রোমাঞ্চকর গল্প ভূতের ফিসফিসানি নদী

ভাষান্তর : মো: আজিজুর রহমান লস্কর | Sep 02, 2019 04:55 pm
রোমাঞ্চকর গল্প ভূতের ফিসফিসানি নদী

রোমাঞ্চকর গল্প ভূতের ফিসফিসানি নদী - ছবি : নয়া দিগন্ত

 

ক্যালগেরি থেকে বেশি দূরে নয়, রকি পর্বতমালার ছায়াতেই বয়ে চলেছে ভূতের ফিসফিসানি নদী। এটি খুব বড় জলের ধারা নয়; কিন্তু এর এক ইতিহাস আছে। যা তোমার অন্তরে গেঁথে থাকবে, স্মৃতি থেকে নদীর কথা বহু দিন আগে মুছে গেলেও। সুদূর অতীতে সাদা মানুষদের আগমনেরও আগে সারসিজ ও ব্ল্যাকফুট নামে দুই গোত্রের মানুষ এখানে বসবাস করত। বর্তমানে তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও মিত্র। কিন্তু অনেক বছর আগে তারা পরস্পর নিষ্ঠরতম যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। পাহাড়ের পাদদেশ হরিণজাতীয় প্রাণী এল্ক ও প্রেইরি ভূমিতে বিচরণশীল বন্য মহিষ শিকারের একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠাই ভয়াবহ যুদ্ধের কারণ ছিল। বংশপরম্পরায় যুদ্ধ চলেছিল। অবশেষে উভয় গোত্রের প্রধানরা উপলব্ধি করতে পারল যে, এভাবে আর যুদ্ধ চলতে দেয়া যায় না। তাদের আরো শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর আগেই চুক্তি করে যুদ্ধ বদ্ধ করা আবশ্যক। শান্তির স্বার্থে ঠুনকো মান-মর্যাদা বিসর্জন দেয়া উচিত।

এক গ্রীষ্মে সারসিজ গোত্র প্রধান এক ভোজের আয়োজন করে নিকট ও দূরবর্তী প্রত্যেককে নিমন্ত্রণ করল। এমনকি চিরশত্রু ব্ল্যাকফুট গোত্রের প্রধানকেও ভোজে আমন্ত্রণ জানানো হলো। ভোজ সারসিজ প্রধানকে এক সুযোগ এনে দিলো। সে তার শিশুপুত্র লিপোটোকে তার একমাত্র প্রিয়পাত্র হিসেবে ঘোষণার সুযোগ পেল; যার অর্থ হচ্ছে এখন থেকে সম্ভাব্য সব অধিকার, ক্ষমতা ও মর্যাদা লিপোটোর প্রতি জমা হতে থাকবে।
ভোজের নিমন্ত্রণ পেয়ে ব্ল্যাকফুট গোত্রের প্রধান হতভম্ব হয়ে গেল! তার কাছে মনে হলো, বাস্তবে এটি এক নতুন মতলব। কারণ সারসিজ গোত্র সুদূর অতীত থেকে ব্ল্যাকফুটের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। তাদেরই প্রধানের কাছ থেকে হঠাৎ আজ ভোজের নিমন্ত্রণ! ব্ল্যাকফুট প্রধান ভীষণ চিন্তায় পড়ল, এখন সে কী করবে?

পরামর্শের জন্য সে ব্ল্যাকফুট গোত্রের প্রবীণদের নিয়ে সভায় বসল। উপস্থিত প্রধানগণ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতিত্বের জন্য খ্যাতিমান ছিল। কেউ ছিল যোদ্ধা হিসেবে বিখ্যাত, প্রতিপক্ষের বিপুলসংখ্যক ঘোড়া চুরির জন্য কেউ ছিল খ্যাতিমান, কেউ ছিল যুদ্ধ কৌশলে সাফল্যের জন্য বিখ্যাত, কেউ যুদ্ধে বীরত্বের প্রমাণ হিসেবে অধিকসংখ্যক শত্রুর মাথার চুলসহ ত্বক কেটে আনতে সক্ষম হয়েছিল এবং যা নিয়ে নিজ পক্ষের মহিলাগণ গান গেয়ে নেচেছিল।
সভায় উপস্থিত প্রবীণগণ দীর্ঘ সময়ব্যাপী তর্কবিতর্ক করল। বৃদ্ধরা বক্তব্য উপস্থাপন করল উচ্চ কণ্ঠে ও নির্বন্ধাভাবে। তরুণরা যথারীতি চুপচাপ বসে কেবল শুনল। কেউ প্রশ্ন করল, এটা কি একটি ফাঁদ? পুরাতন ও সুপরিচিত মতলব? মানুষকে ভোজে নিমন্ত্রণ করে প্রচুর খাবার খাইয়ে ও পানীয় পান করিয়ে অমনোযোগী ও বেহুঁশ করে তোলা; তারপর ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করার চেয়েও যথেচ্ছ করা সহজ!

