সাথে রাঙে মানুষের মন। হোলি খেলায় মেতে ওঠে মানুষ। বাসন্তি পূর্ণিমার আলোতে ঝলমল করে রাতের প্রকৃতি। নজরুলের গানে আমরা গ্রামবাংলার এই বারোমাসিয়া রূপ দেখতে পাই :

একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লীজননী
ফুলে ও ফসলে কাদা-মাটি-জলে ঝলমল করে লাবণী॥
রৌদ্রতপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল
আম-কাঁঠালের মধুর গন্ধে জ্যৈষ্ঠে মাতাও তরুতল
ঝঞ্ঝার সাথে প্রান্তরে মাঠে কভু খেল লয়ে অশনি॥
কেতকী-কদম-যূথিকা কুসুমে বর্ষায় গাঁথ মালিকা
পথে অবিরল ছিটাইয়া জল খেল চঞ্চলা বালিকা।
তড়াগে পুকুরে থৈ থৈ করে শ্যামল শোভার নবনী॥
শাপলা শালুকে সাজাইয়া সাজি শরতে শিশিরে নাহিয়া
শিউলি-ছোপানো শাড়ি পরে ফের আগমনী-গীতি গাহিয়া।
অঘ্রাণে মাগো আমন ধানের সুঘ্রাণে ভরে অবনী॥
শীতের শূন্য মাঠে ফের তুমি উদাসী বাউল সাথে মা
ভাটিয়ালী গাও মাঝিদের সাথে কীর্তন শোনো রাতে মা
ফাগুনে রাঙা ফুলের আবিরে রাঙাও নিখিল ধরণী॥

নদীমাতৃক বাংলাদেশের মাটি অত্যন্ত উর্বর। সব ধরনের গাছপালা, ফসল এখানে অনায়াসে জন্মায়। তাই তো বাংলাদেশের মাঠঘাট-প্রান্তর শুধু সবুজ আর সবুজ। এখানে পাখির ঠোঁট থেকে বীজ পড়ে উদ্ভিদ জন্মায়। গাছের ডাল কেটে মাটিতে পুঁতলে সে গাছ হয়ে যায়। হাজারো রকমের ধান, হাজারো রকমের গাছ। হাজরো রকমের ফুল। হাজারো রকমের ফল। বনবনানী আর তরুলতা। এ মাটিতে ফলে অরো কত সোনার ফসল। তাই তো কবি বাংলার মাটিকে সোনার সাথে তুলনা করেছেন। নজরুল এ দেশের মাটির বন্দনা করে গান রচনা করেছেন :
ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি॥
এই দেশেরই মাটিজলে এই দেশেরই ফুলে ফলে
তৃষ্ণা মিটাই মিটাই ক্ষুধা পিয়ে এরই দুধের বাটি॥

এ দেশের রূপ-লাবণ্য আর ধনদৌলতের কথা ছড়িয়ে গেছিল বিশ্বময়। এত ফসল। এত ফল। এত ফুল। এত মাছ। এত মাংস। আর এত সস্তা সব। এত পাখপাখালি। এত সৌন্দর্য। মধ্যপ্রাচ্যের মতো মরুময় নয় এ দেশ। ইউরোপের মতো শীতের হাতে বন্দী নয় এর প্রকৃতি। আফ্রিকার মতো দুঃসহ নয় এর গ্রীষ্মকাল। অন্য দেশের মতো পাষাণময় নয় এর মাটি। এখানে জীবনযাত্রা বড়ই সহজ। এ দেশের রূপলাবণ্য আর ধনসম্পদের কথায় আকৃষ্ট হয়ে যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছে বিদেশীরা- কেউ পর্যটক হয়ে, কেউ ভাগ্যান্বেষণে, কেউ লুটপাট করার নেশায়, কেউ বা সাম্রাজ্য বিস্তারের উচ্চাভিলাষে। হিউয়েন সাঙ, ইবনে বতুতা, ফাহিয়েন প্রমুখ পর্যটকের ভ্রমণবৃত্তান্তে আমরা সেই সময়ের সম্পদময় সুন্দর বাংলার ছবি দেখতে পাই। তেমনি এসেছে আর্যরা, মোগল, পাঠান, চীন, মগ, ইংরেজ। সে কথার ইঙ্গিত রয়েছে নজরুলের গানে :
এই মায়েরই প্রসাদ পেতে মন্দিরে এর এঁটো খেতে তীর্থ করে ধন্য হতে আসে কত জাতি॥
একসময় বাংলা ছিল জ্ঞানগরিমায়, শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসর। অতীশ দীপঙ্কর তাঁর জ্ঞানের মশাল নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন দেশ থেকে দেশে। সভ্যতা প্রসারে বাংলার রয়েছে ঐতিহাসিক অবদান। সে কথার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন নজরুল :
ও ভাই সন্ন্যাসিনী সকল দেশে
জ্বাললো আলো ভালবেসে।

