কোর্ট ম্যারেজের ফাঁদ

সিরাজ প্রামাণিক | Dec 30, 2019 04:24 pm
কোর্ট ম্যারেজের ফাঁদ

কোর্ট ম্যারেজের ফাঁদ - ছবি : সংগ্রহ

 

বিয়ে মানুন জীবনের একটি সুখকর অনুভূতি ও প্রজন্ম বিস্তারের একমাত্র উপায় হলেও কখনো কখনো তা বিপত্তির কারণ হতে পারে। মুসলিম আইনে বিয়ে হচ্ছে ধর্ম কর্তৃক অনুমোদিত একটি দেওয়ানি চুক্তি। বিভিন্ন ধর্মে বিয়ের বিভিন্ন রীতি প্রচলিত। বিয়ে মূলত একটি ধর্মীয় রীতি হলেও আধুনিক সভ্যতায় এটি একটি আইনি প্রথাও বটে।

বিবাহবহির্ভূত যৌনসম্পর্ক অবৈধ এবং ব্যভিচার হিসেবে অভিহিত পাপ ও অপরাধ।
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান অনুযায়ী, প্রতিটি মুসলিম বিবাহ রেজিস্ট্রি করা বাধ্যতামূলক। বিয়ে রেজিস্ট্রি না করলে স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার, মৃতের সন্তানদের উত্তরাধিকার, খোরপোষ ও মোহরানার অধিকার থেকে নারীকে বঞ্চিত হতে হয়। এ ছাড়া স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করলে বা প্রথম স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে বিয়ে করার উদ্যোগ নিলে স্ত্রী আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন বিয়ে রেজিস্ট্রি করা থাকলে। সুতরাং বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে একজন নারী তার দাম্পত্য জীবনের অনেক জটিলতা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারেন। একই সাথে অসহায়ত্ব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন।

১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইনে (সংশোধিত ৮ মার্চ, ২০০৫) বলা হয়েছে, যদি কেউ বিয়ে রেজিস্ট্রি না করেন; তাহলে তিনি এ আইনের অধীনে অপরাধ করেছেন বলে বিবেচিত হবেন। এ ছাড়া এ অপরাধের জন্য আইন কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি হচ্ছে- দুই বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা আর্থিক জরিমানা; যা তিন হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে অথবা উভয় ধরনের শাস্তিই হতে পারে।

কাবিন রেজিস্ট্রির পরিবর্তে কোর্ট ম্যারেজ অধিকতর শক্তিশালী এ ভুল ধারণার ফাঁদে পড়ে অনেক নারী তাদের দাম্পত্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ‘কোর্ট ম্যারেজের কোনো বৈধতা নেই, এমনকি এর কোনো অস্তিত্বও নেই।’ ২০০ টাকার টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ে কিংবা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয়ে গিয়ে হলফনামা করাকে বিয়ে বলে অভিহিত করা হয়। অথচ এফিডেভিট বা হলফনামা শুধুই একটি ঘোষণাপত্র। আইনানুযায়ী, কাবিন রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করেই কেবল ঘোষণার জন্য এফিডেভিট করা যাবে।

আবেগঘন সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক তরুণ-তরুণীর ভুল ধারণা হয়, শুধু এফিডেভিট করে বিয়ে করলে বন্ধন শক্ত হয়। কাজী অফিসে বিয়ে বড় অঙ্কের ফি দিতে হয় বলে কোর্ট ম্যারেজকে অধিকতর সুবিধাজনক মনে করেন নিম্নবিত্ত শ্রেণীর নারী-পুরুষ।

এফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে সম্পাদন করে একাধিক বিয়ের কথা গোপন করতে চায় অনেকে। কোনো মেয়ের অভিভাবককে ফাঁদে ফেলে টাকা আদায় কিংবা সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করতেও অনেক সময় এফিডেভিটের মাধ্যমে ভুয়া বিয়ের দলিল তৈরি করা হয়। এ দলিল তৈরি করা খুব সহজেই সম্ভব এবং এসব ক্ষেত্রে হলফনামা প্রার্থীকে নোটারি পাবলিকের কাছে হাজির হতে হয় না। এর ফলে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে বয়স বাড়িয়ে দেয়ার সুযোগ থাকে। এ ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা থেকে রক্ষায় আসামিপক্ষের এরকম হলফনামা তৈরির প্রবণতা দেখা যায়।
মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার এক কেস স্টাডিতে দেখা যায়, সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী সাথী ও বিদ্যুৎ (ছদ্মনাম) এফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে সম্পাদন করে। তাদের সংসারে একটি কন্যা সন্তানও রয়েছে। কিন্তু ঘটনা পরম্পরা তাদের দাম্পত্য জীবন বেশিদূর এগোয়নি।

পরে তারা স্বেচ্ছায় বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটাতে নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ে একটি হলফনামা সম্পাদন করেন। হলফনামাটি একটি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রি করেন। কিন্তু বিয়ে বিচ্ছেদের এ ধরনের দলিল রেজিস্ট্রি করা ও এফিডেভিট করা সম্পূর্ণ বেআইনি। হিন্দু আইনে বিয়ে বিচ্ছেদ বলে কিছু নেই। সঙ্গত কারণে বিয়ে বিচ্ছেদ চাইতে হবে পারিবারিক আদালতে। খ্রিষ্টান আইনেও বিয়ে একটি চুক্তি, যা ভঙ্গ করা যায় না। ১৮৬৯ সালের বিয়ে বিচ্ছেদ আইন অনুযায়ী, খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য আদালতে যেতে পারেন।

বিয়ে রেজিস্ট্র্রেশন হচ্ছে সরকার নির্ধারিত ফরমে লিখিত বর ও কনের বিয়েসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি সম্বন্ধে আইনগত দলিল; যা কাজী অফিসে সংরক্ষিত থাকে। সরকার কাজীদের বিয়ে রেজিস্ট্রি করার অনুমতি বা লাইসেন্স দিয়ে থাকে। আইনানুযায়ী, বিয়ের আসরে বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে হয়। বিয়ের আসরে সম্ভব না হলে বিয়ে অনুষ্ঠানের দিন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে হয়। কাজীকে বাড়িতে ডেকে এনে অথবা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করা যায়। এ ছাড়াও কাবিননামার সব কলাম পূরণ করার পর বর-কনে, উকিল, সাক্ষী ও অন্য ব্যক্তিদের স্বাক্ষর দিতে হয়।

ইসলাম ধর্মে বিয়ে নিবন্ধন আইন থাকলেও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে বিয়ে নিবন্ধন আইন ছিল না। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিয়ে নিবন্ধনের বিধান ঐচ্ছিক রেখে হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন আইন তৈরি হওয়ায় এখানেও অনেক জটিলতা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে বিদেশ ভ্রমণ, অভিবাসন, চাকরি, বদলি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিয়ে সম্পর্কিত দালিলিক প্রমাণ একটি অপরিহার্য বিষয়। প্রতারণার সুযোগ বন্ধ করা এবং হিন্দু নারীদের সামাজিক ও আইনি সুরক্ষার লক্ষ্যে হিন্দু বিয়ে আইন ঐচ্ছিক না রেখে বাধ্যতামূলক করা সমীচীন বলে মনে হয়।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
seraj.pramanik@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us