এখানে রয়েছে বালক লিপোটো। নিশ্চয় একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের পর তারা এরকম কিছু করবে না, অথবা তারা এমন কোনো ঝুঁকি নেবে না যা লিপোটোর জীবনের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে! তাই উভয় গোত্রের মধ্যে সুসম্পর্কের সূচনা ও ভবিষ্যতের শান্তির পথ সৃষ্টির লক্ষ্যে ভোজের এ নিমন্ত্রণ রক্ষা করা উত্তম।

সুতরাং ব্ল্যাকফুট গোত্র প্রধান দলবলসহ ভোজে উপস্থিত হলো; সঙ্গে তার স্ত্রী ও ষোলো বছর বয়স্কা সুন্দরী ও গুণান্বিতা একমাত্র কন্যা উইনোনা।
স্বাভাবিকভাবেই লিপোটো ও উইনোনা দু’জন তরুণ-তরুণী প্রথম দর্শনেই পরস্পরের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হলো এবং তাদের অন্তরে অপ্রতিরোধ্য ভালোবাসা জন্ম নিলো। আর তা না হলে তাদের নিয়ে উপাখ্যান সৃষ্টি হতো না।
কিন্তু অনুষ্ঠান চলাকালে তাদের দু’জনের মধ্যে কথা বলার সুযোগ ওয়ে ওঠেনি। বিপুলসংখ্যক লোকের উপস্থিতিতে উভয়ের গোপন সাক্ষাতের ব্যবস্থা করাও ছিল অসম্ভব।

অতঃপর অনুষ্ঠান শেষে ব্ল্যাকফুট প্রধান তার দলবলসহ রাত যাপনের জন্য অনেক দূরে নদীর তীরে শিবির স্থাপন করল। এ সুযোগের জন্যই রিপোটো অপেক্ষায় ছিল। সে তার ঘোড়াকে পানি পান করানোর অজুহাতে নদীর তীর ধরে ঢালু স্থানে পানির কাছে পৌঁছে গেল এবং দেখতে পেল সেখানে উইনোনা তার মায়ের জন্য পানি সংগ্রহে এসেছে।
প্রেইরি ইন্ডিয়ানদের সাংকেতিক ভাষায় লিপোটো উইনোনাকে জানিয়ে দিলো, আজ চন্দ্র উদয়ের অল্পক্ষণের মধ্যেই সে নদী তীরে উইনোনার সাথে সাক্ষাৎ করতে আগ্রহী। প্রত্যুত্তরে উইনোনাও একই ভাষায় তার সম্মতি জানাল।

রাতে সবাই যখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন, লিপোটে চুপি চুপি নদীর তীরে উপস্থিত হলো। বেগবান পানির ধারার ওপাশে রাতের আলো-আধারিতে সে কী অস্পষ্ট অবয়বে উনোনাকে দেখতে পেল?
- ‘উইনোনা’! সে ফিসফিস করে উচ্চারণ করল। অতঃপর সাহস সঞ্চয় করে যথাসম্ভব জোরে ডাক দিলো, ‘উইনোনা’! কিন্তু সে কোনো জবাব শুনতে পেল না। যদিও উইনোনা তার ডাক শুনতে পেয়েছিল এবং প্রত্যুত্তরে কোমল কণ্ঠে জবাব দিয়েছিল, ‘লিপোটো!’
উইলো শাখার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বাতাসের উচ্চ নিনাদ ও নদীর স্রোতের কলকল ধ্বনির জন্য সে উইনোনার জবাব শুনতে পায়নি। তবে উভয়ই নিশ্চিত ছিল, তারা নদীর পাশে একে অন্যের জন্য অপেক্ষা করছে। তারা পরস্পর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে রাতের নদীর কালো ও বরফ শীতল পানির স্রোতের দিকে অগ্রসর হলো,

- উইনোনা!
- লিপোটো!
দু’জনই সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় একে অন্যকে খুঁজতে থাকল এবং বারবার অন্তর নিঃসৃত কণ্ঠে নাম ধরে ডাকতে লাগল। প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সংগ্রামে তাদের দেহ-মন ক্লান্ত! উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় তারা প্রায় উন্মাদ! একসময় নদীর নিষ্ঠুর স্রোত তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেল!

এমনকি আজো যদি তুমি ভূতের ফিসফিসানি নদীতে যাও, হয়তো শুনতে পাবে, করুণ ফোঁপানি ও ভয়ার্ত ফিসফিসানি!
এটা কি শুধু উইলো কুঞ্জের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বাতাসের ধ্বনি, ‘উইনোনা’! এবং এরই প্রত্যুত্তরে নদীর স্রোতের কোমল প্রতিধ্বনি, ‘লিপোটো!’


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us