বাংলাদেশ বৃক্ষময় দেশ। বৃক্ষের সুশীতল ছায়া আর নদীর শীতল মিঠাপানি এ দেশকে সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা করে গড়ে তুলেছে। প্রকৃতি তার ভাণ্ডার হতে অকৃপণ হাতে ঢেলে দিয়েছে বাংলার ভাঁড়ারে। কত বৃক্ষ কত প্রাণী। কত ফুল কত ফল। কত ফসল। কত মাছ। প্রাণী ও উদ্ভিদের জীববৈচিত্র্যময় এমন সুষম সহ-অবস্থান পৃথিবীর খুব কম দেশেই রয়েছে। এ দেশের স্নিগ্ধ ছায়াময় শ্যামল প্রকৃতি আর। মিঠাজলের নদী এ দেশের মানুষের মন ও মনন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ছায়াময় বৃক্ষের প্রভাবে এ দেশের মানুষ সরল, সহজ, কোমলহৃদয়, অতিথিপরায়ণ ও ভাবুক প্রকৃতির হয়ে গড়ে উঠেছে। ফুল ও পাখির প্রভাবে এখনকার মানুষ সঙ্গীতপ্রিয়। নদীর প্রভাবে এখানে মানুষ বাউলমনা। নদী ও বন মানুষকে দিয়েছে ঘরছাড়া ডাক। তার কণ্ঠে দিয়েছে গলাছাড়া সুর। প্রান্তরের গান। আবার হাঙর, কুমির, বাঘ, সাপের সাথে বাস করে, ঝড়ঝঞা, বন্যা, মহামারী মোকাবেলা করে এ দেশের মানুষ হয়ে উঠেছে দুঃসময়ে অসম সাহসী, অকুতোভয় বীর। এ দেশের বারভূঁইয়াদের কাছে পরাজিত হয়ে ফিরে গেছে দুর্র্ধর্ষ মোগল সেনাপতিরা। বাংলার মানুষের এই শান্তিপ্রিয়, ধ্যানী, বাউল, অতিথিপরায়ণ ও সাহসী হয়ে ওঠার পেছনে বাংলার প্রকৃতির যে অবদান তার অপরূপ ছবি এঁকেছেন নজরুল তাঁর গানে :
এই আমাদের বাংলাদেশ এই আমাদের বাংলাদেশ
যেদিকে চাই স্নিগ্ধশ্যামল চোখজুড়ানো রূপ অশেষ॥
চন্দনিত শীতল বাতাস বই এ দেশে নিরন্তর
জ্যোৎস্নাসম কোমল হয়ে আসে হেথা রবির কর।
জীবন হেথায় স্নেহসরস সরল হৃদয় সহজ বেশ॥
নিত্য হেথা ঝরছে মেঘে স্বর্গ হতে শান্তিজল
মাঠেঘাটে লক্ষ্মী হেথায় ছড়িয়ে রাখে ফুলকমল।
হাঙ্গোর কুমীর শার্দুল সাপ খেলার সাথী এই জাতির
দিল্লীর যশ করল হরণ এই দেশেরি প্রতাপ বীর
একদা এই দেশের ছেলে জয় করেছে দেশবিদেশ॥

