এটিএম বুথ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বিদেশীরা

সুমনা শারমিন | Jul 17, 2019 05:12 pm
এটিএম বুথ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বিদেশীরা

এটিএম বুথ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বিদেশীরা - ছবি : সংগ্রহ

 

এটিএম বুথে জালিয়াতির ঘটনায় দেশের গ্রাহকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। ঈদের ছুটিতে জালিয়াতির মাধ্যমে এটিএম বুথ থেকে প্রায় ১৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে ছয়জন ইউক্রেনের নাগরিককে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঈদের সময়ের দীর্ঘ ছুটির মধ্যে ব্যাংক যখন বন্ধ এবং রাজধানীর নিরাপত্তা ঢিলেঢালা ছিল, এমন সুযোগ কাজে লাগিয়ে ওই জালিয়াতির ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
গত ১ জুন রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের একটি বুথ থেকে দুইজন বিদেশী নাগরিক তিন লাখ টাকা তুলে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় তারা কিছু টাকা বুথে ফেলে যায়। বিষয়টি বুথের নিরাপত্তারক্ষী ব্যাংক কর্মকর্তাদের জানালে তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ দেখেন। সেখানে দুই বিদেশী নাগরিকের টাকা তোলার দৃশ্য দেখা গেলেও ব্যাংকের সার্ভারে এই টাকা উত্তোলনের কোনো হিসাব জমা পড়েনি। বিষয়টি তাদের সন্দেহ হয়। পরের দিন আবার দুই বিদেশী নাগরিক একই বুথে ফের টাকা তুলতে যায়। তাদের মুখে মাস্ক, মাথায় ক্যাপ এবং বেশি সময় নেয়ার কারণে নিরাপত্তারক্ষী আশপাশের লোকজন ডেকে জড়ো করেন। বিষয়টি টের পেয়ে দুই বিদেশী নাগরিক পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে একজনকে হাতেনাতে আটক করা হয়। পরে আটক ব্যক্তির দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে আরো ছয়জনকে আটক করা হয়।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মোহাম্মদ শিরিন জানিয়েছেন, জালিয়াত চক্রের সদস্যরা খুবই আধুনিক কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে টাকা তুলে নিচ্ছিল। এরকম প্রযুক্তি আমরা কখনো দেখিনি বা শুনিনি। প্রথম যখন এটিএম বুথে এই জালিয়াতি হয়, আমাদের কর্মীরা চেক করে দেখেছে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেন হয়নি। এমনকি কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা বেরিয়ে যায়নি। সরাসরি এটিএম মেশিনের ভল্ট থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে জালিয়াত চক্র। এটিএমের ভল্টে যে টাকা ছিল, সেখান থেকেই নগদ টাকা বের করে নিয়ে গেছে তারা। ওরা এমন একটা কার্ড ব্যবহার করেছে, যার সাথে কোনো গ্রাহকের অ্যাকাউন্টের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই, এটা সরাসরি ‘মানি ডিসপেন্সার’ থেকে টাকা বের করা হয়। এটা সম্ভবত এ সংক্রান্ত সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। এখন ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা এবং এটিএম বুথের নিরাপত্তা দুটোই বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

কিভাবে হ্যাক হতে পারে এটিএম বুথ
বাংলাদেশে এটিএম ও ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। এমনকি সেটা দিয়ে অনলাইনে ‘আনলিমিটেড’ কেনাকাটা করা সম্ভব। কার্ডরিডার নানা আকারের হতে পারে, অত্যাধুনিক কার্ড হতে পারে এমনকি পাতলা পলিথিনের মতো একটি পরত দেয়া। মানে বিল দেয়ার যে মেশিন, তাতে একটা পলিথিনের মতো পাতলা স্তরও হাতিয়ে নিতে পারে আপনার কার্ডের সব তথ্য। এ জন্য গ্রাহককে খেয়াল রাখতে হবে, বিল দেয়ার যে মেশিন যেন স্বাভাবিক থাকে, কোনো আলগা কিছু না থাকে।
১৯৯২ সালে বাংলাদেশে প্রথম অটোমেটেড টেলার মেশিন যা সংক্ষেপে এটিএম মেশিন নামে পরিচিত তা চালু করা হয়েছিল। এরপর দুই হাজার সালের পর দ্রুত সেই সংখ্যা বাড়তে থাকে। এই মুহূর্তে সারা দেশে ১০ হাজারের বেশি এটিএম বুথ রয়েছে, যার অর্ধেকের বেশি বুথ ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের। বাংলাদেশে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার প্রতি বছর বাড়ছে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বেশ কয়েকটি উপায়ে একটি এটিএম বুথ হ্যাক হতে পারে। যে পদ্ধতিতে এটিএম বুথে সর্বশেষ হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটেছে, সেটি একেবারেই নতুন একটি ব্যবস্থা। এ পদ্ধতিতে যে কার্ড দিয়ে জালিয়াতরা টাকা তুলে নেয়, সেটির মধ্যে জ্যাকপট নামে একটি বিশেষায়িত ম্যালওয়্যার স্থাপন করে একটি নির্দিষ্ট এটিএম বুথকে তার ব্যাংকের নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায়। এরপর ওই মেশিন থেকে ‘অগণিত’ অর্থ তুলে নেয়া সম্ভব।