বাংলাদেশের রূপ কোমল ও মধুর। এ দেশের প্রকৃতিতে শান্ত-সৌম্য-প্রশান্তিময় রূপের ছাপ লেগে আছে। অসংখ্য নদনদী এ দেশের মৃত্তিকাকে করেছে সরস ও শীতল। সেসব নদীর কুলকুল আওয়াজ আর পায়ের কাছে সমুদ্রের নূপুরময় ধ্বনি বাংলাদেশকে করেছে সঙ্গীতমুখরা। ষড়ঋতুর লীলাভূমি এ দেশ। প্রতিটি ঋতু আনে আপন সুর ও সৌকর্য। এ দেশের মাটিজলে সুর ও সুধার সমাহার। এমন দেশ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া ভার। তাই কবি নজরুল চেতনায় বিশ্বনাগরিক এবং রাজনৈতিক ভাবনায় সর্বভারতীয় হলেও তার হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশজুড়ে শুধু বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পরানে যে সুর বাজে, তার তালটি ধরা পড়েছে নজরুলের গানে। নজরুল তাই শান্ত-সৌম্য-সুরময়ী বাংলাদেশের প্রশস্তি গেয়েছেন এবং সারা জীবন বাংলার সুধারস পান করে, বাংলার রূপলাবণ্য দু’চোখ ভরে দেখে বাংলা মায়ের কোলে মাথা রেখে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়তে চেয়েছেন, যা প্রতিটি বাঙালির জীবনাকাক্সক্ষারই প্রতিফলন :
নমঃ নমঃ নমো বাংলাদেশ মম
চিরমনোরম চিরমধুর
বুকে নিরবধি বহে শত নদী
চরণে জলধির বাজে নূপুর॥
এই দেশের মাটি জল ও ফুলে ফলে
যে রস যে সুধা নাহি ভূমণ্ডলে
ঘুমাবো এই বুকে স্বপ্নাতুর॥

বাঙলির প্রাণের নানা রূপ। কখনো সে ধানের ক্ষেতে গৃহস্থ, কখনো প্রান্তরে বৈরাগী, কখনো ঝারি হাতে মালী, কখনো সাপখেলুড়ে বেঁদে, কখনো সন্ধ্যার গৃহবধূ, কখনো সন্ন্যাসিনী, কখনো সংসারী, কখনো একতারা হাতে বাউল, কখনো ভাওয়াইয়া কণ্ঠে গাড়িয়াল, কখনো ভাটিয়ালী সুরের শিল্পী নৌকার মাঝি। তেমনি বাংলার সৌন্দর্য স্থান ও সময়বিশেষে বিচিত্রতর। ফসলের মাঠে, নদীর ঘাটে, গহিন অরণ্যে, নির্জন প্রান্তরে, মেঠোপথে, ফলের বাগানে, বিলের জলে, গৃহস্থের উঠোনে, শ্মশানঘাটে তার ভিন্ন ভিন্ন রূপ। আবার গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত-শীত-বসন্তে তার রূপের বৈচিত্র্যে চোখ জুড়িয়ে যায়। প্রকৃতির সন্তান বাঙালির গৃহস্থ সত্তা আর সাংস্কৃতিক সত্তা বাংলা-মায়ের প্রতীকে চমৎকার প্রকাশ লাভ করেছে নজরুলের ‘শ্যামলবরণ বাংলা মায়ের রূপ দেখে যা আয় রে আয়’ গানটিতে। গানটিতে আমরা দেখতে পাই... গিরি-দরী-বনে-মাঠে-প্রান্তরে রূপ ছাপিয়ে যাচ্ছে শ্যামলবরণ বাংলা মায়ের। ধানের ক্ষেতে, বনের ফাঁকে তার রূপ কালো। ধূলিরাঙা পথের বাঁকে গেরুয়া পোশাকে সে বীণ বাজানিয়া বৈরাগিনী। তার ভীরু রূপটি চোখে পড়ে নির্জন মাঠে পল্লী গ্রামে। সেখানে সে খেলে আর কাদামাটি দিয়ে গড়ে তোলে ঘরবাড়ি। কখনো মেঘের ঝারি নিয়ে জল ছিটায় ক্ষেতের ফসলে সবজির বাগানে। কাজলাদীঘির কালো জলে প্রতিফলিত হয় তার শান্ত পদ্মমুখ। কখনো সে বাঘ-ভালুক, সাপ-কুমিরের সাথে খেলা করে বনজঙ্গলে। আবার ঝড়ের সাথে নাচে তাথৈ তাথৈ। কখনো বেঁদেনী হয়ে সাপখেলা দেখায়। নদীর জলে বাজে তার নুড়িচুড়ির নূপুর। সন্ধ্যা হলে সে বারান্দাতে দাঁড়িয়ে কপালে পরে সন্ধ্যাতারার টিপ। ঘুম থেকে উঠে ভোরের বেলা গাঙের ঘাটে ঘট ভরে সে। সবুজ শস্যে তার আঁচল লুটায় ফসলের মাঠে। ভাটির স্রোতে ভেসে যেতে সে গায় ভাটিয়ালী গান। আবার নির্জন মাঠে বাউল হয়ে একতারায় তোলে আকাশচারী সুর। গানটির চারটি লাইন :