কার্ড স্কিমিং
বাংলাদেশে কয়েক বছর ধরে ক্যাশ মেশিনের সাথে স্কিমিং যন্ত্র বসিয়ে কার্ড জালিয়াতি, পিন ও পাসওয়ার্ড জালিয়াতির অভিযোগ শোনা গেছে। এ ব্যবস্থায় এটিএম মেশিনের সাথে ছোট্ট একটি যন্ত্র জুড়ে দেয়া থাকে, যার মাধ্যমে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের সব তথ্য কপি হয়ে যায়, পরে যা ব্যবহার করে নির্দিষ্ট কোনো অ্যাকাউন্টের অর্থ হাতিয়ে নেয়া যায়।
বাংলাদেশে এটিএম হ্যাক করতে কোনো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছিল, এমনই অনুমান করা হচ্ছে। এ ধরনের কয়েকটি ঘটনা পরপর ঘটার পর ২০১৬ সালে গ্রাহকের কার্ডের সুরক্ষা দিতে প্রতিটি এটিএম বুথে এন্টি স্কিমিং ও পিন শিল্ড ডিভাইস বসানো বাধ্যতামূলক করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জোহা বলছেন, ওই ঘটনার পর সব ব্যাংক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলেও জালিয়াত চক্রও বসে নেই। সর্বশেষ ঘটনাটিই এর প্রমাণ।
কার্ড ক্লোনিং
এ ব্যবস্থায় কোনো ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের যাবতীয় তথ্য কপি করে নেয়ার পর নতুন একটি কার্ডে মোবাইল ফোনের সিমের মতো একটি চিপ স্থাপন করে ক্লোনিং করা সম্ভব। মানে হুবহু আরেকটি কার্ড তৈরি করা যাবে এবং এ ব্যবস্থাতেও নির্দিষ্ট একটি অ্যাকাউন্টের পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আরেকজনের কাছে।
শপিংমলের মেশিনে কার্ড রিডার থাকতে পারে। অনেক সময় শপিংমলের মেশিনে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বিল দেন অনেকে। যে মেশিনে কার্ড সুইপ করে আমরা বিল দেই, সেখানে থাকতে পারে কার্ডরিডার যার মাধ্যমে ওই কার্ডের তথ্য কপি হয়ে যাবে, যার মাধ্যমে একটি ক্লোন কার্ড বানানো সম্ভব।

প্রতিকার কী
বাংলাদেশে ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা এক কোটির ওপরে এবং ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। গ্রাহকের সংখ্যা যত দ্রুত বাড়ছে, বিভিন্ন জালিয়াতির ঘটনা নিয়ে উদ্বেগও বাড়ছে। জ্যাকপট ম্যালওয়্যার দিয়ে যখন চুরি হয়, তখন যেহেতু কোনো গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট নম্বর ব্যবহার করতে হয় না, ফলে আপনি ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন না। যে কারণে এখানে একজন ব্যক্তির চেয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সচেতন হওয়ার প্রয়োজন বেশি। তবে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের সাধারণ নিরাপত্তার জন্য তানভীর জোহা বলছেন, এখনো বাংলাদেশে এটিএম মেশিন থেকে টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে ‘এক স্তর’ নিরাপত্তা অর্থাৎ কেবল পাসওয়ার্ড দিয়ে টাকা তোলা যায়।
এর বদলে যদি ‘টু ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন’ মানে পাসওয়ার্ড দেয়ার পর মোবাইল বা অন্য কোনো যন্ত্রে ব্যাংক থেকে পাঠানো আরেকটি কোড সরবরাহ করা হয় এবং সেটি ব্যবহার করে গ্রাহক টাকা তুলতে পারবেন, এমন ব্যবস্থা চালু করা যায়, তাহলে নিরাপত্তা জোরদার হবে।
কার্ড স্কিমিং ঠেকানোর জন্য একজন গ্রাহক যখনই এটিএম মেশিনে কোনো লেনদেন করবেন তার খেয়াল করতে হবে, এটিএম মেশিনের কি-প্যাডের ওপর বা পাশে কোনো ছোট্ট যন্ত্র আছে কি না। এ ছাড়া পাসওয়ার্ড গোপন রাখতে হবে। কখনোই অন্যের সাথে শেয়ার করা যাবে না।

গ্রাহকরা কতটা সচেতন?
বাংলাদেশে ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়লেও গ্রাহকরা সচেতন হননি। রুবিনা পারভীন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। সন্তানের স্কুলের বেতন, গৃহস্থালি বাজারঘাট এবং পোশাক-আশাক কেনার ক্ষেত্রে ডেবিট কার্ড ব্যবহার করেন। প্রায় আট বছর ধরে কার্ড ব্যবহার করলেও, কার্ডের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি সচেতন হয়েছেন কয়েক মাস হলো।
কারণ তিনি কোনো দিন দুর্ঘটনার সম্মুখীন হননিÑ তাই এত চিন্তা করতেন না। কিন্তু কিছু দিন আগে অসাবধানতার কারণে একজন সহকর্মীর এটিএম মেশিনে কার্ড রেখে বের হয়ে গিয়েছিলেন, পরে কলসেন্টার থেকে তাকে জানানো হয়েছে, তার অ্যাকাউন্ট থেকে ১০ হাজার টাকা তোলা হয়েছে, কিন্তু সেটা তিনি নিজে তোলেননি। এরপর থেকে রুবিনাও সাবধান হয়ে গেছেন।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us