শ্যামলবরণ বাংলা মায়ের রূপ দেখে যা আয় রে আয়
গিরি-দরী, বনে-মাঠে, প্রান্তরে রূপ ছাড়িয়ে যায়॥
ধানের ক্ষেতে, বনের ফাঁকে, দেখে যা মোর কালো মা...
ধূলিরাঙা পথের বাঁকে বৈরাগিনী বীণ বাজায়॥

শত শত বছর ধরে এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমানসহ নানা জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। তাদের মধ্যে সাঁওতাল, মুণ্ডা, বেঁদে আরো কত কী! পেশার দিক থেকে কেউ কৃষক, কেউ মাঝি, কেউ জেলে, কেউ রাখাল, কেউ শ্রমিক, কেউ ব্যবসায়ী। কেউ পুরুষ, কেউ নারী। নজরুল সব রকমের মানুষের জন্য গান লিখেছেন :
ওঠ রে চাষী জগদ্বাসী ধর কষে লাঙল- (কৃষাণের গান)
ও রে ধ্বংস পথের যাত্রীদল- (শ্রমিকদের গান)
ও মাঝি ভাই ও সাম্পানওয়ালা ভাই- (মাঝির গান)
আমরা নীচে পড়ে রইব না আর শোন রে ও ভাই জেলে- (ধীবরদের গান)
সারা দিন পিটি কার দালানের ছাদ গো- (নারী শ্রমিকদের গান)।
ও রে রাখাল ছেলে বল- (রাখালের জন্য গান)
তেপান্তরের মাঠে বঁধু হে একা বসে থাকি- (সাঁওতালদের গান)
কে দিল খোঁপাতে ধুতুরা ফুল গো- (কোনো কৌম জনগোষ্ঠীর গান)
হলুদ গাঁদার ফুল রাঙা পলাশ ফুল- (বেঁদেদের গান)
সাগর আমায় ডাক দিয়েছে- (বাউল গান)

বাংলার মানুষ চিরদিনই ধর্মপ্রাণ। ধর্ম বাঙালির সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। নজরুল বাংলার হিন্দু-মুসলমান-বাউল-সন্ন্যাসী সবার জন্য ধর্মীয় গান রচনা করেছেন। ইসলামী গান এবং শ্যামাসঙ্গীত রচনায় নজরুল আজো অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় জনগোষ্ঠী মুসলমানদের গানের জগতে ফিরিয়ে আনেন নজরুলই। তারা ফিরে পায় হারানো আত্মবিশ্বাস। বাংলাদেশ চিরদিন ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ। কিন্তু ইংরেজদের বিভেদনীতির ফলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয়ে গেছিল। তিনি তাদের মধ্যে সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে সাম্প্রদায়িক সাম্যের ছবি আঁকেন গানে গানে... তার প্রচ্ছদপট বাংলার শ্যামল-শান্ত প্রকৃতি :
মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান
এক সে দেশের খাই গো হাওয়া, এক সে দেশের জল
এক সে মায়ের বক্ষে ফলায় একই ফুল ও ফল।
এক সে দেশের মাটিতে পাই।
কেউ গোরে কেউ শ্মশানে যাই
এক ভাষাতে মাকে ডাকি, এক সুরে গাই গান॥

বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বসবাস গ্রামীণ জনপদে। নজরুল ওইসব মানুষের জন্য নানা ধরনের গান রচনা করেছেন তা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। বাংলার প্রাণ তার সবুজ-সরস-সুজলা-শ্যামল প্রকৃতি। আর গ্রামবাংলার প্রাণের সুরটি প্রবহমান তার ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালী-ঝুমুর-ঝাপান-বাউল-কীর্তন গানে। নজরুল ইসলাম বাংলার প্রাণের সুরটি সঠিকভাবেই ধরতে পেরেছিলেন এবং পরবর্তীকালে সেসব সুর তার অসংখ্য গানে আত্তীকরণ করে নিয়েছেন। নজরুলরচিত ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালী-ঝুমুর-ঝাপান বাউল-কীর্তন গানের সংখ্যা অনেক। তিনি এসব গানে শুধু বাংলার আদি সুরই নয়, তার সাথে যে চিত্রকল্প, উপমা, প্রতীক ব্যবহার করে গানের দেহ সাজিয়েছেন, তাও খাঁটি বঙ্গীয়। উদাহরণস্বরূপ নজরুলের একটি লোকসুরের গান পাঠ করা যেতে পারে :
গাঙে জোয়ার এলো ফিরে তুমি এলে কই
খিড়কি দুয়ার খুলে পথ পানে চেয়ে ওই॥
কালো জামের ডালের ফাঁকে
আমায় দেখে কোকিল ডাকে।
আজও কেন যায় না দেখা তোমার নায়ের ছই।
চুল বেঁধে আর সেজেগুজে পিদিম জ্বালাই সাঁঝে
ঠাকুর ঝিরা মুচকি হাসে আমি মরি লাজে।
বাদলা রাতে বৃষ্টি ঝরে
মন যে আমার কেমন করে।
আমার চোখের জলে বন্ধু মাঠ করে থই থই॥

আমরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা-গল্প-গানে বাংলার প্রকৃতির অকৃত্রিম ছবি পাই; আমরা জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বাংলার প্রকৃতির নিবিড় চিত্র পাই; পাই আরো অনেকের লেখাতেই। সেসব লেখায় বাংলার প্রকৃতি যথাযথভাবে উপস্থাপিত হলেও বাংলার সব জনগোষ্ঠীর জীবন ও প্রাণের সুরটি সামগ্রিকভাবে ফুটে উঠেনি। মূলত একটি বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের জীবনাচার ও ঐতিহ্য সেসব লেখায় স্থান পেয়েছে। নজরুলের গানে আমরা বাংলার প্রকৃতির অকৃত্রিম রূপের সাথে বাংলার সব জনগোষ্ঠীর জীবন ও ঐতিহ্যের ছবি পাই। সাহিত্যে যুগপৎভাবে বাংলার প্রকৃতি ও বঙ্গজ্জনের জনজীবনের রূপকার হিসেবে নজরুল পূর্ণতার দাবিদার।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us